Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ প্রচ্ছদ রচনা
  • নভেম্বর ১৩, ২০২২

তিনি সবাইকে নিয়ে চলায় বিশ্বাসী ছিলেন। ভাষিক সঙ্কীর্ণতা, ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা তাঁকে স্পর্শ করেনি।

সঞ্জীব দেবলস্কর

আজ থেকে পুরো চার দশক আগে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শীতের রবিবারগুলো কাটাতাম জাজেস ফিল্ডে একটি ঘরের সামনে বিস্তৃত মাঠে। ঘরটিকে তখন অনেকে অনেক নামে ডাকতেন। কেউ কেউ বলতেন ভুতের ঘরও। না, ওখানে ভূত প্রেতের কোনও আনাগোনা ছিল না। ঘরের ভিতর একটা কাপড়ের ব্যানারে লিখা ছিল ‘অসম ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্রাফট’। ঘরে থাকত ডাঁই করা কিছু পেইন্টিং, এখানে ওখানে মাটি, ব্রঞ্জ, প্লাস্টার অব প্যারিসের এবং কিছু কাঠের তৈরি অসম্পূর্ণ মূর্তি।

একদঙ্গল ক্ষুদে শিল্পী আসত আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে। ওদের মা বাবারা মাঠে রোদ পোহাতেন। এ আসরের মধ্যমণি যিনি এ ব্যক্তিটিকে দেখা যেত মাঝে মাঝে এদের সঙ্গে খুনসুটি করছেন, আঁকা ছবিগুলো দেখতেন, নয়ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওখানে হাজির হতেন উদীয়মান লেখক, শিল্পী, কিংবা নাটক-সিনেমা-সংগীত জগতের দিকপালেরা। ভরদুপুর আবধি চলত শিল্পচর্চা, আড্ডা, চা পান আর বিস্তর সিগেরেট পোড়ানো। তারপর ধীরে ধীরে আসর ফাঁকা হতে শুরু করত। সন্ধ্যা ঘনাতে না ঘনাতে যে বসতে হবে দ্বিতীয় আসরে। গৌহাটি তখন নিশ্চিতই মহানগরী, কিন্তু আজকের মতো এত ব্যস্ত নগরী নয়। বাস, ট্যাক্সি, রিকশো সবই চলতো– তবে বেশ ধীরে সুস্থ্ রয়ে সয়ে, ভিড়ভাট্টাও এত ছিল না। সবারই হাতে সময় নষ্ট করবার যথেষ্ট সময়ও ছিল। তা তিনি সফল ডাক্তারই হোন বা ব্যস্ততম ব্যবসায়ী, সরকারি আমলা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা আর কেউ। ছাত্রদের তো কথাই নেই।

বিকেলের দিকে এখান থেকে ছিটকে যাওয়া আড্ডাপিপাসুদের দেখা যেত গৌহাটি ডায়েরির সামনে দাঁড়িয়ে দৈনিক কাগজগুলোতে চোখ বুলাতেও। পানবাজারের নাক-কাটা পুকুরের পাড়ে বই আর পত্রপত্রিকার স্টলে চিনা সাহিত্য, অনূদিত রুশ উপন্যাস, নতুন অসমিয়া আর বাংলা বই। স্টলে দেখা যেত দু’পাতার কবিতাপত্রিকা ‘পান্থপাদপ’, এতে হীরেন ভট্টর কবিতা এককলি ছাপা হলে সন্ধ্যের মাঝেই সব বিক্রী। এখানে ছিল অখিল দত্তর গল্পপত্রিকা, প্রগতিবাদী পত্রিকা ‘নতুন দিগন্ত’ আর অসমিয়া, বাংলা ম্যাগাজিনের অঢেল যোগান। অমিত নাগকে দেখা যেত একগুচ্ছ কাগজ নিয়ে চায়ের কাপ সামনে বুঁদ হয়ে বসে আছেন গৌহাটি ডায়েরিতে, হাই-পাওয়ারের চশমা চোখে হীরেন গোঁহাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়েই চলেছেন নতুন কোন ম্যাগাজিনের দীর্ঘ প্রবন্ধ, ‘চিত্র বীক্ষণ’, ‘ইপিডবলিউ’, কিংবা ‘এক্ষণ’, ‘পরিচয়’ নয়ত অসমিয়া সিরিয়াস ম্যাগাজিন, ‘নতুন দিগন্ত’। ওয়েস্টার্ন বুক ডিপো, বুক ল্যান্ড বা লয়ার্স বুকস্টল থেকে সদ্য কেনা প্যাপারব্যাক বা অসমিয়া কবিতা কিংবা বাংলা প্রবন্ধগ্রন্থ কিনে বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল কলেজ কিংবা কটনের তুখুড় ছাত্ররা বসে পড়েছেন মধুমিতা রেস্তোরা বা পিকাডেলি, মিষ্টিমুখ, ফিস ফ্রাই, নয়ত একটু এগিয়ে গিয়ে ফাঁসি বাজারে ‘রবিন ক্যাবিনে’ প্লেট ভরা কবরেজি কাটলেট চিবোতে। ওই ক্যাবিনের বিশেষ আকর্ষণ ছিল গোটা গোটা অক্ষরে লেখা একখানা নির্দেশ, ‘আপনার খোয়া বস্তু পাবলৈ আধা ঘন্টা মান সময় লাগিব’। এই তো চাই। এ বাক্যটির মধ্যে যে এখানে জমিয়ে আড্ডা দেবার অঢেল প্রশ্রয়। এই ছিল সত্তরের গৌহাটি।

