- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- জানুয়ারি ৮, ২০২৩
চিনিপট্টির সুখ-স্বপ্ন
সময়ের দাড়িপাল্লায় দাঁড়িয়ে মানুষ এখন সব পাখি, কেউই আর দেশে থাকতে চায় না, দূর-দূর দেশে পাড়ি দিচ্ছে সুখের সন্ধানে

অলঙ্করণ: দেব সরকার
বাড়ির আগের মানুষগুলো ক্রমগত কমছে, না ফেরার দেশে চলে গেলে কি আর কেউ ফিরে আসে, আসে না বলেই তো শূন্য হচ্ছে ভিটে, উজার হচ্ছে না তা বলে, কারণ সে শূন্যস্থানে পূরণ হওয়ার লোকেরও অভাব নেই। পুরাতন যাচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে আর নতুন আসছে হাঁটি-হাঁটি পায়ে, এই খেলা নিয়ত চলছে জগত-সংসারে, কে তাকে রুখিবে আর, প্রকৃতির এই বিচিত্র খেলা চলছে অবিরাম।
চিনিপট্টি গলির ভেতরের এই বাড়িটা অনেক সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে, ঘর-দোরগুলো বেশ পুরানো, কড়ি-বর্গা সংস্কারের অভাবে যাচ্ছেতাই অবস্থা অথবা দেওয়াল প্যালেস্তারা খসে জবর জং, মেঝেতে বড়-বড় ফাঁক-ফোঁকর বিরাজ করছে, কতোগুলো মানুষ থাকে, কতোগুলো সংসার গড়ে উঠেছে এখানে, তাও কেউ বলতে পারবে না বাইরের কেউ। কেউ সংসার পাতে কেউ বা দূরে চলে যায়, এই যাওয়া-আসা এবং আসা-যাওয়ার ভেতর দিয়ে মানুষের পরিক্রমা শুরম্ন, তার বিকাশ এবং চলমান ধারা।
পুরানো মানুষদের মধ্যে একজন আকরাম বকস এখনো জীবিত, শরীরে শক্তি নেই, দাঁত সব খেয়ে ফেলেছে সময়, দৃষ্টিশক্তি আছে কি নেই তাও আন্দাজ করার উপায় নেই,হাড্ডিসার রুগ্ন একজন মৃত্যুপথ যাত্রীকে দেখে শুধুই করুণা ঝরে পড়ে সবার অন্তরে, দিনরাত্রি অবিরত এই খেলা তার আর ভারো লাগে না হয়তো, শরীর এখন ক্লান্ত তাই হয়তো থামতে চাই, কিন্তু কে থামায় কাকে।
ছেলেবউ মিলে যতোটুকু যত্নআর্তি করার করে নিয়মিত, সকাল-দুপুর বিকেল সন্ধ্যে টিয়ে শ্বশুরের জন্য ব্যস্ত থাকে, আকরাম বকস আপন মন বিড়বিড় করে নিজের সাথে, নিজের সঙ্গে তার সারাজীবনের দোস্তি, বাপের হাত ধরে সেই যে বাষট্টির দাঙ্গায় চলে এলো শরণার্থী হয়ে এপারে, তারপর কতোগুলো জীবন সামনে থেকে হারিয়ে গেলো, আজো সে অংক মেলে না। কষ্ট বাড়ে বুকের ভেতর, কষ্ট তবু ছাড়ে না, কষ্টগুলো পষ্ট হয়ে জীবনভর খোঁচায় শুধু, মন-প্রাণকে অস্থির করে, গোলকধাঁধার বৃত্তের ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলে, কিসের আশায় বসে থাকা, সে জানে না এই প্রশ্নের উত্তর, গুলিয়ে ফেলে সমস্ত উত্তর। অনেকরাত্রে আকাশে যখন রূপোর থালার