- গ | ল্প
- মে ৮, ২০২১
প্রকৃতির পাঠশাল
চিত্র: অভি রায়
“আমি সষ্যের ভুঁইয়ে সেচ দিচ্ছুনু(দিচ্ছিলাম)। বদমাইস ছেলে কুন্ঠে(কোথা) থেকে এসে কাদা ঘাঁটতে লাগল। আমি বুন্নু(বললাম), কী করছিস রে? বুলল, ঘুঘরে পুকা ধরছি। আমি বুন্নু, অ ধরে কী হবে? বুলল, ফান্দের(ফাঁদের) টোপ করে বক ধরব। আমি যেই লুঙ্গি নেংটি মেরে বুন্নু, থাম তোর বক ধরা বার করছি, অমনি মারলো দৌড়। “ কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলল তজিম আলি। তারপর হুফ করে একটা দোম ফেলল। একবার খক করে কাশল। হাতে কোদাল। ঘাড়ের গামছা জোড়পাকড়ে মাথার ফেট্টি। এক পা ঢেলায় আর এক পা কাদায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তজিম। তার বাম কানের লতি আর ঘাড়ের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে লুতফনের কপালের বড় টিপের মতো টকটকে লাল সূর্যটা, পশ্চিম আকাশে থলথল করে ঝুলছে। লুতফন বিয়ে-সাদিতে এরকম লাল টিপ দেয় কপালে। ‘তাহলে কি জুব্বাতের পগারেই আছে? বাছুরটাও তো বাড়িতে নিয়ে যায়নি। যাই দেখি’ বলেই জুব্বাতের পগারের দিকে হাঁটা দিল লুতফন। লুতফনকে দেখেই পানসে লাল রঙের বাছুরটা হাম্বা করে উঠল। দিঘড়ির দড়িটা কেশে ঘাসের ঝোড়টায় পাক বেঁধে বেঁধে আধখানা হয়ে গেছে। দড়ির সেই বৃত্তের ঘাস খেয়ে খেয়ে জায়গাটা লাল করে দিয়েছে বাছুরটা। খুঁটিটাও নড়বড়ে হয়ে কোন রকমে আটকে আছে। দড়িটা কেশে ঘাসের ঝোড়টায় পাক না বাঁধলে হয়ত এতক্ষণে খুঁটিটা উপড়ে যেত। তারপর পাশে মোজামের জমিতে ঢুকে বাঁধাকপি খেত। তখন মোজাম বাছুরটাকে ধরে হুমকি দিত, আজ খোঁয়াড়ে দিয়েই দেব। তখন তার সে কি পাঁয়তারা! অন্যদিন এতক্ষণে মিরাজুল বাছুরটাকে সাথে করে বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু আজ সে বেলা পেরিয়ে সন্ধ্যে হতে চলল তবুও মিরাজুলের পাত্তা নেই। ছোঁড়াটা সেই যে ‘বাছুর দিঘড়ি দিতে গেনু(গেলাম)’ বলে বেরিয়েছে আর বাড়ি ফেরার নাম নেই। জুব্বাতের পগারেই গরু চরাচ্ছিল হাসেম। লুতফন তাকে দেখতে পেয়েই জিজ্ঞেস করল, “মিরাজুলকে দেখেছ গ?”
