- খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
- এপ্রিল ২২, ২০২৩
ইদ কেন সর্বজনীন উৎসব হয়ে উঠল না

ইদ কেন সর্বজনীন হয়েও, দুর্গোৎসব কিংবা বড়োদিন বা অন্যান্য সামাজিক উৎসবের মতো সবার উৎসব হয়ে উঠল না। বিশেষ পরিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে এখনো । এরকম প্রশ্ন তুলে জবাব খুঁজছেন লেখক । আশাব্যঞ্জক লক্ষণের গল্পও শুনিয়েছেন পাশাপাশি যে, সে সুদিন আসবে, যখন ইদের মম গন্ধে মেতে উঠবে গ্রামীণ বাংলা, শহুরে ভারত
ইদ সর্বজনীন হয়েও, আমাদের সমগোত্রীয় বোধের উৎসব হয়ে ওঠেনি কেন? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে অনেকগুলি বিষয় সামনে এসে যায়, এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে যায় বা যাবে, কেন ইদ ভারতে সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। বলা ভালো, এর পিছনে আর্থসামাজিক দিকটা যেমন একটা বড় উপাদান হিসেবে কাজ করেছে, আবার তার পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিবেশ, পরিস্থিতিও অন্যতম ও প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করেছে, এখনো করছে । কখনো আমাদের নজরে আসে ভারতের কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কখনো তাঁর বাসভবনে ইফতার পার্টি করছেন আবার কখনো দেখা যাচ্ছে আগে যে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বাসভবনে ইফতার পার্টির আয়োজন করতেন, তিনি তাঁর বাসভবনে ইফতার পার্টি আয়োজন থেকে বিরত থেকে অন্য কোনও জায়গায় ইফতার পার্টি করছেন । এই সব ঘটনার প্রেক্ষাপট আলোচনা করলেই বোঝা যাবে ইদ কেন ভারতে সর্বজনীন হয়ে উঠল না ।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আগে ইদ উৎসবের ঐতিহাসিক কারণ অর্থাৎ ইদ উৎসবের মূল কোথায় তা নিয়ে কিছু কথা বলতে হয় । ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক গবেষক এবং বিশেষজ্ঞদের মতে ৬২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ঈদ উদযাপন করা হয়েছিল । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মহম্মদ আতাউর রহমান মিয়াজী বিবিসি বাংলাকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, হিজরি দ্বিতীয় সনে ঈদের প্রবর্তন হয় । সাক্ষাৎকারটি ১ মে, ২০২২ সালে বিবিসি বাংলাতে প্রকাশিত হয় । সাক্ষাৎকারে মহম্মদ আতাউর রহমান মিয়াজীর বক্তব্যে পাই, নবি মুহাম্মদ যখন মক্কা থেকে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হিজরত করে মদিনায় যান, তখনকার সময়কে ভিত্তি সময় ধরেই হিজরি সাল গণনা করা শুরু হয় । আনুষ্ঠানিকভাবে অবশ্য হিজরি সালের গণনা শুরু হয়েছিল তারও ১৭ বছর পরে, খলিফা উমরের আমলে ।
“হিজরি প্রথম বছরের অষ্টম মাস অর্থাৎ শাবান মাসে রোজা বাধ্যতামূলক করার প্রত্যাদেশ আসে, এবং তখন নবম মাস অর্থাৎ রমজান মাসে একমাস উপবাস পালনকে অপরিহার্য করা হয় । হিজরি দ্বিতীয় সালে এসে বিধান দেয়া হয় যে রমজান মাস – চাঁদের হিসাবে যা ২৯ দিনেও শেষ হতে পারে বা কখনো ৩০ দিনের – শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদ উদযাপন করা হবে । অধ্যাপক মিয়াজির ধারণা, “ঈদের সামাজিকতা ওই সময় থেকেই শুরু হয় ।”
এ বিষয়ে আনাস নামে নবি মুহাম্মদের একজন সাহাবা বা সাথীর বর্ণনা (হাদিস) থেকে আমরা জানতে পারি, মদিনায় যাওয়ার পর নবি দেখলেন, সেখানকার মানুষ বছরে দুটি বড়ো উৎসব পালন করে । তিনি তখন জানতে চান, সেগুলো কী উৎসব ?
