- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- জুলাই ২, ২০২৩
আদরবিকেল এবং একটি স্মৃতিকাতর জঙ্গল
লাশটার এখন খুব ভালো লাগছে, অনেকদিন পরে সে একটা সত্যিকারের চেনা মানুষ পেয়েছে। চারপাশের নোংরা লোকেদের ভিড় আর তাকে বিরক্ত করছে না...

চিত্র: দেব সরকার
কড়ার ওপরে শিশিটা উপুড় করে অনেকক্ষণ ধরে আছে কমলা, তবু এক ফোঁটা তেলও আর পড়ছে না । কড়াটা ক্রমশ পুড়তে পুড়তে ঝাঁই হয়ে যাচ্ছে । অনেকটা তার নিজের ভাগ্যের মতই । এইসব সময়ে তার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে নারাণকে বিষ খাইয়ে মেরে দিতে । মারতে ইচ্ছে করে নিজের বাপটাকেও । যে কিনা শুধুমাত্র লোকটার মিষ্টি কথায় ভুলে তাকে তার হাতে তুলে দিয়েছিল । সে উপায়টা অবশ্য ঠিক তার হাতে এখন নেই । বাপটা আজ চার বচ্ছর হল স্বর্গে পালিয়ে বেঁচেছে । কিন্তু নারাণ আছে, এই মুহূর্তে হয়তো হাতের সামনে নেই । সে রোজকার মত ভোরবেলার বাস ধরে আজ রামপুরহাটের দিকে গেছে । ফিরতে সেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধে । কিন্তু পেটের শত্তুরগুলোকে তো রেখে গেছে । ছেলে আর মেয়ে, দুজনেই নাহয় এখন বইখাতা নিয়ে বসেছে । কিন্তু খানিক পরেই ইস্কুল যাবার জন্য রেডি হয়ে চেল্লাবে, ‘মা, খেতে দে ।’ রুটিগুলো না হয় তখন তখনই সে গড়ে দিল । কিন্তু তরকারিটা তেল ছাড়া কমলা কী করে করে? এদিগরের মুদি দোকানদারেরা তাদেরকে আর ধার দিতে চায় না । না, না, নারাণ টাকা মেটাতে দেরি করে বলে নয়, লোকটার সেদিকে কোনওরকম বদনাম নেই । আসলে এই সব দোকানদাররা হচ্ছে টিএমসির লোক, বছর কয়েক আগে একবার একুশে জুলাই তাদের দুজনকেই কোলকাতায় মিছিলে নিয়ে যাবার জন্য পার্টির লোকেরা বড্ড জোরাজুরি করেছিল । কিন্তু নারাণ বলে দিয়েছিল, সে গরীব মানুষ, দিন আনে দিন খায় । আগের দিন সকাল থেকে ওই মিটিঙে যাবার জন্য সে নিজের কাজ বন্ধ করে বসে থাকতে পারবে না। তার ছেলেমেয়ে দুটোও তখন ছোটো ছোটো । কোথায়ই বা সে রেখে যাবে ? আর টিএমসি সরকার তো তাকে লোকশিল্পীর ভাতাটাও তো মঞ্জুর করেনি। সে তো অ্যাপ্লিকেশন দিয়েছিল । তখন তো পার্টি তাকে কাগজটা করিয়ে দেয়নি । করালে আজ মাসে মাসে তাদের হাজার টাকা করেএকটা স্থায়ী রোজগার তো থাকতো । মানুষটারও তো বয়েস হচ্ছে । কদিনই বা সংসার টানবে আর ? সেবারে সকলেই ভেবেছিল, বিজেপি এবার রাজ্যে ঢুকে পড়ল বলে । তাদের পরিবারকেও ওরা সেদিন থেকেই বিজেপির সমর্থক বলে দাগিয়ে দিল । তারপর থেকেই ঘাসফুলের লোকেরা তাদেরকে আর এইসব ভুষিমালের দোকানে ধার দিতে চায় না । যা নেবে সব নগদানগদি ।
