- ক | বি | তা রোব-e-বর্ণ
- জানুয়ারি ২১, ২০২৪
কবিতার মনোবাসীর খোঁজে।পর্ব ৮

চিত্রকর্ম: রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়
ঢেউ তোলে তির্যক
কবিতায়, প্রবন্ধে, কবিতার অনুবাদে ছড়িয়ে আছেন বাংলাভাষার অন্যতম গুণী কবি জিললুর রহমান, জন্ম,১৯৬৬ সালে, চট্টগ্রামে। পেশায় চিকিৎসক, নান্দনিক গৃহকর্মেও চিকিৎসা পরিষেবার মতো তাঁর নৈপুন্য,তাঁর মুন্সিয়ানা সূক্ষ্ম, সুগভীর। আংশিক নয়, সর্বক্ষণের অখণ্ড কবি। চিকিৎসা শাস্ত্র যেরকম, নন্দনতত্ত্বও তাঁর মননকর্মের বিষয়। কবিতা, প্রবন্ধ, চিকিৎসা বিদ্যা, অনুবাদ আর অনলাইন গ্রন্থ নিয়ে জিললুরের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২২। বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রবন্ধ ৭৭, যা দেশে বিদেশে প্রকাশিত, সমাদৃত। জিললুরের সহজ- সরল উচ্চারণের আড়ালে যে গম্ভীর, যে রহস্যময়তা জাগ্রত- সে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় র্্যাঁবো- মালার্মের আবহকে, জানতে আর শিখতে বাধ্য করে যে, যাকে আমরা অসংলগ্ন, বিচ্ছিন্ন চিন্তা মনে করি, যুক্তিহীনতা ভেবে উড়িয়ে দিই, তার নেপথ্যে, শব্দ ব্যবহারের পেছনে, বাকপ্রতিমা অথবা রুপকল্প নির্মাণে এরকমই ছায়াময় বাস করে, যাকে দেখা যায় না, ছোঁওয়া যায় না, হঠাৎ ঢেউ তোলে তির্যক অনুভূতিতে। জিললুরের কবিতার এ স্বভাবধর্ম, গহীন স্বর, কখনো নির্জনতার আগুনে দগ্ধ, অর্ধদগ্ধ, কখনো অনুচ্চ, সংযত আর ঋদ্ধ কলরব মুগ্ধ করে দেয় আমাদের। তাঁর কন্ঠধ্বনিতে শক্তিমান মেধাবির পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। আরম্ভর প্রতিটি প্রশ্নের সাবলীল, সংক্ষিপ্ত, লিখিত উত্তর দিয়েছেন জিল্লুর। আমরা কৃতজ্ঞ।
সম্পাদক। ২১.১.২০২২

চিত্রকর্ম: দেব সরকার
অন্তমিল মধ্যমিল নিয়ে বাতিকগ্রস্ত নই
♦ কবিতার মুহূর্তে কি খুব অস্থির হয়ে ওঠেন ?
অস্থিরতা তৈরি হয় কোন পার্থিব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কিংবা মনোজগতে ঘটে যাওয়া কোন তোলপাড়ের কারণে। আর তা কবিতার দিকে ধাবিত করে, লিখতে লিখতে যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় না, তা বলা যাবে না। তবে, একটা লেখা যখন সন্তোষজনক হয়ে ওঠে তখন তৈরি হয় আরেক নতুন উত্তেজনা, সৃষ্টির আনন্দের উত্তেজনা। ভাল কবিতা লিখতে পারার আনন্দে অনেক রাত নির্ঘুম সকাল হবার অভিজ্ঞতাও আছে।
♦ ভেবেচিন্তে লেখেন, না স্বতঃস্ফূর্তভাবে ?
কবিতা তো ভাবনারই নির্যাস। না ভেবে লিখি কি করে! তবে, লেখার সময় অক্ষরগুলো যেন ঝরঝর করে ঝরে পড়ে মস্তিষ্কের ফোঁকর থেকে।
♦ কখনো কি মনে হয়, কেউ আপনাকে ভেতর থেকে লিখিয়ে নেয়, এমন কোনো মনোবাসী ?