রামকিঙ্ককর বেইজ একবার কলাভবনের ছাত্রদের নাটকের রিহার্সেল করাচ্ছিলেন। নীলদা অভিনয়ে ঠিক জুৎ করে উঠতে পারছিলেন না, ‘রেগে মেগে কিংকরদা বললেন, তোমাকে মেরে তোমার মূর্তি বানিয়ে আসাম পাঠিয়ে দেব, কেউ বুঝতে পারবে না এতে প্রাণ আছে কি নেই’। প্রখর রোদের দুপুরে গৌহাটির পথে হাঁটতে হাঁটতে নীলদা বলতেন কিংকরদার মতো এ রকম সময় উচ্চস্বরে রবীন্দ্রসংগীত গাইলে শরীরে গরম লাগবে না।

সেই জাজেস ফিল্ড বা জজ পাথারের চারদিকে কোনও বেড়া বা দেওয়াল ছিল না, একদিকে সারি সারি বিশাল বৃক্ষ, সন্ধ্যাবেলা এর মাথায় ঝিকিমিকি করত তারারা, ডালের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখা দিলে সৌখিন ফটোগ্রাফাররা মাঠের কোণায় নানা ভঙ্গিতে বসে, দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। ভূতের ঘরিটিতে ছিল না ইলেকট্রিকের আলো, হারিকেন এবং মোমবাতিই সম্বল। ছবি আঁকার প্রয়োজনে কুপি জ্বালিয়েও ব্যস্ততম এক শিল্পীকে কাজ চালাতে দেখা যেত। ইনি হলেন রাজেশ্বর শর্মা। দিনের বেলা কাজ করতেন মিউজিয়ামে, আর রাত্রিবেলা এখানে শয়ন, সাধনা, ভোজন সব কিছু। ফাঁক পেলেই রঙ তুলি নিয়ে তন্ময় হয়ে হারিয়ে যেতেন নিজের কাজে। ওদিকে মাঠের উপর দিয়ে যারা আনাগোনা করত এদের দিকেও চোখ রাখতেন। সে রকম মনে হলে ডেকে এনে বসিয়ে দিতেন। তখন গৌহাটি মহানগরীতে মাঠের উপর দিয়ে হেলতে দুলতে বা আকাশ দেখতে দেখতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা খুব কম ছিল না। কোনও ভনিতা ছাড়াই কতজনকে এরা এ আড্ডাতে বসিয়েছেন এর সংখ্যা নেই। এদের বয়স চল্লিশ বা তার উর্দ্ধে তো হবেই, কিন্তু কুড়ি পঁচিশ ত্রিশ বছরের ছেলেছোকরাকে এরা অনায়াসে বন্ধু বানিয়ে ফেলতেন। জাজেস ফিল্ডের সন্ধ্যার আড্ডায় অবশ্য বয়সের কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। কে না আসতেন এখানে? নীলমণি ফুকন, পদুম বরুয়া, পুলক গগৈ, ননী বড়পুজারী, শিলং থেকে হঠাৎ হাজির হওয়া ময়নুল হক্ বড়ভুঁইঞা, তরুণ শিল্পী সমীরণ দাস, নব চৌধুরী, ছবি করার স্বপ্নে বিভোর হেমন্ত দাস, ‘কিন্নর কণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদক গুণেশ্বর দত্ত, গল্পকার কুমার অজিত দত্ত আরো কত কেউ।