“সে তো কুন বিহেন ব্যালায় দেখেছিনু(দেখেছিলাম)। বটতলায় বটের ঝুরি ধরে ঝালঝুপ্পা খেলছিল। আর তো দেখিনি?“ সকালের খোঁজ দিল হাসেম। কিন্তু এখন কি আর সকাল আছে? আসর(বিকেলের নামাজ) কাবার হয়ে মাগরিবের(সন্ধ্যার নামাজ) ওয়াক্ত(সময়) হল বলে। হাসেম যখন মিরাজুলকে বটতলায় দেখেছিল মিরাজুল তখন বটগাছটার ঝুরিগুলো ঝুটি খুলে নেমেছে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে চোখ ফেড়ে তাকিয়ে কীসব দেখছিল। তার খুঁটল ঘুলঘুলি চোখে দুনিয়ার বিস্ময়। তারপর ঝুরিটা ধরে ঝুল খেলেছিল। তার সেই ঝুলন্ত গায়ে ঝিলিক মেরে পড়ছিল ডালপালা লতাপাতার ফাঁকফোকর দিয়ে ছিটকে আসা রোদ। তারপর মনে কিছু একটা দুষ্টুমি উঁকি দিতেই ঝুরিটা ধরেই তিড়বিড় করে বটগাছটায় উঠে পড়েছিল সে। গুঁড়ির ওপরের গাব্দা ডালটার খুঁটলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল হাত। তারপর পড়পড় করে বের করেছিল একটা হরিয়াল পাখি। তার চোখে তখন যুদ্ধজয়ের হাসি। বৃষ্টিডোবার মাঠে তখন পাকা ধানে কার্তিকের রোদ লেগে সে রোদও সোনা রঙ হয়ে উঠছিল। আর সে রোদ যখন ডুমনির পগারে গাব গাছটার লম্বা সতরের ছায়া ফেলে আড়মোড়া ভেঙে আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছিল ঘুমের আবেশ সেই কোন সক্কালে বাড়ির পাটকাঠির ঝাঁপিটা খুলে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিল মিরাজুল। তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল তার টৈ টৈ দিন। বটগাছটার ডালে ডালে হরেক পাখির কিচিরমিচির। একটা দোয়েল সুর করে গান করছিল। নীচের ঝোপ থেকে ফড়ফড় করে উড়ে গেছিল একটা লবরুল পাখি। মিরাজুল আচমকা বাঁদরের মতো তিড়িং করে লাফ মেরেছিল নীচে। বটগাছ না হয়ে যদি এটা নিমগাছ বা কদম গাছ হত তাহলে মিরাজুল বুক ঠেসে সড়সড় করে নামত। তাতে তার উদম গায়ে ছাল বাকলের আঁচড় লাগত। সে জন্যে মায়ের কাছে যাচ্ছে তাই বকুনিও খেত। মা ঠাস ঠাস করে দু চড় লাগিয়েও দিত। অথবা গরু চরানো পান্ঠিটা দিয়ে দু এক ঘা দিত পিঠে। সে পান্ঠির ঘা কতবার খেয়েছে মিরাজুল। তার তেঁতুল বিচির মতো রঙের গায়ে লাল কালশিটে দাগ পড়ে যেত। পরে আবার সেই মা’ই পেটের ছেলের কষ্ট দেখে সরষে তেল গরম করে লাগিয়ে দিত পিঠে।
