শিবভোলার দেশ শিবখোলা
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
র্যশাসিত রোদ চূর্ণ চূর্ণ হয়ে লেগে আছে আগাছা জন্মানো দেওয়ালে । একটা আলোর যেন আজ পতন দেখছেন তিনি দেওয়ালটায়
নলিনীকান্তর দুর্লভ যত সংগ্রহ আছে তার মধ্যে থেকে একটিকে আজ বার করলেন তোরঙ্গ থেকে । একটি ছবি । স্বচ্ছ প্লাসটিকের প্যাকেটে ভরে বিছানার ওপর রাখলেন । তক্তপোষের অর্ধেকটা দখল করে আছে বইখাতা, খবরের কাগজের কাটিং ভরা গোটাকতক ফাইল আর চেপ্টে যাওয়া দুটো বালিশ । সুপর্ণা, বড় ছেলের বউ ইস্ত্রি করা ধুতি-পাঞ্জাবী রেখে গেছে বিছানার ওপর । পরতে পরতে বললেন, ‘খাবার হলো বৌমা?’
সুপর্ণা রান্নাঘর থেকে বললো, ‘যাই বাবা, আর দুমিনিট ।’ ধুতি-পাঞ্জাবী পরে তোরঙ্গটা যত্ন করে ঢুকিয়ে রাখলেন তক্তপোষের নিচে । এসবই তাঁর বাবার কাছ থেকে পাওয়া । বিছানার একপাশে বসলেন নলিনী । ছবিটা তুলে নিলেন বুকের কাছে । দেখলেন মৃত্যু উদাসীন দুটি চোখ, আত্মবিশ্বাসে দৃঢ় চোয়াল আর অত্যাচার চিহ্ন আঁকা চওড়া কপাল । মনে মনে বললেন, ‘বেঁচে আছো, আজও বেঁচে আছো তুমি ।’
সুপর্ণা ঘরে ঢুকলো খাবার নিয়ে । নলিনীকান্ত ছবিটা সরিয়ে নিলেন বুকের কাছ থেকে । তখনই নাতি শৌর্য ঢুকলো ঘরে । বললো, ‘দাদু আজ মাংস খেয়ে আনন্দ করার দিন নয় বলো ?’
– ঠিক ।
– তবে যে সোনাই, মুনিয়াদের আজ মাংস হচ্ছে !
– তুমি কি বলো, আজকের দিনটা কি হুল্লোড় করে কাটানোর জন্য ?
– একেবারেই না । কত মানুষের প্রাণ গেল । সেই প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন হলাম ।
এসব কথা শৌর্যকে শিখিয়েছেন নলিনীকান্ত । যে সব সত্য আজ ঝলমলে আলোর প্রাচুর্যে তলিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো ওর মতো করে বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি । ক্লাস সেভেনে পড়ে ও। একদিন স্কুল থেকে ফিরে শৌর্য বললো, ‘দাদু তুমি আমাকে ভুল শিখিয়েছ ! স্যার আমার লেখা উত্তরগুলো সব কেটে দিয়েছেন !’ নলিনীকান্ত চাইলেন খাতাটা ।
– এই তো দেখ না !
