Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • নভেম্বর ১৫, ২০২৪

আমার বাবা । পর্ব ৪

সবে ফুলছিল লাল টকটকে নাকের ফুলকি৷ চোখের কোলে হড়হড় করছে যখন ঘনবর্ষা, তখন কোন আক্কেলে থামালে আমায় ? দর্শক তো মজবে এমনধারা কান্নায় ! বন্দুকের গুলির মতো চিৎকার করে ঘাড় মটকে দিলে এমন দৃশ্যের !  গর্জন থামিয়ে ফিক করে হাসলেন নাটককার নির্দেশক — ভেতর ডুবল না শোকে ! কান্না কেবল চোখে

ময়ূরী মিত্র
আমার বাবা । পর্ব ৪

পর্ব ৪

 

গুড়ুম৷ কঁকিয়ে উঠলাম৷
— কান্না কেন থামালে আমার ?  কেন থামালে আমার কান্না ? বলো৷তোমায় বলতেই হবে৷ সবে ফুলছিল লাল টকটকে নাকের ফুলকি৷ চোখের কোলে হড়হড় করছে যখন ঘনবর্ষা, তখন কোন আক্কেলে থামালে আমায় ? দর্শক তো মজবে এমনধারা কান্নায় ! বন্দুকের গুলির মতো চিৎকার করে ঘাড় মটকে দিলে এমন দৃশ্যের !

গর্জন থামিয়ে ফিক করে হাসলেন নাটককার নির্দেশক — ভেতর ডুবল না শোকে ! কান্না কেবল চোখে !

আমি খিঁচিয়ে — বেদনায় কান্না আসবে না তো কী আসবে চোখে ?

মৃদু হেসে বাবা বললেন — কেন ! খরাও তো বইতে পারে ! বচনে বিশুষ্ক ভাব ফুটিয়ে দ্যাখ একবার৷একবার দ্যাখ৷ আগে নিজে মাত৷এখন তো দেখি দর্শকেই মেতে উঠছিস তুই৷ First you Enjoy Your character.

চরিত্রের দ্রব ও দ্রবণের হিসেব বোঝার সেই শুরু আমার৷ মনোজ মিত্রের সঙ্গে সেটা ছিল আমার প্রথম নাটক৷ ছায়ার প্রাসাদ এবং বকুনি শুনে গুলিবিদ্ধ হওয়া৷সে নাটকে বাবা দ্বৈপায়ন৷আমি শূদ্র মেয়ে হংসী৷দ্বৈপায়ন ! অকিঞ্চিতকর অ-পুরুষ এক শ্মশানঠাকুর৷ হৃদয়ের গহীন ডাকে শ্মশান থেকে জিনিষ কুড়িয়ে সংসার গড়ত সে৷ ঘটিবাটি, গাইবাছুর, সদ্যভূমিষ্ঠ মানবশিশু কী না জুটিয়ে ছিল সে৷এহেন দ্বৈপায়নের পালিত গাই ভোলানাথ৷ রাজার কাছে শিশু ভোলানাথকে রেখে গিয়েছিল সে৷রাজার নির্দেশেই মারা পড়ল ভোলা৷