জুব্বাতের পগার থেকে নামুতে(নীচে) নামল লুতফন। তার আগে দিঘড়ির খুঁটিটাকে ঠক ঠক করে ঠেকনার ঘা দিয়ে গাব্দা করে পুঁতে দিল যাতে গায়ের সব বল দিয়েও আর উপড়াতে না পারে বাছুরটা। ঢালু আল বেয়ে চলে এল বৃষ্টিডোবার মাঠে। বর্ষায় এ মাঠ ডুবে থাকে। আর ভরা বর্ষায় তো ডুবে আস্ত একটা বিল হয়ে যায়। মাঠ জুড়ে পাকা ধান ঝলমল ঝলমল করছে। মনে হচ্ছে কানে সোনার দুল লাগিয়ে খিলখিল করে হাসছে আমন ধান। ধান কাটছে ইসলাম সেখ। কাঁচি দিয়ে ধান কাটার ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ শব্দ আছাড়পাছাড় খেয়ে তড়পাচ্ছে। লুতফন তাকেই শুধাল, “মিরাজুলকে এদিকে দেখেছ গ?” ইসলাম বলল, “মুন্টুর ছ্যালোতে(স্যালোতে) পানি খাতে একবার দেখেছিনু। কিন্তুক সে তো কুন দুফুর(দুপুর) ব্যালায়। আর তো ইদিক পাণে দেখতে পাইনি।”
স্যালো মেশিনের নলের মুখে মুখ লাগিয়ে জল পান করেছিল মিরাজুল। জল খেয়ে পেটটাকে একেবারে ঢুলিপাড়ার চন্দন ঢুলির ঢোল করে ফেলেছিল। তারপর এক গাল জল মুখে পুরে কুলকুচি করেছিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে যখন দেখেছিল আশপাশে কেউ নেই তখন সে নলের যে মুখ দিয়ে গলগল করে জল বের হচ্ছিল জলের সে মুখে একটা কঞ্চি গায়ের বল দিয়ে ধরে সে জলধারাকে ফেড়ে দু ভাগ করে দিয়েছিল। আর যখন সে ফাঁড়া জলধারা দুভাগ হয়ে আরও দূরে ছিটকে পড়ছিল তখন খিখি করে দুষ্টু হাসি হেসেছিল মিরাজুল। তখন আরও জোরে গ গ করে ডেকে উঠেছিল স্যালো মেশিনটা। তাতেও দমেনি মিরাজুল। মেশিন হাওয়া টানছে বলে টিউবয়েলের গোঁড়ার কাদাটাকে আরও ভালো করে লেপে দিয়েছিল। শেষে নলের মুখ থেকে গলগল করে বেরোনো জলে মাথা চুবড়িয়ে স্নান করেছিল। তারপর পরনের ভেজা স্যান্ডো গেঞ্জিটাকে হাতে ওড়াতে ওড়াতে একটা হট্টিটি পাখির পিছু পিছু ঠ্যাং ঠেঙিয়ে দৌড়েছিল জোলের দিকে। সে গায়ের জল গায়েই শুকিয়ে গেছিল। পরনের হাফ প্যান্টটা শুকিয়েছিল পরনেই। এঁটেল মাটির মতো তার গায়ের রঙ। আঙুল ঘষটালে খস্কা দাগ পড়ে। এসময় উত্তরে খসখসে হাওয়া টানলে তার গায়ের চামড়া সাপের খোলসের মতো ফেটে যায়। ধানি জমির আল দিয়ে যখন সে হাঁটছিল তখন তার মাথাটা ধান গাছের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছিল। গায়ে ঠেকছিল পাকার ধানের শিষ। ধানের সে হুলে তার খোলা গা কুটকুট করেছিল। পাখির নেশায় সেসব খেয়াল করেনি মিরাজুল। তারপর তাকে শেষ দেখেছিল রহিম ন্যাংড়া, ছাপাতুল্লার ডারায় ছৌচকর্ম করতে। রহিম ন্যাংড়া সেখানে গরুর গা ধোয়াচ্ছিল।
