- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- জানুয়ারি ৮, ২০২৩
গ্রহণ

বাবা প্রায়ই বলতো,” যাস নে বাবা।ওদের বিশ্বাস করিস নে।ওরা ভালো মানুষ নয় রে।”
কথাটা কানেই তোলেনি শুভঙ্কর। তার তখন চোখ জোড়া স্বপ্ন।বুক ভরা আশা।এইসব জমিজমা,চাষবাস, ধুলোমাটির গন্ধ একেবারেই ভালো লাগে না তার।এর চেয়ে ঢের ভালো মনে হয় চাকরি।হ্যাঁ,যেমনই হোক একটা চাকরি সে জোগাড় করবে।নিত্যদিন অফিস।ছায়াঘেরা ঘর।মাস গেলে অনেকগুলো টাকা।টাকা জমিয়ে ভাঙাচোরা এই কুঁড়েঘর টাকে সরিয়ে নতুন একখানি ঘর দেবে সে।ইটের দেওয়াল।মাথার ওপর ছাদ।দিনরাত আলো বাতাসের ছড়াছড়ি।
দিবানাথ সরখেল বলেছিল,” সব হবে।সময়টা হতে দে।পার্টির হয়ে কিছুদিন কাজ কর।তুই পার্টিকে দিবি।পার্টি তোকে দেবে।রাজনীতি মানে হল দেওয়া নেওয়ার ব্যাপার।নেওয়াটা পরে।আগে দিতে হয়।”
” কাজটা আমার বড়ো দরকার দিবানাথ দা।এতদূর পড়াশোনা করে এই মাঠ-মাটি,চাষবাস – আমার একদম ভালো লাগে না।”
” কথা যখন দিয়েছি তখন ধরে নে কাজটা তোর হয়েই গেছে।”
” কোন কাজ দিবানাথ দা?”
” সে কী আর এখনই বলতে পারি রে।দেখি কোথায় কী দেওয়া যায়।তবে তার আগে একটা কথা তোকে বলি শোন,এখনই কাজের জন্যে অমন হা ভাতেপনা করলে হবে না।”
” কেন দাদা?”
” ওই যে বললাম দেওয়া নেওয়ার ব্যাপার।আগে কিছুদিন দে।”
দিবানাথ সরখেলের কথায় কেবল দিয়েই চলেছে শুভঙ্কর। মাঠেঘাটে খেটে,গায়ে ধুলো কাদা মেখে বাবা তাকে পড়িয়েছিল ছেলে লেখাপড়া শিখে ভালো মানুষ হবে,বড়ো চাকরি করবে – এই আশায়।সেই ছেলে রাজনীতির জন্যে নিজেকে কেবল দিয়েই চলেছে।বলতে বলতে বাবার মুখে ফেনা উঠে গেলেও ছেলে শোনেনি।বরং দিন দিন যেন আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়েছে রাজনীতির সঙ্গে। বলে বলে ব্যর্থ হয়ে অগত্যা বলা ছেড়েই দিয়েছে বাবা।কেবল মা ই যা মাঝেমধ্যে কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান করে,” ও খোকা,শুনছিস?”
” কিছু বলবে?”
” এসব তুই ছেড়ে দে বাবা।এসব ভালো জিনিস নয় রে।”
” দেবো মা,দেবো।”
” আর কবে দিবি?”
” আগে একটা কাজ হোক।তারপর – “
” তোর বয়সি কত মানুষ বিয়ে – থা করে সংসার করছে,আর তুই – “
” বিয়ে,সংসার – এত উতলা হচ্ছো কেন মা?”
” হবো না?আমাদের বয়স বাড়ছে।কখন কী হয়ে যায়।কত আশা নিয়ে তোর বাবা তোকে লেখাপড়া শেখালো।তুই বড়ো হবি,আয় উন্নতি করবি – কত স্বপ্ন ছিল তোর বাবার।আর তুই কিনা – “
” যা দিনকাল পড়েছে মা তাতে কেবল পড়াশোনা জানলেই চাকরি হয় না।তেমনটা হলে কবেই তো আমার হয়ে যেত।আজ এমন বেকার বাউন্ডুলের মত ঘুরে বেড়াতে হত না “
” কিন্তু এসব করেই বা কী পাবি?”
