Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • নভেম্বর ১৪, ২০২৪

আমার বাবা । পর্ব ৩

আবির ধুয়ে বিকেলে অঙ্ক করতে বসতাম৷ মাথার চুল থেকে নামতায় লাল গুঁড়ো ঝরত৷ গুঁড়োগুলো একটু একটু করে এক একটা  আঙুলের ডগায় নিয়ে দেখতাম৷ পেছন থেকে দার্শনিক বাবা বলতেন, বিন্দু রঙেই কত রঙ্গ ! 

ময়ূরী মিত্র
আমার বাবা । পর্ব ৩

পর্ব ৩

 

কুচোবেলা থেকে আইঢাই ঢাউস বয়স অব্দি রঙের খেলায় দুটো রঙ খুঁজে যাই৷চাঁদসাদা আর মিশি কালো৷ গরুখোঁজা যাকে বলে৷ কালো মিলত৷ সাদাটা কোনদিন  জোগাড় হয়নি৷ আসলে জীবনে চাঁদসাদা  যে কী — তা বুঝেই উঠতে পারিনি৷ সে চাঁদের শুভ্র আমার জীবনে কখনো এসেছে কিনা তা কী করে বলি !  মাঝে মাঝে মা কালোর সাথে গোলার জন্য রূপোলি এনে দিতেন৷ বাবা বলতেন — তোমার  রুপোর জমকে মাঝখান থেকে এমন বিউটিফুল কালোর গ্ল্যামারটা গেল খোয়া৷

ঠিক বাবা ঠিক৷ চাঁদের সাদা হাতের বাইরেই থেকে যেত৷ বারবার৷ নিজের ওপর অসন্তোষ হত৷ কেন যে গোলাপি হলদে ছেড়ে এই বেখাপ্পা রং দুটো দিমাগে  ঝামেলা  বাঁধাত জানি না ৷ কিশোরকাল এল ৷ ছেলে দেখে গা মোচড়ানো ভাবও তৈরি হল৷
খুব ইচ্ছে করত — দুটোকে মিশিয়ে তৈরি করব ধোঁয়াশা রং৷ সুপুরি গাছের একটি পাতায় কড়া চাঁদ ঝরলে বাকি পাতা যেমন ঝাপসা আলোয় ভরে তেমনি অস্পষ্ট হবে আমার প্রিয়র  মুখ৷  দোলের সকালে সুপুরির ঝরা পাতা আদুল শরীরে হাত বোলাতাম — যদি আগের রাতের চাঁদ লেগে থাকে পাতায়৷ ছোট্ট মেয়ের দুবিন্দু স্তন কি জড়িয়ে যেত পাতার উপশিরায় ? মনেও পড়ে না ছাই !

আমার বেরঙ মনপুরুষ৷ মুখখানা তার প্যাঁচার মতো৷ গায়ে  জেব্রা ডোরা —দুর্লভ প্রাণের আঁকিবুকি৷ সে তো পরাণে মোর !

আবির ধুয়ে বিকেলে অঙ্ক করতে বসতাম৷ মাথার চুল থেকে নামতায় লাল গুঁড়ো ঝরত৷ গুঁড়োগুলো একটু একটু করে এক একটা  আঙুলের ডগায় নিয়ে দেখতাম৷ পেছন থেকে দার্শনিক বাবা বলতেন, বিন্দু রঙেই কত রঙ্গ !

তখন আমার ক্লাস এইট৷ চলচ্চিত্র নির্দেশক তপন সিংহের আদালত ও একটি মেয়ে ছবির শুটিং শুরু হবে৷ একটি দৃশ্যে ধর্ষণের সবুদ নিয়ে সমুদ্রের ধার দিয়ে প্রবল ছুটতে হবে ইন্সপেক্টররূপী মনোজ মিত্রকে ৷ চোখ থাকবে সূর্যের দিকে৷ সে চোখে একটি নিরীহ মেয়েকে বিচার পাইয়ে দেবার আনন্দ থাকবে৷ অভিনেতা মনোজকে এমনই নির্দেশ ছিল তপনবাবুর৷ তপনবাবুর মতো চরিত্রের এত ডিটেলড (detailed) অভিব্যক্তি নিয়ে ভারতের, কজন পরিচালকই বা ভেবেছেন !