নলিনী দেখলেন প্রশ্নটা । স্বাধীনতা যুদ্ধে ফাঁসির মঞ্চে আত্মবলিদানকারী চারজন বিপ্লবীর নাম লিখতে বলা হয়েছে । তিনি শিখিয়েছিলেন যে সব নাম তার মধ্যে থেকে শৌর্য লিখেছে ক্ষুদিরাম বসু, প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ রায় আর মানকুমার বসু ঠাকুর । স্যার ক্ষুদিরামের পাশে রাইট চিহ্ন দিয়ে বাকি নামগুলো সব কেটে দিয়েছেন ।
পরদিন নলিনীকান্ত স্কুলে গিয়েছিলেন একটি ফাইল হাতে নিয়ে। শিক্ষকটির সঙ্গে দেখা করে বিনীত ভাবে সেই সময়ের খবরের কাগজ থেকে কাটিংগুলো দেখিয়েছিলেন তিনি। ডগলাসকে হত্যার জন্য প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য। মি. বার্জেকে গুলি করার জন্য রামকৃষ্ণ যায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী ও নির্মলজীবন ঘোষ, সবশেষে মানকুমার বসু ঠাকুরকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চেষ্টার অভিযোগে নির্মম ভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়। প্রদ্যোৎ, পঁচিশ ছয় উনিশো বত্রিশ । বার্জের হত্যাকারীদের, এগারো দুই উনিশো চৌত্রিশ আর মানকুমার, নাইন্টিন ফরটি থ্রি টোয়েন্টি সেভেন্থ সেপ্টেম্বর।
খুব লজ্জিত দেখালো শিক্ষকটিকে । নলিনীকান্তর কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন তিনি ।
সুপর্ণা বলল, ‘খাবারটা খেয়ে নিন বাবা । বাবুয়া টোটো নিয়ে এসে গেছে ।’
আজকের দিনটা ঘরে বসে কাটান না নলিনীকান্ত । বাবা দুর্গাচরণ মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট হত্যার ষড়যন্ত্রে, সেলুলার জেলে কাটিয়েছিলেন জীবনের অনেকগুলো বছর । তিনি দেখেছেন তাঁর ছেলেবেলায় বাবা ক্লাবে ক্লাবে পতাকা উত্তোলনের জন্য আমন্ত্রিত হতেন । সতীর্থ বিপ্লবীদের কথা বলার সময় গর্বে ভরে উঠতো বাবার বুক । পতাকা উত্তোলেনর বর্গভূমি থেকে মাটি কুড়িয়ে বাবা পরিয়ে দিতেন তার কপালে ।
খাওয়া শেষ করে ছবিটা কাঁধের ব্যাগটায় রাখলেন নলিনী । শৌর্যকে বললেন, ‘আর একটু বড় হও দাদু ভাই । তোমাকেও তখন নিয়ে যাবো কেমন ?’
টোটোয় এসে বসলেন নলিনীকান্ত । বাবুয়া জিজ্ঞাসা করলো, ‘কোন দিকে যাবো জেঠু ?’
– তোর যেদিকে ইচ্ছে ।
ছেলেটা পিছন ফিরে তাকালো নলিনীর দিকে। দু চোখে বিস্ময়। নলিনী একটু হেসে বললেন, ‘বিশ্বাস হল না ! আজ তো স্বাধীনতা দিবস। তোর যেদিকে খুশি চল ।’ টোটোটা স্টার্ট দিয়ে বাবুয়া বললো, ‘তাহলে চণ্ডীতলার রাস্তাটা ধরি ?’
– ধর ।
মেঘের রঙ সাদা হতে শুরু করেছে। ভেসে যাওয়া মেঘের চাঙড়ের ফাঁকে ফাঁকে আকাশের নীল দেখা যাচ্ছে। রাস্তার দু-দিকে সাজানো গোছানো সব বাড়ি। কয়েকটির মাথায় পতাকা উড়ছে। পথে যে কটা ক্লাব দেখলেন সবগুলো থেকেই ভেসে আসছে মাইকের তীব্র আওয়াজ। হচ্ছে চটুল সব গান। এইসব সংগীতে সংগীতে পার হচ্ছে একটা স্বাধীনতা দিবসের সূর্য। আরো খানিকটা যাবার পর টোটোটা দাঁড় করালেন নলিনী। কতকগুলো ছেলে বসে আছে । কটা ইট সাজিয়ে জাতীয় পতাকাটা উড়ছে। নলিনীকান্ত এসে দাঁড়ালেন ছেলেগুলোর কাছে। ছবিটা বার করলেন ব্যাগ থেকে। বললেন, ‘দেখোতো এঁকে চিনতে পারো কিনা ?’ ছেলেগুলো ঝুঁকে দেখলো । তারপর একজনের হাত থেকে অন্যজনের হাতে ঘুরলো ছবিটা। ফেরত দিয়ে বললো, ‘না দাদু, মালটাকে ঠিক চিনতে পারছি না।’
ট্রেন চলে গেলে যেমন মাটি কাঁপে, সেই রকম কেঁপে উঠলো নলিনীর পায়ের নিচের মাটিটা। মাথা নিচু করে ফিরে এসে বসলেন টোটোটায়। বললেন, ‘চল বাবা।’ খানিকটা গিয়ে বাঁ দিকে ঢুকতেই একটা ছোটো মতো কারখানা নজরে পড়লো। গেটের সামনে পতাকা উড়ছে। কিছু নেতা ধরনের মানুষজন বসে আছে চেয়ারে। টোটোটা দাঁড় করিয়ে এগিয়ে গেলেন নলিনী। বললেন, ‘এই ছবিটা কার বলতে পারবেন ?’ একটা মোটাসোটা লোক হাত বাড়িয়ে নিল ছবিটা। কপাল কুঁচকে দেখলো। বললো, ‘মনে হচ্ছে কোনো দাগি মালটাল হবে। থানায় জমা দিয়ে দিন দাদু।’
চারিদিকটা একবার তাকিয়ে দেখলেন নলিনী। ভাবলেন এদের কাছে এখন কি মূল্য আছে এই ছবিটার ! সেই সব দিন গুলোর কথা জানেইনা এরা। টোটোয় এসে বসতে ৰাবুয়া বললো, ‘জেঠু, এবার ডানদিক না বাঁদিক ? নলিনী বললেন, ‘কলেজের রাস্তাটা ধর । তুই তো সুধীরের ছেলে?’
