- ন | ন্দ | ন | চ | ত্ব | র প্রচ্ছদ রচনা
- জানুয়ারি ১০, ২০২৪
গান স্যালুটে শেষ বিদায় ওস্তাদ রাশিদ খানকে। উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রী সহ অগনিত গুণমুগ্ধ। শেষকৃত্য পৈতৃক ভিটে বদায়ূঁতে
রবীন্দ্র সদনে প্রয়াত ওস্তাদ রাশিদ খানকে গান স্যালুটে শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, মেয়র ফিরহাদ হাকিম, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী, কন্ঠ সংগীত শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা, শিবাজি চট্টোপাধ্যায়, ঊষা উত্থুপ, পরিচালক রাজ চক্রবর্তী, অভিনেত্রী জয়া শীল সহ উপস্থিত বহু শিল্পী,গুণমুগ্ধ ও ওস্তাদ রাশিদ খানের ছাত্রছাত্রী। রবীন্দ্র সদন থেকে মরদেহ তাঁর নাকতলার বাড়িতে নিয়ে আসা হয় কিছু ধর্মীয় আচারের জন্য। তারপর বাড়ি থেকে শেষ যাত্রা উত্তরপ্রদেশের পৈতৃক ভিটে বদায়ূঁতে, সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। ওস্তাদজির অকাল প্রয়াণে সংস্কৃতি জগতে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সুরের জগত এখন থমথমে।
শীতের সময় কলকাতা শহরে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর বসে। ওস্তাদ রাশিদ খানকে আমরা সেই আসরে পাই কিন্তু এবার শীতকালেই শহরকে স্তব্ধ করে চলে গেলেন ওস্তাদ রাশিদ খান। মঙ্গলবার বিকেল ৩টে ৪৫ মিনিটে তিনি তাঁর অগনিত শ্রোতাকে অতৃপ্ত রেখেই তিনি চলে গিয়েছেন অমৃতলোকে।
বুধবার সকাল ৯টায় শিল্পীর নাকতলার বাড়ি “শ্রী” থেকে তাঁর মরদেহ রবীন্দ্র সদনে নিয়ে আসা হয়। প্রয়াত শিল্পীর বাড়িতে এদিন সকালেই পৌঁছে যান রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। রবীন্দ্র সদনে শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন বহু শিল্পী, তাঁর অনুরাগী ও ছাত্রছাত্রীরা। দুপুর ১টায় গান স্যালুট দেওয়া হয় মুখ্যমন্ত্রীর, মুখ্যসচিব ও অগনিত গুণমুগ্ধের উপস্থিতিতে। তারপর আবার তাঁর মরদেহ রবীন্দ্র সদন থেকে নিয়ে আসা হবে প্রয়াত শিল্পীর নাকতলার বাড়ি “শ্রী”-তে। সেখানে ধর্মীয় কিছু আচার সম্পন্ন করে অবশেষে শেষ যাত্রা ছেলে বেলার ফেলে আসা পৈতৃক ভিটে উত্তরপ্রদেশে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।
রবীন্দ্র সদনে শিল্পীর মরদেহের পাশে প্রথম থেকেই তাঁর স্ত্রী,পুত্র, দুই কন্যা ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস, কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধি, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী শোকজ্ঞাপন করেছেন। রবীন্দ্র সদনে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য, লকেট চট্টোপাধ্যায় সহ দেশ ও রাজ্যের সবস্তরের ব্যক্তিত্ব। বিশ্বখ্যাত শিল্পীর মৃত্যকে তাঁরা ভারতীয় মার্গ সংগীত জগতে নক্ষত্র পতন বলে বর্ণনা করেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্র সদনে প্রয়াত শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।
কন্ঠ সংগীত শিল্পী অজয় চক্রবর্তী, হৈমন্তী শুক্লা, ঊষা উত্থুপ, অভিনেত্রী জয়া শীল, রাঘব চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায় সহ বহু শিল্পী তাঁর মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপন করেন রবীন্দ্র সদনে। মুম্বইয়ের সুরকার ও শিল্পী শান্তনু মৈত্র ওস্তাদ রাশিদ খানের মৃত্যুতে বলেছেন, “গত বছর আমার ভাই কেকে-কে হারিয়েছি, এ বছর আমার দাদা রাশিদ খানকে হারালাম। এই দিনটা দেখতে হবে ভাবিনি।”
রবীন্দ্র সদনে শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। তিনি শিল্পীর মৃত্যুতে তাঁর ছোট বেলা থেকে শিল্পী রাশিদ খান হয়ে ওঠার স্মৃতিচারণ করেন। বলেন, প্রতি বছর তাঁর কাছে রাশিদের ভাই ফোঁটা নিতে আসার স্মৃতির কথা।
শিল্পী রাঘব চট্টোপাধ্যায় বললেন, “ওস্তাদ রাশিদ খানের কাছে আমি কিছুটা সময় গান শিখেছি। তিনি একাধারে আামার গুরু অন্যদিতে আমার দাদা। আমি আজ অভিভাবকহীন হলাম।”
রবীন্দ্র সদনে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে অভিনেত্রী জয়া শীল বললেন, “আমরা এমন একজন শিল্পীকে অকালে হারালাম যাঁর কাছে আমাদের আরও অনেক ভালো গান শোনার ছিল। তাঁকে আমি ভাই বলতাম।তিনি এই সময়ের ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের অন্যতম সেরা উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী। ফিউশন, হিন্দি চলচ্চিত্রের গান, রবীঠাকুরের গান, সবেই তিনি ছিলেন সমান দক্ষ ও সাবলীল। তাঁর আওগে যব তুম সাজনা, কোনও দিন কেউ ভুলবেন না।”
ওস্তাদ রাশিদ খান ছিলেন কলকাতা, বাংলা, ভারতের গর্ব। ওস্তাদ রাশিদ খান ছিলেন কলকাতায় বসবাস করা এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁকে একডাকে গোটা বিশ্ব চেনে। ১৯৮৬ সালে কলকাতার ডোভারলেন মিউজিক কনফারেন্স সেতার বাজাতে বাজাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন পন্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, তারপর তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে পরের দিন তিনি ৫৫ বছর বয়সে আমাদের একা করে চলে যান। ঠিক ৫৫ বছরেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ওস্তাদ রাশিদ খান, যাঁকে পন্ডিত ভীম সেন যোশী বলেছিনে, “রাশিদ হচ্ছে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের ভবিষ্যৎ।” কার হাতে রেখে গেলেন ওস্তাদ রাশিদ খান ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের ভবিষ্যৎ? কে বইতে পারবে তাঁর ঘরানার উত্তরাধিকার? তৃপ্তি দিতে পারবেন অগনিত শ্রোতাদের?
