শিবভোলার দেশ শিবখোলা
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি সব সময় আমাদের ছায়ার মতো অনুসরণ করে। আমাদের উচ্চশিক্ষা, চাকরি, বিদেশভ্রমণ—সর্বত্র ইংরেজি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। আসলে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজির গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা বিষয়টি জানলেও তেমন ভাবে মানিনি। আমাদের ছোটকালে ইংরেজি-জানা মানুষের ছিল ভয়ানক আকাল। তাই নিজের মতো করে ইংরেজি চর্চা করতে গিয়ে আমাদের নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। ইংরেজি নিয়ে আমাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। ইংরেজি বানান উচ্চারণ একসময় আমাদের কাছে সীমাহীন ভীতির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। সি ইউ টি কাট (cut), বি ইউ টি বাট (but) কিন্তু পি ইউ টি (put) পাট না হয়ে পুট! এটা আমাদের জন্য খুবই গোলমেলে!
আমার এক বন্ধু একবার ‘মানি (money)’ বানান munny লেখায় উত্তমমধ্যম খেয়েছিলেন। এরপর সে ইংরেজি বানানের ক্ষেত্রে ‘সৃজনশীল’ উদ্যোগ গ্রহণ করে। সে শব্দের উচ্চারণ বদলে দেয় যেন সেই বানান মনে থাকে। ‘মানি’কে সে বলত ‘মনি’। ‘ডিজেল’কে বলত ডাইসেল (Diesel), ‘এজুকেশন’কে এডুকেটিওন (education), ‘কালার’কে কোলআওয়ার (colour), ‘কোরাপশন’কে কোররাপটিওন (corruption), ‘ফলস’কে ফলসে (False) বলত
। আমাদের স্কুলজীবনে স্যাররাও নানাভাবে চেষ্টা করতেন ইংরেজি বানান ও মানে শেখাতে। যেমন, স্কুলে ইংরেজির স্যার গুপ্তহত্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Assassination মনে রাখার সহজ উপায় বলেছিলেন :গাধা-গাধা-আমি-জাতি। আমাদের সময়ে আমরা নানা ধরনের ‘ক্রিয়েটিভ’ ইংরেজি ব্যবহার করতাম। যেমন বৃষ্টি পড়ছে—রেইন ইজ রিডিং, আমি তাকে চিনি—আই সুগার হার, তোমার জন্য আমার মন কেমন কেমন করছে—মাই মাউন্ড ইজ ডুইং হাউ হাউ ফর ইউ, মেয়েটি নিচে দাঁড়িয়ে—মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং!তবে এমন ইংরেজি চর্চা যে কেবল আমি বা আমরা করেছি, তা কিন্তু নয়। যে কোনো বিদেশি ভাষা শিক্ষা নিয়ে সব মানুষের অভিজ্ঞতাই প্রায় এমন। ইংরেজি ভাষা রপ্ত করতে বাঙালিকে যে কত তামাশা করতে হয়েছে, তার কোনো শেষ নেই। উত্পল দত্তের সেই ফিল্মি সংলাপে আজও বাঙালির পেটে খিল ধরে যায় । আমি দেশের মুখ উজ্জ্বল করব-এর ইংরেজি অনুবাদ : আই উইল বার্ন দি ফেস অব দি কান্ট্রি! যুগপৎ আমরা ভুল ইংরেজি শিখে এবং যথাযথভাবে বাংলাটা না শিখে যুগ যুগ ধরে যেন তা-ই করে যাচ্ছি।
ইংরেজি চর্চা যে কেবল আমি বা আমরা করেছি, তা কিন্তু নয়। যে কোনো বিদেশি ভাষা শিক্ষা নিয়ে সব মানুষের অভিজ্ঞতাই প্রায় এমন। ইংরেজি ভাষা রপ্ত করতে বাঙালিকে যে কত তামাশা করতে হয়েছে, তার কোনো শেষ নেই।
ভারতবর্ষে ইংরেজিচর্চার ইতিহাস বেশি দিনের নয়। বাংলায় ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করার ব্যাপারটি শুরু হয় সতেরো শতকের ত্রিশের দশকে, প্রথমে কলকাতায়, তারপর হুগলিতে ইংরেজদের ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার পরে। ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান সুজা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্দেশে যে ফরমান জারি করেছিলেন, তার মাধ্যমেই এ অঞ্চলে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক আধিপত্যের সূচনা হয়; ইংরেজি ভাষা ব্যবহারেরও সূত্রপাত ঘটে তখনই। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম দিকে পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও ধীরে ধীরে তাঁরাও ইংরেজির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন ।
