Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৩

ব্রেকিং নিউজ

বিপ্লব চক্রবর্তী
ব্রেকিং নিউজ

অলঙ্করণ: দেব সরকার

খিদে পেলেই আমি চেপে রাখতে শিখেছিলাম। অপেক্ষা করতে হয় জেনেছিলাম।হাতে ধরে সেটা কেউ জানায়নি বা শেখায়নি।শিখে গিয়েছিলাম বাধ্য হয়ে। অভাবের সংসারে বাড়তি বলে কিছু ছিল না। একবারই রান্না হোত। অর্ধেকটা রেখে দেওয়া হত রাতের জন্য। বিকেলে এত খিদে পেল যে, নিজের ঘরে নিজে চুরি করলাম। বিকেলের পুরোটাই সাবড়ে দিয়েছিলাম গোপনে। মা ঠিক ধরে ফেলেছিল। বকাবকি করেনি। শুধু বলে ছিল, ” যদি জীবনে সুখী হতে চাস, খিদেকে কখনো বাড়তে দিস না”। আর কিছু বলেনি। সেদিন যদি মা আমাকে এসব কথা না বলে একটা থাপ্পর কষাত ,ভালো করত। এত মর্মদাহ হত না। সেদিন রাতে সবাই না খেয়েই শুয়ে পড়েছিল। তারপর থেকেই খিদেটা চেপে রাখতে শিখে গিয়েছিলাম। চেপে রেখেও ছিলাম। কতক্ষণ আর চেপে রাখা যায়। যা হবার তাই হল।
মায়ের কথাটা সারাজীবন মনের মধ্যে গেঁথে না রেখে যদি কাজে প্রমাণ করতে পারতাম, আজ এখানে এসে এভাবে কথার জাবর কাটতে হোত না।খিদেটাকে যে ভাবে বাড়িয়ে ফেললাম সেটা সুদে আসলে এখন আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
এই বয়সে এসে আতঙ্ক আর ভয়ে ভেবে দেখলাম, আমার খিদেটা শুরু হয়েছিল কৈশোর আর যৌবন বয়সের সন্ধিক্ষণে রাস্তায় মেয়ে দেখার মতো। তখন সব্বাইকে হেব্বি লাগত। সবার সঙ্গে মনে মনে প্রেম করে ফেলতাম। কারো কারো আকারে ইঙ্গিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইতাম। আমার একটা মাত্র জামাপ্যান্ট ছিল সেটাকে নিজে কাচতাম। এদিক সেদিক পয়সা জোগাড় করে ইস্তিরি মেরে আনতাম। তারপর টার্নিং পয়েন্টে কায়দা মেরে দাঁড়াতাম, হাঁটতাম। মনটা আকুপাকু করত। প্রত্যেকবারই ভাবতাম সেই মেয়েটি আমার সামনে এসে বলবে, চলো আমাকে ঘুরতে নিয়ে চলো ! পুরো রোমান্টিক ইডিয়েট ছিলাম।
এইভাবে অনেকগুলো মেয়ের মুখ আমার হৃদয় থেকে ছিঁটকে চলে যাবার পর যৌবনের শুরুতেই বুঝেছিলাম ওই সব প্রেম ট্রেম এই বান্দার জন্য নয়। একটাই জামা আর একটাই প্যান্ট পরে, একই পলিথিনের চপ্পল পায়ে গলিয়ে, লাইনে খেলছি মেয়েরা ঠিক ধরে ফেলে। এই মহাজ্ঞানের পর থেকে আমি কখনো মেয়েদের ছায়া মাড়াইনি। হেসেছি দূর থেকে। পাশে বসেছি দূরত্ব রেখে।
বয়সটা আরো পরিণত হল, ধান্দাতে কামাই করতে শেখার পর, কতগুলো কালো চোখের সামনে  ধরা পড়ে গেল।মাইরি বলছি, সেইসব কালো ধরার জন্য আমাকে এতটুকু পরিশ্রম করতে হয়নি। গুপি দা, গুপি দা বলে আমার কাছে বেশ কয়েকটা মেয়ে কয়েকবছর ঘুর ঘুর করেছিল। প্রথম প্রথম হেব্বি গলে যেতাম।… আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই…” ওরা সামনে এলেই, এইসব লাইন মনে মনে আওরাতাম।একমাস দুমাসের মধ্যে প্রয়োজনটা মিটিয়ে মেয়েগুলো ভাগলবা হয়ে যেত। আমিও একসময়কার পুরনো জামা ইস্তিরি মেরে পরে আসা সেই মাল। মেয়েগুলো আসলেই দিমাগটাকে কাজে লাগাতাম। দিমাগটা সঙ্গে সঙ্গে বলে দিত ,কোন ধান্ধায় এসেছে। বিশ্বাস করুন তারপর থেকে ওই রকম মেয়ে এলেই ওয়েটিং লিস্টে বসিয়ে রাখতাম।থাক বসে থাক।সত্যি কথা বলতে কি ওয়েটিং লিস্টে যাদের বসিয়ে রাখতাম বেশিরভাগই অচল মাল।সব নিজেদের বাজার যাচাই করতে আসা ফেক আইডি। সব ছদ্ম নামে মার্কেটিং করছে। আমাকে সিঁড়ি করার জন্য এসেছে।
এই হচ্ছে আমার দোষ। কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলি। শুরু করেছিলাম খিদে নিয়ে।খিদের জন্য অপেক্ষাটা সেই ছোট্ট বেলা থেকেই শিখে ফেলেছিলাম। আমার শেখাটা বেশ জম্পেস, মানে হাতেকলমে শুরু হয়েছিল গর্ভধারিণী মায়ের বাণী দিয়ে। সেটাই ধাপ বাই ধাপ রিনিউয়াল করে গেছি। আর একটা টপ সিক্রেট এই মওকায় বলে ফেলি…!
