- মা | ঠে-ম | য় | দা | নে
- মে ১৩, ২০২৪
জন্মদিনেও বাবা–মাকে প্রত্যাখান, রিংয়েই ‘শান্তি’ পারভীনের

পাতিয়ালা থেকে রোহতকের দূরত্ব কত? মেরেকেটে ১৯০ কিমি। সাড়ে তিন ঘন্টার রাস্তা। অথচ বেশ কয়েকমাস বাড়িমুখো হননি পারভীন হুডা। আগামী ২–৩ মাস বাড়ি যাওয়ার স্বপ্নও দেখছেন না। অলিম্পিকের প্রস্তুতিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন দেশের এই প্রতিশ্রুতিবান বক্সার। চোখে অলিম্পিক পদকের স্বপ্ন।
পারভীনের বাড়ি রোহতকের রুরকিকে। অলিম্পিকের প্রস্তুতির জন্য এই মুহূর্তে রয়েছেন পাতিয়ালায় জাতীয় শিবিরে। এপ্রিলে জন্মদিন ছিল। পারভীনের বাবা–মা’র ইচ্ছে ছিল জন্মদিনে মেয়ের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর। মেয়ে বাড়ি আসতে পারবেন না, জানতেন। তাই মেয়েকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাঁরা পাতিয়ালায় গিয়ে দেখা করবেন। কিন্তু তিনবেলা সেশন থাকায়, বাবা–মা’র প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন পারভীন।
বাড়ির জন্য মন খারাপ করে পারভীনেরও। কিন্তু বাড়ির থেকেও তাঁর কাছে বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে অলিম্পিক। বাড়ির কথা তুললেই পারভীনের জবাব, ‘প্লিজ, বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করবেন না। আমি আমার পরিবার, বাড়ি খুব মিস করি। আর মাত্র ২–৩ মাস বাকি আছে। তারপর বাড়িতে ফিরে আরাম করতে পারব।’
এখনও পর্যন্ত চারজন ভারতীয় বক্সার অলিম্পিকে যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পারভীন হুদা। ২৪ বছর বয়সী এই ভারতীয় বক্সার অলিম্পিকের প্রস্তুতি পর্ব দারুণভাবে উপভোগ করছেন। ইতিমধ্যেই ৫৭ কেজি বিভাগে ২০২২ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জিতেছেন, এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছেন। গতবছর এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ ছিনিয়ে নিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসা অলিম্পিকের স্বপ্নপূরণ হয়েছে। এবার পদক জিতলেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে পারভীন হুদার।
আত্মবিশ্বাসী পারভীন বলছিলেন, ‘চাপের অনুভূতি আছে, কিন্তু উত্তেজনাও আছে। আমি প্রশিক্ষণের প্রতিটা ছোটখাট বিষয়ের ওপর ফোকাস করছি। প্যারিসে ভাল কিছু করার ব্যাপারে আমি আত্মবিশ্বাসী।’ পারভীনের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাঁর ক্রমবর্ধমান উত্থান। গত কয়েক বছরে বড় ইভেন্টগুলিতে সাফল্য মনোবল বাড়িয়েছে। এশিয়ান গেমসসহ প্রতিটি প্রতিযোগিতায় তিনি সেমিফাইনালে পৌঁছে প্যারিস কোটা সুরক্ষিত করেছিলেন। আর প্যারিসের কোটা নিশ্চিত করে পদকের চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ হয়েছেন।
পারভীনের কথায়, ‘সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি আমি শিখেছি তা হল, নিজের ওপর কোনও সন্দেহ না থাকা। আমি এই ইভেন্টগুলিতে বেশ কয়েকজন সেরা বক্সারকে পরাজিত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে জয় আমাকে অনেক প্রেরণা জুগিয়েছে এবং আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। শীর্ষ স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অভিজ্ঞতাও এই বক্সারদের সাথে লড়াই করার ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল।’
বক্সিংয়ের প্রযুক্তিগত অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে প্যারিসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন পারভীন। বেশ কয়েকবার বিশ্ব পদকজয়ী চাইনিজ তাইপেইর লিন ইউ টিং–এর কাছে হ্যাংজুতে পরাজয় তাঁকে পাল্টা আক্রমণের দিকে তাকাতে বাধ্য করেছিল। তিনি এখন পাল্টা আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে দ্রুত আক্রমণে যাওয়ার কৌশলে অনেক উন্নতি করেছেন। পারভীনের কথায়, ‘আগে আমি পাল্টা আক্রমণে যাওয়ার ওপর নির্ভর করতাম। বুঝতে পেরেছিলাম, খেলার একটা মাত্র স্টাইল নিয়ে পড়ে থাকলে উন্নতি করতে পারব না। এশিয়ান গেমসের পর থেকে আক্রমণাত্মক এবং ক্লোজ রেঞ্জের খেলা তৈরি করেছি। এখন আমি দূর থেকে, মাঝামাঝি ও কাছাকাছি জায়গা থেকেও দীর্ঘক্ষণ লড়াই করতে পারি।’
পরিবর্তন অবশ্য হুদার কাছে নতুন নয়। যুব থেকে সিনিয়রে উত্তরণের সময় ৬৩ কেজি বিভাগে চলে আসেন। ২০২১ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন এবং পরের বছর বিশ্ব ও এশিয়ান পদক জিতেছিলেন। কিন্তু অলিম্পিকে ৬৩ কেজি বিভাগ না থাকায় পারভীনকে নিচের ওজন বিভাগে নেমে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তাঁর কথায়, ‘প্যারিস অলিম্পিকের কথা মাথায় রেখে ৫৭ কেজি ছিল আমার সেরা বিকল্প।’ যার অর্থ হল নিজের প্রশিক্ষণের লোড বাড়ানো এবং ওজন কমাতে কঠোর প্রোটিন সমৃদ্ধ, কার্ব-চেকিং এবং জাঙ্ক-শেডিং ডায়েটে লেগে থাকা। এছাড়া আরও বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। পারভীন বলছিলেন, ‘আমি চা ভালোবাসি। দুই মাসের জন্য আমি পুরোপুরি চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎ করে ৬ কেজি ওজন কমানো শুরুতে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু আমার লক্ষ্য এবং স্বপ্ন ছিল অলিম্পিক, তাই আমাকে এটা করতে হয়েছিল।
২০১৯ সালে এক ঘরোয়া ট্রায়ালে সরিতা দেবীকে পরাজিত করে ভারতীয় বক্সিংয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছিলেন পারভীন হুদা। ২০২৪ সালে যখন তিনি অলিম্পিকের স্বপ্নের চূড়ায় দাঁড়িয়ে, তখন তিনি একজন সম্পূর্ণ ভিন্ন বক্সার। তবে দক্ষতার দিক থেকে যতটা, মনের দিক থেকে ততটা নয়। পারভীনের কথায়, ‘আমার খেলা তখনও ভাল ছিল, কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। এখন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় কয়েকটি পদক জেতার পর আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। লড়াইয়ের আগে আমি আর নার্ভাস হই না।’
খেলার বাইরের বাহ্যিক বিষয়গুলি অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন পারভীন হুদা। কদাচিৎ মোবাইল ব্যবহার করেন, সামাজিকতা পছন্দ করেন না। একমাত্র রিংয়ের ভেতরেই ‘শান্তি’ খুঁজে পান। তাই তো জন্মদিনেও বাবা–মা’র সাক্ষাতের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। প্যারিসই যে তাঁর বড় স্বপ্ন।
❤ Support Us