বৃষ্টিডোবার মাঠ থেকে এদিক ওদিক চোখ ফেলে তাকাল লুতফন। দূরে নলডুবরির বিলে কয়েকজনকে কাদা ছেকে মাছ ধরতে দেখা গেল। কেউ জল ছেকছে কেউ মাছ ধরছে। আবার কারও হাতে বিত্তি কারও হাতে ফাঁস জাল আবার কারও হাতে পচকা। কিন্তু তাদের আঁকার আকৃতি ছাপড়ানো কুঁচকানো দেখে লুতফন আন্দাজ করল, ওরা বয়স্ক লোক। তবে কি খসেদের কলাবাগানে ঢুকে আছে মিরাজুল? ভাবল লুতফন। লতফন জানে, তার বিচ্চু বেটা মাঠে গরু দিঘড়ি দিতে আসার সময় বা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় খসেদের কলাবাগানে ঢুকে কলার কাদি থেকে ডাগর কলা ছাড়িয়ে মাটিতে পুঁতে রাখে। তারপর একদিন দুদিন পর সে পোঁতা কলা মাটি থেকে তুলে চুরি করে খায়। কিন্তু এখন সে কলাবাগানে থাকবে কী করে? এই তো কিছুক্ষণ হল খসেদ কলাবাগান থেকে কলা কেটে নিয়ে বাড়ি এল। তবে কি ও জোলের ডুমনিতে মাছ ধরছে? ছোঁড়া মাছ পেলে কাদার সাথে লেপ্টে যায়। ভাবল লুতফন। মাছধরার কথা ভেবে ডুমনির দিকে পা বাড়াল লুতফন। এদিকে সূর্য ডুববো ডুববো করছে। সিঁদুর রাঙাতে শুরু করে দিয়েছে পশ্চিমের আকাশ। লুতফনের খড়ি-লড়ি শরীরের ওপর আলুথালু শাড়িটায় ছিটকে পড়ছে সে লালাভ হলুদ আলো। তার গোল মুখটা শুকনো পাকুড় পাতা হয়ে উঠছে। উচ্ছে ফালি চোখে দুশ্চিন্তার নহর। স্কুলটা খোলা থাকলে ছেলেটা এত বেয়ারা হত না! একটা বন্ধনে বাঁধা থাকত। মনে মনে স্কুলের ঘাড়ে দোষ চাপাল লুতফন। সে এখন মাঝেসাজেই বলতে শুরু করে দিয়েছে, ‘এসব সরকারের ফন্দি যাতে করে গরিবদের ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া না হয়। মূর্খের বেটা মূর্খই থাক। আঙুল তুলে কথা তো বলতে পারবে না? লেখাপড়া শিখে চোখ খুলে গেলে যে বড়লোকদের বিপদ। তখন যে ওরা নিজের ন্যায্য হক বুঝিয়ে নেবে? চাকরি চায়বে। রোজগার চায়বে। তার চেয়ে ওদেরকে মূর্খ করে রাখ ওতেই সুবিধা। তা নাহলে দুনিয়ায় সব খুলে গেল আর স্কুল খুলল না! হাট খোলা বাজার খোলা বাসে-ট্রেকারে বাঁদর ঝুলা ঝুলে লোক যাচ্ছে নেতা-মন্ত্রীদের মিটিং মজলিস হচ্ছে মাঠ উপচে পথ উপচে, তাতে দোষ নেই। যত দোষ ওই গরিবের ছেলে-মেয়েদের ইস্কুল খুললেই! যেন দুনিয়া এক দিনেই উল্টে যাবে! অতই ফকেটিয়া নাকি? এখনও রোজকিয়ামতের সময় আসেনি । এখনও দুনিয়ায় অনেক আল্লাহবাল্লাহ লোক আছে।
লুতফন একবার স্কুলে মিড ডে মিলের চাল আলু ছোলা সাবান নেওয়ার সময় মাস্টারদের জিজ্ঞেস করেছিল, ‘স্কুল কবে খুলবেন গ মাস্টার? ছেলেগুলো সব বেয়ারা হয়ে গেল!’ প্রধান শিক্ষক গৌতমবাবু বলেছিলেন, ‘ওসব কি আমাদের হাতে যে খুলব? আমাদের কিচ্ছু করার নেই। আমরা হলেম সরকারের চাকর। সরকার অর্ডার দিলেই খুলে দেব।‘ লুতফন বলেছিল, ‘আপনারা খোলেন, আমরা ছেলে পাঠাচ্ছি।