কেশব দাশ নামে আমাদের পাড়ায় পয়সাওয়ালা একজন কাপ্তেন ছিল। ডকে ঠিকেদারি করতেন। পরিপূর্ণ কৃষ্ণভক্ত ছিল। গলায় তুলসির মালা।মুখে হরেকৃষ্ণ।অমায়িক ব্যবহার। পাড়ার সব্বার সঙ্গে মাখো মাখো পিড়িত। ওনার বাড়িতে ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমাতে, একসপ্তাহ ধরে পদাবলী কীর্তন, নিমাই সন্ন্যাস, সব শেষে অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তন হোত।বাইরে থেকে কীর্তনের দল আসতো। এই সাতদিন পাড়ার বেপাড়ার বহু লোক প্রসাদ খাবার অছিলায় সকাল থেকে রাত্রি ভরপেট্টা খেতো কেশব কাকার বাড়িতে। আমিও অপেক্ষা করে থাকতাম ওই সাতদিনের জন্য। সারা বছরের খিদেটাকে ওভারলোডে মিটিয়ে নিতাম। কীর্তনের ভলান্টিয়ার হয়ে যেতাম।ক্ষমতা কাকে বলে দেখিয়ে দিতাম। পরিচিত দের ডেকে  খাবার ঘরের চট তুলে বসিয়ে দিতাম। প্রত্যেকটা আইটেম ধরে ধরে খাইয়ে ছাড়তাম।ওই সাতদিন কেমন যেন নিজেকে হিরো মনে হত। বাড়ির মালিক আমার কাজের বহর দেখে গলে জল। মালকিন ঘরে খাবার তৈরি করলেও, ভালোবেসে ডেকে খাইয়ে দিচ্ছে।ওই সাতদিন কত্ত বন্ধুবান্ধব যে হয়ে যেত। সেই সময় থেকেই বুঝেছিলাম শুধু আমি একা নই অনেক বান্দাই খিদে জমিয়ে রাখে।
সেই হিরোগিরি মারাতে গিয়েই শেষবার আমি ঘেঁটে ঘ হয়ে সোজা মাঠের বাইরে। অপমানিত হওয়া কী জিনিস জীবনে প্রথম বুঝেছিলাম।তখন হেব্বি লজ্জা ছিল বলে বলতে পারিনি। এখন বলেই ফেলি !
আসলে ছুটকির সঙ্গে একটা কেলো করে ফেলেছিলাম। পাড়ার সুজন কাকুর মেয়ে ছুটকি। স্কুলে ওর আলাদা একটা নাম ছিল কাবেরী। পাড়ার সবাই ছুটকি বলেই ডাকতো।আমিও ছুটকি বলেই ডাকি। কীর্তনের ওই পাঁচদিন আমার হিরোগিরি দেখে আমার ন্যাওটা হয়ে গেল। গুপি দা, গুপি দা বলে একেবারে ল্যাজেগোবরে। বলার আগে কাজ করে দিচ্ছে।
— ছুটকি জগে জল ভর তাড়াতাড়ি !
ছুটকির জগ রেডি।
— ছুটকি, লাবড়ার বালতিটা এনে এই পাতে খানিকটা দিয়ে দে!
