Advertisement
  • খাস-কলম প্রচ্ছদ রচনা
  • মে ১৬, ২০২৩

দীর্ঘস্থায়ী অবিশ্বাস আর অনাস্থাই কি মণিপুরের হিংসার অন্দর কাহিনী ?

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
দীর্ঘস্থায়ী অবিশ্বাস আর অনাস্থাই কি মণিপুরের হিংসার অন্দর কাহিনী ?

হিংসার আগুনে পুড়ে চলেছে মণিপুর। ৩৫৫ ধারা জারি করে, দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়েও কিছুই হচ্ছে না। মণিপুরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, মেইতেই সম্প্রদায়, কুকি সম্প্রদায়ের সঙ্গে দফায় দফায় দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বৈঠক করেছেন রবি ও সোমবার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও মুখ্যমন্ত্রী বৈঠক করেছেন। বৈঠকে মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায় অমিত শাহের কাছে আলাদা করে অশান্তি না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনও অশান্ত মণিপুর।

মণিপুরে হিংসার কারণ খুঁজতে গেলে সেই রাজ্যের জনবিন্যাস নিয়ে আলোচনা জরুরি। জনসংখ্যার নিরিখে মেইতেই সম্প্রদায় মণিপুরে সংখ্যায় বেশি। এই মেইতেই গোষ্ঠীর তফসিলি জনজাতি (এসটি) তকমার দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়ার পরেই কিন্তু মণিপুরে হিংসার আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। যা এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

ইতিহাস বলছে মণিপুরে হিংসার শুরু ব্রিটিশ আমল থেকে। তবে কুকি-জোমি উপজাতি ও বৃহত্তর হিন্দু মেইতিদের মধ্যে এই রক্তক্ষয়ী লড়াই তিন দশক পরে আবার মণিপুর প্রতক্ষ্য করছে। সময়টা ১৯৯৩। সেই সময় মেইতিদের সঙ্গে পাঙ্গালদের মণিপুরে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছিল। উপজাতি নাগা আর কুকিদের মধ্যেও ব্যাপক হিংসা ছড়িয়েছিল তখন। একদিনে ১০০-র বেশি কুকিকে হত্যা করা হয়েছিল। হাজার হাজার কুকি তাঁদের বাড়িঘর ছেড়ে তখন পালিয়ে গিয়ে প্রাণরক্ষা করেছিল।

১৬টি জেলা নিয়ে গঠিত মণিপুর রাজ্য ‘উপত্যকা’ এবং ‘পাহাড়’, এই দুটি ভাগে ভাগ হয়ে রয়েছে। ইম্ফল পূর্ব, ইম্ফল পশ্চিম, থৌবাল, বিষ্ণুপুর এবং কাকচিং-এর আজকের উপত্যকা জেলাগুলো নিংথৌজা রাজবংশ দ্বারা শাসিত কাংলেইপাকের আগের রাজ্যের অংশ ছিল। অনেকের মতে  উপত্যকার বাইরের উপজাতীয় অঞ্চলগুলোও মণিপুর রাজ্যের অধীনে ছিল এক সময়। উপজাতিদের জন্য ওই অঞ্চলে তখন থেকেই সমস্যা চলছিল। এই সমস্যার জন্য নাগা উপজাতিদেরই মূলত দায়ী করা হয়ে থাকে।

তবে মণিপুরের হিংসার পিছনে এই জনগোষ্ঠীর অবস্থান বড় ভূমিকা নিয়েছে। মণিপুর উপত্যকাটি নাগাল্যান্ড এবং মিজোরামে ছড়িয়ে পড়া নীচু পাহাড়ের সীমানা দিয়ে ঘেরা। মণিপুরের ভৌগোলিক অঞ্চলের বেশিরভাগ অংশ নিয়ে গঠিত এই পাহাড়ি এলাকা। যেখানে রয়েছে ১৫টি নাগা উপজাতি এবং চিন-কুকি-মিজো-জোমি গোষ্ঠীর বাস। এই সব গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে কুকি, থাডউ, হামার, পাইটে, ভাইফেই এবং জোউ জনগোষ্ঠীও। কাংলেইপাক, সেই সময় ছিল একটি ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্য। এর উত্তরের পাহাড় থেকে নেমে আসা নাগা উপজাতিদের দ্বারা বারবার রাজ্যটি আক্রান্ত হয়েছিল।

মণিপুরের ব্রিটিশ রাজনৈতিক প্রতিনিধি মেইতেই এবং নাগাদের মধ্যে সংঘাত নিবারণের  কাজ করা এবং উপত্যকাকে লুণ্ঠনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বার্মার কুকি-চিন পাহাড় থেকে কুকি-জোমিদের এনেছিলেন বলে ইতিহাস মনে করে। নাগাদের মতো কুকিরাও প্রচণ্ড যোদ্ধা জাতি। কুকিদের মণিপুরের মহারাজা পাহাড়ের ধারে জমি দিয়েছিলেন। তাদের নিম্নভাগের ইম্ফল উপত্যকার রক্ষার জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা ছিল এই জমি দেওয়ার আসল কারণ।

এদিকে পার্বত্য জনগোষ্ঠী এবং মেইতেইদের মধ্যে জাতিগত উত্তেজনা পূর্ববর্তী রাজ্যের সময় থেকেই প্রকট ছিল। কিন্তু, ১৯৫০-এর দশকে নাগা জাতীয় আন্দোলন শুরুর সময় এবং একটি স্বাধীন নাগা রাষ্ট্রের দাবির মধ্যে দিয়ে এই সংঘর্ষ ক্রমেই বাড়তে শুরু করে। মেইতেই এবং কুকি-জোমির মধ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থানের মাধ্যমে সেই সময় নাগা বিদ্রোহ মোকাবিলা করা হয়েছিল।

