Advertisement
  • খাস-কলম ন | ন্দ | ন | চ | ত্ব | র
  • জুলাই ১৮, ২০২৪

মানিক বাবুর মেঘ: নির্মম দুনিয়ায় মুক্তিকামীর আশ্রয়

অসাধারণ এই ছবির চিত্রনাট্য, পরতে পরতে শাণিত চিত্রকাঠামোর সঙ্গে পাল্লা দেয় । ছবিতে কেন অহেতুক সংলাপ আর টানা বর্ণনার দিন পেরিয়ে এসেছে তা বুঝতে মানিকবাবুর মেঘ দেখা দরকার

অমিত মুখোপাধ্যায়
মানিক বাবুর মেঘ: নির্মম দুনিয়ায় মুক্তিকামীর আশ্রয়

সামান্য কেরানি মানিক (চন্দন সেন) তার শয্যাশায়ী বাবাকে (নিমাই ঘোষ) একার হাতে দেখাশোনা করে, ছাদে গাছেদের পরিচর্যা করে, বাবাকে খাইয়ে ও খেয়ে কাজে যায় । বাড়িওয়ালি থেকে বাড়ির বাইরের লোক তার প্রতি বিমুখ হলেও, সে নিজের জীবনের ছন্দে পথের গাছ থেকে প্রাণীকে জড়িয়ে রাখে । এমন চরিত্র আমাদের খুব চেনা জগত থেকে চলা শুরু করে ক্রমশ চোখের সামনে কেমনভাবে অচেনা হয়ে ওঠে, সেটাই এ ছবির উল্লেখযোগ্য অর্জন । সেই যাত্রাপথ প্রায়শ বিচিত্র, কখনো চমক-জাগানো হলেও বলার গুণে, চিত্রকল্পের সৌজন্যে কখনো অবিশ্বাস্য হয়ে ওঠে না ।
 
সাদা-কালো রঙ বেছে নেওয়া, এই বিষয়ের পক্ষে অসামান্য হয়ে ওঠে একের পরে আরেক চিত্রকাঠামোর নৈপুণ্যে, যেখানে ছায়ার ব্যবহার মুগ্ধ করে বারংবার । এখানে গল্প বলতে গিয়ে পেশির বিস্তার করা হয়নি, বরং তা রেখা ধরে চলে এবং দৈনন্দিনের আবর্তনের সামান্য পরিবর্তনে মণিমুক্তো তুলে আনে চেতন থেকে অবচেতন, বাস্তব থেকে পরাবাস্তবে নিয়ে যায় । আমাদের দেখার নানা ফাঁকফোকর আর ফাটল দিয়ে অনুভবকে অন্য রকম স্তরে নিয়ে যায়, বাইরের জগতের বিপরীতে আপাতশান্ত এবং প্রায়-নীরব মনের প্রতিক্রিয়াকে অচেনা পথে তুলে ধরে । এখানে সফলভাবে মানিকবাবুর সেই যাপনকে বোঝানো হয় যা নিয়ত সমাজ ও ব্যক্তির বিরোধে নতুন ধারার সৃষ্টি করে ।
 
শুরুরও শুরু থেকে সচেতন প্রয়াস রাখেন অভিনন্দন । লিটল ল্যাম্ব ফিল্মসের প্রযোজনার অংশে, যেখানে মেঘের দেহের চাপ থেকে বাঁচতে শিশু ভেড়ার ডাক এবং শেষে ওই মেঘেদের একটিতে চড়ে পড়া দেখানো হয় । প্রযোজনায় মেঘের ইঙ্গিতে ও তারই শরণ নেবার দৃশ্যে এভাবেই যেন একাত্ম হন বৌদ্ধায়ন ও মোনালিসা মুখোপাধ্যায় । ছবি শুরু হয় কলকাতা শহর দেখিয়ে, যার কেন্দ্রে থাকে খানিক আবছা রবীন্দ্র সেতু । এই দৃশ্য এবং সেতু যে কেবল স্থানিক আন্দাজ দেবার জন্য নয়, তা পরে বোঝা যায় পরে মেঘের সঙ্গে মানিকবাবুর সম্পর্ক গড়ে ওঠার সময় । সেই দৃশ্যে অন্যভাবে দেখা দেয় সেতুর শহর এবং যেন সম্ভাব্য এক নৈসর্গিক সম্পর্কের বন্ধনের প্রতীক হতে চায় ।
 

