- ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
- মে ৫, ২০২৪
কবিতার মনোবাসীর খোঁজে। পর্ব ১৯

শিল্পকর্ম: পাবলো পিকাসো
বালক অথবা সাবালক কবিকে নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা
কথার ওপর কথা বাজে, গরমে জলাজমির উত্যক্ত, তাড়িত পুঁটির মতো খই ফোটে কন্ঠে, আলাপ চলতে থাকে, কেবল আড্ডায় নয়, নিভৃতের ভিতরে, বাইরেও নির্মিত হয় সংলাপ, অসংলগ্ন শব্দ, অসংলগ্ন স্থাপত্য, কবিতার দীর্ঘ স্তবক, দীর্ঘ শিরোনাম, বিরতি চিহ্নে হেথায় হোথায় আত্মঘাতী ঝোঁক, বিশৃঙ্খল, নিয়মহীন, অথচ অনুভূতির তীক্ষ্ণতা, অনুচ্চারিত নিঃসঙ্গমগ্নতা, অনুপ্রাসহীন, বিশেষহীন কটাক্ষ, সাংকেতিক বিদ্রোহ দিয়ে ভাবিয়ে তুললেন একজন আত্মস্থ কবি। প্রায়ই খামে ভরা তাঁর কবিতা আসে আমাদের দফতরে। স্পেস নেই, সব ছাপানো যায় না, সম্মোহিত আমি, পড়তে থাকি কবিকে, পড়তে পড়তে স্তম্ভিত।
একদিন বিকেলে, অস্তাচলের মুহূর্তে ফোন করলাম, গোলাম রসুলের সঙ্গে কথা বলতে চাই। ওপার থেকে ভেসে এলেন স্বয়ং কবি— আমিই গোলাম রসুল। ওই যে, স্বাভাবিক পরিচিতি জড়িয়ে শুরু হল সহযাপন, সে খরস্রোত এখনো বইছে, নৌকা আসে যায়, বন্ধুত্ব রং পাল্টায়, অবাক হয়ে দেখি, বহু কবির বিশ্লেষণ প্রীতি, অতিশয় সময়াসশক্তিতে বিরক্ত বোধ করি।
১৬ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ,প্রথম ফোনালাপে চমকে দিয়েছিলেন গোলাম রসুল। বলেছিলাম, কি করছেন? বললেন, স্কুল থেকে ফেরার পথে পুকুরে ঢিল ছুঁড়ছি, জলে ঢেউ উঠছে, ঢেউয়ের সঙ্গে তাল ভাঙ্গার খেলায় আমার চারিদিকে পুকুর পাড়ে ধ্বস নামছে। সেদিনই বুঝতে পারি, প্রত্যাশিত বিকল্পের খোঁজ মিলেছে। হবে। এর সঙ্গে ওঠা- বসা, স্বতঃস্ফূর্ত নৃত্যমঞ্চেও পা রাখা দরকার। পরে, ওর দুটি সংকলন ‘বালকের বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা’ আর ‘আরেকটি গল্প হয়ে উঠুক’ ‘আরম্ভ পাবলিশার্স ‘ থেকে বের হয়। বালকের কয়েক পৃষ্ঠা এর মুখবন্ধে নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করতে হল আমাকে, ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার আরেক পুরুষ, যাঁর পুর্বআভা আমাদের পড়বার সুযোগ হয়েছে, র্যাবো, মালার্মে, ভেলারিন, ভাস্কো পোপা, নীলমণি ফুকন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তুষার রায়, তুষার চৌধুরীর মতো লিখিয়ে আঁকিয়েদের কবিতায়। ভ্যান গঘ, পিকাসো, রদ্যাঁ, রামকিঙ্কর, প্রকাশ কর্মকার, এস এম সুলতান আর কামরুল হাসানের ভাস্কর্য চিত্রলিপিতেও । প্রসঙ্গত বলা জরুরি, শিল্প বিপ্লবের পর থেকে ইউরোপীয় কবি শিল্পীদের মধ্যে পাগলপনার ভেতরে শৃঙ্খলাহীন, শৃঙ্খলার উদ্ভাস দেখেছি আমরা, প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় মহাসমরের পরের এক স্তর থেকে আরেক স্তরেও ঘন জঙ্গলের রাজাধিরাজরা বেরিয়ে এসেছেন নাগরিকতা বোধের শূন্যতায় । ফসল ফলিয়েছেন আঙ্গুলের ডগায় । খরা কিংবা ধূসর হেমন্তে । দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি, গোলাম রসুল এদেরই সমগোত্রীয়, অবিশ্বাসী, অনানুশাসিত, সৃজনশীল বিদ্রোহী। তাঁকে নিয়ে ভাবা দরকার। জরুরি তাঁর নৈরাজ্যিক ভাষারীতি আর অনুভুতিময়তার সংলগ্ন অসংলগ্নের অধ্যয়ন। বড়ো কবি । ওজন অসামান্য। যাযাবর। কখন কোথায় থাকেন, জেনেও বলতে গিয়ে আটকে যায়, ছড়িয়ে যায় বাচনভনঙ্গি।
কবিতার মুহূর্তে, তাঁর অন্তরে বাইরের আচরনে কী কী ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়, তাঁকে কী উদ্বুদ্ধ, উত্তেজিত করে তোলে কোনো মনোবাসী, মিল অন্তমিল, ছন্দের নির্মাণ আর বিধিভঙ্গে আসক্ত, না অনাসক্ত জানতে চেয়ে সাতটি প্রশ্ন করি। সরাসরি উত্তর দেননি, অলিখিত জবাবে চিৎকার জুড়ে দিয়ে জানিয়েছেন— শব্দ, ছন্দ, অনুপ্রাস, বাক্যরীতি, প্রেরণা ইত্যাদিকে একদম আমল দিই না, বাস করি স্বতন্ত্র জগতে, সময় ভাবায় না, ভাবিয়ে তোলে সময়ের গহীনে লুকিয়ে থাকা অথবা ডুবুডুবু নিঃস্ময়।
বাহার উদ্দিন
৫.৫.২০২৪