দীঘলিপুকুরিতে দাঁড়াতো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস। ছাত্রদের আনাগোনা ছিল মুক্ত মাঠের উপর দিয়ে এ আড্ডার গা ঘেঁষে। বলা হয়নি, বাইরে চেয়ার বা মুড়াতে বসে থাকতেন যে ব্যক্তিটি তাঁর পরনে পাজামা পাঞ্জাবি, থুতনিতে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, আর দুই ঠোঁটের ফাঁকে একটুকরো চারমিনার। সব সময় এ থেকে ধোঁয়া না উঠলেও কোন ব্যাপার নেই, যা ব্যাপার তা হল, সিগেরেটের প্যাকেটটি শেষ হয়ে গেলেই শিল্পীর কাজ শুরু। নিপুণ হাতে প্যাকেটটি ছিঁড়ে উলটো দিকে পেন্সিল দিয়ে কী সব আঁকিবুকি করে অতি সযত্নে পকেটে চালান দিয়ে নতুন প্যাকেট ভাঙতেন। সামনে যাকে পেতেন তাকেই বিলোতেন ভেতরের জিনিসগুলো। এগুলো পুড়ে গেলেই তো কাগজের গায়ে জন্ম নেবে নতুন নতুন ফিগার। আমরা কিছু বললে মৃদু স্বরে শুনিয়ে দিতেন এক কলি রবীন্দ্রসংগীত, ‘আমার এ ধূপ না জ্বালালে গন্ধকিছুই নাহি ঢালে…।‘ লোকটি আর কেউ নন, আসামের প্রবাদপ্রতীম চিত্রকর নীলপবন বরুয়া। তিনিই এ আসরে ডেকে নিয়েছিলেন খ্যাপাটে স্বভাবের কবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্কলার বাহারউদ্দিনকে, ইতস্তত বিচরণশীল আমাকেও এক হেমন্তের সন্ধ্যায় এ ব্যক্তটি ডেকে নিয়ে বসিয়ে দিলেন। এ আসরে যেত কটনের ছাত্র, এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া নেপালি বন্ধু কপিলমণি রাই, যেতো কটনের মেধাবী ছাত্র চন্দন হাজারিকা, শিলচরে ওর বাবা ছিলেন ডেপুটি কমিশনার, গৌহাটিতে গিয়ে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব, তাঁর নেশা ছবি আঁকা। তো জাজেস ফিল্ডে গিয়ে বিশেষ কোনও কিছু বলার প্রয়োজন নেই, কিছু করারও প্রয়োজন নেই। বুঝতে পারলাম এখানে আসতে হলে কিছু হবারই প্রয়োজন নেই, শিল্পী না হলেও চলে। আসাটাই চাই। এখানে ভূপেন হাজারিকার গান, বিহুর সুর, জীবনানন্দের কবিতা, ভাওনা, ভ্রাম্যমাণ নাটক নিয়ে চর্চা, নতুন ধারার সিনেমা, কলকাতায় আয়োজিত রঁদ্যার ভাস্কর্য প্রদর্শনী, রবীন্দ্রসংগীত, আর ছবি তো আছেই– এসব নিয়ে সবাই মশগুল।

