Advertisement
  • দে । শ
  • অক্টোবর ১৭, ২০২৫

ভোটের নিরিখে এগিয়ে মহিলারাই, তবুও বিহার নির্বাচনে প্রার্থী তালিকায় কমছে নারী প্রতিনিধিত্ব

ইমরাজ হাসান
ভোটের নিরিখে এগিয়ে মহিলারাই, তবুও বিহার নির্বাচনে প্রার্থী তালিকায় কমছে নারী প্রতিনিধিত্ব

নির্বাচনের ময়দানে ‘নারীশক্তি’র জয়গান। অথচ মনোনয়নের তালিকায় নারীদের নাম প্রায় নেই। ২০২৫-এর বিহার বিধানসভা ভোটে আবারো স্পষ্ট হয়ে উঠল পুরুষ-প্রধান রাজনীতির চেহারা। কাগজে-কলমে নারী ক্ষমতায়নের বুলি যতই উঠুক, বাস্তবে তাঁরা এখনো ভোটব্যাঙ্ক, ক্ষমতার শরিক নন। বিহারের নির্বাচনের পরিসংখ্যান বলছে, লোকসভা, বিধানসভা ও পঞ্চায়েত-জেলাপরিষদ নির্বাচনে ক্রমশ বেড়েছে মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা। কিন্তু সাফল্যের হার তলানিতে। ২০১০-এ যেখানে মোট ২১৪ জন নারী প্রার্থী ছিলেন, ২০২০-এ সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৭০। অথচ জয়ী হয়েছেন মাত্র ২৬ জন। ১৫ শতাংশ থেকে কমতে কমতে সাফল্যের হার এসে দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশে।

এবারের নির্বাচনে বিজেপি ও জেডিইউ— দু-দলই ১০১টি করে আসনে লড়ছে। মহিলা প্রার্থী ? মাত্র ১৩ জন করে ! অর্থাৎ, দু-দলের ক্ষেত্রেই শতাংশের হিসাবে প্রায় ১২.৯ শতাংশ। অন্যান্য শরিক দলগুলি, যেমন এলজেপি (রামবিলাস), হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চা বা রাষ্ট্রীয় লোক মঞ্চ, সব মিলিয়ে বিহারে এনডিএ জোটের নারী প্রার্থী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২.৫ শতাংশে। ২০২৩ সালে সংসদে পাস হওয়া ‘নারী সংরক্ষণ বিল’ অনুযায়ী, আগামী নির্বাচনে ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি কার্যকর হবে ২০২৯-এর পর, নতুন সীমানা পুনর্নির্ধারণ হলে। তার আগে রাজ্য রাজনীতিতে কোনো দলই নারীদের উপযুক্ত জায়গা দিতে রাজি নয়, তা ফের প্রমাণ হলো।

যেমন, গোপালগঞ্জ সদরের বিজেপি বিধায়ক কুসুম দেবী টিকিট পাচ্ছেন না— এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন তিনি। তাঁর জায়গায় দলের মনোনয়ন পেয়েছেন সুভাষ সিংহ। ক্ষুব্ধ কুসুমের প্রশ্ন, ‘যে দল ‘নারীশক্তি’র কথা বলে, সে দলই কি এ ভাবে অপমান করে এক মহিলাকে?’ একই ভাবে জেডিইউ কর্মী নেহা সাইফি, যিনি দীর্ঘদিন ধরে দলের সঙ্গে যুক্ত, টিকিটের আশায় ছিলেন পশ্চিম চৌপারণ কেন্দ্র থেকে। কিন্তু মনোনয়ন গেল প্রাক্তন বিধায়কের ছেলের হাতে। অভিমানে ফেটে পড়ে নেহার বক্তব্য, ‘তাঁরা ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলেন, কিন্তু যাঁরা সুযোগ পান, তাঁদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক উত্তরাধিকারভোগী।’

বিহারের এই ছবি ভারতের সামগ্রিক রাজনৈতিক চিত্রের প্রতিফলন। ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, দিল্লি— সর্বত্রই নারী প্রার্থীর হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। অথচ প্রায় সব দলের বক্তৃতা, প্রচার, বিজ্ঞাপনে ‘নারীশক্তি’ যেন রাজনীতির প্রধান মুখ !

