- দে । শ পুঁথিঘর
- মে ১৫, ২০২৪
বাংলা প্রকাশনার পথিকৃৎ গঙ্গাকিশোরের স্মৃতিরক্ষার উদ্যোগ

ক্ষীণতোয়া সাইনির দুই পাড়ে আগাছার ভিড়। তার মাঝে মাথা তুলেছে বট-পাকুড়ের মত মহীরুহও। ভাল করে নজর করলে দেখা মেলে একটা ভাঙাচোরা নির্মাণ নিঃশেষিত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। ওই খণ্ডহর নির্মাণের সুড়কি আর জড়ামড়ি শেকড়-বাকড়ে আটকে রয়েছে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য নামে এক বিরল ব্যক্তিত্বের স্মৃতি-সত্তা। পূর্বস্থলীর পিলা পঞ্চায়েতের সাইনি নদী লাগোয়া বহড়া গ্রামে আনুমানিক ১৮৭২ সালে জন্মে দেশের প্রকাশনা জগতের পথিকৃৎ হয়েছিলেন গঙ্গাকিশোর।
তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি প্রকাশক, পুস্তক ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক। রাজা রামমোহন রায়ের সমসাময়িক। সংবাদপত্র প্রকাশনার জন্য গঙ্গাকিশোর হুগলী জেলার শ্রীরামপুরের কাছে থাকতে শুরু করেন। সেখানেই খ্রিস্টান পাদ্রীদের পরিচালিত ছাপাখানায় তিনি কাজ শেখেন। কিছুদিন পরে তিনি কলকাতায় গিয়ে স্বাধীনভাবে বই প্রকাশনায় নিযুক্ত হন। গঙ্গাকিশোর বাংলা বই ছাপিয়ে বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। তার সম্পাদিত প্রথম বাংলা বইয়ের নামে ‘অন্নদামঙ্গল’। এটি ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে মুদ্রিত হয়েছিল। তিনি নিজের কাজের সুবিধার জন্য একটি মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করেন। এটি ‘বাঙ্গাল গেজেট প্রেস’ নামে পরিচিত ছিল। বহু প্রসিদ্ধ গ্রন্থকারের বই এই যন্ত্রালয় থেকে মুদ্রিত হত। এছাড়া তিনি বাংলা ভাষায় একটি ইংরেজি ব্যাকরণ, ব্যাখ্যা ও টীকাসহ মূল ভগবদ্গীতা, চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে কয়েকটি বই প্রকাশ করেন। এখান থেকেই প্রকাশিত হয় এ গ্রামার ইন ইংলিশ অ্যান্ড বেঙ্গলি, দায়ভাগ, দ্রব্যগুণ, গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিনী, চিকিৎসার্ণব, বেতাল পঞ্চবিংশতির মত সেকালের সাড়াজাগানো গ্রন্থাবলি।
গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘বাঙ্গাল গেজেট’ বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা বলে ধরা হয় । পত্রিকাটি ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই মে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এই কাজে হরচন্দ্র রায় নামে আর এক বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি তাঁর সহযোগী ছিলেন। যদিও ‘বাঙ্গালা গেজেট’ পত্রিকাটি বেশিদিন চলেনি। পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেলে গঙ্গাকিশোর তার মুদ্রণযন্ত্রটি নিজের গ্রাম বহড়ায় নিয়ে আসেন। এখান থেকে ছাপা হত বলে জায়গাটি আজও ‘ছাপাখানাডাঙা’ নামে খ্যাত। তাঁর মৃত্যুর পরেও ছাপাখানাটি ছিল। বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির বই এখান থেকে ছাপা হয়েছিল।
ফি-বছরের মত এবারও গঙ্গাকিশোরের ভিটেয় শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের আয়োজন করল গঙ্গাকিশোর স্মৃতিরক্ষা কমিটি ও কালনা মহকুমা প্রেস ক্লাব। আয়োজকদের তরফে দ্বারকানাথ দাস, দীপঙ্কর চক্রবর্তীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এখানে গঙ্গাকিশোরের নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়েছে। স্থানীয় বিধায়ক তপন চ্যাটার্জি তাঁর বিধায়ক তহবিলের টাকায় এখানে গঙ্গাকিশোরের স্মৃতিতে একটি সংগ্রহশালা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এলাকায় গঙ্গাকিশোরের যেটুকু স্মৃতি অবশিষ্ট রয়েছে, তার সংস্কার করা হবে। এলাকার বাসিন্দা বিশিষ্ট কবি পুলক মণ্ডল গঙ্গাকিশোরকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। সেই গবেষণার ফসল ‘উপেক্ষিত নায়ক গঙ্গাকিশোর’ গ্রন্থটি ইতিমধ্যেই পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছে। অবশ্য গঙ্গাকিশোরকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার কৃতিত্ব বর্ধমান শহরের বাসিন্দা প্রয়াত সাংবাদিক সদানন্দ দাসের। মূলত তাঁরই উদ্যোগে বর্ধমান শহরের প্রেস কর্ণারটি গঙ্গাকিশোরের নামে আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়া কাটোয়ার বাসিন্দা প্রয়াত প্রাক্তন পুরপ্রধান শশাঙ্কশেখর চট্টোপাধ্যায় ও প্রবীণ সাংবাদিক দীপ্তিকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় গঙ্গাকিশোরকে প্রচারের আলোয় আনতে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করতেন। ১৯৯২ সালে দীপ্তিবাবুর সম্পাদনায় গঙ্গাকিশোরকে নিয়ে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। কাটোয়ার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির উদ্যোগে ২০১৬ সালে কাটোয়া বাসস্ট্যান্ডটি ‘গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য’ নামাঙ্কিত হয়।
❤ Support Us