মন্ত্রবৎ কাজ।
— ছুটকি আমার জামার হাতাটা একটু গুটিয়ে দে তো, সব লেগে যাচ্ছে।
ছুটকি হাত মুছে দুটো হাতাই গুটিয়ে দিল সুন্দর করে।
মাধ্যমিক পাশ করার পর সবে বিড়ি ভাগ করে টানতে শিখেছি। এই কীর্তনের সপ্তাহে কোনো ভাগ নয়, পুরো একপ্যাকেট বিড়ি পকেটে। হিরোগিরির দৌলতে মুফতে দু একটা সিগারেটও জুটে যায়।জাস্ট একটু আড়াল নিতে হয়। বয়সটা কম। চারপাশে কাকু জ্যাঠুরা ঘুর ঘুর করছে।বিড়ি মুখে দেখলে পেছন থেকে কানটা টেনে ধরবে। আরে বাবা, তখন একটা সময় ছিল পাড়ার সবাই গার্জেন হয়ে যেত। যুত মতো পেলে গালে মাথায় কয়েক ঘা বসিয়ে দিত। বাড়ির লোক তার উপরে কষাতো।তাই একটু  আড়ালে গিয়েই হুকুম করতাম, — ছুটকি, ঠাকুর মশাইর থেকে দেশলাইটা চেয়ে নিয়ে আয় !
জো হুকুম ! ছুটকি দেশলাই নিয়ে হাজির। ধরিয়ে দেশলাইটা ওর হাত দিয়েই সোজা ঠাকুরমশাইর জিম্মায় পাঠিয়ে দিতাম।
এখন যাকে বলে গোল্ডেন টাইম। আমার তখন সেই রকম ফর্মা। বন্ধুবান্ধবেরা দূর থেকে ছুটকির সঙ্গে আমার মাখোমাখো ফর্মাটা দেখছে আর হিংসায় জ্বলে যাচ্ছে। কাজের তালে কুনি মেরে ছুটকিকে বাজিয়ে নিয়েছিলাম কয়েকবার। স্যিওর হয়ে তিনদিনের  দিন, আসরে তখন পদাবলী কীর্তনের প্রস্তুতি চলছে। রান্নার তাঁবুর আড়ালে যেখানে বিদ্যুতের আলোটা কম পড়েছে, হাতকলের অদূরে ছুটকিকে  চেপে ধরে ঝকাস করে দুটো চুমু খেয়ে ফেললাম। ছুটকি মেনে নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। আবার জাপটে ধরে যেই চুমু খেতে গেলাম,
— কে কে তোরা !
বাড়ির মালকিনের গলা। কলে কী ধুতে এসেছিল। হাতে নাতে ধরে ফেলেছে। ধোয়ার বাসনটা হাতে নিয়ে সোজা অন্ধকারে চলে এল। তখন হিম্মত ছিল, আমি আর ছুটকি জায়গা ছেড়ে একটুই হিলি নি !
— ছি ছি ছি ! অসভ্য জানোয়ার কোথাকার। মেয়েটার সর্বনাশ করছিস। ডাকব সবাইকে”! মালকিনের দাবড়ানি।
আমরা নট নড়নচড়ন, একেবারে টকাস।মালকিন এবার ছুটকিকে বকা দিল, ” এখনো দাঁড়িয়ে আছিস এখানে , তোর বাবাকে ডাকব !” ছুটকি কথা না বলে আমাকে একা ফেলে এক ছুটে পালিয়ে গেল। ফাঁসিকাঠে আমি তখন একা।

সবকটা চ্যানেলে একই খবর। দেখতে দেখতে ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা আমি। এখন আমার আর খিদে পাচ্ছে না। শুধু গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। কেন যে মায়ের কথাটা মনে রাখিনি। মা মাগো…!

— “তোর মতো ভিখিরিকে লাই‌ দিলে এই হয়। মাথায় চড়ে বসিস।আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় তোকে যেন না দেখি—” বলে বাড়ির মালকিন আমার সামনে থেকে চলে গেল। সম্মানে পুরো কার্বাইড মেরে চলে যেতেই, নিজের প্রতি খুব ঘেন্না হোল। তখন আমি মালকিনের চোটপাটে জানলাম খিদে জমিয়ে রাখা লোকদের ওরা ভিখিরি বলে। কেউ না‌ দেখে মতন ওই কীর্তনের বাড়ি থেকে আড়াল আবডাল দিয়ে সোজা হাঁটা লাগালাম বাড়ির দিকে। পদকর্তা কীর্তনের মাইকে তখন বলছিল, —’ কৃষ্ণসাথে মিলিবারে শ্রীরাধিকা,  যমুনার তীরে যাবার জন্য সখীদের তাড়া দিয়ে যাচ্ছে !’ শুনে বুকে শেল বিঁধে গেল।
ভেবে নিলাম এখন থেকে আর খিদে জমিয়ে রাখা যাবে না। খিদে জমিয়ে রাখলেই ভিখিরি বানিয়ে দেবে।এদিক ওদিক ভাবতে ভাবতে দুদিন পর বকাই কাকার কাছে পুরো রাগটাকে ঢেলে দিয়ে বললাম, কাকা,  বাবা বলে দিয়েছে আর পড়াতে পারবে না। আমিও আর খিদে চেপে রাখব না, একটা উপায় করে দাও !’