চিত্রকর্ম: দেব সরকার
গোলাম রসুল
পাহারায় নিযুত নক্ষত্র আর চাঁদ
শোনো
আমার বাবার কবর আমি বিক্রি করব না
নিযুত নক্ষত্র আর চাঁদকে করে রাখব পাহারাদার
আমার বাবা আর আমি গরুর গাড়ি করে নিয়ে যাব হাড়গোড় গুলো
মহাশূন্যে গিয়ে যখন পৌঁছুব
আর সেটা হবে একটা কমেডি
তুমি কি মনে করতে পারছ
যখন আমাদের দেশ ভাগ হয়েছিল তখন কবরগুলোর স্থানান্তর নিয়ে
একটি প্রস্তাব পঠিত হয়েছিল
কিছুটা হাত সাফাই হল
আর বেরিয়ে গেল আকাশ পুষ্প মেঘদল
এখন আমাদের শৈশবের কিছু অভিজ্ঞ চাষির দল
তাদের ঘরবাড়ি খড়কুটো হাঁস মুরগি
নগ্নদেহে রঙ মাখছে
আমাদের দেখা আদিম নৃবাসীদের
তাদের লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত হানছে অটোমোবাইল
দেখ আমরা তো সময়ের শহিদ ক্রীতদাস
মুহূর্তের পরমাণু
আমি ভাবছি মানুষের কথা
মানুষ যেন ভাগ না হয়
আমি পাহারায় নিযুত নক্ষত্র আর চাঁদকে

চিত্রকর্ম: পাবলো পিকাসো
আশ্চর্য পরমাণু
আমার বাবার পদবীকে আমি প্রত্যাখ্যান করেছি
আমার বাবার আর আমার দূরত্ব কম নয় মহাশূন্যের দূরত্বের চেয়ে বেশি
তাই
আমি উচ্ছেদ করব আমার ভাড়াটিয়া কল্পনাকে
তার পরিবর্তে আজ রাতে আমি নক্ষত্রদের বাৎসরিক উৎসব দেখব
আমি দেখব চাঁদ কীভাবে হেঁয়ালি করছে সমুদ্রফেনায়
বিবাহিত বহির্ভূত বাতাস ঢেউ খেলে যায় সমান্তরাল
শ্বেত উদ্বেগে
যার দৃষ্টি জেগে ওঠে মহাশূন্যের স্তনযুগল থেকে
প্রতিটি মানুষ মরার সময় একবার করে হত্যা করে যায় মানুষের মেঘ আর পৃথিবীকে
আবার পৃথিবীর পুনর্জন্ম হয়
আমি মধ্যরাতের হিসাবরক্ষক
ঋণ নেব আকাশের ঠোঁট থেকে
আমি ব্যবসা করব নভোচারীদের সঙ্গে
আর যদি পৃথিবী হত একটি বেহালা নির্মাতার দোকান
আমি একটি বেহালা কিনে নিয়ে বাজাতাম
সুরের ওপর ঝরে পড়ত পরমাণু
এখন বলো কেন লিখব পদবি
আমি তো আশ্চর্য পরমাণু
পরিগৃহীত যে রূপ আমার
সে রূপ তোমার তো
•♦• •♦• •♦• •♦•
❤ Support Us