দৃশ্যটি ছিল এইরকম— অনেকদিন পরে হংসীর হাতে তার ভোলার গা ছাড়ানো শুকনো ছালটা দেখে ফেলেছে দ্বৈপায়ন৷ ঝটিতে ছালটাকে কাছে টেনে নেয়৷ ছোঁয়ামাত্তর, ওমা ! ভোলার পিতার শীর্ণ আঙুল যে শিউরে ওঠে মাগো৷ আমার পিতার চোখে তখন জাগছে চতুর্দশীর নিঝুম শ্মশানে তাঁর ভোলানাথকে কুড়িয়ে পাওয়া— সে রাতে সে সজীব প্রাণটির নড়াচড়া, চালকলার পুটলিতে ক্ষুধার্ত বাছুরটির মুখ গোঁজা৷ তার শ্বাসপ্রশ্বাস৷গোটা নাটকে দ্বৈপায়নের সঙ্গে হংসীর একবারই দেখা৷তাও একটুক্ষণ৷বুকের কাছে সন্তানসম বাছুরের চামড়াখানা হাঁকড়ে ধরে বেরিয়ে যাচ্ছেন অভিনেতা মনোজ৷বড়ো অগোছালো পায়ে চলে যাচ্ছেন পিতা৷ কাঁদতে কাঁদতে হংসী বলছে— চিনতে পারলে ? শুধু হাতখানা বুলিয়ে একবার ? জ্যান্ত জীবের পরশ না হয় তোমার বড়ো চেনা৷ আজ ধুলোমাখা একখণ্ড চামড়ায় তুমি সে প্রাণের উত্তাপ প্রাণের স্পর্শ কী করে পেয়ে যাও ? ওগো ও শ্মশানঠাকুর ?

— সে কী কান্না পাচ্ছে আমার ! আবার গুলি–  ফের !  কান্নায় তোর বেদনা পচা তরল হয়ে গেল যে ! এতক্ষণ হৃদয়ে জমল কী !

আচার্য ! আমি নতজানু৷পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম৷ অপার বিস্ময় !

১০ 

তখন সুন্দরম নাট্যগোষ্ঠীতে নিয়মিত অভিনয় করি আর মনোজ মিত্রের কাছে মঞ্চ ও জীবনকে মেলাবার অভ্যেস করে চলি৷ মেলানোটা কখনো আমার আঁক কষে -কখনো অনুভবে৷বলাবাহুল্য দ্বিতীয়টি বেশি জোরদার৷ একদিন বাবা বললেন, মঞ্চে কুৎসিতকেও সুন্দর লাগিয়ে প্রকাশ করতে হয়৷ প্রশ্ন করার জন্য মুখিয়ে থাকতাম৷ বললাম–সুন্দর লাগিয়ে মানে ?

 

উত্তর –Touch touch only touch – not রূপসাগরে ডুবু ডুবু ৷

সংশয় বলল– দার্শনিক নাট্যকার মেলা ভার৷ ছাড়িস নে৷প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে মার৷

জিজ্ঞেস করলাম ফের — জীবনে কি কুৎসিত সুন্দর হয় ? কালোয় আলোর আভাস কোনোদিন আসে ? যতসব হিজিবিজি বলে আমার পার্ট গুলিয়ে দেওয়া !

বড় তীব্র উত্তর এল, সেটা নিজে দেখে নিজেকেই বুঝতে হবে৷ সুযোগ পেলে নিকষ আঁধার রাত খুঁজে নিয়ে তার তলায় বসে যেও৷

অমাবস্যায় আমার আকর্ষণ বাড়ল৷ আকর্ষণ মোহ হল, বীরভূমে কল শো করতে গিয়ে৷যাঁরা আমাদের নাটক করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা খুব একটা সচ্ছল নন৷ তা বলে অন্তরের অভাব ছিল না উদ্যোক্তাদের৷ দুপুরবেলা রাঙা ভাতে পুকুর কেটে ডাল ঢালছি, দেখলাম এক পায়ে ব্যান্ডেজ করে একটা মানুষ দাওয়ায় এসে বসলেন৷আমাকে সংকুচিত হতে দেখে হেসে ফেললেন হো হো করে— অমন করে কী দেখো দিদি ? আমার কুঠ ( কুষ্ঠ ) হয়নি৷ পায়ের পাতার তলায় ফোঁড়া হয়েছে৷ শালার ফোঁড়া আর হওয়ার জায়গা পেল না গো ! এমনিতে ব্যাথা নেই– হাঁটতে গেলেই লাল মাটিতে সাদা পুঁজ লাগে৷ তাই ব্যান্ডেজ লাগিয়ে রেখেছি৷