১৮২৬ সালে কলকাতা মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে ইংরেজি ভাষার অন্তভুর্ক্তিতে তাঁদের সে চেতনা প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।উনিশ শতকের মাঝামাঝি,
শিক্ষার উচ্চতর স্তরগুলিতে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাদানের মাধ্যমে পরিণত হয়। যেহেতু উচ্চশিক্ষালাভে আগ্রহী সবাইকে ইংরেজি জানতে হত, সেহেতু স্কুল পর্যায়েও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা বাড়ানোর ব্যবস্হা গৃহীত হল ।ইংরেজরা বুঝতে পারল, কেবল সাদা চামড়া দিয়ে ভারত শাসন করা যাবে না। তখনই তাঁদের ধারণা হয়, কী করে তাঁদের দোসর এ দেশে তৈরি করা যায়। সে থেকেই ইংরেজি শিক্ষার চর্চা শুরু। বাঙালির ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে অনেক গালগল্প চালু আছে। শোনা যায়, সে আমলে চাকরি পাওয়া নিয়ে খুব কাড়াকাড়ি হত। আগে ভালো দরখাস্ত পাঠাতে পারলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যেত ।
তাই অনেক চাকরিপ্রার্থী অগ্রিম খবরের সন্ধানে শ্মশানঘাটে গিয়ে সদ্যমৃত চাকরিজীবীদের নামধাম খুঁজে বের করত, মৃত ব্যক্তি কোন দপ্তরে, কী পদে চাকরি করেছিলেন—সব জেনে দরখাস্ত পাঠাত মৃতের চাকরিস্হলে। ইংরেজি ভাষায় লেখা সেই দরখাস্তের শুরুটি ছিল এ রকম—‘লার্নিং ফ্রম বার্নিংঘাট (শ্মশানঘাট) দেট এ পোস্ট হেজ ফলেন ভ্যাকেন্ট, আই বেগ টু অ্যাপ্লাই ফর দি সেম।’
দ্বিতীয় গল্পটি আরো মজার। একটি সদাগরি হাউসের বার্ষিক বাজেট তৈরির শেষ পর্যায়ের কাজ চলছিল । কোম্পানির বড় সাহেব অনাবশ্যক বিবেচনা করে কয়েকটি বরাদ্দ কেটে দিতে কলম তুলেছেন। এমন সময় অধঃস্তন কর্মচারী ছুটে এলেন সাহেবকে থামাতে। বলতে চাইলেন, যে বরাদ্দগুলো আপনি
কেটে দিতে চাইছেন, তা নানা কারণে অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু এত কথা বোঝানোর মতো ইংরেজি তার পেটে ছিল না। তাই সাহেবকে অনুনয় করে বললেন, ‘নো কাট, নো কাট। রিজন হ্যাজ (কারণ আছে)’, অর্থাৎ বরাদ্দগুলো কাটবেন না, এগুলো রাখার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। বলা বাহুল্য, সাহেব ব্যাপারটা বুঝে বরাদ্দগুলো রেখে দিলেন।একবার একজন ইংরেজ জজকে ‘গাভি’ বোঝাতে অল্প ইংরেজি জানা উকিল পাশের মাঠ থেকে একটি ষাঁড় ধরে এনেছিলেন। তারপর জজকে বলেছিলেন, ‘গাভি’ ইজ হিজ ওয়াইফ স্যার ! এভাবেই পরস্পরের ভাষার অজ্ঞতায় একধরনের সহাবস্হান তৈরি হয় শাসক আর শাসিতের মধ্যে। তা না হলে ভাষাবিভ্রাটের ঠ্যালায় ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কাজকর্ম শিকেয় উঠত।
তখন কিছু কিছু ইংরেজও বাংলা শিখত। তাঁদের বাংলা ছিল বাঙালির ইংরেজির চেয়েও ভয়ংকর। তেমনই একজনের কথা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন—