‘ গৌতমবাবু তখন বলেছিলেন, ‘আপনার কথা শুনে কি আমরা চাকরি খোয়াব? অর্ডারের বাইরে আমরা কিচ্ছু করতে পারব না। আমাদের হাত-পা বাঁধা।‘ তখন লুতফন বিড়বিড় করে বলেছিল, ‘আপনারা খুলবেন কেন? আপনাদের তো ভালোই হচ্ছে, বাড়িতে বসে বসে বেতন পাচ্ছেন। বউ ছেলে নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। আপনাদের ছেলে-মেয়েরা অনলাইনে ঠিকই লেখাপড়া করছে। গরিব মরলে আপনাদের কী।’
ছ-মাস হতে চলল ছেলেটার কোন স্কুল টিস্কুল নেই। সারাদিন মাঠঘাট বনবাদাড় আগার পগারে টৈ টৈ করে বেড়ায়। নতুন পড়া তো দূরের কথা এতদিন যা শিখেছিল তাও ভুলে কোথায় চলে গেল। এমনিতেই পড়াশোনাতে ভাড়ুল গাছ। অ বলতে বললে বলে খ। গাছ বললে মাছ বলে। কী আর হবে মুনিশেরর বেটা মুনিশই হবে। বলে লুতফন। বৃষ্টিডোবার মাঠ থেকে লুটাহারার মাঠে গেল লুতফন। সেখানকার আল ডাঙ্গা খুঁজল। পরে আঁশঘাটির ডারায় গেল। যারা ছিপ ফেলে মাছ ধরছিল ডারায় তাদেরকে জিজ্ঞেস করল। তারা কোন হদিশ দিতে পারল না। লুতফন এবার ঢনঢনির মাঠে নামল। সন্ধ্যা তখন ধানের শিষে চুমু খেতে শুরু করেছে। ফিনফিনে কোয়াশায় মুখ ঢাকছে। পুরো মাঠ জুড়ে নামছে হেমন্তের জাড়। লুতফনের দুশ্চিন্তা এবার হাড়ে ঠক ঠকাচ্ছে। তবে কি মিরাজুল নলডুবরির বিলে হেলু খেলতে গিয়ে ডুবে গেল! না আমার ওপর অভিমান করে স্বরূপপুরে নানি বাড়ি চলে গেল! গতকাল ওভাবে মারা আমার ঠিক হয়নি। লুতফন গতকাল মিরাজুলকে দু গাদন দিয়েছিল। মিরাজুল পাশের বাড়ির তৌসিফের গায়ে কাদা মাখিয়ে দিয়েছিল। সে নিয়ে তৌসিফের মা রূপা ছোটবড় কথা শুনিয়ে লুতফনের গিল্লা করে গেছিল। তা আর সহ্য হয়নি লুতফনের। সে রাগ সে ছেলের ওপরে তুলেছিল। পড়াশোনা তো উচ্ছেন্নে গেলই এবার ছেলেটাই না দুনিয়া ছাড়া হয়! ভেতরটা থক করে উঠল লুতফনের। যতই হোক মায়ের মন দুরুদুরু তো করবেই। লুতফন এখন ছেলের এই বেয়াড়া হওয়ার জন্যে সরকারকে প্রায়শই গালিগালাজ করে। তার হক কথা, ‘আল্লা দুনিয়ায় যে অসুখ দেন তার ওষুধও ঠিক দিয়ে থন। মানুষকে শুধু খুঁজে নিতে হয়। ওর জন্যে জান-জীবন বন্ধ করে রাখলে হবে? দুনিয়ায় কোন অসুখটা এল আর চলে গেল? আল্লাহর দেওয়া সব অসুখই দুনিয়ায় থেকে গেছে। শুধু তার কামড়ের বিষ কমেছে এই যা।‘ হেলথ সেন্টারের আশা দিদিমণি যেই বলেছিলেন, ‘ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত মনে হয় স্কুল খুলবে না’ অমনি লুতফন খ্যাঁক করে উঠেছিল, ‘ভ্যাকসিন যদি এ জনমে না আসে? তাহলে কি আমাদের ছেলে-মেয়েগুলোর লেখাপড়া হবে না? বড়লোকদের বেলায় তো ঠিকই হচ্ছে? বাড়িতে বসে বসে নেটে সব শিখে নিচ্ছে। মরছি আমরাই।‘