কড়াটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো কমলা । এইরকম সময়ে সে সাধারণত এটাই করে । আস্তে আস্তে কড়ার কালো রংটা পাল্টে যেতে যেতে একটা হলুদ সরষে ক্ষেত হয়ে গেল, অল্পবয়সী কমলা তার মধ্যে দিয়ে ছুটছে । একটু শীত শীতও করছে তার, ওই তো দূরে বাপকে দেখা যাচ্ছে, ক্ষেত চষছে, ‘হে বাপ, তেলীকে একটু বলে দিব্যা, ঘরে এক পলা তেলও নাই যে ।’ ‘সে তো আজ শ্বশুরঘর গিয়েলো, চল তার ঘরকে যেয়ে দেখি।’ তার বাপ তাকে সঙ্গে নিয়ে তেলীবাড়ির দিকে হাঁটা দিল । ছোট্ট কমলা হাঁটছে, বাপের সঙ্গে, তার ফ্রক উড়ছে, বেণী দুলছে, সে কলকল করে বাপের সঙ্গে বকতে বকতে চলছে । হাতে দড়িতে বাঁধা শিশি । একটু পরেই মুখে তাপ লেগে কমলার চটকাটা ভেঙে গেল । কড়াটা ক্রমশ পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছে, তার সামনে একটা গলায় দড়ি বাঁধা সরষের তেল টুপটুপে ভর্তি শিশি । তাকে এক্ষুণি তেলটাকে রান্নায় লাগিয়ে দিতে হবে, নইলে পরে আর সেটা দেখতে পাওয়া যাবে না ।
নারাণ গ্রামের পথ দিয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে লক্ষ্য করল মেঘটা আকাশের কোণায় ক্রমশ ঘন হচ্ছে । তাকে আজ পাতুরিতে একবার যেতে হবে ই। সেখানে পশ্চিম পাড়ায় ওর এক পরিচিত দর্জিকে দিয়ে ও নিজের সাজগুলোকে সেলাই করায় । তা, ইদানীং অনেক রকম সাজ লাগে বইকি। সাজ না থাকলে মানুষ হাত উপুড় করে না । ওর বাপের সময়ে কৃষ্ণ, কালী, রাধারানী এই তিন রকম সাজেই চলে যেত । তখন মানুষজন অন্য রকম ছিল । তিনদিন সাজ দেখিয়ে চতুর্থদিন তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে সিধে জোগাড় করত । তখন লোকের দান ধ্যানের মনটাও অনেক বড়ো ছিল, মানুষ এতখানি কুচুটে, স্বার্থপর হয়ে যায়নি। চাল আলু তো সব বাড়িতে জুটতোই । তার সঙ্গে কাঁচা টাকা অবশ্য শুধু বড়লোকেরা দিত । মধ্যবিত্ত একটু সম্পন্ন গেরস্থরা হয়তো তিন চারটে বেগুন, একটা লাউ, কি একছড়া কলা ঝুলিতে দিয়ে বলল, ‘খেয়ো এখন, ছেলেপুলেদের সঙ্গে । আমার গাছের জিনিস ।’ আর এখন লোকে সিধের বদলে পয়সা দিতেই বেশি পছন্দ করে । ওর সেটা ভালোও লাগে । ছোটবেলা থেকে হাজার রকম চাল ফোটানো ভাত খেয়ে খেয়ে ওর পেটটা একদম গেছে । ও চায় না ওর ছেলেমেয়েরও এরকম হোক। ওরা এখন নিজেদের জমির চালের ভাতই খায় । তবে ওর ওইটুকু জমি থেকে বছরকার চালটা পুরো ওঠে না । কিনে খেতেই হয়। বাপও তো আর ভিটেটুকু ছাড়া কিছু রেখে যায়নি । যেটুকু জমি সে ওই শ্বশুরের দেওয়া। মেঘটা বাড়ছে, জঙ্গলের পথ দিয়ে সর্টকাট করলে সে তাড়াতাড়ি পাতুরি পৌঁছে যাবে । একটা বিড়ি ধরিয়ে সে জোরকদমে প্যাডেল করা শুরু করলো। চোখ বন্ধ করে প্যাডেল শুরু করলেই পাতুরি ।