” যদি কিছু হয় তো এতেই হবে।দিবানাথ দা কথা দিয়েছে – “
” নেতারা অমন কত কথাই দেয়।ওদের কথা বিশ্বাস করতে নেই রে।”
” দিবানাথ দা তেমন মানুষ নয় মা।কতদিন ধরে পঞ্চায়েত প্রধান আছে বলো তো?তেমন হলে কী আর – “
মা বোঝে ছেলে আর ও পথ থেকে ফিরবে না।তাই এক সময় কথা থামিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।তাকিয়ে মেঘ দ্যাখে।মেঘের গায়ে ছড়িয়ে পড়া রোদ দ্যাখে।উড়ে যাওয়া পাখি দ্যাখে।তবে সব থেকে পরিস্কার করে দেখতে পায় বিরাট একটা শূন্যতা।যে শূন্যতা হিংস্র এক চাউনি নিয়ে হা করে চেয়ে থাকে কেবল।এক একটা সময় আচমকাই তাই শিউরে ওঠে মা।
ছেলের চোখ এড়ায় না তা।জিজ্ঞেস করে,” কী হল মা?”
আকাশের দিক থেকে চোখ নামিয়ে ছেলের দিকে তাকায় মা।বলে,” তুই কত বড়ো হয়ে গেছিস শুভ।”
এটুকু কথার মধ্যে যে অনেকখানি কষ্ট লুকিয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারে শুভ।ইদানীং তাই বার বার দিবানাথ সরখেল কে সে বলছিল,” এবার কিন্তু একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতেই হবে দিবানাথ দা।”
দিবানাথ সরখেলও একই উত্তর দিয়ে আসছিল বার বার,” দেবো রে,দেবো।আগে ভোট টা মিটতে দে।”
কালও এভাবেই বলেছিল দিবানাথ সরখেল।তখন সন্ধেবেলার আকাশ আঁধারে ঢাকতে শুরু করেছে।ঝোপঝাড়ের গায়ে গায়ে জ্বলতে শুরু করেছে জোনাকি।মাটির বাসা থেকে মুখ উঁচিয়ে ডাকতে শুরু করেছে ঝিঁঝিঁপোকা।
দিবানাথ সরখেলের কাছারি ঘরটায় তখন গাঁয়ের ছেলে-ছোকরাদের ভীড়।শুভঙ্করের মতই কিছু পাওয়ার আশায় সকলেই পার্টির হয়ে নেমে পড়েছে।দিন-রাত এক করে খাটছে সবাই।পঞ্চায়েত এবারও তাদেরই পেতে হবে।’দিবানাথ দা ‘ কে প্রধান করতে হবে।দিবানাথ সরখেল বলেছে,” যে করেই হোক পঞ্চায়েত কিন্তু আমাদের চাই।না হলে তোদের চাওয়াটাও কিন্তু পূরণ হবে না – এটা মনে রাখিস।”
” এতদিন তো যা করার সবই করেছি দিবানাথ দা।রাত ফুরোলে কালই তো ভোট।আর কী করতে হবে?” জিজ্ঞেস করেছিল শুভঙ্কর।
দিবানাথ সরখেল বলেছিল,” তাও কী আমার বলে দিতে হবে?এতদিন আমার কাছে কাছে থেকে শিখলি কী?”
” সত্যি বলছি দিবানাথ দা,কিছু বুঝছি না।”
” তাহলে শোন,পরিস্থিতি এবার খুব একটা ভালো নয়।বিরোধীরা জান প্রাণ দিয়ে খাটছে।সবাই যদি ঠিকঠাক ভোট দেয় তাহলে রেজাল্ট উল্টে যেতে পারে।তাই – “
” তাই কী দিবানাথ দা?”
” নিতাই – “
একপাশে বসে চুপচাপ আলাপ আলোচনা শুনছিলো নিতাই।দিবানাথ সরখেলের ডাকে সাড়া দিয়ে নিতাই বলেছিল,” হ্যাঁ,বলো।”
” ব্যাপারটা আর কখন বোঝাবি এদের?এসব কাজ কী হুট করে হয়?”