১৯৬৮ সালের ১ জুলাই উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁতে জন্ম রাশিদ খানের। তিনি ছিলেন রামপুর-সাসওয়ান ঘরানার শিল্পী। যে ঘরানার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইনায়েত হুসেন খাঁ-সাহিব। রাশিদ তালিম নিয়েছেন এই ঘরানারই আর এক দিকপাল ওস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ-সাহিবের কাছ থেকে। যিনি ছিলেন সম্পর্কে রাশিদের দাদু। রাশিদের মামা গোয়ালিয়র ঘরানার উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খাঁ-সাহিবের কাছেও তালিম নিয়েছেন রাশিদ। তিনি রাশিদকে মুম্বই নিয়ে গিয়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। এসব রাশিদের ভালো লাগছিল না। তারপর মামা তাঁকে আবার বাড়িতে ফিরিয়ে আনলেন। এই সময় আইটিসি সংগীত রিসাচ অ্যাকাডেমি বা এসআরএ থেকে তাঁর দাদু ওস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ কে সিনিয়র গুরু হিসাবে আমন্ত্রণ জানানো হল। তিনি সঙ্গে করে রাশিদকে আইটিসি এসআরএ-তে নিয়ে এলেন। রাশিদ এখানে গানের তালিম নেওয়ার জন্য পরীক্ষা দিলেন গান গেয়ে। তাঁর কন্ঠের পরীক্ষা নিলেন পন্ডিত এ টি কানন। এক পরীক্ষায় রাশিদ নির্বাচিত হলেন। শুরু হল তাঁর গান শেখা। তখন তাঁর বয়স ৬/৭ বছর। তারপর থেকে ৮ জানুয়ারি, ২০২৪, একটা ইতিহাস হয়ে রইল পুরোটা। তিনি তাঁর অসম্ভব কন্ঠ নৈপুণ্যে মুগ্ধ করেছেন কলকাতা,বাংলা, ভারত ও বিশ্বের সংগীত প্রিয় মানুষদের। তবে এই চলা অসময়ে থেমে গেল।
শোনা যায় ছোটবেলায় গানের প্রতি তাঁর আগ্রহ কম ছিল। তাঁর মামা গোলাম মুস্তফা খান প্রথম তাঁর মধ্যে সঙ্গীত প্রতিভা লক্ষ্য করেছিলেন এবং কিছু সময়ের জন্য তাঁকে মুম্বাইতে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। তবে, রশিদ খান তাঁর প্রধান প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন নিসার হোসেন খানের কাছ থেকে, প্রাথমিকভাবে বদায়ূঁর বাড়িতে। নিসার হুসেন খান একজন কঠোর নিয়মানুবর্তী মানুষ ছিলেন। তিনি ভোর চারটা থেকে কণ্ঠের প্রশিক্ষণের উপর জোর দিতেন এবং রশিদকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্বর সাধনা, অনুশীলন করাতেন।ওস্তাদ রাশিদ খান ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন, “একটি মাত্র নোটের ওপর অনুশীলন করতে একটি পুরো দিন আমার কেটে যেত। কথা না শুনলে দাদু মারত।” ছোটবেলায় রশিদ এসব পছন্দ না করলেও, তখনকার সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ রাশিদ খানকে তান ও লয়কারিতে দক্ষ করে ওস্তাদ রাশিদ খান করে তোলে।
উত্তরপ্রদেশে জন্ম হলেও ওস্তাদ রাশিদ খানের সংগীতের প্রশিক্ষণ হয় টালিগঞ্জের আইটিসি এসআরএ তে। রাশিদ বলতেন, ” গানের তালিম শেষ করে যেটুকু সময় পেতাম মাঝে মাঝে টালিগঞ্জ ট্রামলাইনের সামনে এসে দাঁড়াতাম।” তারপর একদিন রাশিদ খান ওস্তাদ রাশিদ খান হয়ে উঠলেন। তবে টালিগঞ্জের মায়া তিনি ছাড়তে পারলেন না। বাড়ি করলেন নাকতলা ২৩ এফ-ঠিকানায়। বাড়ির নাম দিলেন তাঁর পছন্দের রাগ “শ্রী”- র নামে। আমৃত্যু তিনি দক্ষিণ কলাতায় থাকলেও মৃত্যু তাঁকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল পৈতৃক ভিটে বদায়ূঁতে। সেই ৬/৭ বছর বয়সে যে পৈতৃক বাড়ি ছেড়েছিলেন ছোট্ট রাশিদ, ওস্তাদ রাশিদ খান হয়ে মৃত্যুর পর ফিরে এলেন সেই বদায়ূঁতেই।
❤ Support Us