আমি বস্তুবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তাই এরকম অদ্ভুত ভাবনা আমার কখনো আসেনি, আসে না। তবে, ‘আত্মজার প্রতি’ বা ‘লাল মাফলার’ কবিতাগুলোর মতো দীর্ঘ কবিতা লেখার সময় ক্রমাগত শব্দগুলো যখন হুলুস্থুলু করে এসে পড়ছিল, তা অন্যরা ভাবলে গায়েবি কিছু মনে করতে পারতেন, কিন্তু আমি তো জানি, এসব মস্তিষ্কের উর্বরতার উচ্ছ্বাস।
♦ একটানা লেখেন, না থেকে থেকে লিখতে হয় ?
আমার অধিকাংশ লেখাই একবসায় জন্ম নিয়েছে। তবে, পরিচর্যায় তাদের অনেকটা সময় কাটাতে হয়েছে। আবার অর্ধসমাপ্ত কোন লেখা হয়তো কয়েক মাস বা বছর পেরিয়ে পূর্ণতা পেয়েছে। কোনো কোনো পংক্তির আর কবিতা হওয়ার সুযোগ মেলেনি।
♦ লেখার আগে কি মনে মনে পংক্তি আওড়ান ?
আমি মুখস্থ বিদ্যায় খুব দুর্বল। তাই মাথার ভেতরে পংক্তি নিয়ে ঘুরতে পারি না। কোনো পংক্তি মাথার মধ্যে খেলে গেলে সাথে সাথে তা টুকে নিতে চেষ্টা করি এবং প্রায়শ লেখাটি পূর্ণতা পেয়ে যায়। যেসব লাইন সময় মতো টুকে নিতে ব্যর্থ হই, সেসব হারিয়ে যায়, আর আমার ধারণা, আমার শ্রেষ্ট লেখাগুলো তাই আমি লিখতেই পারিনি।
♦ অন্তমিল, মধ্যমিল কি কবিতায় ফেরাতে চান ?
এদের ফেরানো বা বিদায় দেওয়া কোন ব্যাপারেই আমি বাতিকগ্রস্ত নই। এরা কবিতার প্রয়োজনে জুড়ে থাকবে, আবার কবিতারই প্রয়োজনে বিদায় নেবে। অলংকার তো শরীর হতে পারে না।
♦ ছন্দের ওলট পালট বা ভাঙচুর কতটা পছন্দ ?
ছন্দ কবিতার ফিগার বা কাঠামো তৈরি করে। এটাও কবিতার প্রয়োজনেই কবিতায় আসে এবং কবিতা থেকে দূরে থাকে। তবে, ছন্দ নিয়ে গবেষণার পূর্বশর্ত খুব ভাল ছন্দজ্ঞান। একটা সময় ছিল, প্রথাগত ছন্দকে সচেতনভাবে ভাঙার চেষ্টা করেছি। ‘কথনের স্পন্দন‘ বলে এক ধরনের মিশ্রছন্দে লেখারও প্রয়াস পেয়েছি। আজ মনে হয়, ছন্দকে কবিতার যেমনটি প্রয়োজন তেমনটি করেই গড়াগড়ি করতে দেওয়াই উত্তম। ছন্দের গবেষণা কবিতার মূল কাজকে যেন বাধাগ্রস্ত না করে, সে দিকে খেয়াল রাখা জরুরি।

চিত্রকর্ম: রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়
ধিক্
অকস্মাৎ বজ্রপাতে বুঝি জ্বলে পুড়ে খাঁক — ফানুসের বেশে ওড়ে, ছাই হয় এ শহরে গাড়ি ট্রেন মানুষ মানুষী। এখানে ঢেলো না জল হে দমকল, এরা ফুল নয়, শিশুরা নারীরা আজ পটকার মতো ফোটে। অথচ এদেশে কোন যুদ্ধই বাধেনি আজ। এদেশ ইউক্রেনের কিংবা গাজা প্রান্তরের মতো নয়, এইখানে স্বজাতি মুখাগ্নি করে নিজের জ্ঞাতির। এখানে খইয়ের মতো ফোটে বোমা, আত্মঘাত ছাড়া এই পোড়া দেশে মৃত্যু যেন স্বাভাবিক পথেই আসে না। বনপোড়া হরিণের অস্থিরতা নিয়ে জ্বলে মরে নির্বিরোধ সাধারণ লোক। ধিক্কার তাদের জন্য, যারা ট্রেনে আগুন জ্বেলেছে— ধিক…
দৌড়
ক.