লুতফন নিজেও অকাট মূর্খ। দু পাতা লেখাপড়া জানা থাকলে সে বাড়িতে ছেলেটাকে একটু দেখিয়ে দিতে পারত। রাজমিস্ত্রির জোগাড় বাপটাও কোনদিন স্কুলের তিন সীমনায় পা দেয়নি। তারপরে রুটিরুজির সন্ধানে সম্বচ্ছর ভিন রাজ্যেই পড়ে থাকে। এই তো করোনার লকডাউনে টানা তিনমাস বাড়ি ফিরতে পেরেছিল না। পরে গুচ্ছের টাকা খরচ করে গাড়ি ভাড়া করে যখন বাড়ি ফিরল তখন দেশে কোন কাজ নেই। মাসখানেক বাড়িতে বেকার বসে খেয়ে আবারও রোজগারের তাগিদে কেরালা পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে। মাসের শুরুতে একদিন মিড ডে মিলের চাল ডাল নেওয়ার সময় আশিস মাস্টার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী রে মিরাজুল, বাড়িতে বইটই খুলেছিস?’ মিরাজুল উত্তর দিয়েছিল, ‘না স্যার।‘ দাঁত কেলিয়ে খ্যাঁক করে হেসেছিল তপন মাস্টার। কিন্তু আশিস স্যারের চোখ ছলছল করে উঠেছিল। মনে মনে দুঃখ করেছিলেন, ছেলে-মেয়েগুলো সব শেষ হয়ে গেল! আশিস মাস্টার ধরেই নিয়েছেন, টানা ছ মাস বইয়ের সঙ্গে যোগ নেই মানে এতদিন যা দাঁত ভেঙে কলম ভেঙে এট্টুআট্টু শিখেছে মিরাজুল তা তো ভুলে যাবেই উল্টে বইয়ের পাতার অক্ষরগুলোকে তার মনে হবে মাটির ঢেলা ছিমড়ি মাছ ঘুঘুর বাসা ঘূঁঘরে পোকা ফড়িঙ প্রজাপতি অথবা পদ্মর বিচি প্যাটাঙ্গার ফল শালুক ফুল। কিম্বা ভ্যান্না পাতার বাঁশি তল্লা বাঁশের পটকা বাবলা ডালের ছিটকেনি কাগজের নৌকো পেপার ছেঁড়ার ঘুড়ি। আশিস মাস্টার যেই বলেন, ‘শুধু ওসবে পড়ে থাকলে হবে? বইয়ের পড়াও শিখতে হবে, মিরাজুল। তা নাহলে কী করে মানুষ হবি?’ মিরাজুল তখন মায়ের কথাটা বলে স্যারকে, ‘ মা বলেছে, আমার যা মাথা বইয়ের পড়া শিখে কিচ্ছু হবে না স্যার, ওই মাঠ ঘাট ডহর নহর ধুলো কাদাই পেটের ভাত দেবে।‘ এত পাকা কথা শুনে আশিস মাস্টারের চোখ কপালে উঠে গেছিল! তখন তার তপন মাস্টারের কথাটা মনে পড়ে গেছিল। মিরাজুলকে অফ টাইমে একটু হাতে ধরে পড়া শেখালে তপন মাস্টার ঠেস মেরে বলেন, ‘ওসব ভুষিতে মলন মাড়াই হচ্ছে আপনার, ফলন কিছুই পাওয়া যাবে না।‘ তবুও হৃদয় দিয়ে চেষ্টা করেন আশিস মাস্টার। ভাবেন, গরিব মানুষের ছেলে, একটু দেখিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। আমরা দেখাব না তো কে দেখাবেন? এদের জন্যেই তো সরকার আমাদেরকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বেতন দেন?