দূর থেকে একটা শিয়াল ভিজে মাটিতে রক্তের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে আসছিল । তার সদ্য হওয়া বাচ্চাগুলোর ভালো করে এখনো চোখ ফোটেনি । রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা শরীরটা থেকে গড়ানো রক্তটা অনেকক্ষণ হল জমে গেছে । চোখের পাতা, আর কান নাকের ফুটোগুলোর দিকে লাইন করে এগিয়ে আসছে পিঁপড়ের সারি । কয়েকটা ভিজে শালপাতা উড়তে উড়তে এসে আধখোলা শরীরটার ওপর এসে পড়ল । একটা কাঠবিড়ালি শাড়ির আঁচলটাকে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বোঝার চেষ্টা করছিল, এটা কী কাজে লাগে ? পাতা পড়ার শব্দে চমকে উঠে সে আবার তরতর করে গাছে উঠে গেল । কাঁকসার জঙ্গলের এই অংশটায় পথচলতি মানুষের পা খুব কমই পড়ে। একমাত্র পাতা কুড়োতে আসা মেয়েছেলেরাই এখানে নিয়মিত আসে । আর ক্বচিৎ কখনো স্থানীয় গ্রামের মানুষজন হয়তো হারানো ছাগল বা গরু খুঁজতে জঙ্গলে ঢুকে পড়লো । অথবা কোন বাচ্চা ছেলেপুলেরা লুকিয়ে প্রথম বিড়ি টানার জন্য একটু ঝোপের পেছনে গিয়ে বসলো । কখনো আবার পাতাকুড়োনি তরুণীদের সঙ্গে তাদের রাখাল প্রেমিকেরা খানিকটা শরীরের স্বাদ পাবার জন্য খুঁজে নিল ঝোপের আড়াল । কিন্তু এখন পাতা কুড়োনোর সিজন নয় । বর্ষার ঘন আগাছা ঘোমটার মত ঢেকে রেখেছে লাল মাটিকে । এর মধ্যে দিয়ে একটা পাতুরি বনগ্রাম যাবার সর্টকাট পথ আছে বটে, কিন্তু খারাপ রাস্তা আর নির্জনতার কারণে লোকে সাধারণত ওটাকে এড়িয়েই চলে । তার ওপর এধারে প্রচুর চিতি সাপের উৎপাত । মাঝে মাঝেই সাপের কামড়ে গরু মরার কথা শোনা যায় ।
জঙ্গলের রাস্তায় কিছুটা এগিয়েই নারাণ বুঝতে পেরেছিল, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। বর্ষার আগাছায় ঢেকে গিয়ে পথ বলতে এখন আর কিছু নেই। একটা আবছা রেখা তরুণীর সিঁথির মত যেন দেখা যাচ্ছে। আবার রাস্তায় এত গর্ত গাড্ডা যে, যে কোনও মুহূর্তে সাইকেল হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে। পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙলে তখন আর এক বিপত্তি হবে। বেশ খানিকটা এগিয়ে আসার জন্য এখন ফেরাটাও আর মোটেই লাভের হবে না। এদিকে আকাশটাও ঘন কালো হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝেই ঝিলিক মারছে। জল নামলে আবার জঙ্গলে বাজের ভয়টাও থাকে। সাপ আর আগাছা উপেক্ষা করে নারাণ সাইকেল থেকে নেমে পড়লো। একে তার আর বেশি সাজ নেই। জলে ভিজলে আজকের এই কৃষ্ণের সাজের একদম বারোটা বেজে যাবে। সেই কোন সকালে বাস ধরে রামপুরহাট গিয়েছিল, সেখানে বাসস্ট্যান্ডে সারাদিন সাজ দেখিয়ে হল মোটে একশো পঁচাত্তর টাকা। আজকের দিনে এই টাকায় চারটে মানুষের খোরাকি চলে। একটা ঝোপের ধারে দাঁড়িয়ে নারাণ কৃষ্ণের রঙিন ধুতি আর ঝকমকে জামাটা খুলে প্যান্টটা পরে ফেললো। তারপর ব্যাগটা মাটিতে রেখে একটা ঝাঁকড়ামত গাছের নীচে বসে আরাম করে একটা বিড়ি ধরালো। মনে হচ্ছে জলটা খুব তাড়াতাড়িই নামবে। এইবার অন্য কোনও একটা ধান্দা বেছে না নিলে আর চলছে না। এ পেশায় আর পয়সা নেই। লোকে বহুরূপীর সাজ দেখে আর পয়সা