নীলদা শান্তিনিকেতনের ছাত্র। রবীন্দ্র প্রসঙ্গ উঠলে তিনি কত কথাই বলতেন এক নাগাড়ে। কবিগুরুর গান তো তাঁর নিত্য সঙ্গী। মাঝে মাঝে রামকিঙ্ককর বেইজের খ্যাপামো নিয়ে গল্প বলতেন। একবার নাকি কলাভবনের ছাত্রদের নাটকের রিহার্সেল করাচ্ছিলেন। নীলদা অভিনয়ে ঠিক জুৎ করে উঠতে পারছিলেন না, ‘রেগে মেগে কিংকরদা বললেন, তোমাকে মেরে তোমার মূর্তি বানিয়ে আসাম পাঠিয়ে দেব, কেউ বুঝতে পারবে না এতে প্রাণ আছে কি নেই’। প্রখর রোদের দুপুরে গৌহাটির পথে হাঁটতে হাঁটতে নীলদা বলতেন কিংকরদার মতো এ রকম সময় উচ্চস্বরে রবীন্দ্রসংগীত গাইলে শরীরে গরম লাগবে না। ইঙ্গিত বুঝে আমি বললাম গৌহাটি ক্লাবের সামনে এসব করলে লোকে পাগল বলবে। অনেক দিন পর সমরেশ বসু রামকিঙ্কর বেইজের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস লিখছিলেন দেশ পত্রিকায়, ‘দেখি নাই ফিরে’। এটা যখন ধারাবাহিক ভাবে বেরোচ্ছিল মিলিয়ে দেখেছি এর অনেক কিছু নীলপবন বরুয়ার মুখে আগে শোনা একেবারে ডিটেলস সহ। তো, প্রকাশ্য রাজপথেই রামকিঙ্কর বেইজের কথা বলতে বলতে নিজেই গেয়ে উঠলেন ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। ভাগ্যিস মৃদুস্বরে। তবে আরেকদিন নৌকাচড়ে ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে উমানন্দ পৌঁছেই নীলদা গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলেন, ‘আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে’। সঙ্গে তাঁর আরও কয়েকজন সাঙ্গাৎও ছিল। একজন পকেট থেকে নোটবই বের করে সদ্য লেখা কবিতা পাঠ করা শুরু করল, আরেকজন মন্দিরের পেছনে ভিড় করে বসা কয়েকজন তান্ত্রিক টাইপের মানুষের সঙ্গে বসে পড়ল। ফিরে আসার সময় নীলদা ফিস ফিস করে বললেন—‘ওর সঙ্গে বেশি কথা বলবি না, আমার কাছে সরে বস। ছোকরাটা মহাদেবের প্রসাদ পেয়েও আসতে পারে’।

উমানন্দর পাথরে বসে নীলদা সিগেরেটের প্যাকেটের উপর কিছু স্কেচ করে নিলেন, বাকিরাও পেনসিল দিকে প্রচুর স্কেচ করল। আমি আকাশে চিলের উড়াউড়ি দেখলাম, কীর্তিনাশার দিকে উড়ে যাওয়া গাঙশালিখের খেলা দেখলাম। ব্রহ্মপুত্রের সৌন্দর্য কী ভাবে উপভোগ করতে হয় এটা নীলদা বুঝিয়ে দিলেন। তিনি হঠাৎ শিশুর মতো গান গাইতে শুরু করলে আমরাও গলা মেলালাম। সবই রবীন্দ্রসংগীত। তাঁর গায়কী সেই শান্তিদেব ঘোষের মতোই। আর তাঁর স্মৃতিতে অসংখ্য গান, একেবারের অন্তরা সঞ্চারী সহ। একটি শব্দেরও এদিক ওদিক নেই। শান্তিনিকেতন তাঁর মর্মের ভিতর ঢুকে গিয়েছিল। আরেক জ্যোৎস্না রাতে নীলদা আকাশের দিকে তাকিয়ে আচমকা বলে উঠলেন ‘পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পাড়ের দেশ মনে হয়’। জীবনান্দ দাশের কবিতার ভক্ত ছিলেন ছিলেন নীলপবন বরুয়া।