মতো চাঁদ লক্ষ-কোটি তারকার সঙ্গে বাসর সাজিয়ে বসে থাকে, আকরাম বকস তখন অর্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে দেখে বিশাল আকাশটাকে, আকাশ দেখার মধ্যে কি আর নতুনত্ব আছে, তবুও খোলা আকাশ ভালো লাগে। গোল চাঁদ ওই বাতাবিলেবু গাছের মাথায় অবিরাম আলো ছড়িয়ে পৃথিবীকে ঝলমলে করে তোলে, পৃথিবী তখন সুন্দর থেকে সুন্দরতম হয়ে ওঠে।
পাতকুয়াটা জেগে থাকে, কখনো হয়তো পুরানো দিনের গল্প বলে ওঠে, যেহেতু কালের একমাত্র সাক্ষী আকরাম বকস, মাটির পাত বসানো পাতকুয়া এখন আর কারো প্রয়োজন পড়ে না,পানির ব্যবস্থা যথেষ্ট এখন, সিটি কর্পোরেশনের সাপ্লাই পানি যেমন আছে, বাড়ি-বাড়ি বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবয়েল তো আছেই, কিন্তু কুয়াটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে জবরজং শরীর নিয়ে দাঁত কেলিয়ে, হয়তো যে কোনো একদিন বিনা নোটিশে বন্ধ হয়ে যাবে, সেখানে একটা ঘর উঠবে তারপর, একসময় বাড়িখানা কতো ফাঁকা-ফাঁকা ছিলো, কতো বড় উঠোন, কয়েকটা বিশাল-বিশাল গাছ ছিলো ওধারে, মাঠের মতো ওদিকটায় সকাল-বিকেল কতো ছেলে-মেয়ে খেলে বেড়াতো, আর আজ কেমন গিজগিজ করছে, ভরে গেছে বাড়িঘরে, ফাঁকা নেই এতোটুকু, আকরাম বকস আজ স্থবির একজন মানুষ হলেও কালের সাক্ষী সে। কতো ঝড়-বাদল বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে, কতো গল্প, না বলা গল্প, অপ্রকাশিত গল্প সঞ্চয় হয়ে আছে, কিন্তু সে সব সবই তো তার নিজের, কাউকে বলে বোঝানো যায় না, কেমন ধোঁয়ায়-শিশিরে একাকার হয়ে আছে তার মধ্যে, তারপরও সে একজন মানুষ, মানুষই তো, মানুষ ছাড়া তা আর কিছু নয়, এভাবেই কি একজন মানুষের গল্প রচিত হয়।
বাষট্টির দাঙ্গা তামাম কলকাতাকে তছনছ করে, হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রতি-ভ্রাতিত্বকে ভেঙে খান-খান করে দিলো, আকরাম বকস তখন যুবক, সেই বয়সে মানুষের চোখে অগ্নি দেখেছে, চেনা মানুষও যে কিভাবে বড় বেশি অপরিচিত হয়ে যায়, তার স্বরূপ চোখে না দেখলে সে নিজেও বিশ্বাস করতো না। তারপর বাপ একদিন বললো, আর না এদেশে, চলে যেতে হবে…বাপের কথা শুনে বুকের ভেতরটা কেমন ধড়াৎ করে উঠেছিলো, কোথায় যাবে তারা, কোন্ দেশে আজ তাদের আস্তানা। চোখে অনেক-অনেক জিজ্ঞাসা, অনেক প্রশ্ন কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারেনি। সময় বড় খারাপ, নিজেকে শুধু সান্তনা দিয়েছে নিরবে, মানুষের