– হ্যাঁ ।
– উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছিলি না ?
– ওই আর কি । উল্টো দিক থেকে একটা বাস আসছিল । তাকে পাশ দিয়ে বাবুয়া বললো, ‘জেঠু আপনি যদি আগে বলতেন আমি ব্যবস্থা করে দিতুম । ছবিটা নিয়ে এই রোদ্দুরে রোদ্দুরে ঘুরে বেড়াতে হতো না আপনাকে ।’
– কি রকম !
– ছবিটা আমার ফেসবুকে পোষ্ট করে দিলেই সঙ্গে সঙ্গে খবর হয়ে যেতো ।
নলিনীকান্ত হাসলেন একটু । মেঘের নিচে যেভাবে হাসে ক্ষনিকের বিদ্যুৎ । বললেন, ‘ওই পাঁচ আঙুলের জিনিসটা খুব সাংঘাতিক রে বাবুয়া ।’
কলেজের মোড়ে এসে দেখলেন কলেজের গেটে তালা । ভেতরের মাঠটায় পতাকা তোলার কোনো চিহ্ন নজরে এলো না ।
নলিনীর ডানহাতটা আপনা থেকেই উঠে গেল ওপরে । অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলেন তিনি। সেই অপরাহ্নের আলোয় সূর্য ছুঁয়ে যেন মাটিতে নেম এলো একটা পড়ন্ত ইতিহাস। রাগে কাঁপতে কাঁপতে তিনি ভাতের হাঁড়ি, মুরগির ডেকচি দেখিয়ে বললেন, ‘আজকের দিনটা কি ফুর্তি করে কাটাবার দিন ?
একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকলেন বাবুয়াকে নিয়ে । নিজে সামান্য কিছু খেয়ে বাবুয়াকে পেট ভরে খাওয়ালেন । ঘাড়ে মুখে জল দিয়ে বললেন, ‘তোর গাড়িটা ওই ছায়ায় একটু রাখ । রোদের তেজটা আজ বড্ড বেশি । একটু বিশ্রাম নিই ।’
– আচ্ছা জেঠু ।
– টোটোর দিকে যেতে যেতে নলিনী বললেন, ‘তুই তারকেশ্বর দস্তিদারের নাম শুনেছিস ?’
– না ।
– সূর্য সেনের সঙ্গে একই দিনে ফাঁসি হয়েছিল ছেলেটার । ভবানী ভট্টাচার্য আর রবি ব্যানার্জী ?
খুব লজ্জিত দেখাল বাবুয়াকে। তার মনে হল ওই দুটি অমূল্য জীবনও হয়তো ফাঁসিকাঠের পাটাতনের ফাঁক দিয়ে তলিয়ে গেছে ইতিহাসের অন্ধকারে। মাথা নিচু করে থাকলো বাবুয়া । নলিনী বললেন, ‘তোর দোষ নেই রে। এই সব অতীতগুলোর মধ্যে যে সব কীর্তি গরিমা লুকিয়ে আছে সেগুলোই তো আমাদের ঐতিহ্য। এটা ধ্বংস হলে অন্যের উগ্র অপ-সংস্কৃতি গুলো সহজেই গিলিয়ে দিতে পারবে এই প্রজন্মটাকে। দেখছিস না চারিদিকে তাকিয়ে। তা না হলে কালীপদ, নির্মল, ব্রজকিশোর, মনোরঞ্জন, রোহিনী, কানাই, সত্যেন আরো কত কত প্রাণ এভাবে হারিয়ে যায় ! হারিয়ে যায় একটা জাতির জীবন থেকে !’