” এই তো দাদা এখনই সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।”
সন্ধে উতরে তখন রাত নেমেছে।কৃষ্ণপক্ষের রাত।গাঢ় আঁধারে চারপাশ মাখামাখি। হাত কতক দূরেও দৃষ্টি চলে না।
বিষয়টা নিতাই ই বুঝিয়ে দিয়েছিল ভালো করে।বলেছিল যে করেই হোক বুথের দখলটা হাতে নিতে হবে।নিজে হাতে ‘ ছাপ্পা ‘ মারতে হবে।আর তাই –
অনেকটা রাতের দিকে বাড়ি ফিরেছিল শুভঙ্কর। সারাটা গ্রাম তখন গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।হালকা হাওয়ায় কেবল গাছেদের পাতা নড়ার শব্দ।নির্জন হয়ে আসছে চারপাশ।
ঘরের দাওয়ায় আধশোয়া হয়ে পিঠটাকে এলিয়ে দিয়ে বসে ছিল মা।তার ফিরতে রাত হলে আজকাল মা এমনি করেই বসে থাকে।যতক্ষণ ছেলে না ফিরছে ততক্ষণ বসে আঁধার দ্যাখে।আঁধারে ঘেরা ঝোপঝাড় দ্যাখে।জোনাকির জ্বলা-নেভা দ্যাখে।তারা ভরা আকাশ দ্যাখে।
শুভঙ্করকে অতখানি রাত করে ফিরতে দেখে মা বলেছিল,” এত রাত হল তোর ফিরতে?জানিস আমার কেমন চিন্তা হচ্ছিলো।”
নিতাইয়ের কথাগুলো শোনার পর থেকে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে পড়েছিল শুভঙ্কর। বেশিকিছু শুনতে তাই একদমই ভালো লাগছিলো না তার।সে তাই বলেছিল,” বড্ডো খিদে পেয়েছে।তাড়াতাড়ি খেতে দাও দেখি।”
মা আর কথা বাড়ায়নি।
তাড়াতাড়ি চাট্টি খেয়ে শুয়ে পড়েছিল শুভঙ্কর। কিন্তু ঘুমোতে পারেনি।আশঙ্কার একটা কালো মেঘ তার মনের আকাশের পুরো দখল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চেতনায়।ভয়ে বার বার শিউরে উঠেছিল সে।
আর তাই আজ যখনই নিতাই বলেছিল,” চল শুরু করি ” তখন শুভঙ্কর বলেছিল,” আমার বড্ডো ভয় করছে নিতাই দা।”
নিতাই বলেছিল,” ভয়?ভয় কীসের শুভ?আর তুই তো একা নোস,আমরা এতগুলো মানুষ – “
” তবুও।”
পিঠে হাত রেখেছিল নিতাই ” কোনও ভয় নেই।আমি তোর পাশে পাশেই থাকবো।”
না,পাশে থাকেনি নিতাই।অতগুলো মানুষ যখন মার মার করতে করতে তাড়া করে আসছিলো তখন নিতাই ই পালিয়ে গিয়েছিল সকলের আগে।পিছু নিয়েছিল অন্যরাও।কেবল ক্ষণিকের জন্যে হলেও থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল শুভঙ্কর। আর আচমকাই ‘ধা’ করে একটা গুলি ছুটে এসে পিঠে বিঁধতেই দিক বিদিক হারিয়ে ছুটতে শুরু করেছিল সেও।ছুটতে ছুটতে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিল উমানাথ বিশ্বাসের এই আমবাগানে।
কতক্ষণ তা ভালো করে মনে নেই।তখন চারপাশে কত শব্দ ছিল।অথচ এখন সব কেমন নির্জন হয়ে আসছে।নৈঃশব্দের চাদরে মুড়ে যাচ্ছে সবকিছু।সারা আমবাগান জুড়ে নেমে আসা হিংস্রতার মাঝে এখনও পড়ে আছে শুভঙ্কর। দুইচোখে পাথরের ভার।গলাটা শুকিয়ে কেমন একটা কেঠো অনুভূতি।
মাথাটা তুলতে গেল শুভঙ্কর। আর ঠিক তখনই আচমকা দূরে কোথায় মায়ের কান্না ভেজা কন্ঠের আর্তি ভরা ডাক,” শুভ,কোথায় গেলি বাবা – “
ভেতরটা কেমন করে উঠলো শুভঙ্করের। বুকের ভেতরে ঠেলে উঠলো একটা কষ্ট। সাড়া দিতে ভীষণ চেষ্টা করলো সে।কিন্তু একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ ছাড়া মুখ দিয়ে বেরোলো না কিছুই।হঠাৎই মনে হল ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তার।কেমন একটা অস্পষ্টতার পর্দা এসে ঘিরে নিচ্ছে তাকে।চোখের সামনে অস্পষ্ট করে কেবল ভেসে উঠছে তাদের বাড়িঘর।ফালি উঠোন।তুলসির চারা।
ফের একবার ডেকে উঠলো মা,” শুভ – “
শেষ কথাটুকু আর শুনতে পেল না শুভঙ্কর। একটা গভীর ঘুম ততক্ষণে তাকে পুরোপুরি গিলে নিয়েছে।
♦♦♦♦♦♦ ♦♦♦♦♦♦
❤ Support Us