মজার ব্যাপার হল, এই সদা চঞ্চল মানুষটি আচম্কা কয়েকদিনের জন্য ঘরবন্দি হয়ে যেতেন। ওই সময় নিয়ে বসতেন দীর্ঘ দিনের সঞ্চিত সেই সিগেরেটের প্যাকেটের উপর করা স্কেচগুলো। বাড়িতে ব্যক্তিগত স্টুডিওতে বসে এখন ছবি আঁকছেন নীলদা। বাইরে কোনও প্রদর্শনীতে যাবে ছবিগুলো। গৌহাটির বাইরে প্রদর্শিত এসব ছবি থেকে কিঞ্চিৎ বাণিজ্য হয়ে গেলে নীলদার আবার সেই বাউন্ডুলে জীবন। দিন কতক রেস্তোঁরায় খেয়ে, নিজের জন্য, অন্যদের জন্য সৌখিন পাঞ্জাবি কিনে, একে ওকে ডেকে খাইয়ে তাঁর দিন পূর্ববৎ।
এ হেন ব্যক্তির মনের ভিতর কোন বিষাদের ছায়া দেখিনি। ঘরে তাঁর শয্যাশায়ী সহধর্মিনী। এ নিয়ে কোনও আক্ষেপ বা দুঃখবোধ তাঁর ছিল না। কী মায়াবী হাতে তাঁর সব কিছু করে দিয়ে, নিপুণ হাতে প্রসাধন করে দিয়ে একজন সহায়িকাকে বসিয়ে তিনি বাইরে যেতেন, আবার বাড়িতে ফিরেই তাঁর কাছে বসে থাকতেন হাসি মুখে। আসামের প্রবাদপ্রতিম স্বর্ণকণ্ঠী গায়িকা দীপালি বড়ঠাকুর দিনমান নির্বাক শুয়ে থাকেন, মাঝে মাঝে হুইল চেয়ারে এঘর থেকে ওঘরে বিচরণ। আমরা ওদের সংসারে হানা দিলে বিছানায় শুয়ে শুয়েই তাঁর সহধর্মিনী ব্যস্ত হয়ে যেতেন কী ভাবে আপ্যায়ন করা হবে। শিল্প সংগীতের জগতে দুই দিকপাল যে কী কঠিন জীবনযুদ্ধে রয়েছেন কে বিশ্বাস করবে? নীলপবনদা এরই মধ্যে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলো করে চলেছেন। নীরবে দীপালিদিদি রয়েছেন অনুপ্রেরণা হিসেবে। দীপালিদির মৃত্যুর পর তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলে একটি কথাই বললেন, ‘দীপালি তো চলে গেছে’। বুঝতে পারিনি এরপর থেকে তিনি ধীরে ধীরে বোধশক্তি হারা হচ্ছেন। অতিমারির প্রথম ধাক্কা আসার প্রাক্মুহূর্তে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখি সবই আছে, কিন্তু তিনি কিছুতেই যেন কিছুতে আর নেই। অনেক চেষ্টা করে আমাকে চিনতে পেরেছেন। এ বিভ্রমের ফলে যেন বেশ কিছুক্ষণ বিষাদগ্রস্ত হয়ে রইলেন। আমার পুত্র শাশ্বত, তাঁর মাসতুতো দাদা শ্রীমান রাজর্ষি চৌধুরী এবং নাতনি রায়না ঘরের ভিতর গিয়ে ছবি, ফটোগ্রাফগুলো দেখল। উচ্চ সরকারি আধিকারিক রাজর্ষি অনুমতি নিয়ে কিছু ছবি তুলল। এত বড় মাপের মানুষটি এখন কেমন রয়েছেন দেখে ওরা খুব দুঃখিত। আমি পাশে বসে রইলাম নীরবে। বেলতলার সৌরভনগরে কী চমৎকার বাড়ি সাজিয়েছিলেন মানুষটি। গাছ লতাপাতায় ঘেরা প্রতিটি কোণায় শৈল্পিক স্পর্শ। এ বাড়িতে বসেই ট্র্যাডিশনেল মুখশ বানিয়েছিলেন তিনি, একই দিনে এক হাজার স্কেচও করেছিলেন কবে যেন তিনি মনে করতে পারছেন না।

ডানদিকে কাঠের তক্তা দিয়ে উঁচু একটা স্টুডিও। সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাওয়া যায়। স্বপ্নের ওই বাড়িটিতে তিনি একটা গেস্ট রুমও পরিকল্পনা করেছিলেন, যেখানে শিল্পীরা এসে থাকবেন। তাঁকে এ নির্জন পুরীতে শুধুমাত্র একজন সহায়িকার তত্ত্বাবধানে বাস করছেন দেখে বেশ মনটা খারাপ হয়ে গেল। শিলচর এসে এখানে ওখানে কয়েকটি চিঠি, মেল করে এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলাম। তেমন কোনও সাড়াও পাইনি। জানতাম তার মৃত্যুর পরই এসব হবে, তাঁর শিল্পকর্ম সংরক্ষণের দাবিও উঠবে। জীবিতাবস্থায় এ ব্যক্তি চলতি হাওয়ার পন্থী ছিলেন না। তিনি সবাইকে নিয়ে চলায় বিশ্বাসী ছিলেন। ভাষিক সঙ্কীর্ণতা, ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা তাঁকে স্পর্শ করেনি। নেতামন্ত্রীকে খোসামোদ করা তাঁর ধাতে ছিল না। তবু ভালো, কিঞ্চিৎ দেরিতে হলেও তাঁকে ২০২১ সালে ‘আসাম সৌরভ’ পুরস্কার দেওয়া হয়, কিন্তু তখনই তিনি তো এসবের প্রায় উর্ধ্বেই। মনে আসে অধ্যাপক অমরেশ দত্তের কথা। শতবর্ষজীবী এ খ্যাতিমান ব্যক্তির ভাগ্যেও তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি জুটেনি। তাঁর মতো বিদ্বান ব্যক্তির উপস্থিতিতে তাঁরই শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান (যদি আয়োজিত হত) তো একটি জাতীয় অনুষ্ঠানই হতে পারত। আসামের অবহেলিত মহান শিল্পী নীলপবন বরুয়ার প্রয়াণে এ কথাটি মনে আসে আর এ অবহেলা বড় বেদনার মতো বাজে।