লাশ দেখে মানুষের যে কি আনন্দচিৎকার, মানুষের প্রতি মানুষের এই ক্ষোভ এতোকাল তাহলে কি সঞ্চিত ছিলো পাথর বাক্সে, কি এক অমানিশা এলো জীবনে, চারদিকে কোনো সূজন নেই, সবাই শত্রু একে অপরের, কোথায় মানুষের ভালোবাসা, নিজের ভেতর চেতনা যেন খাবি খাচ্ছে তার। ভয়াবহ একরাত্রে চেনা-জানা পরিবেশ ছেড়ে, চকচকে রাস্তা ঘাট ফেলে চোরের মতো পালিয়ে আসতে হয়, চোখে ছিলো ভয়, কোথায় কি হয়, সে ভয় আজো আকরাম বকসকে তাড়া করে বেড়ায়, কবে আবার ডাক পড়বে চলে যেতে হবে একেবারে সহায়-সম্বলহীন হয়ে, মহাকালের ডাক তো উপেক্ষা করতে পারবে না, আর তাই সে মহাকালের ডাকের অপেক্ষায় কান সর্বদা সজাগ রেখে তন্দ্রাহীন।
মানুষের সঙ্গে মানুষের কতো ভাব-ভালোবাসা ছিলো, কেউ তো অপর নয়, একে অপরের কতো কাছাকাছি, ওই বাড়ি সেই বাড়ি বলে কোনো কথা ছিলো না, সবাই আপন অথচ আজ কেমন সব ছাড়া-ছাড়া, যেন সবাই দূর দেশের মানুষ
রাত্রি যতো গভীর হয়,শরীর তখন অন্যরকম পঙ্খি হয়ে ওই আকাশে হারিয়ে যেতে চায়। চোখের ছানি আজো কাটা হলো না, মনের আন্দাজে সবই সে দেখে, কিন্তু খোলা চোখ শুধু একটা খোলস, পূর্বে স্মৃতি হাত মরে মনে, চোখের কি আর প্রয়োজন, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে ভারী কষ্ট, তারপরও নিতে হয়, প্রাণপাখি যতোক্ষণ আছে, এভাবেই আসবে-যাবে। কতোগুলো মানুষ ছিলো দলবদ্ধ হয়ে, সবাই একেএকে চলে গেলো, ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আকরাম বকস এখন বড্ড একা, তার ট্রেন এখন যে এলো না, তবে কি ট্রেনের ধর্মঘট চলছে, নাকি কোথাও লাইন নষ্ট হয়েছে, মেরামতি কাজ চলছে এখনো।
চিনিপট্টি গলি নামটা শুনলে মনটা কেমন চিনি-চিনি লাগতো একটা সময়, এখন সে নামে বড় কেউ ডাকে না, রাণীবাজার বলতেই সবাই ব্যস্ত, বাষট্টির পরপর যখন প্রথম এই চিনিপট্টি গলির বাসিন্দা হলো তারা, আকরাম বকসের কাছে এলাকাটা প্রিয় হয়ে উঠলো, বৈঠকখানা রোডের মতো জনাকিন্য জায়গার চেয়ে কম কিসের চিনিপট্টি গলি। কতো মানুষের বাস, ফাঁকা-ফাঁকা কতো বাড়ি, মাঠ-পুকুর ওদিকে স্কুলমাঠ-ভাঙা মন্দির-পরিত্যাক্ত বাড়িঘর-সরকারী অফিস আর ওপাশে খোলামেলা জায়গা, ছিলো পাখিদের কলকাকলিময় সন্ধ্যা, ভোর হতো পাখির ডাকে, দূরের মসজিদের মধুর আজান আর হরেক পাখিদের ডাকে মনে অন্যরকম অনুভূতি জাগতো, সকালটা হয়ে যেতো পবিত্র, বুক ভরে শ্বাস নিতে কষ্ট হতো না, হাওয়ায়-হাওয়ায় মন জুড়িয়ে যেতো, মন হতো উদাসীন। মানুষের