বকাই কাকা খুবই তালেবর লোক ছিলেন। বিশাল দাপট ছিল। দাপুটে লোকের  মেজাজ বলে কথা। কাকার মেজাজ তখন কড়কে ছিল। আমার কথা শুনে উদোম খিস্তি করল। আমি ফাঁদে আটকানো ইঁদুরের মতো চুপচাপ খিস্তিগুলো হজম করতে বাধ্য হলাম। জেদ চেপে গিয়েছিল বলে, আমার খিদেটাকে উত্তরোত্তর বাড়তে দিচ্ছিলাম। নিজের সঙ্গে নিজের একটা দর কষাকষি করছিলাম, খিদের সঙ্গে আর কোনো কম্প্রমাইজ করবো না। খিদে নিয়েই মাঠে নেমে খেলতে হবে, না হলে মালিক মালকিনরা আমাকে ভিখিরি বানিয়ে দেবে। দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বকাই কাকার রাগটা কমতেই আমাকে বলল, ” চল আমার সঙ্গে,কত খেতে পারিস দেখব!”
সোজা নিয়ে এল কানুদের বড়োপুকুর পার করে টেকো ডাক্তারের বাগানে। এদিকটাতে সেসময় লোকজন কম আসত বলে একা এদিকটাতে আসতে  ভয় করত আমাদের। বকাই কাকার হাত ধরে এখানে আসতে পেরে মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠল। দেখলাম, বাগানের ভেতরে কয়েকজন মানুষ, অনেক অনেক টাকা, প্রত্যেকের হাতে তাস। বকাই কাকা আমাকে ওদের মাঝখানে এনে বলে দিল,  — ” ছেলেটা বলছে ও আর খিদে জমিয়ে রাখবে না। তোদের কাছে এনে দিলাম, ওকে কাজে লাগা !”
লাইনটা এভাবেই বকাই কাকা ধরিয়ে দিয়েছিল আমাকে। কী বলব সেদিন থেকে আমাকে আর খিদে চেপে রেখে অপেক্ষা করতে হয়নি। শুরুটা বেশ হিট করেছিল আমাকে।বকাই কাকা হাতটা ছেড়ে দিতেই সেই লোকটা আমার হাতটা চেপে ধরে ছিল। লোকটার সামনে সবচাইতে বেশি টাকা ছিল। ওখান থেকে দুটো একশোর পাত্তি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ” বাজারে গিয়ে আমাদের ছয় জনের জন্য খাবার আর তিন প্যাকেট সিগারেট, এক প্যাকেট মোমবাতি আনবি, যা থাকবে সেটা তোর…”! ওসব জায়গায় তখন কারেন্টের কথা ভাবাই যেত না। মোমবাতি আনতে হবে শুনেই ধরে ফেলেছিলাম রাতেও এই ঠেক চলবে। আমাকে শুধু নিজের বাড়ি আর গার্জেনকে ম্যানেজ করতে হবে।
সেই শুরু ! তারপর হেসে খেলে দুটো বছর অবিডিয়েন্ট হয়ে কাটিয়ে দিলাম। তারপর থেকে খিদেকে আমি  দাবড়ে বেড়াই।হলে কি হবে, বেশ বুঝতে পারছি প্রতিটা দিন আমার খিদেটা শুধু বাড়ছিল। পরপর মাঠ খেয়ে ফেলেছি, পুকুর খেয়ে ফেলেছি, পুরনো বাড়ি খেয়ে ফেলেছি। এত খেয়েও বদহজম তো দূরের কথা খিদেটাই শুধু দিনকে দিন বাড়ছে। কেউ বলতে পারবে না কাউকে ঠকিয়েছি। সবার খিদের প্রাপ্যটুকু মিটিয়ে দিয়েছি।বাজারে অন্ধকারের গুডউইল তৈরি করেছিলাম।
কখনো হাতেখড়ির গুরুকে অসম্মান করিনি।গুরুর শেষ সময়টা , যদিও অনেকবছর হয়ে গেছে,মনের ভেতরে এখনো ঝকঝক করছে।মনে হচ্ছে এই তো সেদিন।
টেকো ডাক্তারের ঠেক ভর সন্ধ্যায় পুলিশ রেট করলো। বোকাই কাকা হাতেনাতে পাকড়ে গেল বামাল ক্যাশটাকা , সঙ্গে আরো দশ’জনকে নিয়ে। দশজনকে ধমকে ধামকে টাকাপয়সা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল থানা। বোকাই কাকাকে পুরো গ্যাঁজা কেস দিয়ে চালান করে দিল দমদম সেন্ট্রাল জেলে।এই বান্দাই খুঁজে খুঁজে গিয়ে জেলে দেখা করে বিড়ি আর টাকা দিয়ে এসেছি।বকাই কাকিমাকে বাড়ি গিয়ে সাহস দিয়ে বলেছি, ‘ কাকিমা মনে সাহস রাখো, কাকার কিচ্ছু হবেনা। উকিল বলেছে সামনের তারিখে জামিন হয়ে যাবে !