বিহারে ভোটার হিসাবে মহিলাদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। মোট ৭.৪৩ কোটির ভোটার তালিকায় ৩.৫ কোটি নারী ভোটার। ২০২৪ লোকসভা ভোটে পুরুষদের থেকে বেশি সংখ্যায় ভোট দিয়েছেন মহিলারাই। ৫৯.৪ শতাংশ বনাম ৫৩ শতাংশ। তবুও প্রার্থী তালিকায় তাঁদের জায়গা নেই। চোখে পড়ে শুধুই প্রতীকী উদ্যোগ। মুখ্যমন্ত্রীর ‘নারী কর্মসংস্থান প্রকল্প’-এর মাধ্যমে ১০,০০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে ৭৫ লাখ মহিলাকে। সমাজকর্মী নিবেদিতা ঝা বলছেন, ‘নারীদের ভোট চায় সব দলই, কিন্তু রাজনীতিতে তাঁদের জায়গা দিতে চায় না কেউ। ভোটে ব্যবহার হয়, নীতিনির্ধারণে নয়।’

আরও একটি প্রবণতা স্পষ্ট— বিহারে ভোটের ময়দানে এবার দুই ধরনের ‘এমওয়াই’ ফর্মুলার লড়াই। আরজেডি-র পুরনো ‘মুসলিম-যাদব’ সমীকরণের মুখে এনডিএ-র নতুন সমীকরণ— ‘মহিলা-যুবা’। বিজেপি ও জেডিইউ দুই দলই এবার প্রচারের কেন্দ্রে এনেছে এই দুই গোষ্ঠীকে। ভোটে প্রার্থী না হোক, উন্নয়ন-প্রকল্পে মহিলা ও তরুণদের ভরসা করে ভোট টানার চেষ্টা। নির্বাচনের আগে এনডিএ সরকারের তরফে একাধিক প্রকল্পের ঘোষণা, যার লক্ষ্য তরুণ-তরুণী এবং মহিলা ভোটাররা। বিহারে প্রায় ১.৫ কোটিরও বেশি যুব ভোটার, যার মধ্যে ১৪ লক্ষের বেশি প্রথমবার ভোট দেবেন। এক জেডিইউ নেতার কথায়, ‘নিতীশ কুমারের মহিলামুখী প্রকল্প এবং যুব কর্মসংস্থান পরিকল্পনা ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।’

২০২০-র নির্বাচনে এনডিএ জোটে বিজেপি দিয়েছিল ১২ জন নারী প্রার্থী, জেডিইউ ২২ জন— শতাংশের হিসাবে যথাক্রমে ১১.৯ ও ২১.৮। ওই সময় লজেপি (চিরাগ পাসোয়ানের দল) একা ১৩৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ২২ জন মহিলা প্রার্থী দিয়েছিল (১৬.৩ শতাংশ)। সেই তুলনায় এবারের চিত্র আরো হতাশাজনক। এক বিজেপি মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা রাজ্যসভা ও বিধান পরিষদে মহিলা প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছি। টিকিটে ৩৩ শতাংশ দিতে না পারলেও, অন্যভাবে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছি।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, ‘এ বক্তব্য আসলে দায় এড়ানোর অজুহাত মাত্র।’ গবেষক দিব্যা গৌতম, যিনি এবার দিঘা আসন থেকে সিপিআই (এমএল)-এর প্রার্থী, তিনি বলেন, ‘নারীদের চাকরি বা ভাতায় আটকে রাখা হচ্ছে। কিন্তু নীতিনির্ধারণী কমিটিতে, পার্টির স্থায়ী বোর্ডে, নির্বাচনী মনোনয়ন কমিটিতে তাঁদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই।’ তাঁর দাবি, সংবিধানিক রূপে প্রত্যেক দলে ৩৩ শতাংশ নারী মনোনয়ন বাধ্যতামূলক করা হোক। বিহারের এই ছবি ভারতের সামগ্রিক রাজনৈতিক চিত্রের প্রতিফলন। ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, দিল্লি— সর্বত্রই নারী প্রার্থীর হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। অথচ প্রায় সব দলের বক্তৃতা, প্রচার, বিজ্ঞাপনে ‘নারীশক্তি’ যেন রাজনীতির প্রধান মুখ! দিব্যার বক্তব্য, ‘নারীদের কর্মসংস্থান বা রেশন নয়, চাই নীতিনির্ধারণের জায়গায় সরাসরি প্রতিনিধিত্ব। যত দিন না নারীরা নীতিনির্মাতা হচ্ছেন, তত দিন ক্ষমতা নয়, কেবল দয়া পাচ্ছেন তাঁরা।’


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!