অত্যন্ত সহজ আলেখ্য জুড়ে চিত্রমালা গেঁথে অভিনন্দন আদতে সেই জগত দেখাতে চেয়েছেন যা বেনেতন্ত্র কেবল লুকিয়ে রাখে না, বিলীন করে দিতে চায় । সম্পদের রোবটতন্ত্রের আড়াল থেকে তিনি অনুভূতির সত্যকে, হরিতের হরিষকে, আকাশের ব্যাপ্তিকে মূর্ত করে তোলেন । দেখান যে মানিকের মতো মানুষের চাহিদা অপ্রাপ্তি বা অভিযোগ নেই, সে সন্তুষ্ট । 

 
একই ভাবে অন্যান্য অনেক দৃশ্যপট ফিরে ফিরে আসে নতুন দৃষ্টিকোণে, আরেক ব্যঞ্জনা নিয়ে, যা দৃশ্যের ভাষায় ঘটনার ভেতরের জগতকে মেলে ধরে । একেবারে দ্বিতীয় দৃশ্যের শোবার বিছানার কথা বলা যেতে পারে । এই চিত্রকাঠামোয় নিপুণভাবে মানিকের পরিচয় উঠে আসে । তার সামাজিক আর্থিক অবস্থান, অগোছাল উদাসীন ব্যক্তিসত্তার নিঃসঙ্গতা ফুটে ওঠে। পরের শয্যাচিত্রগুলো মানিকবাবুর ক্রমবিবর্তনের নবতম পর্যায়ের সন্ধান জুগিয়ে চলে । কখনো দুধওয়ালাকে বাড়িওয়ালির কুবচন ইঙ্গিত দেয়, কোন পরিবেশে অসহায় হয়ে আছে মানিক । মনে পড়িয়ে দেয় সামান্য আগেই বাবাকে দেখাশোনা করে বাইরে কাজে যাবার মুখে বাড়িওয়ালির বাণী কেমন গেটের মুখে থমকে দিয়েছিল তাকে । বাড়িওয়ালিকে কখনো দেখা যায় না, সত্যি বলতে মানিকের নারীবিবর্জিত জীবনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এখানে কোনও নারী চরিত্র সামনে আসে না । অথচ নগরজীবনের পরিবেশের অশান্তি ও শব্দদূষণ শান্তিপ্রিয় মানিককে কেমন বিপর্যস্ত করে তার আভাস পায় দর্শক ।
 

মানিকবাবুর মেঘ (নির্মাণকাল ২০২১) এবং উইম ওয়েন্ডার্সের পারফেক্ট ডেইজ (২০২৩) 

এই দৈনন্দিনের আবর্তনের কথা প্রসঙ্গে বলি, মানিকবাবুর মেঘ (নির্মাণকাল ২০২১) দেখার সময় আরেক অসামান্য সৃষ্টি, উইম ওয়েন্ডার্সের পারফেক্ট ডেইজ (২০২৩) মনে পড়ে । পরিবেশ ও পরিস্থিতির তফাত থাকলেও দুই চরিত্রই সবার মাঝে একা, অথচ সেটাই প্রকৃতির সঙ্গে জড়ানো তাদের নিজস্ব পরিপূর্ণ জগত । একেক দিন যেন একই রকম কাটে, অথচ তার সামান্য পরিবর্তনে চরিত্রের বিকাশ ঘটে চলে । টোকিয়ো আর কলকাতার ঘর, ছাদ, আকাশ আর গাছপালা অমিলের মাঝেও কোথায় একাকার হয়ে যায় । এ সবই সফলভাবে সময়কে ধরার লক্ষণ, যা একই সঙ্গে ফল্গুধারার মতো অনুচ্চকিত বার্তা দেয় ।
 