এইসব মানবিকতা দেখাতে গিয়ে ফালতু অনেকটা সময় আমার নষ্ট হয়ে গেছিল। গুরুকে সেবা দিতে গিয়ে ঠেকের কাজটাই চলে যাচ্ছিল। অনেক পরে দিমাগটা আমার খুলেছিল।আসলে পুলিশ গ্যাঁজাকেস সবটাই ছিল ঠেক দখলের লড়াই।তখন গ্যাঁড়া বাচ্চু টকটকে লাল গেঞ্জি গায়ে গলিয়ে রাস্তায় হেঁটে গেলে চমকে তাকাতো মানুষ। খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা বোকাই কাকা ওর কাছে কখনো ধোপে টেকে? গ্যাঁজা কেসে সোজা হাজতে। কদিন পর, গ্যাঁড়া বাচ্চু আমাকে ডেকে সোজা থ্রেট, ‘ দালালি মারবি তো বেওয়ারিশ লাশ করে ফেলে দেব !’
এক চমকানিতে আমি পুরো ফিউজ।বেগরবাই করা যাবে না। গুরুকে কৃতজ্ঞতা দেখালে সমূহ বিপদ।তার চাইতেও আমার বড়ো বিপদ ক্ষিদেটা।আগে এত বাড়তো না।এখন বেড়েই চলেছে।আসলে আমার মতো হাড়- হাভাতের যা হয়। মায়ের কথাটা একদম মন থেকে চেঁচে তুলে দিয়েছিলাম। ক্ষিদের নেশায় তখন আমি ছুটছি।গ্যাঁড়া বাচ্চুর কাছে পুরো সারেণ্ডার  হয়ে গেলাম।
ভগবানের দিব্যি! গ্যাঁড়া বাচ্চুর হাতে পড়ে পুরনো ঠেকের খোলনলচে সব পাল্টে গেল। রাতারাতি ছাদ হোল। রেস্টরুম হোল। ঠেকের জেল্লা বেড়ে গেল। প্রাইভেট চালিয়ে সব নতুন নতুন কাস্টমাররা আসতো।গাড়ি রাখার পার্কিং হোল। সবটাই হোল গোপনে বাগানের আবডাল রেখেই।গ্যাঁড়া বাচ্চুর ম্যানেজমেন্টটাই আলাদা। বাইরের মালদার কাস্টমাররা মাসে চার পাঁচদিন করে ঢুকতে লাগলো। আমার ক্ষিদে ও দায়িত্ব দুটোই বাড়িয়ে দিল নতুন মালিক বাচ্চুকাকা। এখানেও আমার জীবনের ছোট্ট একটা টুইস্ট আছে।
গ্যাঁড়াকে সবাই বাচ্চুবাবু বলে। আমি  টুকুস করে বাচ্চুর সঙ্গে একটা কাকু বসিয়ে বাচ্চুকাকু বানিয়ে দিলাম।ডাকটা একেবারে মাখমের মতো গিলে নিল গ্যাঁড়া বাচ্চু।পুরো গদ গদ। বাচ্চুকাকু কখনো দেশী ছুঁতো না।রাত্রি আটটার পর তিন পেগ বিলিতি চড়াতো।তখন আমাকে ছাড়া নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করত না।ঠেকের থেকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে বলতো, বুঝলি ভাইপো কারো ভালো কেউ সহ্য করতে পারে না। নিজের দলের লোকেরা বেইমানি করছে তলে তলে।ভাড়াটে এনে কখন টপকে দেয় সেইটাই ভাবছি! আমিও পোড় খেয়ে খেয়ে ব্রয়লার থেকে দেশি হয়ে যাওয়া গুপি দা। কার কত এলেম, সব আমার নখদর্পণে। কে কোথায় স্কিম করছে সবার আগে ঠেকে খবর চলে আসে। তাই,বাচ্চুকাকু মাল খাওয়ার পর যখনি মৃত্যু ভয়ের কথা বলতো, আমি গদগদ করে পুরো অভিনয় করে বলতাম, ‘ —  তোমার নিচের ঘরটা আমাকে রাতে শেয়ার করো, কোমরে মেশিন রেখে শুয়ে থাকবো, যে ঢুকবে দানা ভরে দেব…!’ বাচ্চুকাকু রাজনীতিজীবী মাল, আমার ওসব বাতেলাকে গুরুত্বও দেয়নি। জানতাম দেবেও না। স্রেফ নিজের ধান্দা টিকিয়ে রাখার জন্য মাখোমাখো হয়ে থাকা। ঠেকের লাইনে টিকে থাকার দস্তুরি এটাই।এভাবে তেলদিলেও কোমরে মেশিন দেখিয়ে মাস্তান সাজার যোগ্যতা আমার অন্তত ছিল না।আমি হলাম স্রেফ ধান্ধাবাজ।ঢাল বুঝে ড্রামাবাজি করে যাওয়া আমার কাজ। মিথ্যে বলবো না, আসলে আমার ক্ষিদের স্টেটাসটা বাচ্চুকাকাই বাড়িয়ে দিয়েছিল।সেটা না বললে  নিজের সঙ্গেই বেইমানি করা হবে।
জাস্ট, নিজের সম্বন্ধে একটা ইনট্রোডাকশান দিয়ে রাখছি। সেইসময় আমি দেড়শো সিসির হিরো পালসারে যাতায়াত করতাম। এক্সপোর্ট কোম্পানি মেড জামা প্যান্ট পরতাম।সেসময় যে জুতোটা পরে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খেতাম, জুতোটার দাম ছিল বারো হাজার টাকা। ফোনে মিসকল দিলে হোটেলে বান্ধবীরা পৌঁছে যেত। সবই ঠেকের দৌলতে। তখন ছুটকির মতো মেয়েরা আমার লেবেলটাই  বুঝতে পারতো না, ধরা তো দূরের কথা।আর সেই কেশব মালকিন, কয়েকবছরের মধ্যে আমার সঙ্গে বারকয়েক পিড়িত জমাতে এসেছিল, পাত্তাই দিই নি।আমার তখন ফর্মাটাই অন্যরকম হয়ে গেছিল। মরা মায়ের দিব্যি কেটে বলছি, মায়ের সেই কথাটা তখন বেমালুম ভুলে গেছিলাম।কেউ বেসুরো বললেই চমকাতাম।
বাচ্চুকাকুর সময় থেকেই টেকো ডাক্তারের বাগানের  ঠেকে  মাস মাইনের ছয়জন বাউন্সার রেখেছিলাম আমি। অবশ্য বাচ্চুকাকুর অনুমোদন নিয়েই।আমি ছিলাম সবার হেড। কাস্টমারকে জেতার পর  টাকা সহ নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দিতাম  দুজন বাউন্সার দিয়ে।  দুটো বাউন্সারের কোমরে দুটো মেশিন থাকতো।ঠেকের নিজস্ব গাড়ি ছিল।
শেষদিকটায় বাচ্চুকাকু  একদম সময় পেত না। জেলা শহরে তাঁর দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছিল। এলাকায় কম থাকতো, স্রেফ প্রাণের ভয়ে। বাচ্চুকাকার সাধের লালগেঞ্জিটা পরতে পরতে পুরো রঙ জ্বলে গিয়েছিল। সেই গেঞ্জি পরলেও, কাপ্তানিটা আর মানছিল না কেউ। থানা পুলিশ কেমন যেন বিগড়ে গিয়েছিল। সেই মর্মান্তিক সময়টাতে এই ঠেকের শেষকথা তখন আমি বলতাম। বাচ্চুকাকাকে কত টাকা সপ্তাহে পাঠাবো সেটাও আমার ওপর নির্ভর করতো। আমার চল্লিশ বছর বয়সেই  রাজারহাট, সল্টলেক, বারাসাতের ফরচুন সিটি মিলিয়ে  চার চারটে ফ্ল্যাট করেছিলাম। সমুদ্রসৈকতে দুটো হোটেল লিজে চালাচ্ছিলাম।বেশ চলছিল।