সঙ্গে মানুষের কতো ভাব-ভালোবাসা ছিলো, কেউ তো অপর নয়, একে অপরের কতো কাছাকাছি, ওই বাড়ি সেই বাড়ি বলে কোনো কথা ছিলো না, সবাই আপন অথচ আজ কেমন সব ছাড়া-ছাড়া, যেন সবাই দূর দেশের মানুষ, আকরাম বকস নিজের মধ্যে নিজেই যুদ্ধ করে, তার সঙ্গি-সাথীরা সব কোথায়, হয়তো বেঁচে নেই, কিংবা দূর-দূর কোনো আস্তানায়। মানুষ যেন পাখি হয়ে গেছে, মানুষ কি কখনো পাখি হয় ! সময়ের দাড়িপাল্লায় দাঁড়িয়ে মানুষ এখন সব পাখি, কেউই আর দেশে থাকতে চায় না, দূর-দূর দেশে পাড়ি দিচ্ছে সুখের সন্ধানে, বন্ধুত্ব-আত্মীয়তা বলে কোনো খ্যাতির রাখতে কেউই আর চায় না। মূলত সবাই ব্যস্ত, কেউ কাউকে সময় দেবে না।
সন্ধ্যের পর-পর বড় ছেলের বউ কাপড় ঝেড়ে ঝগড়া করেছে একতরফা, বাড়িতে তার গলাটা বেশি, শ্বাশুড়ির সঙ্গে কথা নেই-বার্তা নেই, লেগে যায়, বিষয় যে কি কিছুই জানে না, সেজো ছেলের ছেলেরা মানুষ হলো না কেউ, লোকের দোকানে কাজ করে, বিয়েও করেছে সব ঝগড়াট্টি বস্তি মেয়েদের, এতোগুলো ছেলে আকরাম বকসের কিন্তু তারা কেউই মানুষ হলো না, নাতিগুলোও ওই একই গোয়ালের। আকরাম বকস সবই জানে, কিন্তু কি হবে জেনেই বা, ভাতের মাড়ের মতো ফ্যাকাসে দুটো চোখ, নির্বিকার তাকিয়ে থাকে দূর দিগন্তে, নিজেকে অনেকটা ওই উঠোনের কোণের পাতকুয়াটার মতো মনে হয়, কখন বা সে নিজেই মাটির গভীরে হারিয়ে যাবে।
আজকাল কদাচিৎ বাষট্টির সেই মফঃস্বল শহরের কথা স্মরণে আসে, যখন প্রথম এই শহরে ঘাঁটি বাঁধে, নিরব-নিস্তব্ধ ছোট একটা মাঝারি শহর, সাপ চলা পথের মতো আঁকাবাঁকা সরু সড়ক, দক্ষিণে পদ্মানদী, বিশাল তার শরীর ভয়াবহ গর্জন। আজ নদী মরে গেছে, পদ্মা যেন সাবেককালের একটা খাল, হয়তো কোনদিন সে মরে যাবে, আকরাম বকস রাত্রের অন্ধকারে হারিয়ে যায়, চোখে হাজারো জিজ্ঞাসা, সব প্রশ্নের উত্তর তো তার জানা নেই, স্মৃতি হাতড়ে নিজেকে ভেঙে-ভেঙে নতুন চরের মতো জাগিয়ে তোলে। চর যেন অনেক প্রত্যাশা নিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় ভূমিহীন কৃষককে, কিন্তু কৃষক কি কখনো সে ভূমির অধিকার পায়, নাকি পেয়েছে কোনোকালে, আকরাম বকস অর্নিমেষ তাকিয়ে রাত্রের আকাশের হাজারো তারকার দিকে, আর জোনাকিরা মিটিমিটি আলো ছড়িয়ে দেয় চারদিকে, সে আলোর ভেতর কিসের এক সুরভি পায়, বনতুলসির ঘ্রাণ মাতোয়ারা করে তোলে, অথচ আকাশ এখনো ধীর স্থির হয়ে সেই মুখে হাসি নিয়ে দিগন্তে ছড়িয়ে।
♦♦♦♦♦♦♦♦♦
❤ Support Us