এর পর  ১৯৯০-এর দশকে, এনএসসিএন-আইএম জঙ্গিগোষ্ঠী যখন স্বাধীনতা বা আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আরও জোর দেয়, তখন কুকি-জোমি গোষ্ঠীগুলোরও সামরিকীকরণ শুরু হয়। কুকিরা সেই সময় স্বাধীন ‘কুকিল্যান্ড’-এর জন্য নিজস্ব আন্দোলন শুরু করেছিল। তবে, নাগা আন্দোলনের বিপরীতে, কুকি-জোমির আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, ভারতের মধ্যে একটি রাজ্যে জন্য। কোনও পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তারা করেনি। যদিও কুকিরা মেইতেই সম্প্রদায়ের রক্ষক হিসেবেই তখন কাজ শুরু করেছিল। তবে কুকিল্যান্ডের এই দাবি এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদের জন্ম দেয়।

সম্প্রতি মণিপুরে যে হিংসার আগুন জ্বলছে তার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রায় এক দশক ধরে নানাভাবে মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষরা আইনিভাবে তফশিলি উপজাতি বা “শিডিউলড ট্রাইব” (এসটি) তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। তাঁদের বক্তব্য, স্বাধীনতার আগে স্বাধীন মণিপুর রাজ্যে তাঁদের “উপজাতি” হিসেবেই স্বীকৃতি ছিল। স্বাধীনতা ও তারপর ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে মণিপুরের অন্তর্ভুক্তির পর তাঁদের এই স্বীকৃতি লুপ্ত হয়ে যায়। ফলে জমি থেকে শুরু করে ঐতিহ্য, ভাষা, পোশাক সবেতেই স্বকীয়তা বজায় রাখার যে সুবিধেগুলি তফসিলি উপজাতিরা পেয়ে থাকেন, সেই সুবিধা থেকে মেইতেইরা বঞ্চিত হচ্ছেন। মেইতেইরা এখন এনআরসি চাইছে রাজ্যে। বলছে তাহলে রাজ্য থেকে সেই জনগোষ্ঠীদের বিতাড়িত করা যায় যারা প্রকৃতপক্ষে এই রাজ্যের বাসিন্দা নয়।

এই আবহেই “তফশিলি উপজাতি”-এ স্বীকৃতির জন্য তাঁরা মণিপুর হাইকোর্টে আবেদন করে মেইতেইর। হাইকোর্ট তাদের আবেদন শুনে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়ে বলে,  চার সপ্তাহের মধ্যে আবেদনকারীদের দাবিদাওয়া যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে রাজ্যের অবস্থান জানাতে। কিন্তু আদালতের এই নির্দেশ মণিপুরের বাকি উপজাতিরা মেনে নিতে পারেনি। তাঁরা বলতে শুরু করেন, আদালতের এই নির্দেশে মেইতেইরা  অন্যায়ভাবে সুবিধে পেয়ে যাবেন এবং তাতে আখেরে ক্ষতি হবে নাগা, কুকি-সহ বাকি উপজাতিদের। এমনিতেই মেইতেইরা যথেষ্ট অগ্রসর। রাজ্যের বেশিরভাগ বসতি যেহেতু উপত্যকায়, তাই বিধানসভার আসনও বেশিরভাগ মেইতেই অধ্যুষিত অঞ্চলেই। বিধানসভাতেও মেইতেইরাই সংখ্যার দিক থেকে গরিষ্ঠ। মেইতেই ভাষাকে সংবিধানের বাইশটি সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়াও  হয়েছে। তাছাড়া মেইতেইরা বেশিরভাগ একটি বৃহত্তর সম্প্রদায়ের অংশ হওয়ায় এমনিতেই তফশিলি জাতি (এসসি) বা অন্যান্য অনগ্রসর জাতি (ওবিসি) সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁরা তফশিলি উপজাতি-ভুক্ত হলে বাকি উপজাতিদের কাজের ক্ষেত্রে বা পড়াশোনায় বা চাকরিবাকরিতে যেটুকু যা সুযোগ-সুবিধে ছিল, তাও থাকবে না।

আর তাই হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে মিছিলের ডাক দেয় উপজাতি ছাত্রদের সংগঠন “অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অফ মণিপুর।” তারপর থেকেই এই সংঘাত তথা গৃহযুদ্ধের শুরু। এই ঘটনায় এখন কঠিন  চাপের মুখে মণিপুরের বীরেন সিং-য়ের নেতৃত্বে বিজেপি সরকার। এই জাতি সংঘাতের সঙ্গে স্থানীয় আবেগ এমন ভাবে জড়িত গিয়েছে যে  কোনও কিছু দিয়েই এই সংঘাত থামানো যাচ্ছে না। তাই কোনও সমাধান সূত্র বার করতে না পেরে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী সরাসরিভাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। বিরোধীরাও একই দাবি তুলেছে মণিপুরকে শান্ত করতে। তবে পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে মণিপুরে কি রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়ার দিকে এগোচ্ছে? এই প্রশ্ন এখন উঠছে।


  • Tags:

Read by: 105 views

❤ Support Us
Advertisement
homepage vertical advertisement mainul hassan publication
Advertisement
homepage billboard publication
Advertisement
Advertisement
শিবভোলার দেশ শিবখোলা স | ফ | র | না | মা

শিবভোলার দেশ শিবখোলা

শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া স | ফ | র | না | মা

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া

সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।

মিরিক,পাইনের লিরিকাল সুমেন্দু সফরনামা