দুম করে সময়টা খারাপ হয়ে পড়লো। হঠাৎ একদিন বিকেলবেলা এলাকার কিছু মানুষ এসে ঠেক ভাঙচুর শুরু করলো। কাস্টমারদের পেঁদিয়ে ঠেক ছাড়া করে দিল। বড়বাবুকে ফোন করে হেল্প চাইলাম। বড়োবাবু ফোন ধরে বললেন,  ‘ওয়েদার রিপোর্ট শোনেননি, ঝড় আসছে। আদি গঙ্গায় ভয়ঙ্কর নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে। আমাদের কিছু করার নেই। ঝড় থেমে গেলে কথা হবে… সময় থাকতে ফুটে পড়ুন”!  বড়োবাবু ফোন রাখতেই আমিও এলাকা ছেড়ে ভাগলবা। পিছুটান আমাকে ফেরাতে পারলো না। বউ বাচ্চাদের না জানিয়েই সোজা আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে গেলাম।
সেই ঝড়ে সব বড়ো বড়ো মাথারা চিটপটাং। আমিতো চুনোপুঁটি। শামুকের খোলের মধ্যে সেঁধিয়ে বসে রইলাম বছরকয়েক, সুদিনের অপেক্ষায়। সবুরে মেওয়া ফলল। এলাকা থেকেই কল পেলাম। লোকাল কাউন্সিলার ডেকে পাঠালো, রিঙ্কুকে দিয়ে।
রিঙ্কু ছিল আমার হাইস্কুলের বন্ধু। তখন একেবারে ঝিরকুটে মার্কা ছেলে, আমরা ম্যাঁদা রিঙ্কু বলে ডাকতাম। নতুন জার্সি গায়ে চড়িয়ে পুরো খোলনলচে পাল্টে ফেলেছে। দাদার নির্দেশে খোঁজখবর  নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে একদিন হাজির। আমি তো প্রথমে চিনতেই পারিনি। কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকাতেই বলল, ‘ স্কুলের ম্যাঁদা রিঙ্কুকে ভুলে গেলি গুপি, আমাকে নিয়ে কত রসিকতা করেছিস!’ বলার পরেই চিনতে পারলাম। তবুও ধরা দিলাম না। ফালতু রিস্ক নিলাম না, বলা যায় না ও যদি কোনো বিপদ হয়ে আসে !
—  কতো কষ্ট করে তোর ঠিকানা জোগাড় করে এলাম, খুব দরকার ? ভেতরে আসতে বলবি না !’
ফ্ল্যাটের ভেতরে এনে বসালাম। ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথাই বলল।স্রেফ শুনে গেলাম। শুনতে শুনতে তখন কান মাথা ভনভন করছিল। মাথা ঠাণ্ডা রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ সে সব না হয় বুঝলাম, আমার কাছে আসার কারণটা কী?’
—  ঝুঙ্কু দা তোর এই ঠিকানাটা জোগাড় করেছে। আমাকে চাপনিসে তোর কাছে পাঠিয়েছে।
—  ঝুঙ্কু দা , মানে এখন  যে কাউন্সিলার?
ম্যাঁদা রিঙ্কু দুই দিকে মাথা নাড়ালো।
—  কেন পাঠাল তোকে আমার কাছে।
—  তুই ঠেকটা আবার শুরু করতে পারিস।
—  না, ওই ধান্ধায় আর যাব না।পয়সা থাকলেও মানসম্মান থাকে না। এখন ছেলে মেয়ে দুটো বড়ো হয়ে গেছে, জানলে কেলো করে দেবে। ছেড়েছি যখন আর ধরবো না।
ম্যাঁদা রিঙ্কু সোফার থেকে উঠে আমার সামনে চলে এল।হাতটা চেপে ধরলো। মোলায়েম করে বলল, ‘ঝুঙ্কু দা বলেছে সব রকম চাপ ও নেবে, তুই শুধু ঠেকটা আবার শুরু কর, কারো হাতে ঠেকটা দিতে সাহস পাচ্ছে না।তোর ইমানদারি নিয়ে কোনো কথা হবে না।  গ্যাঁড়া বাচ্চু তোর সার্টিফিকেট দিয়েছে…!’
—  মানে, ওরাতো আলাদা।
—  ওটা ওপর ওপর। ভেতরে সব এক! লাইনে ঢোক সব বুঝে যাবি !