এ ছবির শক্তি হলো বলার সংযম, অতি অল্প দেখিয়ে, আরও অল্প বলে সামগ্রিকতাকে তুলে আনার ক্ষমতা দেখিয়েছেন অভিনন্দন। বেশির ভাগ কথার উত্তরে মানিকবাবু চুপ করে থাকে, কখনো মাথা নামিয়ে, নয়ত সরাসরি নীরব নজর রেখে । কদাচিত সে মাথা নাড়ে, হাসার চেষ্টা করে, কিন্তু তার মনোভাব গোপন থাকে না । এমনকি শান্ত বাড়িওয়ালার মুখে (অরুণ গুহঠাকুরতা) বাড়ি ছাড়ার মতো ভয়ানক বার্তা তাকে শঙ্কিত করে তুললেও তার চোখের পাতা প্রথম বার কেঁপে উঠে, ভেতরের তোলপাড় দেখায় ।
 

বাবা মারা যাবার পরে অতি ধীরে পাল্টে যেতে থাকে মানিক । সব দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করে, কিন্তু মৃত বাবার দেহের পাশে আবেগতাড়িত হয় না । পারলৌকিক কাজ সেরে ধরাচুড়ো পরে পাথরের মতো স্থির দাঁড়িয়ে থাকে ভাগীরথীর পারে । ছাদওলা বাড়ি খোঁজার কথা বলে নীরবে গালাগাল খায় কালীভক্ত কালীদার কাছে (দেবেশ রায়চৌধুরি) । চুল কামানোর সময় মাথা কেটে যেতে, নাপিত রক্ত বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে ছুটলে, রোদে কষ্ট পেয়ে হাত দিয়ে মাথা ঢাকে সে । আর তখনি দৃশ্যগত ভোজবাজি দেখান পরিচালক, অতি সামান্য অথচ দক্ষ আয়োজনে । নইলে ওখানেই নষ্ট হয়ে যেতে পারত ছবিটি ।
 

কত শৈল্পিক দক্ষতায় এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি অর্জন করেছেন অভিনন্দন । তার সঙ্গে মিশে যায় ছদ্মকৌতুক আর সূক্ষ্ম রঙ্গ, যখন সে কালীদাকে মেঘ দেখিয়ে অনুসরণ করার কথা বলে এবং ব্যর্থ হয়ে পথে অন্যত্র, পথ চলতিদের দেখাতে থাকে । এই কল্পনার জগতে আশ্রয় খোঁজা, মুক্তিকামী এই বিভ্রম কে সকলে পাগলামির লক্ষণ বলে হাসে, অথচ এখানেই আরেক মাত্রা আনে অসহায়ের নিরুপায় হয়ে আশ্রয় খোঁজার নির্মম দশা

 
মানিক কেবল উপরের দিকে তাকায়, স্বস্তি পায় । আর দর্শক পায় এক চাপা উত্তেজনার আবহসঙ্গীত । এই আবহ বারংবার ফিরে আসে, প্রথমে বিস্ময়, পরে ভয়ের অনুষঙ্গে । যত ঘাবড়ে যায় মানিক, তত গভীর হয় আবহ এবং স্বাভাবিক উত্তেজনা গড়ে ওঠে। পথে সে দৌড়োয়, সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নামে, আর আমরা আধুনিক হিচককের রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি টের পাই । চূড়ান্ত ভয় যেন সর্বত্র তাড়া করে চলে এবং শেষে চেহারা পায় বালতির জলে, যেন পাল্টা তাকিয়ে আছে কেউ !
 