দেয় না। আর দেবেই বা কেন ? টিভিতে সারাক্ষণ ঠাকুর দেবতার সিরিয়ালে যাদের দেখছে, তাদের মেকআপ, ড্রেস সবই একদম আসলের লাগান। এমনকি সে নিজেই একদিন টিভিতে দেখলো রাবণের দশটা মুণ্ডুই একসঙ্গে চোখ পিটপিট করছে, দশ মুখে কথা বলছে। এরপর তাদের সেফটিপিন লাগানো জামা আর ছেঁড়া কাগজের মুখোশ দেখে কে আর পয়সা দেবে ? এসব আর চলবে না। তবে এখন স্ট্যাচুর বাজার নাকি খানিকটা ভালো। আর এক বহুরূপীর মুখে সেদিন বাজারে শুনছিল, স্ট্যাচু সাজলে বিয়েবাড়িতে, বড়লোকের ছেলেপুলেদের জন্মদিনে, পুজো প্যান্ডেলে, ইদানীং কাজ জুটছে। এমনকি বড়ো বড়ো দোকান, ওই যে শপিং মল না কী যেন বলে সেখানে নাকি এইসবের চাকরিও পাওয়া যায়। সেই লোকটা নাকি মিকি মাউস না কী সেজে ওই শপিং মলে দুমাস কাজও করেছে। তবে সে বলছিল, খাটুনি খুব। বাহ্যে পেচ্ছাপ বন্ধ করে সাত আট ঘণ্টা একভাবে দাঁইড়ে থাকা, কঠিন আছে বাপু। সে কী পারবে ? তার আবার একটু পেচ্ছাপের ধাত আছে, ঘট ঘট করে দিনে দশবার জল খায় আর পেচ্ছাপ করে। তবে টাকা রোজগার করতে গেলে তো খানিক কষ্ট করতে হবেই। পাশ দিয়ে চলতে থাকা লাল পিঁপড়েদের একটা মোটা লাইন হঠাৎ করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। বৃষ্টি এলে পিঁপড়েরা তো ডিম মুখে ওপর দিকে বাইবে, এরা ঝোপের মধ্যি ঢুকছে কেন ? সে কৌতূহলী হয়ে বিড়িটা ফেলে ঝোপের পাতাগুলো সরালো।
হাওয়ায় আর শিয়ালটার টানাটানিতে শাড়িটা ছিঁড়ে গিয়ে মেয়েটার লাশটা এখন উদোম হয়ে গেছে। লাশটার খুব লজ্জা করছিল। না শিয়ালটাকে নয়, সে বুঝতে পারছে একটা আতঙ্কিত মাঝবয়েসি পুরুষ এখন তাকে ঝোপের ফাঁক দিয়ে দেখছে। মৃতেরা অনেক কিছু দ্রুত বুঝতে পারে, সেও বুঝেছে পুরুষটার চোখ ভয় পাবার আগের মুহূর্তে তার অক্ষত বুক, পেট, যোনি সবই স্পষ্ট করে দেখে ফেলেছে। তারপরেই অবশ্য ভয়ে চিৎকার করে উঠেছে। যদিও এই জঙ্গলে সেই চিৎকার শোনার কেউ ছিল না, শুধু শিয়ালটা ভয় পেয়ে সোজা নিজের বাচ্চাগুলোর কাছে দৌড় মেরেছে। এই মুহূর্তে লাশটার আর লোকটার দুজনেরই মনে পড়েছে, কেন তাদের পরস্পরকে এত চেনা চেনা লাগছে। লোকটার চোখে ভেসে উঠছে, লাশটার ওই পাতলা ফ্যাকাশে ঠোঁট, বুকের বেগুনি বৃন্তের পাশে ওই বড়ো কালো আঁচিলটা, কতবছর আগে যেন এইসব কিছু তার খুব প্রিয় ছিল। লাশটাও ভাবছে, ওই নীল রঙ মাখা কৃষ্ণের মুখ, ওই টানা টানা চোখ, ওই বাঁশি ধরা আঙুল, তার স্বপ্নেও যেন কতদিন আগে ভেসে আসত। কোথায় একটা যেন তাদের দেখা হয়েছিল একদিন, তারপর আবার কী যেন…। ঠিক এই সময় লোকটাকে চমকে দিয়ে একটা বিদ্যুতের ঝলক আর গুড়গুড় আওয়াজ আকাশ থেকে নেমে এল আর সেই মুহূর্তেই শিয়ালটাও যেন ভয় পেয়ে দূর থেকে ডেকে উঠল। শিয়ালের ডাকটা এক ঝটকায় লাশটাকে আর লোকটাকে সোজা পনেরো বছর পেছনে ছিটকে ফেলল।