রাজ্যের এক বিভ্রান্ত বিপন্ন সময়েই শান্তি, সম্প্রীতি এবং ভ্রাতৃত্বের আহ্বান জানিয়ে শিলচরে আত্মপ্রকাশ করেছিল প্রগতিশীল লেখক-শিল্পী-কলাকুশলী সংস্থা, ‘দিশারী’ যে সংস্থা আয়োজিত বার্ষিক ‘মৈত্রী উৎসব’ বরাকের চৌহদ্দি পেরিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এ উৎসবের আহ্বান পেয়ে নীলপবন বরুয়া ১৯৮৯ সালে এসেছিলেন শিলচর। তিন তিনটি দিন শহরের এদিক ওদিক ঘুরে রাস্তাঘাটের দুরবস্থা দেখে নিতান্তই বিমর্ষ হয়েছিলেন নীলদা। গভীর শ্রদ্ধাভরে বরাকের তীরে দাঁড়িয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত, পরিচিত শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনীর খবর পেয়ে শিশুর মতো ছুটে গেলেন মুকুন্দ দেবনাথের বাড়িতে। ইচ্ছে প্রকাশ করেন ঐতিহাসিক রাজমোহন নাথের বাড়িতে যাবার। কিন্তু ওদের কেউ আর নেই ওখানে। জেলা গ্রন্থাগারে ঢূঁ মেরে বেশ উষ্মা প্রকাশ করলেন, ‘এখানে আরও ভালো সংগ্রহ আশা করেছিলাম’। রিডিং রুমের দেওয়ালে বীরেন্দ্রলাল ভৌমিকের আঁকা রবীন্দ্র প্রতিকৃতির উপর ধূলার আস্তরণ, জলের ফোঁটা দেখে খুব রেগে গেলেন। লাইব্রেরিয়ানের ঘরে গিয়ে দেখতে পেলেন আরেকটি ছবির অনুরূপ অবস্থা। তিনি অক্ষরিক অর্থেই বিমূঢ়—‘কিঙ্করদার ছবির এ অযত্ন!’। গ্রান্থাগারিককে বললেন এ ছবিটি নামিয়ে দিন, আমি পরিষ্কার করি’। তাঁর বিনীত প্রস্তাব ছিল, বীরেন্দ্রলাল এবং রামকিঙ্কর এ দুজনের ছবিই তিনি রিপেয়ার করে দেবেন—‘সামান্য তুলির কাজ করলেই আগের জায়গায় চলে আসবে। আমি কিঙ্করদারই ছাত্র’। ছবি দুটো গৌহাটিতে পাঠিয়ে দেবার প্রস্তাবও তিনি রাখেন। এতে কোন পারিশ্রমিকও লাগবে না, তাও জানান। শেষ অবধি অবশ্য ওরা কিছুই করেনি। সরকারি আধিকারিকদের কাছে বীরেন্দ্রলাল ভৌমিক, রামকিঙ্কর বেইজই বা কি আর নীলপবনই বা কে?