অবাক হলাম৷মানুষটা নিজের ঘায়ে মাটি লাগা নিয়ে ভাবছে না তো ! ওর যত চিন্তা, লাল মাটিতে ফোঁড়ার রস লাগা নিয়ে৷
এতটা শোনার পরও হয়ত আমার চোখে অবিশ্বাস দেখেছিল৷ তাই চলে গিয়েছিল৷ তার আগে অবশ্য ঠেস মেরে বলে গিয়েছিল– বড্ড ভীতু ! এখন নাটক করে নাও৷ রাতে মনসা থানে নিয়ে যাব৷

মনসাকে ঘিরে প্রচুর জুঁই গাছ৷একটার সঙ্গে অপরটা জড়ানো৷ অমাবস্যার আকাশে যেমন কালোর মধ্যে একটি  তারাও নেই, দেবীর মন্দিরে ঠিক তেমনি সাদার মাঝে একটি কালো গুঁড়ি নেই৷ বিধাতা নির্ভুল হিসেবে জগতের সেরা দুটি রঙকে চিরজীবনের মতো আটকে দেবার জন্য এই আলোহীন রজনীকে যেন নববধূ করে সাজিয়ে নিয়েছেন

নাটক শেষে রাত চুপচাপ৷ সহঅভিনেতারা এদিক ওদিক বসে গল্প করছেন৷ ভোর রাতে কলকাতা রওনা দেব৷
— চলো !
চমকে উঠলাম৷
— কী গো চলো৷ কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি৷ এত্ত এত্ত খেতে লেগেছ তুমি ! আমি যে থানে নিয়ে যাব বলেছিলাম, ভুলেই গেছ৷

ব্যান্ডেজ বাঁধা পা ঘষটে আমায় নিয়ে চলল মনসার বাড়ি৷
— কেন তোমাকে দেখাতে নিয়ে এলাম জান দিদি ? আজ অমাবস্যা৷ মনসা থানে আজ হাজার জুঁই মোম জ্বালে৷ কত সুন্দর লাগছে দেখো চারদিকে৷

দেখলাম, মনসাকে ঘিরে প্রচুর জুঁই গাছ৷একটার সঙ্গে অপরটা জড়ানো৷ অমাবস্যার আকাশে যেমন কালোর মধ্যে একটি  তারাও নেই, দেবীর মন্দিরে ঠিক তেমনি সাদার মাঝে একটি কালো গুঁড়ি নেই৷ বিধাতা নির্ভুল হিসেবে জগতের সেরা দুটি রঙকে চিরজীবনের মতো আটকে দেবার জন্য এই আলোহীন রজনীকে যেন নববধূ করে সাজিয়ে নিয়েছেন৷

জখম পায়ে এতটা হেঁটে এসে মানুষটা হাঁফাচ্ছিল৷খাঁটি মানুষের জোরাল হাঁফ জুঁইদের দুলিয়ে দিল৷আমার মনে হল -জুঁই গাছরা একটি মাটির নৌকো করে বহুদূর পাড়ি দিয়ে শুধু আজকের রাতটার জন্য আমার কাছে এসেছে৷ আর আমার নতুন বন্ধুটা মাপছিল গো মাপছিল, তার চেষ্টায় সর্বোচ্চ কত তৃপ্তি পেতে পারি আমি !

ব্যান্ডেজ টাইট করে বাঁধছিল মানুষটা৷
বাধা দিলাম৷
— হালকা করে বাঁধো৷ বাতাস,ফুলের গন্ধ, তোমার ঘায়ে আরাম দেবে৷

আলো নেই৷
ধরণীর বাকিটুকু তো আছে৷

অচেনা যুবতী নিয়ে রাত চরতে বেরিয়েছ৷
নিজেকেও অচেনা করে রেখো !

পরপর ডায়লগ বানাচ্ছিলাম আমি৷

·•··•··•· ·•··•··•·

ক্রমশ…

দ্বিতায় পর্ব পড়ুন: আমার বাবা

আমার বাবা । পর্ব ৩


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!