নলডুবরির বিলের দিকে যখন নামল লুতফন তখন রাঙা দিগন্ত টকটকে লাল সূর্যটাকে আধখানা গিলে নিয়েছে। পুবের আকাশে একটু একটু করে হিজাব মেলছে অন্ধকার। একটু পরেই ঝুপ করে নেমে আসবে রাত। এমনিতেই হেমন্তের দিন হুস করে চলে যায়। একখানা বেলা যেন পুনখানা হয়ে যায়। তারপর লম্বা সতর বিছিয়ে চলে ধান মাড়ার রাত। বিঘে ধান মেড়েও যেন সে রাত এতটুকুও কমে না। বিলের ওপর ফুটে থাকা শালুক ফুল আর কচুরিপানার সাদা বেগুনি ফুলের ওপর পশ্চিমের রক্তাভ রঙ পড়ে বিলটাকে বেহেশতের উদ্যান করে তুলছে। লুতফন মনে মনে বলল, এক্ষনি মসজিদে মাগরিবের আযান পড়বে আর তার সঙ্গে সঙ্গে আসমান থেকে এই বিলের সুঘ্রাণ নিতে নেমে আসবে ফেরেশতারা। লুতফন আধো আলো আধো ঝুঝকিতে মিটমিটে চোখ খুঁটে জরিপ করল বিলের এপাশ ওপাশ। আল বিল। শুকনো পচা কচুরিপানার স্তুপগুলোকে ভালো করে হাংলিয়ে দেখল। গলা ছেড়ে একবার হাঁকও ছাড়ল, ‘মিরাজুল আছিস?’ কিন্তু কোত্থাও মিরাজুলের টিকি দেখতে পেল না। তারপর জুলমাতের আধমানুষ লম্বা ধানের ভুঁইয়ের আড়াল দিয়ে দেখল পগারে আকাশ সোজা বেড়ে ওঠা তালগাছটার তলায় কে একজন যেন দাঁড়িয়ে আছে! গড়ন উচ্চতা দেখে মনে হচ্ছে বড়সড় কোন মানুষ নয়, ছেলেমানুষ। খুদুর বেটা খাইরুল নয় তো? ছোঁড়া আবার বাপের মতন রাতেও ভুঁই নিড়ায়। তবুও ছেলেমানুষের আদল দেখে লুতফনের ভেতরটা ধেই করে উঠল। আল দিয়ে গডগড করে পা চালাল সে। খুদুর শিমের ভুঁইয়ের আল ডিঙিয়ে যখন পগারে উঠল লুতফন তখন চোখ বড় করে যা দেখল তাতে তার অন্তরটা যেমন খিলখিল করে উঠল তেমনি সে অন্তরের কোন এক কোণে একটা রাগও ফোঁস করে উঠল। মন বলল, কচার ডাল দিয়ে পিঠে আগে দু সাট দিয়েই দিই। কিন্তু কাদা ধুলো মাখা নেঙ্গুট গা আর রোদ পোড়া চামটা মুখটা দেখে তার মায়ের অন্তরটা গলে গেল। মনে মনে বলল, বাপের কোল ছাড়া স্কুল ছুট ছেলেটা ধুলো কাদা মেখে পাখি পোকা বুন জঙ্গল রৈদ পানি শিখবে না তো কী শিখবে? আমারও কি আর অত সময় আছে যে সব সময় তৌখিদ করব। খিলখিল করা চোখ ছলছল করে উঠল লুতফনের। লুতফন তালগাছের গুঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। তখনও মায়ের উপস্থিতি টের পায়নি মিরাজুল। তালগাছের মটকার ডালে তখন ঠিকরে পড়ছে দিনের শেষ আলো। মিরাজুল তখনও বিভোর হয়ে তালগাছটার দিকে তাকিয়ে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দেখছে, একটা বাবুই পাখি কীভাবে তার বাসা বোনাচ্ছে !
❤ Support Us