ঠোঁটে ঠোঁটে বেজে উঠেছিল দুজনে। বাঁশি, দুপুর আর সুর মিলেমিশে গিয়েছিল তাদের শরীর পরবের প্রথম উদযাপনে। সেই প্রথম আনন্দের স্মৃতি যে তাদের দুজনেরই এখনো মনে আছে, দেখে বেশ ভালো লাগলো তার। ‘যাক গা, সে কথায় তুমি যে এখনো লাজ পাচ্ছ, সেইটো আমার খুব ভালো লাগছে।’ বলে উঠলো লাশটা
নারায়ণ তখন অনেক কম বয়সী। বাঁশি বাজানো আর সারাদিন সাইকেলে টহল মারা ছিল তার একমাত্র কাজ।কমলার সঙ্গে তার তখনও সংসার হয়নি। বহুরূপীর সাজ দেখানো ছাড়া সে তখন মাঝে মাঝে সাপও ধরতো।সাপ ধরাটা অবশ্য গ্রামদেশের লোকেদের কাছে এমন কিছু একটা শক্ত বা জটিল বিষয় নয়। ছেলেপুলেদের অনেকই পারে। বিষহরির মাদুলি পরা থাকলে মরার ভয়টাও আর থাকে না। প্রথমে একটু সাহস করে ঘাড়টা চেপে ধরতে হয়, তারপর একবার রামঝাঁকুনি দিলেই বাবাজীর কারিগুরি সব বন্ধ। পুরোটাই হাতের কায়দা। তা ছোট থেকে বেদেদের সঙ্গে এ জঙ্গল, ও জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে সে হাতের কায়দা ভালই রপ্ত করেছিল। একটা সাপ ধরতে পারলেই মোটামুটি দু’হপ্তার ঘরের খরচ বা নেশার খোরাক চলে আসে। গাঁয়েতেই এইসব মাল কেনার লোক আছে, তারা কি করে যেন প্রথমেই শিশিতে সাপের বিষটা বার করে নেয়, তারপর তার চামড়া ছাড়িয়ে শুকিয়ে বিক্রি করে দেয়। এমনকি হাড়গুলো দিয়েও বাতের মাদুলি তেল, এইসব হয়। একটা ভালো সাইজের সাপ বেচতে পারলেই চার পাঁচ হাজার টাকা আরামে উঠে আসে। তো যাই হোক সেদিন বিকেলে কেষ্ট সেজে ঘুরতে ঘুরতে নারাণ সাইকেল নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল জরুগ্রামে। জরুগ্রাম তাদের খুব একটা কাছে নয়, আবার খুব দূরেও নয়। তবে তার চলাচলতি পথের বেশ খানিকটা বাইরে। জরুগ্রামের জঙ্গল হল গিয়ে এ তল্লাটে বিখ্যাত। যেতে যেতে হঠাৎ নারানের শখ হলো সেই জঙ্গলে একটা পোড়ো পুকুরের ধারে বসে সে একটু বাঁশি বাজায়। আজকাল বাঁশিতে ফুঁ দিলেই সে কীভাবে যেন অন্য একটা জগতে চলে যায়। একটা কামরাঙা গাছের তলায় একলাই বসে সে বাঁশিতে ফুঁ দিল। ওই তো দূরে একটা সরু চিকচিকে নদী দেখ যাচ্ছে। ওটাই কী যমুনা নাকি ? এইখানে বসে একলা একলা সে কীকরছে ? বাঁশি বাজাচ্ছে না গরু চরাচ্ছে ? নদীর পাশেই দেখছেতো তার গরুগুলো সব ঘাস খাচ্ছে। বাঃ, অনেকগুলো গরু তো তার। আর কী সব স্বাস্থ্য। নিশ্চয় অনেক দুধ হয়। হবেনা, নিয়ম করে মাঠের টাটকা ঘাস জল পায় তো। আরে, নদী থেকে ওটা কী উঠে আসছে। বাপ রে বাপ, ওটা যে একটা প্রকান্ড সাপ। সাপ এত বড়ো হয় ? ও তো একটা আস্ত পরুকে গিলে নেবে। নারান সাপটাকে তাড়িয়ে দেবার জন্য তার বাগালি করারপাঁচনবাড়িটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