সিনেমাটি না দেখলে বোঝা যাবে না কত শৈল্পিক দক্ষতায় এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি অর্জন করেছেন অভিনন্দন । তার সঙ্গে মিশে যায় ছদ্মকৌতুক আর সূক্ষ্ম রঙ্গ, যখন সে কালীদাকে মেঘ দেখিয়ে অনুসরণ করার কথা বলে এবং ব্যর্থ হয়ে পথে অন্যত্র, পথ চলতিদের দেখাতে থাকে । এই কল্পনার জগতে আশ্রয় খোঁজা, মুক্তিকামী এই বিভ্রম কে সকলে পাগলামির লক্ষণ বলে হাসে, অথচ এখানেই আরেক মাত্রা আনে অসহায়ের নিরুপায় হয়ে আশ্রয় খোঁজার নির্মম দশা ! এই যে ছদ্মকৌতুকের আবহ, তা আগে থেকেই তৈরি করা হয় নানা ছোটো পরিস্থিতি, মানিকের হাবভাব, এমনকি তার বাবার সংলাপে, ‘ হ্যাঁ রে, নেতাজি কি ফিরে এলেন !’
 
সকলেই নিজের মতো করে মুক্তি খোঁজে, বাড়িওয়ালা নিজের স্ত্রীর কাছ থেকে (বার বার বলে, আমি বলছি না…আমার বৌ বলছে!), কালীদা তার আরাধ্যের কাছে, মানিকের বাবা নেতাজির কাছ থেকে ।
 
আদতে যা উচ্চারিত নয়, সেই সর্বগ্রাসী মেকি সভ্যতা এই সৃজনের লক্ষ্য । যা গুটিয়ে থাকা, আর্থিকভাবে দুর্বল, পরিস্থিতির চাপে ন্যুব্জ সাধারণ মানুষ নিতে পারে না বলে ভাড়াঘরে-বাজারে-অফিসে হেরে চলে । টিভির বদলে রেডিও, ফ্রিজের বদলে রোজকার চুনোপুঁটি, আলোর জায়গায় অন্ধকার আর মোবাইলের বদলে নিঃসঙ্গতা থাকে তার । ছাদের বাতিল টিভি, ফ্রিজের বিপরীতে টবের তাজা চারা, ঘরের পাখার শব্দ, পাসবালিশ, আই ড্রপ, টর্চ, কলের চেহারা আর অ্যালার্ম-ঘড়ি তাই কেবল অসাধারণ চিত্রকল্পে ধরা দেয় না, অভিজ্ঞান হয়ে মানিকের জীবনের মূল সুর ধরিয়ে দিতে থাকে । সামান্য টিকটিকি, পিঁপড়ে, রাস্তার কুকুর ততটাই গুরুত্ব পায়, পথের যে পত্রহীন গাছ নিত্য জলের স্পর্শে যা পায় ।
 
তাই মানিক বাবার শেষকাজের পরে মাটি থেকে যা কুড়িয়ে নেয়, তা এক মঙ্গলঘট, যেটাও সে পরে রাখতে পারে না, ধাপার আবর্জনার মাঝে ফেলে দিয়ে আসে ! রাস্তার হোর্ডিঙে পাশাপাশি উত্তম সুচিত্রার ছবিও যেন ছদ্মকৌতুক, এই বুঝি গেয়ে উঠবে, নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড় ! অসাধারণ এই ছবির চিত্রনাট্য, পরতে পরতে শাণিত চিত্রকাঠামোর সঙ্গে পাল্লা দেয় । ছবিতে কেন অহেতুক সংলাপ আর টানা বর্ণনার দিন পেরিয়ে এসেছে তা বুঝতে মানিকবাবুর মেঘ দেখা দরকার ।
 
চূড়ান্ত পর্বে আবার পাল্টে যায় মানিকবাবু এবং অন্যান্য বারের মতোই তার চলা বলা তাকানো আর হাসির ভঙ্গি নতুন চেহারায় ধরা দেয় । চন্দন সেনের সংবেদনশীল অভিব্যক্তি অবাক হয়ে দেখে যেতে হয় । এত ভালো অভিনয় অনেকের কথা মনে পড়ায়, বিশেষ করে তুলসী চক্রবর্তীর দক্ষতার পরশপাথর যেন ছোঁয়ানো আছে এখানেও ।
 