নদীর ওপারে একটা চিমনির গা ঘেঁসে সূর্যটা হেলে পড়েছে । নদী যেন তাকে ধারণ করছে তার চঞ্চলতা দিয়ে । নলিনী বললেন, ‘চল এবার ফিরি । লালবাড়ি হয়ে খেলার মাঠের পাশের রাস্তা ধর । শর্টকাট হবে ।’
এ দিকটায় অনেকদিন আসেননি নলিনীকান্ত । একদিকে নদী আর একদিকে জনপদ । রাস্তার পাশে পাশে ত্রিফলা আলো । খেলার মাঠ ছেড়ে একটু এগোতেই দেখা গেল রাস্তার পাশেই রান্নার তোড়জোড় চলছে । কুড়ি-পঁচিশটা ছাল ছাড়ানো মুরগি বড় একটা ডেকচিতে রাখা ।
নলিনী টোটোটা থামাতে বললেন । নেমে এগিয়ে গেলেন ছেলেগুলোর দিকে । বললেন, ‘কিসের খাওয়া দাওয়া ভাই?’ একটা ছেলে বললো, ‘আরে দাদু, আজ স্বাধীনতা দিবস। জানেন না ? কেন জন্মেছেন এদেশে ?’ নলিনী স্পষ্ট মদের গন্ধ পেলেন । ছেলেটা তাঁর সামনে একা বিশ্রি অঙ্গভঙ্গি করে কোমরটা দোলালো । নলিনীকে বেশ উত্তেজিত দেখালো । বললেন, ‘স্বাধীনতার কথা বলছিলিস না তোরা ? যাঁরা সেদিন ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করে ছিল, পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল, তাঁরা ওপর থেকে সব দেখছেরে হারামজাদা । শুয়োর ।’ নলিনীর ডানহাতটা আপনা থেকেই উঠে গেল ওপরে । অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলেন তিনি। সেই অপরাহ্নের আলোয় সূর্য ছুঁয়ে যেন মাটিতে নেম এলো একটা পড়ন্ত ইতিহাস। রাগে কাঁপতে কাঁপতে তিনি ভাতের হাঁড়ি, মুরগির ডেকচি দেখিয়ে বললেন, ‘আজকের দিনটা কি ফুর্তি করে কাটাবার দিন ? কত অমূল্য প্রাণ সেদিন দিতে হয়েছিল জানিস ?’
ছোটো-খাটো একটা ভিড় জমে গেল নলিনীকে ঘিরে । ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠল, ‘দাদুর হিম্মত আছে মাইরি । নুলোর সঙ্গে পাঙ্গা দিচ্ছে !’ বাবুয়া তাড়াতাড়ি নলিনীর হাতটা ধরে টেনে নিয়ে গেল টোটোর দিকে । গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে যেতেই নদীর দিক থেকে ফুরফুরে হাওয়া এসে লাগলো তাঁর চোখেমুখে । উত্তেজনায় যেন একটা প্রলেপ পড়ল সেই আত্মীয় হাওয়ায় । বাবুয়া বলল, ‘সকাল থেকে কার ছবি নিয়ে ঘুরছেন জেঠু?’
বাতাসটা বড় মিষ্টি লাগছিল নলিনীর। বললেন, ‘দাঁড়া একটু ।’ একটা সাইড করে টোটোটা দাঁড় করাল বাবুয়া । নলিনী এবার ছবিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন ‘বিপ্লবী উল্লাসকে এখন আর কেউ চিনতেই পারে না রে বাবুয়া ! মানুষটা ক্রমশ ইতিহাসের অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে ।’ বাবুয়া দেখলো নলিনীর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল । ধুতির খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলে চলেছেন, ‘হেমচন্দ্ৰ কানুনগো ভিটেমাটি বেচে সেদিন সুদূর ফ্রান্সে গিয়েছিলো শুধু বোমা তৈরি শিখবে বলে । সেই বোমা দিয়ে অত্যাচারী ব্রিটিশদের থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করবে বলে । সেই প্রযুক্তির বোমা এদেশে প্রথম বানিয়েছিলো উল্লাসকর । সেকালের কৃতি ছাত্র বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত ।’
– উল্লাসকরের ফাঁসি হয়েছিল না জেঠু ?