বাংলা ভাষায় দক্ষ প্রজাহিতৈষী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিনওয়েল সাহেবের জেলায় দুর্ভিক্ষ দেখা গেছে। তিনি সরেজমিনে দুর্ভিক্ষের অবস্হা দেখতে বেরিয়ে ঘোড়ায় চড়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। পথে এক কৃষকের সঙ্গে দেখা। সাহেব বাংলা পরীক্ষায় পাশ করে পুরস্কার পেয়েছেন। সুতরাং সেই কৃষকের সঙ্গে বাংলা ভাষাতেই কথাবার্তা শুরু করবেন। সাহেবের প্রথম প্রশ্ন ‘টোমাডিগের গুড়ামে ডুড়বেক্কা কেমন আছে?’ ‘ডুড়বেক্কা’ কী কৃষকটির অজানা। ভাবল হয়তো-বা কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম হবে। কিন্তু কেমন আছে? এর উত্তর কী দেবে?যদি বলে যে ডুরবেক্কাকে চেনে না, তবে সাহেবের এক ঘা চাবুকের মার পিঠে পড়বে। যদি বলে যে ভালো আছে, তবে তাকে হয়তো ডেকে আনতে হুকুম হবে। তখন কী হবে? কৃষকটি অনেক ভেবেচিন্তে উত্তর দিল, ‘বেমার আছে।’ সাহেব বুঝে উঠতে পারলেন না। দুর্ভিক্ষ কী করে অসুস্হ হয়। নিশ্চয়ই কৃষকটি তার কথার অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। একটু ঘুরিয়ে আবার জিগ্যেস করলেন, ‘ডুড়বেক্কা কেমন আছে? অধিক আছে কি কম আছে?’—এবার কৃষকটির চোখ খুলে গেল। তার মাথায় ঢুকল এ যখন সাহেব, তখন হাকিম না হয়ে যায় না। হাকিম যখন জানতে চাইছে ডুড়বেক্কা অধিক আছে, না অল্প আছে—তখন ডুড়বেক্কা অবশ্যই একটা নতুন ট্যাক্সের নাম। এখন যদি বলি, ‘আমাদের গ্রামে সে ট্যাক্স নাই, তবে বেটা এখনই ট্যাক্স বসাইয়া যাইবে।’ অতএব মিছা কথা বলাই ভালো।
সাহেব আবার একই প্রশ্নটা করলে কৃষক উত্তর দিল, ‘হুজুর, আমাদের গায়ে ভারি ডুড়বেক্কা আছে?’ সাহেব ভাবলেন, ‘হুম! আই থট অ্যাজ মাচ।’ তদন্তে সন্তুষ্ট হয়ে সাহেব ফিরে গেলেন। বুদ্ধিমান কৃষকের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? চাষা আসিয়া গ্রামে রটাইল, ‘একটা সাহেব টাকায় আট আনা হিসাবে ট্যাক্স বসাইতে আসিয়াছিল, চাষা মহাশয়ের বুদ্ধি-কৌশলে বিমুখ হইয়াছে।
তরুণ প্রজন্ম ইংরেজি শিখছে, বাংলার সঙ্গে মিলিয়ে ভুলভালও বলছে। ইংরেজি ভাষাকে নিয়ে যাচ্ছে-তাই কাণ্ড করছে দাপটের সঙ্গে। যেমন, পৌঁছে মোবাইলে ‘একটা ম্যাসেজ করে দিস’ : কথাটা ‘ম্যাসেজ’ নয়, ‘মেসেজ’ (message)। ‘ম্যাসেজ’ (massage) বলে ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে ঠিকই, কিন্তু তার অর্থ মর্দন বা দলাইমলাই। বার্তা বা এসএমএস বোঝাতে ‘ম্যাসেজ’ নয়, বলতে হবে ‘মেসেজ’ (message)। একইভাবে ‘স্ট্যাটাস’ নয়, ‘স্টেটাস’। ‘ক্যাওস’ নয়, ‘কেওস’। অনেকেই বলে থাকে :‘মেয়েটির গলার ভয়েজ ভারি মিষ্টি’। এটা পুনরুক্তি দোষ। ‘ভয়েজ’ মানেই গলার আওয়াজ। ‘এটাই সব থেকে বেস্ট’। আবারও একই গলতি। ‘বেস্ট’ মানেই তো সব থেকে ভালো।
ইংরেজি শুধু অর্থোপার্জনের ভাষা নয়, উচ্চশিক্ষার মাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক যোগসাধনের এক মাত্র সোপান। প্রায় ১০০ বছর আগে প্রমথ চৌধুরী ইংরেজি ভাষাকে বাঙালির দ্বি-মাতৃভাষা আখ্যা দেন, শিক্ষিত বাঙালির ক্ষেত্রে আজও তা সুপ্রযুক্ত এবং এতে আপত্তির কিছু নেই।
শুধু ভাষাটা একটু শুদ্ধ করে শিখতে হবে—এই যা। আমি ইংরেজিতে কাঁচা বলতে—আই অ্যাম গ্রিন ইন ইংলিশ’ বললে চলবে না !
সৌজন্য: দৈনিক ইত্তেফাক
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।
মিরিক নামটি এসেছে লেপচা ভাষার “মির-ইওক” শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুনে পুড়ে যাওয়া জায়গা।
15:34