নিঃসঙ্গ মানিক যখন বোঝে টুকরো মেঘখানি তাকে ছায়া দিতে চায়, সঙ্গী হতে চায়, অচিরে সে প্রেমিক হয়ে ওঠে ! কথা বলা শুরু করে নির্জনে, আবেগ নিয়ে চেয়ে থাকে । আকাশ থেকে খবর নিয়ে আসা ঘুড়ির ঘ্রাণ নেয় । নতুন জামা বানায় সে, কোট গায়ে দিয়ে মেঘের মন কাড়তে চায় ময়দানের ঘাসে শুয়ে পড়ে, আর সেই ছবি আকাশের উচ্চতা থেকে তোলা হয় বলে অনবদ্য প্রতিক্রিয়া আনে ! আর কোনও কিছুর পরোয়া সে করে না । ব্যাঙ্কে টাকা রাখে না সে, তাই প্যাকেট ইত্যাদি থেকে ঝেড়েঝুড়েও কম পড়লে আসবাব বেচে ছত্রিশ হাজার টাকা জোগাড় করে, রসিদ ছাড়াই দালালকে দিয়ে দেয় এবং ঠকেও বিচলিত হয় না । তার বাংলা আবৃত্তির টিউশনি ইংরেজির শিক্ষক বেহাত করে নিলে দমে না ।
 

নিঃসঙ্গ মানিক যখন বোঝে টুকরো মেঘখানি তাকে ছায়া দিতে চায়, সঙ্গী হতে চায়, অচিরে সে প্রেমিক হয়ে ওঠে ! কথা বলা শুরু করে নির্জনে, আবেগ নিয়ে চেয়ে থাকে । আকাশ থেকে খবর নিয়ে আসা ঘুড়ির ঘ্রাণ নেয় । নতুন জামা বানায় সে, কোট গায়ে দিয়ে মেঘের মন কাড়তে চায় ময়দানের ঘাসে শুয়ে পড়ে, আর সেই ছবি আকাশের উচ্চতা থেকে তোলা হয় বলে অনবদ্য প্রতিক্রিয়া আনে

 
স্নানঘরে কলের কথা একটু বলা যাক । মানিক স্নান করে কলের নিচে বসে মাথা পেতে দিয়ে, ফলে জল ছিটকে পড়ে ফোয়ারার মতো ! মেঘপ্রেমিকার সদয় বর্ষণের পরে মানিক ছাদে গিয়ে বালতিভর্তি বৃষ্টির জল পায় । তারপর অসম্ভব আবেদনময় দৃশ্যে সে নগ্নস্নানে মত্ত হয় ! আশ্চর্য অভিঘাতে অপার্থিব মিলনের কাব্য রচনা হতে থাকে, অনেক যৌনদৃশ্যকে হার মানায় । আর বৃষ্টির মাঝে মেঘের খাওয়ার জন্য ছাদে সাজানো থালা রেখে যাওয়া দেখতে হয় হাঁ করেই ! কত কথা যে না বলে বলা যায়, তা সত্যি মুগ্ধ করে ।
 
অনেক প্রলোভন ছিল এমন ছবিতে অন্য আধুনিক ধ্রুপদী ছবির কেরামতি নেওয়া, বিস্তর সুযোগ ছিল, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী অভিনন্দন স্রেফ কলকাত্তাইয়া নজরমিনার ব্যবহার করেই লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন । গলি দিয়ে পালানো মানিক চ্যাপলিনকে ছুঁয়েও পিছলে স্বতন্ত্র হয়ে থাকে । অফিসের টেবিলে ক্রমাগত ফাইল জমা পড়ে চলে, তখন তার নিস্পৃহতা অনেক বিখ্যাত লেখক ও পরিচালকের কথা মনে আনে ।  আরেকটি হোর্ডিঙের ব্যবহারের কথা বলা উচিত । ছাদওলা বাড়ি খোঁজার জন্য যখন সে উপহসিত ও ব্যর্থ, তখন সে পথে বহুতলের বিজ্ঞাপন দেখতে পায়, যেখানে কাঠামোর মাথা মেঘ ছুঁয়ে থাকে । বলা হয় মেঘের কাছে থাকুন ! হাঁ করে সেই ছবি দেখতে থাকে মানিক এবং অবশ্যই অসংখ্য স্বপ্নচারী সাধারণ মানুষ ! শুরু থেকে শেষ অবধি এমনিভাবে মেঘ অন্যান্য নানা চেহারায় আসতেই থাকে বারংবার ।
 