সব কথা শুনে বলেছিলাম—ঝুঙ্কুকে বল ও নিজেই ঠেকটা চালাক। আমার আর কোনো ইন্টারেস্ট নেই। তুই এখন ফোট।
ম্যাঁদা রিঙ্কু ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘তোর উপর ঝুঙ্কু দা নির্ভর করবে বলেই আমাকে পাঠিয়েছিল..!’
রিঙ্কুর কথায় চড়াৎ করে পুরনো ক্ষিদেটা আবার বেড়ে গেল। শরীরটা আবার পুরনো ফ্রেমে নেচে উঠল। এমন গা গরম করা কথায়, ভুলেও মায়ের চেতাবনিটা কখনো মাথায় আসে না। ক্ষিদে একটা নেশার মতো আমার কাছে। বললাম, “জার্সি ছাড়া এবার খেলতে নামবো না রে রিঙ্কু। তোর ঝুঙ্কু দা আমাকে সবার সামনে জার্সি কি দিতে পারবে ?
— অবশ্যই, তা নিয়েও আমার সঙ্গে কথা হয়েছে ! তুই শুধু একবার রাজি হয়ে যা !
কথা রেখেছিল ঝুঙ্কু দা। আমিও কথা রেখেছিলাম।ঠেক থেকে শুরু করে হায়ার লেবেল পর্যন্ত ঝুঙ্কুদার কথা মতো ক্ষিদের রেশন পৌঁছে দিতাম। একটা পার্থক্য হাড়ে মজ্জায় টের পেলাম। যাকে বলে মহাবোধ।
গ্যাঁড়া বাচ্চু এলাকার বাইরে, ওর ওপর লেবেলের সঙ্গে আমাকে ছায়া মাড়াতে দিত না।ঝুঙ্কু দা’র ওসব ব্যাপার নেই । সব খুল্লামখুল্লা।দোস্তি, মস্তি, খিস্তি , তোলাবাজিতে যার যার তার তার।বিন্দাস চলছিল।বেশ জেগে উঠেছিলাম। নতুন করে চাঁদমারি দ্বীপে  দুই বিঘে জায়গার ওপর হোটেল তৈরির কাজ চলছে আমার। ছয়মাসের মধ্যে হোটেল শুরু করে ফেলবো। এই ছয় বছরে আরো দুটো ফ্ল্যাট কিনতে বাধ্য হয়েছি। সেটা শুধু ক্ষিদে বাড়ার জন্য নয়, অন্য কারণে। সময় পেলে বা আমাকে সময় দিলে অবশ্যই বলে যাব।সময় পাব কি না বুঝতে পারছি না। পুরো ফিউজ হয়ে বসে আছি।
ছয় ছয়টা বছর এই উদার গণতান্ত্রিক হাওয়ায়  ক্ষিদের নেশাটা আমাকে আতঙ্ক আর মৃত্যুর দোরগোড়ায় এনে দাড় করিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছে করলেও আগের মতন এখন আর আণ্ডারগ্রাউন্ড হতে পারবো না। অনেকের সঙ্গে ছবি আছে আমার। আমার নিজের একটা ফ্ল্যাটও আমার গোপনীয়তা দিতে পারবে না। নতুন কেনা ব্যারাকপুর আর গড়িয়ার দুটো ফ্ল্যাট আমি আর গোপন রাখতে পারবো না। ব্যারাকপুরের ফ্ল্যাটটা মেয়ের নামে, গড়িয়ার ফ্ল্যাটটা ছেলের নামে কেনা হলেও, ছেলে আর মেয়ে কেউই ওই দুটো ফ্ল্যাট সম্বন্ধে কিছুই জানেনা। সংবাদের শিরোনামে যখন তখন চলে আসতে পারি।
ব্রেকিং নিউজ। টিভিতে বলছে। পুলিশ ব্যারাকপুরের একটি আবাসনে, বন্ধ পড়ে থাকা ফ্ল্যাটের হদিশ পেয়েছে। পুলিশবাহিনী, আবাসন চত্ত্বর ঘিরে রেখেছে। উচ্চ পদস্থ আধিকারিকরা এলে, ফ্ল্যাটটির তালা ভেঙে ভেতরে সার্চ করা হবে।
সবকটা চ্যানেলে একই খবর। দেখতে দেখতে ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা আমি। এখন আমার আর খিদে পাচ্ছে না। শুধু গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমার তিল তিল করে জমানো খিদেগুলো হারাতে হবে। গ্যাঁড়াবাচ্চু, ঝুঙ্কুদা দের কিছু হয় না। আমার মতো গুপি-রাই বানের জলে ভেসে যায়। কেন যে মায়ের কথাটা মনে রাখিনি। মা মাগো…!
♦♦♦—♦♦♦

  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!