এই মেয়েটার তখন অনেক কম বয়স, সে তখনও লাশ হয়ে ওঠার কথা ভাবেনি নিশ্চয়। ওই জরুগ্রামের কাছেই ছিল তার বাপের ঘর। তখন লাশটার একটা সুন্দর নামও ছিল, রাধা। বিকেলেই কাছের কুনুর নদীতে রাধাজল আনতে গিয়েছিল। তারপর হঠাৎ বাঁশির আওয়াজ শুনে উঁকি মেরে দেখে কে যেন এক কেষ্টঠাকুর কামরাঙা গাছের তলায় এক মনে বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। রাধার বাপেরা আদতে বেদে হলেও অনেকদিন তারা এই গাঁয়ে থিতু হয়েছে। ঝুড়ি চ্যাঙারী এইসব বুনে আর বিক্রি করে তারা সংসার চালায়। পথে পথে তাঁবু নিয়ে আর ঘোরে না। তবু রক্ত বলে একটা কথা থাকে, বেদে রক্তের গভীরে সুরের টানে জোয়ার খেলা করবেই। খানিকটা সেই টানেই রাধা এগিয়ে এল তার কেষ্টঠাকুরকে দেখতে। এগিয়ে আসতেই তার অভ্যস্ত চোখে ধরা পড়লো কামরাঙা গাছের পাতার মাঝ থেকে যেন একটা অন্যরকম চকচকে বাদামী দুলুনি। মাঝে মাঝে রোদ পড়তেই ফণার ওপরে পায়ের ছাপের মত কালো দাগটা যেন ঝলকিয়ে উঠছে।
সাপটা অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিল, ছোকরাকে কোথায় দেখেছে ? ছোকরানির্ঘাত এ গাঁয়ের নয়। এ গাঁয়ের সব ছোঁড়াকেই সে দিব্যি চেনে। এই নীলচে কালো রঙের শরীর সে নিশ্চিত আগে কোথাও দেখেছে। আজকাল তার আর অনেক কিছু মনে পড়ে না। বয়েসের দোষ হবে। তবে এই ছেলেটা তার চেনা। অনেক দিন আগে একবার এই ছেলেটা একদম তার ফণার ওপর উঠেদাঁড়িয়ে কী যেন একটা করেছিল। সেবারে খুব হেনস্থা হয়েছিল তার। সেখান থেকে একেবারে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। যমুনা না কী নামের একটা নদীর ধারে সে তখন থাকতো। সেই পুরনো রাগে অন্ধ হয়ে সাপটা…।
মানুষের নজরেরও একটা ভার আছে, বাঁশি বাজাতে বাজাতেই নারাণ হঠাৎ চোখ খুলে খেয়াল করলো, একটা ধলা রঙের অল্পবয়সী মেয়ে তাকে প্রাণপণে পাশে সরে যেতে ইশারা করছে। সে কিছু না বুঝেই তৎক্ষণাৎ ডানদিকে বেশ খানিকটা সরে বসলো, আর সেই মুহূর্তেই শামুকভাঙা কেউটেটা গাছের ওপর থেকে নারানের মুকুট লক্ষ্য করে ছোবল দেবার জন্য নীচে লাফ মারলো। সাপটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও মাটিতে পড়েই ফণা তুলে ঘুরে দাঁড়ালো। কিন্তু ততক্ষণে নারাণ নিজেকে ফিরে পেয়েছে। সে তাক বুঝে সাপটার ঘাড়টা চেপে ধরে একটা রামঝাঁকুনি দিলো। ‘ওইভাবে এই বুনো জঙ্গলে বসে কেউ বাঁশি বাজায় হে কেষ্টঠাকুর ? আর একটু হলেই তো এতক্ষণে একেবারে ওপরে পৌঁছে যেতে।’ ‘হ্যাঁ, আসলে পথ চলতে চলতে এই জায়গাটা ভারী ভালো লেগে গিয়েছিল, তাই একটু বসে বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছিলাম আর কী ? তা তুমি কী এধারকেই থাকো নাকি ? জল আনতে এয়েছিলে ?’ ‘আমাদের ঘর ওই নামোপাড়ায়। আমরা বেদের জাত, আমার নাম রাধা।’ ‘ও, তুমি বেদের ঘরের মেয়ে ? তা এই সাপটারে তালে তুমিই নিয়ে যেও।’ কথা বলতে বলতে একটা ছোট বস্তায় ততক্ষণে নারাণ সাপটাকে ভরে ফেলেছে। এত দামী একটা জিনিস কেউ এক কথায় অচেনা মানুষকে দিয়ে দেয়, এমনটা কিন্তু রাধা আগে দেখেনি। তার ওপর এমন সুপুরুষ। গায়ের ঘামের গন্ধটাও যেন কী মিষ্টি। সে মুগ্ধ হয়ে নারানের সামনে পাটি পেতে বসে। নারাণ হেসে বলে, ‘বাঁশি শুনবা, তাইলে চোখ বোজো।’ বাঁশির সুর তাদেরকে পৌঁছে দেয় কোনও এক অচেনা নদীর ধারে। তারা সেখানে পরস্পরের হাত ধরে ছোটাছুটি করে। ফুল ছোঁড়ে পরস্পরের দিকে, দুজনে দুজনের দিকে নিস্পলক চেয়ে থাকে হয়তো বা। সাপটাও তাদের সঙ্গে সেখানে খেলা করে। জলের কলসিটা মিথ্যেই মাটিতে গড়াতে থাকে।
এরপরে নারাণ অনেকবার জরুগ্রামে গিয়েছে। দেখাও করেছে রাধার সঙ্গে, ভাব ভালোবাসা গোছের কিছু একটা কুঁড়িও যেন মেলছিল তাদের দুজনের মধ্যে, কিন্তু শেষপর্যন্ত আর কিছু হয়নি। সময় আর তার পেশার অনিশ্চয়তা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষকালে কমলার বাবার দেওয়া একফালি জমিটা ওকে খানিক নিরাপত্তা জুগিয়েছে। সংসারী বিবেচনায় সে এই নিরাপত্তাটুকুকেই বেছে নিয়েছে।
লাশটার এখন খুব ভালো লাগছে, অনেকদিন পরে সে একটা সত্যিকারের চেনা মানুষ পেয়েছে। চারপাশের নোংরা লোকেদের ভিড় আর তাকে বিরক্ত করছে না। এখন আর তার খুব একটা লজ্জাটজ্জাও করছে না। বরং মনের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন মজা সুড়সুড়ি দিচ্ছে। লোকটা নিশ্চয় এতদিনে বিয়ে থা করেছে। ছেলেপুলেও হয়েছে নিশ্চয়। বউটারে কেমন দেখতে হয়েছে কে জানে ? তার যা যা আছে, নারানের বউয়েরও তো সেইসব জিনিসই আছে, না কী ? তাহলে নারাণের এখন কাকে বেশী ভালো লাগছে ? সে আড়ে আড়ে নজর করেছে, নারাণ ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার তার বুক আর পেটের দিকে তাকিয়েছে। এই ঝুম বৃষ্টিতে লাশটা প্রাণপণ চেষ্টায় একটুখানি নড়ে ওঠার চেষ্টা করলো। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে নারাণ ঝোপের মধ্যেই গুঁড়িসুড়ি মেরে বসলো। সে এখন লাশটার একদম পাশেই। জলটা খুব জোরেই নেমেছে। সে লাশটার সঙ্গে কথা বলা শুরু করলো, ‘কেমন আছো, আর এখন জিজ্ঞেস করে কী করবো ? অনেকদিন পরে তোমায় দেখলুম তো, তাই মুখটা পেত্থমে ঠাহর করতে পারিনি। কী হয়েছিল গো, তোমার ? এমনি করে এই কসাড় জঙ্গলে মরে পড়ে আছো ?’ ‘আর সে তোমায় কী বলবো কেষ্টঠাকুর। ভাগ্যের ফের, আমি কিন্তু তোমায় এক দেখাতেই চিনেছি। ওই মুখ আর ওই বাঁশির সুর সারা জেবনেও তো ভুলতে পারলুম না। এখনো বাঁশি বাজাও ?’ ‘তা বাজাই কখনো কখনো।’ ‘তবু এই জঙ্গলে মরে পড়ে ছিলাম বলেই তোমায় শেষ দেখাটা দেখতে তো পেলাম। সেই কোন ছুটোকালে আসবে বলে কথা দিয়ে আর তো এলেই না, ভয়ে পেলিয়ে গেলে।’ ‘আরে না না। ভয়ে পেলিয়ে যাবো কেন ? সে সময়টাই তো অন্যরকম ছিল, তারপর…।’ ‘আচ্ছা মানছি, ভয় নয়। তবে আমায় ফোটালে ক্যান ? আমি তো তখন কতো ছোট। যদি কিছু হয়ে যেত ? আমি তখন কোন ঠেঁয়ে যেতাম ?’ নারাণের মনে তার প্রথম সঙ্গমের অনুভূতিটা ফিরে এল। তখন সেও অনেক ছোট। একদিন দুপুরে বাঁশি শুনতে শুনতে সেই পোড়ো বাঁশবনে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল রাধা। ঠোঁটে ঠোঁটে বেজে উঠেছিল দুজনে। বাঁশি, দুপুর আর সুর মিলেমিশে গিয়েছিল তাদের শরীর পরবের প্রথম উদযাপনে। সেই প্রথম আনন্দের স্মৃতি যে তাদের দুজনেরই এখনো মনে আছে, দেখে বেশ ভালো লাগলো তার। ‘যাক গা, সে কথায় তুমি যে এখনো লাজ পাচ্ছ, সেইটো আমার খুব ভালো লাগছে।’ বলে উঠলো লাশটা। ‘বিয়ে করেছো তো ?’ ‘ তা, করেছি।’ ‘বেশ কথা। আর করবে নাই বা কেন ? কোথাকার কোন রাধার জন্য কতদিন আর বইসে থাকবে ? কেমন দেখতে বউ ? আমার চেয়ে ভালো নিশ্চয় ?’ নারাণ হেসে ফেলে। ‘ঠিকই আছে দেখতে। তোমার মতোই দেখতে অনেকটা, তবে ভালো কী না বলতে লারবো ?’ ‘যাকগে, তুমি এখন কাপড়টা দিয়ে আমায় একটু ঢেকে ঢুকে দাও তো বাপু। ওই শিয়ালোটোর জ্বালায় পুরো ল্যাংটা হয়ে রয়েছি।’ নারাণ খুব আদর করে লাশটার সারা শরীরটা আবার কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দিল। ‘বললে না তো, কীভাবে এখানে মরলে ?’ ‘ওই একটু খারাপ লাইনে চলে গেছিলুম আর কী। কী করবো ? বরটা ভালো ছিল না, রোজগার পাতি করতো না, নেশা করে পড়ে থাকতো রাস্তায়। সংসারের চাপ। পেটটা তো চালাতে হবেক কেষ্টঠাকুর ! জীবনে তোমার মতো কাউকে তো আর পালাম না। যাক গে,ওইসব সাতসতেরো প্যাচালমরার পরেও আর ভালো লাগছে না বাপু। তা তুমি এখন কী করো কেষ্টঠাকুর ?’ ‘ওই যা করতাম। বহুরূপী সেজে বাঁশি বাজিয়ে দুটো ভাতের জোগাড় করি।’ হঠাৎ লাশটা বলে উঠলো, ‘আজ আমায় এখানে দেখে ভালো লাগছে কেষ্টঠাকুর ? সত্যি করে বলোতো একবার। আমার কিন্তুক খুব ভালো লাগছে।’ ‘লাগছে গো লাগছে। খুব ভালো লাগছে। আর লাগবে না ? কতো কী কথা যে মনে পড়ছে আমার।’ ‘তবে একটা কথা রাখবে আমার ?’ ‘হ্যাঁ, রাখবো গো রাখবো। বলোই না কথাটো ?’ ‘একবারটি আমায় জড়িয়ে ধরে শোবে আমার পাশে ? একবারটি আগের মত করে চুমু খাবে ? আমিই তো তোমার জীবনে পেত্থম ছিলাম, তাই না ? এটা পেলেও আমার মনটায় শান্তি লাগবে।’ ‘হ্যাঁ, গো হ্যাঁ, তুমিই আমার জীবনে পেত্থম, আর সে কথাটো তো তুমি জানোই ?’ নারাণ রাধাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওই ঝোপের মধ্যেই শুয়ে পড়ে। কিছু জংলী কুঁচো ফুল জলে ভাসতে ভাসতে এসে তাদের শরীরে আটকে থাকে।রাধাও সেই মুহূর্তে তুমুল আশ্লেষে নারাণকে জড়িয়ে ধরেছিল।
লোকে বলে ঠিক সেইসময় নাকি একটা বিশাল বাজ পড়েছিল ওই জঙ্গলের ওপর, তুমুল বৃষ্টি নেমেছিল আকাশ ভেঙে এবং একটি মৃত সাপকে স্মৃতি পেরিয়ে সেদিকে এগিয়ে যেতে দেখা গিয়েছিল। তারপর আগুনের ইরেজার মুছে দিয়েছিল সমস্তকিছু…।
♦–♦♦–♦♦–♦
❤ Support Us