তপন সিংহের আদালত ও একটি মেয়ে ছবির দৃশ্যে মনোজ মিত্র

বেলগাছিয়ার মাঠে দৌড় প্র্যাকটিস শুরু করলেন আমার বাবা মনোজ মিত্র ৷ সময় বাছলেন ঠিক ভোর সাড়ে চারটে ৷ আমি তখন অমূল্যর ভেজিটেবল চপ গিলে আর অন্যদের চপের পেট থেকে বাদাম বের করে করে মস্ত মোটা হয়েছি ৷ আমাকেও টানলেন ৷ দমদেওয়া ঘড়িতে আমাকে সময় মাপতে বললেন ৷  তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যেই বারবার গোল করে করে ছুটতে লাগলেন ৷ গোলটা বারবার একই সাইজের বল হয়ে যাচ্ছিল ৷ ঘুম চোখে বললাম — গোল করে ছুটছ কেন ? যত সোজা কাজ বাছা তোমার ! গোলে দৌড়লে গোলের অন্য প্রান্তে ফিরতে হয় ৷ সূর্য টুর্য কিচ্ছু দেখা হবে না তোমার ! ফালতু ফ্লপ ছবি দিয়ে ফিরে আসবে ৷ সোজা এবং লম্বা করে দৌড়োও ৷ না বুঝতে পার তো চল জলধরে যাই ৷ ফার্স্ট জিলিপি নেমে গেছে ৷ কটা নিয়ে এখন বাড়ি চল ৷ তারপর জ্যামিতি খাতায় এঁকে  বুঝিয়ে দেব ক্ষণ ৷ ভালো অভিনয় করতে গেলে জ্যামিতি জানতে হয় বুঝলে ? বলো তোমার পরিচালককে ৷

ঠাসস ৷

একী ! হাসিমুখে চড় মেরে কোথায় যাচ্ছে লোকটা ! দেখলাম সোজা ছুটতে ছুটতে খোয়ার উঁচু ঢিবিটার ওপর উঠে পড়েছেন ৷ তবু বেঁকেচুরে দিক বদলাননি ৷ পা সামান্য কেটে গেছে ৷ এগিয়ে গিয়ে আবার চালিয়াতি করলাম, খোয়ার ঢিবিতে উঠতে গেলে কেন ? পার না -কিছু না ৷ এমনি প্লেন ঘাসে দৌড়োও !

উত্তর এল, সোজা পথে কেউ অক্ষত থাকে না ৷ কিন্তু  অক্ষয় হয় ৷ যে যায় সেও ৷ পথটাও ৷

ঢিবির উচ্চতা কি তাঁর চোখ দুটোকে দ্রুত পৌঁছে দিচ্ছে সূর্যের কাছে ! এত আলোময় চোখ !

ঝাপসা বাকি সব ৷
তবে কি উজ্জ্বলতাই  চাঁদশুভ্র !

ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে আবার ভুলভাল কথা বলতে লেগেছেন অভিনেতা মনোজ !

আসলে সূর্যটা কালো— যারা তার থেকে নির্গত হয় তারাই তাকে আলো করে দিয়ে চলে যায় ৷

চাঁদশুভ্র পাইনি৷
তবে বুঝেছি, যদি সে রঙ কোনোদিন পৃথিবীতে তৈরি হয় তবে তা হবে জীবের গাত্রে ৷
আলো উৎসে নয়৷
আলো প্রবাহে৷

 

আমার কৈশোর কাটছে যখন, তখনো মানুষের হাতে নগদ অর্থ  কম থাকত৷ যাঁরা বসতবাড়ি বানাতেন, একটু একটু করে তৈরি করতেন৷ একসঙ্গে পুরো বাড়িটা গড়তে পারতেন না৷ আমার অধ্যাপক বাবাও তাই৷ যখন যেমন হাতে অর্থ জমত, ঠিক ততটুকু করে তৈরি হতে লাগল আমাদের সল্টলেকের বাড়ি৷ কখনো সামনের বারান্দায় মোজাইক বসে, তো কখনো শ্রী রামকৃষ্ণের ঘরের দেওয়ালে বাদামী রঙ লাগে৷ আধগড়া বাড়িটার চারপাশে তখন বড় বড় কাশগাছ৷ কাশগুলো অশ্বিনের খেয়ালি ঝড়ে একটু নেতিয়ে গেলে দেখতাম বনের ওপাশে টিমটিমে আলোয় বাজার৷ কুপির আলোয় ছটফট করে লাউ বেগুন বেচছেন ৷ কেউ কেউ রাতেও দোকান ঘরে থাকতেন৷ তাঁদের কুপি ভোররাতেও জ্বলত৷ কতজনের সঙ্গে যে ভাব পাতিয়ে দোকানঘরের পেছনে তাদের স্টোভ, বিছানা দেখে এসেছি ৷ বসে পা দোলাতাম৷ একই ঘর দিনে খরিদ্দারের আর রাতে বিক্রেতার হয়ে যায় ! পাড়ার  সবাইকেই  দেখেছি—এমন একটু একটু করে ইট আনছেন আর বাড়ি বানাচ্ছেন ৷ সিমেন্টে নিজের হাতে বালতি বালতি জল ঢালছেন৷ মানুষের নিজের  বসত গড়ার ইচ্ছেটা টের পেয়েছি এই একটু করে ইট বসানো প্লাস্টার মারা দেখতে দেখতে৷ বাড়িটা একসঙ্গে পুরো হলে এই ইচ্ছের তাপ পেতাম না৷ জানতে পারতাম না, জল খেলে বাড়ি শক্ত হয়৷