দৌড় একটা সংক্রামক ক্রিয়া। যখন তটস্থ কেউ ভীত দৌড়ায়, চারপাশের সকলের মধ্যে সঞ্চারিত হয় ভয়। তারপর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য সকলে দৌড়ায়, জানে না, জানতে চায় না কেন——কি কারণে এই দৌড়। তারপর একসময় সকলেই ভুলে যায় দৌড়ে কে প্রথম হয়েছে কিংবা প্রথম কে দৌড় শুরু করেছে। সব দৌড় প্রতিযোগিতার নয়, কিছু কিছু ভীতযোগিতারও।খ.
আমরা শৈশবে বেহুদা দৌড়েছি, বাবার মারের ভয়ে, পাড়ার জাঁদরেল মুরব্বির ভয়ে, মিউনিসিপালিটির টিকাদিদির ভয়ে…. দৌড়াতে দৌড়াতে বেয়ে উঠেছি সুউচ্চ সুপারী গাছ, দেয়াল টপকে পালিয়েছি প্রতিবেশির বাসার পেছনে। শৈশব মানেই দৌড়, কখনওবা পুকুরে লাফাবো বলে। এখন বার্ধক্যে দেখি দৌড় চলছে অনন্তকাল——জীবনের দৌড়, জীবিকার দৌড়, অর্জনের দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে এলেও ফরেস্ট গাম্পের মতো কদর করে না কেউ। কেমন চোরের মতো মনে হয়, দৌড়ে যাচ্ছি জীবনের কাছে ধরা পড়ে যাবো বলে…গ.
ইশকুলে বার্ষিক প্রতিযোগিতা জিনিষটা দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া দরকার। এখানেই প্রথম জেনেছি সহপাঠীরা বন্ধু নয়, শত্রু—প্রতিযোগী—প্রতিদ্বন্দ্বী। তারপর ক্লাস টেস্ট কিংবা বার্ষিক পরীক্ষায় মৃত্যুঞ্জয় আমাকে ডিঙিয়ে প্রথম হলেই বাবা রেগে কাঁই। আমিও দিলাম ভোঁ দৌড়——পালাই পালাই। আর সেই মৃত্যুঞ্জয় যখন পরীক্ষার খাতা শূন্য রেখে মৃত্যুর কাছে পরাজয় মেনে নেয়, তখনও কি আমি তার সাথে পেরেছি প্রতিযোগিতায়? সে আমার ঢের আগে পৌঁছে গেল জীবনের শেষ সীমানায়…ঘ.