প্রশ্ন উঠতে পারে সব কিছু বলা দেখানো আর চলচ্চিত্রীয় ইঙ্গিত দেওয়ার পরেও ডাক্তারের পরীক্ষার অংশটি কেন দরকার হলো ! আমার মনে হয়েছে অন্তত দু’টি কারণ আছে । প্রথমত ডাক্তারও সমাজের বাকি অংশের মতো স্রেফ চোখ দেখে ঠাট্টা করে, গভীরে যায় না । আসলে মন পাঠ করার শিক্ষা এখনো তেমন সুলভ নয় । তার চেয়ে বড় কারণ এমন লোকেদের যে কথাটুকুও বলতে দেওয়া হয় না, তা দেখানো । মানিক রীতিমতো আঙুল তুলে, একটা কথা বলা যাবে কিনা জানতে চাইলে, তাকে কোনও আমলই দেওয়া হয় না । তাই সারা সিনেমায় মানিকের ফ্যালফ্যাল তাকানো আর নীরবতা এখানে এসে নিশ্চিতভাবে অন্য মাত্রা পায়, কেউ তার কথা শুনতে, তাকে জানতে আদপেই রাজি নয় । কাকে কোন কথা বলবে সে !
 
অত্যন্ত সহজ আলেখ্য জুড়ে চিত্রমালা গেঁথে অভিনন্দন আদতে সেই জগত দেখাতে চেয়েছেন যা বেনেতন্ত্র কেবল লুকিয়ে রাখে না, বিলীন করে দিতে চায় । সম্পদের রোবটতন্ত্রের আড়াল থেকে তিনি অনুভূতির সত্যকে, হরিতের হরিষকে, আকাশের ব্যাপ্তিকে মূর্ত করে তোলেন । দেখান যে মানিকের মতো মানুষের চাহিদা অপ্রাপ্তি বা অভিযোগ নেই, সে সন্তুষ্ট । তবু পরিস্থিতি তাকে নির্দয়ভাবে ঠেলে নিয়ে চলে ।
 
ছাদে যে ভাবে সমাপন হয় ছবির, তা বাকি অনেক অংশের মতোই চিত্রমোদীর হাতে ভাবনা ও ব্যাখ্যার সুতো ছেড়ে রাখে । একটা কোনঠাসা মানুষ কী কী করতে পারে তা অনুমান করে নিতে হয় । ছড়ানো ছেটানো ছাদের উল্টানো টব, ছাতা, বিশৃঙ্খল জিনিসের মধ্যে যা পড়ে থাকে, তা হলো বিষণ্ণতা ।
 
অনুপ সিংয়ের অনুভূতিময় চিত্রগ্রহণ চমকজাগানো শিল্প উপহার দেয় । শুভজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত, সংবেদী আবহশব্দ ছাড়া প্রত্যাশিত মাত্রা পেত না এই ছবি । উপস্থাপক অনির্বাণ ভট্টাচার্যের গলায়, ‘তোমার আমার গল্প হত’, গান ছবির সম্পদ । সাদা কালোয়, অতি অল্প আলোয় যে শাশ্বত আলোর সৃজন করেছেন পরিচালক, তা অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য । তাঁর প্রথম নির্মাণে অনবদ্য ভাবনা আর চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষায় আদ্যোপান্ত সৃজন করে অবাক করেছেন বললে কম বলা হয় ।


  • Tags:
❤ Support Us
আশ্রয় গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
পথ ভুবনের দিনলিপি। পর্ব ১২ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
হিরণবালা । পর্ব ১২ ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
error: Content is protected !!