এই দু’টি বড়ো উৎসবের একটি নওরোজ, অন্যটি মিহিরজান । উৎসব দু’টো সেখানকার বাসিন্দাদের ধর্ম এবং গোত্রের রীতি অনুযায়ী একটি শরতে এবং আরেকটি বসন্তকালে উদযাপিত হত ।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যে ভাবে বড়োদিন উদযাপিত হতে দেখি, যে ভাবে দুর্গাপুজো উদযাপিত হতে দেখি, তাতে সর্বজনীন উৎসবের চিত্রটা খুবই স্পষ্ট ভাবে নজরে আসে । কিন্তু সেই অনুপাতে ভারতে এবং বাংলায় ইদ উৎসবকে সর্বজনীন হতে দেখা যায় না। এর পিছনে দুটো কারণ আছে । প্রথমটি হচ্ছে আর্থসামাজিক দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক । বড়দিন, দুর্গাপুজোর মতো ইদ কি ভারতে সর্বজনীন রূপ পেয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তরে না বললেও অত্যুক্তি হবে না । কারণ আমরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যে ভাবে বড়োদিন উদযাপিত হতে দেখি, যে ভাবে দুর্গাপুজো উদযাপিত হতে দেখি, তাতে সর্বজনীন উৎসবের চিত্রটা খুবই স্পষ্ট ভাবে নজরে আসে । কিন্তু সেই অনুপাতে ভারতে এবং বাংলায় ইদ উৎসবকে সর্বজনীন হতে দেখা যায় না । এর পিছনে দুটো কারণ আছে । প্রথমটি হচ্ছে আর্থসামাজিক দ্বিতীয়টি রাজনৈতিক ।
আমাদের দেশে বা রাজ্যে মুসলমানরা সাধারণত দরিদ্র, নিম্নবিত্ত সমাজের সদস্য । তাঁরা সামাজিকভাবে সে মর্যাদাটা পাননি । ভালো চোখে তাঁদের দেখা হয়নি । বরাবরই এই ধারা ছিল, এই ধারা এখনো চলে আসছে । এরা যেহেতু সংখ্যায় বেশি নয়, তাই সামাজিক স্বীকৃতি সেভাবে মেলে না, পাওয়ায় ইদ তাই সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি । এরই পাশাপাশি মধ্যবিত্ত বা শিক্ষিত মুসলিমদের সংখ্যা ইদানিং বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তাঁরা তাঁদের মতো করে নিজেদের মধ্যে ইদ উৎসবকে কিছুটা হলেও সামাজিক রূপ দিতে চেষ্টা করছেন । আমাদের রাজ্যে বিধানসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ হাসিম আব্দুল হালিমের বাড়িতে তাঁর পুত্র চিকিৎসক ফুয়াদ হালিমের দেওয়া ইফতার পার্টিতে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষরা আমন্ত্রণিত হন । তবে তার মানে এই নয় যে চিকিৎসক ফুয়াদ হালিমের বাড়িতে ইফতার পার্টি হওয়ার অর্থ এই যে বাংলায় বা দেশে ইদ সর্বজনীন উৎসবের রূপ পেয়েছে । দেশের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে ইদ সর্বজনীন চরিত্র পেলেও সার্বিকভাবে সেটা হয়নি । এখনও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা মুসলিম পড়ুয়াদের কলকাতার মতো এলিট শহরে বাড়ি ভাড়া পেতে কালঘাম ছুটে যায় । চারপাশের পরিস্থিতি যখন এরকম, তখন ইদ উৎসব কী ভাবে সর্বজনীনতা পাবে, সে প্রশ্ন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও থেকে যাচ্ছে ।