একদিন আমার পায়ের সামনে চকচকে ফুটবল এসে থামবে। সামনে গোলপোস্টে গোলী উধাও। চাইলেই দৌড়ে গিয়ে এক লাথিতেই গোল করা যায়। কিন্তু আমার সমস্ত আগ্রহ ফেলে দিয়ে এসেছি বঙ্গোপসাগরে। আমি আর দৌড়াব না ফুটবলের পেছনে। তোমরা একে পরাজয় বলবে, আমি অনুভব করবো পরম বিজয়—দৌড়ের বিরুদ্ধে।

চিত্রকর্ম: রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়
ভূমিকম্প
তুমি বললে পৃথিবী যে মোষের সিংয়ের ‘পরে বসে সে মোষ উঠলে নড়ে থরথর কাঁপছে পৃথিবী আমি বললাম, না, এত পসিডন ত্রিশুলে খোঁচালে ভূমি প্রচণ্ড আক্রোশে – ভূমি কাঁপে। তুমি বললে কিছুই জানি না আমি, আসলে পৃথিবী এক বিশাল দৈত্যের মতো, যার গায়ে চড়ে বেড়ায় মানুষ। দৈত্য যখন গা-ঝাড়া দেয় কিংবা নড়ে ওঠে – ভূমি কাঁপে। আমি বললাম, না, যখন বিষের তীব্র দাপটে হঠাৎ অভিশপ্ত দেব লকি নড়েচড়ে ওঠে – ভূমি কাঁপে। তুমি বললে, ঘোড়ার ডিমটি জানো, পৃথিবী গা-ঝাড়া দেয় যখন চমকে দেখে রাজাকার এখনও আহার করে শ্বাস নেয় ভূমি কাঁপে, ধ্বংস হয় চন্দ্রমুখ রাজাকার –
দহন
পোড়া ঘরে লোক ডুবে যায় ঘুমে
ভোলে সংসার নীরব নিঝুমে
পুড়ে যাওয়া বুকে দগদগে ক্ষত
গাজা প্রান্তর রক্ত বাহিতঘরের ভেতরে জমে আছে ধোঁয়া
বিপন্ন শ্বাস বিদঘুটে হাওয়া
আগুনের শিখা তাড়া করে ফেরে
আকাশদীর্ণ গোলা-বোমা পড়েকি ক্ষতি লুপ্ত হলে সভ্যতা?
জানি যুগে যুগে ধ্বংসের কথা!
লুপ্ত সিন্ধু মহেন্জোদারো
মিশর ট্রোজান গ্রিক কত আরওপুড়ে যাওয়া ঘরে পোড়ে শত স্মৃতি
সাথে শিশু আর নারীদের প্রীতিচিত্রকর্ম: রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়
বয়স বিষয়ক
বয়স বলে কিচ্ছুকে মানবো না
এখনও সেই উনিশ বিশেই আছি
দিকদিগন্তে মেলে ধরি ডানা
জীবনটাকে দেখছি যেন মাছি!হৃদয় তবে দুঃখে ভীষণ দীর্ণ
বয়স ষাটের কার্নিশে আজ ভিড়ছে
মন পবনের তৃষ্ণা তবু দৃপ্ত
যেন আজও বিশ পঁচিশের মিনশেইচ্ছেতে আজ জুড়লো বুঝি ডানা
যেন ইটি’র সাইকেলে দুই চক্র
উড়ে বেড়ায় মন মানে না মানা
পথটা যতোই বন্ধুর হোক বক্রতখন যেমন আজও ভীষণ ঘুরছি
ঝোঁপের আড়ে কচু বনেই স্বর্গ
মনের মতো প্রেমের টানেই গড়ছি
কোত্থাও নেই তেমন ছ্যুৎমার্গতোমার বয়স আঠারো কি উনিশ
আমার নয় তো দু’চার বছর বেশি
কালের গর্ভে কতো কিছুই হাপিশ
এক লাথিতে জাল ছিঁড়ে দেয় মেসিবয়স বাড়ে শরীরে আর চশমায়
রক্তে কিছু বেড়েছে শর্করা
তাই বলে আজ স্বর্গ খোঁজার দরগায়
কড়া নেড়ে করবো না মশকরা
আনন্দ নগর
তোমাদের আকাশে ভীষণ রঙের বন্যায়
ভেসে যায় কুটোর মতোন নানান অন্যায়সুরুজের উদয়ের কালে যে কল কল্লোল
পাখিদের দারুণ হল্লা বাধালো সে কি গোল
ছোটে কেউ পশ্চিম দিকে পরম প্রার্থনা
কারো মুখে পুব প্রান্তরে রবির বন্দনাসারারাত আঁধারের ঘোরে শঙ্কা গাঢ় জমে
ভোর বেলা কেটেছে তমসা নতুন মরশুমে
বায়সের কর্কশ স্বর বিদারে নীরবতা
ঠোঁট তার এনেছে ফিরিয়ে ভোরের সতেজতাদূরে ওই পাহাড়ের গায়ে এলিয়ে পড়া রোদে
আনন্দ উপচে পড়েছে অচেনা কোনো ছাদে♦—♦—♦♦—♦—♦♦—♦—♦
❤ Support Us