আলো ছায়া দুটোই মুখে এলে অভিব্যক্তি স্পষ্ট হয় ৷ ঠিক তাঁর মনেরই মতো ৷ অভিনেতার মন কখনো যদি দুঃখ না দেখে তাহলে উপযুক্ত সময় সে হর্ষ বোঝাবে কেমন করে ! আমি নই – আমি যে আলোর ছকে ঘুরছি এখন তারাই চরিত্র ! —বাবার কথাগুলো ছিল এইরকম৷

দোতলার বারন্দার কাঠামোটা তৈরি হয়ে গেছে ৷ সিমেন্ট করা হয়নি ৷  মেঝেতে হাঁটতে গেলে পায়ে নুড়িগুলো লাগে ৷  রোজ দেখতাম, বাড়িটায় সূর্যের প্রথম আলো যেই পড়ল, অমনি বাবা দোতলায় চলে যাচ্ছেন ৷ পিছু নিলাম ৷  বারন্দায় তখনো ভারা বাঁধা, একদিকে রেলিং নেই ৷ তার মধ্যেই নিমগাছের ছায়া আর রোদে মিলে চৌকো ঘর তৈরী করেছে ৷ একটি ছায়াঘর, পাশেই রোদঘর ৷ আর আমার অভিনেতা বাবা একবার রোদঘরে একবার ছায়াঘরে যাচ্ছেন আর আসছেন ৷ অনেকটা বাচ্চাদের চু কিৎ কিৎ খেলার মতো ৷ যখন রোদে যাচ্ছেন কিংবা যখন ছায়ায় যাচ্ছেন, নিজের হাত পা খোলা পেট সব লক্ষ্য করছেন ৷

কী দেখো ? —বললাম আমি ৷

— এই যে রোদ আর ছায়ার খেলা দেখছি ৷ কখন আমার মুখে আলো কমছে ! কোথায় দাঁড়ালে আমার মুখ উজ্জ্বল শিউলিফুল হচ্ছে৷ বাবা বোঝাতে লাগলেন ৷

— সরে এসো বাবা  ৷ পুরো রোদ্দুর যেখানে পড়েছে ওখানে দাঁড়িয়ে চা খাও ৷

— না ৷ আলো ছায়া দুটোই মুখে এলে অভিব্যক্তি স্পষ্ট হয় ৷ ঠিক তাঁর মনেরই মতো ৷ অভিনেতার মন কখনো যদি দুঃখ না দেখে তাহলে উপযুক্ত সময় সে হর্ষ বোঝাবে কেমন করে ! আমি নই – আমি যে আলোর ছকে ঘুরছি এখন তারাই চরিত্র ! —বাবার কথাগুলো ছিল এইরকম৷

এবার রাগলাম ৷

— হেই মা, গো মা ৷  অসম্পূর্ণ আলোর মাঝে আলোটাই চরিত্র হয়ে গেল…?

— অসম্পূর্ণ না হলে শিল্পী  সম্পন্ন করবেন কী  !

— সেদিনের কথোপকথনে এটাই বাবার শেষ কথা !

অনেকদিন বাদে ছোটনাগপুর অঞ্চলে থিয়েটার করতে গেছি৷ সন্ধে নামছে৷ তেরপোল ঘেরা মেকআপ রুমের বাইরে মেকআপ নিয়ে বসে হাওয়া খাচ্ছি৷  বাবা নিঃশব্দে আঙুল দিয়ে একটা দিক নির্দেশ করছেন৷ একটা ঝাঁকড়াচুলো বিরাট গাছের তলায় অনেকখানি গোলাকার জমি ৷ ঘাস অব্দি নেই -এমনই শূন্য সে মাটি৷ অথচ একটু দূরে গাছ ঘাস সব আছে৷ একদৃষ্টে সেই গোল সবুজহীন ক্ষেত্রে তাকিয়ে থেকে বললেন, ওটা নিস্ফলা জমি৷ ওখানে ঘাসও হবে না ৷ তবু ওটা থাকবে৷ নিস্ফলারও শ্বাস নেওয়ার অধিকার আছে ৷

একটু থেমে, নিজের দেশ যখন অন্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম তখন সে অন্যলোকদের স্বাধীনতা মনে মনে স্বীকার করেই তো আসতে হয়েছিল ! অভিনেতার মনে মুহূর্তের পর মুহূর্ত তৈরি হয় — আবেগ বদলায় গাভীমেঘের মতো ৷ তাদের চরতে তো দিতে হবে !

মনোজ মিত্রের সেদিনের নাট্যশিক্ষা নির্ভর করেছিল অভিনেতার জীবনবোধের ওপর৷ আজো তাই করে৷ অভিনয়  মনজাগতিক৷

·•··•··•· ·•··•··•·

ক্রমশ…

দ্বিতায় পর্ব পড়ুন: আমার বাবা

আমার বাবা । পর্ব ২


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!