আমরা টানা দু’তো বছর মহামারির জন্য বিধিনিষেধ থাকার কারণে ইফতার পার্টি, ইদ উৎসব হতে দেখিনি । কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের জন্য ভোটের মিছিল, জমায়েত হয়েছে পূর্ণ উদ্দমে, সেটাও দেখেছি । তবে ২০২২ সালে যখন মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হল তখন উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবকে দেখলাম তিনি তাঁর বাড়িতে ইফতার পার্টি বন্ধ করে দলীয় কার্যালয়ে ইফতার পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন । ২০২৩ সালের ইফতার পার্টিও তিনি তাঁর বাড়িতে করেছেন বলে খবর নেই । উত্তরপ্রদেশ সরকার ঘোষণা করে দিয়েছে, নির্দিষ্ট স্থানে ছাড়া ইদের নমাজ পড়া যাবে না । তবে এরই মধ্যে বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমরা অনেকটাই মুক্তচিন্তার ছবি দেখতে পাচ্ছি, পেয়েছি । সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ইফতার পার্টি দিতেন, নমাজে যেতেন রেডরোডে । তারপর বাম আমলে আমরা দেখলাম ইদে কোনও মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত নেই । যদিও তাঁরা কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেননি । বড়োদিন, ইদ ,দুর্গাপুজো সব উৎসব থেকে বামপন্থীরা নিজেদের দূরে সরিয়েই রেখেছেন ।

ফাইল চিত্র
২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর বাংলার ইদের সমবেত প্রার্থনা মঞ্চে রেডরোডে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতি রাজ্যবাসীর নজরে এসেছে । ২০২৩ এর রেডরোডের নমাজের জন্য রাজ্য সরকার পূর্ত দফতরের মাধ্যমে অস্থায়ী পরিকাঠামো তৈরির কাজ করে দিচ্ছে । এই কাজগুলোকে কেউ কেউ ভোটের রাজনীতি বলছেন। উত্তরপ্রদেশেও অখিলেশ যাদবের বাড়িতে ইফতার পার্টি না করার পিছনে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ভোট হারাবার ভয় কাজ করছে বলেও রাজনৈতিক বিশেষেজ্ঞরা মনে করছেন । আবার পশ্চিম বাংলার ক্ষেত্রে আমরা দেখছি বড়োদিনে, দুর্গাপুজোয়,ইদ উৎসবে মুখ্যমন্ত্রী সমানভাবে যোগ দিচ্ছেন । মুখ্যমন্ত্রীর এই সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে কেউ রাজনীতি বলছেন, কেউ বাহবা দিচ্ছেন ।
এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বলা যাচ্ছে না, ভারতে ইদ সর্বজনীন উৎসবের রূপ পেয়েছে । বড়ো দিনের পার্কস্ট্রিটের আলোকসজ্জা, বাড়িতে বাড়িতে সান্টা কেনা কিংবা দুর্গাপুজোয় সাতদিন ধরে কল্লোলিনী কলকাতার জনজোয়ারের তুলনায় ভারতে ইদের সর্বজনীনতা বড়ই ফিকে । ইদানিং বাঙালি মুসলমানরা শিক্ষায় আগের চাইতে অনেক বেশি অংশগ্রহণ করছেন, ফলে চাকরি, ব্যবসা করে অর্থবান হচ্ছেন । তাঁরা এখন নিজেদের মধ্যে ইদ উৎসব উদযাপন করছেন । নিউমার্কেটে, কলকাতার শপিং মলে ইদের জন্য ছাড় দেওয়া হচ্ছে । বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলায় ইদের মুখে বাংলা সিনেমা রিলিজ হচ্ছে, এবার অধীররঞ্জন চৌধুরীর দাবি মেনে, ইদের আগের দিন কলকাতা-মুর্শিদাবাদ দু’টো ট্রেন চালাবার কথা ঘোষণা করেছে রেল মন্ত্রক । কলকাতায় যাঁরা কাজ করার জন্য থাকেন তাঁরা ইদের আগে বাড়ি ফিরতে পারেন, পরিজনদের সঙ্গে ইদ উদযাপন করতে পারেন । তবে এসবই হচ্ছে খুব ক্ষুদ্র পরিসরে । তাই বলা যায় হয়তো এমনদিন আসবে যেদিন বড়োদিন, দুর্গাপুজোর মতো ইদও সমানভাবে সর্বজনীন উৎসবের মর্যাদা পাবে । এখনও সেই সময়টা আসেনি, আসবে । আমরা আশায় আছি। আসুন হাতে হাতে নিবিড়ের বন্ধন আঁকি।
♦♣♦ ♦♣♦ ♦♣♦ ♦♣♦
❤ Support Us