মৈত্রী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা সব কিছুতেই আগ্রহ ভরে অংশগ্রহণ করেছেন। বহুভাষিক কবি সম্মেলনে অনন্ত দেবের পরামর্শ মতো তাঁকে সভাপতিত্ব করার প্রস্তাব করা হলে তিনি সঙ্কুচিত—‘আমি সামান্য কিছু ছবি আঁকি, কবি সম্মেলনে কী সূত্রে আমার উপর এ দায়িত্ব’। গৌতমপ্রসাদ যখন বলল অসমিয়া সাহিত্যে ‘ধ্বনিকবি’ বলে খ্যাত বিনন্দচন্দ্র বরুয়ার সুযোগ্য সন্তান হবার সূত্রেই তিনি এ আসরের মধ্যমণি। এসব শুনে তাঁর মুখের সেই ঔজ্জ্বল্য মনে রাখার মতো। অনুষ্ঠানে তিনি তার পিতৃদেবের একখানা কবিতাও পাঠ করে সেদিনে কবিসম্মেলনের মান অনেক উঁচুতে স্থাপন করেন, সেও আজ এক ইতিহাস। উল্লেখ্য ঐ উৎসবে অসমিয়া ছবি ‘নিশি উজাগর’ এর পরিচালক কুলদাকুমার ভট্টাচার্য চলচ্চিত্রশিল্প নিয়ে বক্তৃতা করতে এসেছিলেন, সংগীতের ডালি নিয়ে এসেছিলেন কলকাতার কণ্ঠশিল্পী মণ্টু ঘোষ আর কল্যাণ সেনবরাট। মণ্টুবাবু আর কুলদাবাবু তাঁর পূর্ব পরিচিত। এদের সঙ্গে আসরে বসে আশে পাশের সবাইকে নিয়ে নীলপবনদা তিনটি দিন যথার্থই মৈত্রী উৎসবের বাতাবরণ গড়ে তুলেছিলেন। উৎসব শেষ হলে তাঁকে আরেকদিন বেশি থেকে যাবার অনুরোধ করলে দুই হাত তুলে বলেন, ‘ওদিকে আমার জন্য পথ চেয়ে বসে আছেন আরেকজন, শুধু তোদের কথা বলে এসেছি রে, এখন যেতে দে’। নীলদার মনের ভেতর রয়েছেন সেই স্বর্ণকণ্ঠী গায়িকা, যার কণ্ঠে অনুপম গীতটি আজও শ্রোতাদের উন্মনা করে —‘সোনর খাড়ু নেলাগে মোক বিয়ার বাবে আই, সেনেহে জরি তয় দিয়া মোক হাততে শোভায়।’ সোনার কাঁকনে তাঁর প্রয়োজন নেই, এ হাত যে ধরেছিলেন আসামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর নীলপবন, এ’ই তার শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার।
বরাক উপত্যকার প্রতি নীলপবন বরুয়ার অন্যধরনের ভালোবাসা ছিল। এখানকার শিল্প সাহিত্যের প্রতি তাঁর ছিল গভীর মুগ্ধবোধ। এখানের পত্রপত্রিকা, বই তাঁকে পাঠালে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন।

আমার কনিষ্ট ভ্রাতা, সঞ্জয় দীর্ঘদিন ধরে ‘কাটুম কুটুম’ চর্চা করত। গাছের শিকড় বাকড়, মরা ডাল এসব ওসব কুড়িয়ে নিয়ে এ দিয়ে তৈরি নানা ধরনের ফিগারগুলোকে শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম দিয়েছিলেন ‘কাটুম কুটুম’। তাঁর ইচ্ছে ছিল রাজ্যস্তরে এ শিল্পের একটি প্রদর্শনী হোক্। নীলদার সহযোগিতায় গৌহাটির স্টেট আর্ট গ্যালারিতে জাঁক জমকের সঙ্গেই ১৯৯৩ সালের ৩, ৪ এবং ৫ জুলাই তারিখ তিনদিনের এ প্রদর্শনী শিল্পী মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। সঙ্গে টেনে নিয়েছিলেন আসামের প্রতিথযশা কবি নীলমণি ফুকনকে। বলা বাহুল্য এ প্রদর্শনীর উদ্বোধনী নীলদাই করেছিলেন।

তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আমার বন্ধু গৌতম শর্মা লিখেছেন, ‘নীলপবন বরুয়া কেবলমাত্র একজন প্রতিভাশালী শিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন ত্যাগের প্রতীক একজন সত্যিকারের মানুষ’। একেবারে সঠিক মূল্যায়ন।


  • Tags:
❤ Support Us
গুম গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
ধারাবাহিক: একদিন প্রতিদিন । পর্ব ৫ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
পথ ভুবনের দিনলিপি । পর্ব এক ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
error: Content is protected !!