– না রে । নিজের বানানো বোমা পরীক্ষা করতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন তিনি । সঙ্গী প্রফুল্ল চক্রবর্ত্তী মারা গিয়েছিলেন সেই বোমা পরীক্ষার বিস্ফোরণে । সকলের অজান্তে । অগ্নিযুগের প্রথম শহীদ ।
– আর উল্লাসকর ?
– উল্লাসকরের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল প্রথমে । পরে রায় বদলে হয় দ্বীপান্তর । কালাপানি পেরিয়ে সেলুলার জেলের সেই ভয়ঙ্কর কুঠুরি ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই টোটোটা এসে দাঁড়ালো নলিনীকান্তর বাড়ির সমানে । বাবুয়ার টাকা মিটিয়ে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালেন তাঁর ভিটের আঙিনায় । সুর্যশাসিত রোদ চূর্ণ চূর্ণ হয়ে লেগে আছে আগাছা জন্মানো দেওয়ালে । একটা আলোর যেন আজ পতন দেখছেন তিনি দেওয়ালটায় । একটার পর একটা গুলি খেয়ে সেদিন মাটিতে লুটিয়ে পড়েও যে পতাকাটি উর্দ্ধে তুলে রেখে ছিলেন সেই বৃদ্ধা, সেটা টাঙিয়ে আজ ডান্স, ফিস্টি, মদ খাচ্ছে ছেলেগুলো। নাকি এতকষ্টের পাওয়া স্বাধীনতা এইভাবেই ফুর্তি করে পালন করা উচিৎ! কোথাও কি ভাবনায় ভুল হচ্ছে তাঁর !
বাবুয়া এসে ডাকলো পিছন থেকে । বললো, ‘জেঠু সন্ধ্যেবেলা ক্লাবে নাচ-গান-নাটক । ওই ছবিটা দেবেন ? মঞ্চের একপাশে রাখবো ।’
নলিনী বললেন, ‘যত্ন করে ফেরৎ দিবি তো ?’
– দেবো জেঠু । উল্লাসকর সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য দিন না । একটা কাগজে লিখে নিই ।
– আয় । তবে ভেতরে আয় ।
সন্ধ্যা নামছে। ছাদ থেকে পতাকাটা খুলে গুছিয়ে রাখলেন নলিনী । সুপর্ণা চা আর মুড়ি এনে বললো, ‘সারাদিন তো অনেক ধকল গেলো বাবা । আজ না হয় শৌর্যকে নাই পড়ালেন ।’ চায়ের কাপটায় চুমুক দিয়ে একটু হাসলেন তিনি । কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই সেখানে । বললেন, ‘বইখাতা নিয়ে দাদুভাইকে এখানে পাঠিয়ে দাও বৌমা ।’
কিছুক্ষন পড়ানোর পর কাছে পিঠের কোনো জাগয়া থেকে মাইকের শব্দ কানে আসছিল তাঁর । উপেন্দ্র, বারিন, সেলুলার এই শব্দগুলো বলছে কেউ । বললেন, ‘আয় দাদুভাই, একবার ছাদে যাই ।’
ছাদে এসে কথাগুলো বেশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন নলিনী । ছেলেটি বলে চলেছে, ইটের গোলায় অমানুষিক পরিশ্রমের পর প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন উল্লাসকর । একশো পাঁচ ছয় ডিগ্রী জ্বরে তাঁকে শুধু ভাতের মাড় খাইয়ে দেওয়ালে হাতকড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল সারারাত । ভোরবেলা হাতকড়ি বাঁধা অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে ঝুলছিলেন তিনি । শুধু একজন উল্লাসকর দত্ত নয়, তাঁর মতো আরো শত শত প্রাণের আত্মবলিদান, যাঁদের নাম গুলো আজ…’
সারাদিন পর মনটা আনন্দে ভরে উঠল নলিনীকান্তর । আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালেন তিনি । দেখলেন, শত শত নক্ষত্রের কিরণ নেমে আসছে মাটির দিকে ।
♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।
মিরিক নামটি এসেছে লেপচা ভাষার “মির-ইওক” শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুনে পুড়ে যাওয়া জায়গা।
15:34