শিবভোলার দেশ শিবখোলা
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
অলঙ্করণ: দেব সরকার
বাঁশের চেড়া দিয়ে বানানো একটা বেড়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া গোলাপের গায়ে ডুবে যেতে বসা সূর্যের আলো এসে পড়েছে আর দুটো প্রজাপতি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে, কাছে কিন্তু কোনো লোকজন নেই, এই গোপন বাগানে কেউ আসে বলে মনে হয় না, একটা মাদী বেড়ালের গর্জন শোনা গেল, নজর করলে দেখা যাবে এখানে একটা-দুটো নয়, হাজার হাজার ফুলের গাছ, সবাই গোলাপ নয়, তবে সবাই ফুল।
আমি এক অচেনা ঝোপের নিচে লুকিয়ে পড়লাম।
পেটে লোহার রড ঢুকিয়ে দিলে ফিনকি দিয়ে রক্ত ওঠার মতো আওয়াজ, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে মাথায় গুলি করলে থপ করে ওঠে যেরকম সেই আওয়াজ আর গোটা গ্রাম জ্বলে উঠলে যে চিড়বিড় শব্দ হয়, সেরকম কিছু কানে আসছে। নানা রকমের কান্না শোনা যাচ্ছে। হাজার হাজার লোক পালাচ্ছে, হাজার হাজার লোক ধাওয়া করছে। কারো হাত ছেড়ে গেল, কেউ হাত ছেড়ে দিল। দাঙ্গা কোথায় গিয়ে থামবে জানি না।
ঝোপের ভিতরে বসে থাকতে থাকতে এক সময় শুয়ে পড়লাম। ভয় জমে জমে রগের কাছে চিনচিন করতে করতে ঘুম এসে গেল।
দেখলাম, আমার প্রিয়ার বাড়ি। তার খালা, ফুফু, মেজ আব্বা, দাদি, নানা সবাই গোল হয়ে বসে আছে। প্রিয়ারও একধারে জায়গা হয়েছে। বড়ো বড়ো হাঁড়িতে গোশত পাকানো হচ্ছে। প্রিয়ার আব্বার সামনে আমি নতমুখে দাঁড়িয়ে আছি। সে লোক জিজ্ঞেস করল—পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয় ?
—চার ওয়াক্ত হয়, ফজরে উঠতে পারি না।
—ব্যবসা করতে পারবে?
— চেষ্টা করব।
—হিসেব জানো?
— মোটামুটি।
— বলো তো চার আর দুয়ে কত হয়?
— ছয়?
—জবাব দিচ্ছ নাকি জিজ্ঞেস করছ?
—জ্বি, ছয়।
—কেন, আট হয় না?
—হ্যাঁ, তা হয়, গুণ করলে হয়।
—তাহলে গুণ না করে যোগ করলে কেন?
আমার প্রিয়ার বাড়ি রজনীগন্ধার পাকানো দড়িতে ঢাকা। সানাই নেই তবে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে—তুমি কোন কাননের ফুল। তার কি আজ বিয়ে ?
দাদির মতো কেউ বলল, খেয়ে যেও বাবা।
—এত সাজানো কেন?
সবাই পাশ কাটিয়ে চলে গেল, আমার প্রিয়ার দিকে যত পথ হাঁটি ফুরোয় না, সে একইরকমভাবে তাকিয়ে আছে, যেন নিজের মুখ খুলে রেখে সে অন্য কোথাও চলে গেছে, আমার সামনে শুধু হাজার হাজার লোকের ঠেলাঠেলি, পৌঁছতে পারছি না।
ঘুম ভেঙে গেল।
♠♠
সদরের এক দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাগজে আমাদের এলাকার গল্প পড়ছি। কত নিহত, কত আহত, কত নারী, কত পুরুষ, কত শিশু, কত বৃদ্ধ, কত হিন্দু, কত মুসলিম। কারা শুরু করল, কারা শেষ করল, কারা সব জানে, কারা কিছুই জানে না, কারা রক্ষা করল, কারা হারিয়ে গেল !
♠♠
দেখি, আমার পাশে একজন ঘাপটি মেরে বসে আছে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে তার মুখ পরিষ্কার দেখা না গেলেও সে যে ভীষণ ভয় পেয়েছে সেটা বোঝা গেল। ঝোপের ভিতর থেকে প্রচুর আলো দেখতে পেলাম। গ্রামগুলো মশালের মতো দাউদাউ করে জ্বলছে।
আমি উঠে বসতেই সে ফুঁপিয়ে বিঘত খানেক সরে গেল। তার গায়ে কিছু নেই, শুধু গামছা। গড়ন রোগা বলেই মনে হল। আর অন্ধকারে সবাই কৃষ্ণাঙ্গ।
ফিসফিস করে তাকে বললাম, আমি কে তা জানতে চেয়ো না, আমিও জানতে চাইব না তুমি কে। আমরা এখনও বেঁচে আছি, খুব ভয় পেয়ে আছি, আমাদের পরিবার শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু দুঃখ করার মতো জায়গায় আমরা নেই, এটুকুই আমাদের পরিচয়।
তার গায়ে হাত রাখলাম, বরফের মতো ঠান্ডা।
হালকা বাতাসে গোলাপের গাছ দুলে দুলে উঠছে আর আলো না থাকায় তাদের রং বোঝা যাচ্ছে না। তাদের প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখার চোখও আমরা এখন হারিয়ে ফেলেছি।
সেই ঝোপের ভিতর দুজনে আগুন নেভার অসীম অপেক্ষায় বসে রইলাম।
দুদিন পর আমরা ঝোপ থেকে বের হলাম। চলে যাওয়ার আগে সে আমার দিকে যেভাবে তাকাল যেন আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছি, রক্ষা করেছি। যদিও পালানোই আমাদের একমাত্র পথ ছিল। স্বার্থপরের মতো পালিয়ে যাওয়া। যাইহোক, ও জানত আমি ওকে আঘাত করব না, আমি জানতাম সে আমাকে আঘাত করবে না। এ হল ভয়ের চুক্তি।
সপ্তাহ খানেক পর সদরের এক দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাগজে আমাদের এলাকার গল্প পড়ছি। কত নিহত, কত আহত, কত নারী, কত পুরুষ, কত শিশু, কত বৃদ্ধ, কত হিন্দু, কত মুসলিম। কারা শুরু করল, কারা শেষ করল, কারা সব জানে, কারা কিছুই জানে না, কারা রক্ষা করল, কারা হারিয়ে গেল!
জোহরের আজান হয়ে গেছে তখন। ওজুখানায় উবু হয়ে বসে অনেকে মেশওয়াক করছে। এমন সময় দেখলাম, জামে মসজিদের সিঁড়ি বেয়ে নামাজ পড়তে উঠছে সেই লোক যার সঙ্গে গোলাপবাগানে ঝোপের মধ্যে তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটিয়েছিলাম কয়েকদিন।
♦♦♦♦♦♦♦♦
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।
মিরিক নামটি এসেছে লেপচা ভাষার “মির-ইওক” শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুনে পুড়ে যাওয়া জায়গা।
15:34