- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- জানুয়ারি ২২, ২০২৩
দরবেশ
এক আশ্চর্য কূপ আছে দরগা মহল্লার ভিতর। যেখানে বড়ো বড়ো দুই সোনার গজার মাছ খেলা করে, সাড়ে সাতশ বছরের পুরোনো। মক্কার জমজম কূপের সঙ্গে দরগার কুয়োর যোগ আছে। ওখান থেকে একজন টাকা ভর্তি স্যুটকেস পাঠিয়েছিলেন, সিলেটে ভেসে উঠেছিল গজার মাছের পিঠে ভর করে

অলঙ্করণ: দেব সরকার
বর্ধমানের দরবেশ চৌধুরীর সখ দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর। কার্জন গেটের গায়ে তার মিষ্টির দোকান ‘দরবেশ সুইটস।’ বাংলার বিখ্যাত কিছু মিষ্টির জন্য সুনাম তার দোকানের। ল্যাংচা সীতাভোগ মিহিদানা আর মোটা দানার তিন রঙা দরবেশ। গুরু পুরোহিত বংশের সন্তান তার দাদু মন্ত্রোচ্চারণ ছেড়ে বাউল গান গাইতে শুরু করেন মাঝ বয়সে। খাতার পর খাতা ভর্তি করে গান লিখতে শুরু করেন। নাতির জন্মের পর দরবেশ নাম রেখে তাঁর সাধের একতারা আর নানান রঙে রঙ করা আলখাল্লা গায়ে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন নিরুদ্দেশ। যাওয়ার আগে বাড়ির ইন্দারায় গানের খাতা সমর্পন করে যান।
দরবেশ নামের লাড্ডুটিও তিন রঙের বোদে মিলিয়ে বানানো হয়। দরবেশের আলখাল্লারও যে প্রধান রঙ তিনটি। তাদের দোকানের প্রতিটি মিষ্টিরই একটি ইতিহাস আছে। আর ছোটো দরবেশের বাবা খণ্ডঘোষ হাইস্কুলের মাস্টারমশাই সে সব ইতিহাস বাংলায় লিখে রেখেছেন ছেলের নামের দোকানে। আদি বর্ধমানের ল্যাংচাকে বাংলাদেশের নেত্রকোনায় বলা হয় বালিশ মিষ্টি। ক্ষীরপাইয়ের বাবরশা দিল্লির বাদশাহকে ভেট দেওয়া হয়। সব থেকে বেশিদিন রেখে খাওয়া যায় জনাইএর মনোহরা। কাঁচা ছানায় চিনির সিরা মিশিয়ে গোল্লা পাকালেই হয়ে গেল কাঁচাগোল্লা। তবে নবীন দাস থেকে ওডিশার সঙ্গে লড়াইয়ের অনেক আগেই ওপার বাংলার পিরোজপুরে ক্ষিরমোহন নামে প্রথম উদয় হয় মিষ্টির রাজা রসগোল্লার। খদ্দেরের জ্ঞানপিপাসা মেটাতে দোকানে সাজানো মিষ্টির সঙ্গে ফাউ ইতিবৃত্তকথা জানতে ভিড় বাড়তে থাকে। বিক্রিও বাড়ে। এদিকে দরবেশ চৌধুরীও স্কুল ফাইন্যাল দিয়েই চলে যায় সুইজারল্যান্ডের লুসান বিশ্ববিদ্যালয়ে। আতিথেয়তা বিদ্যা শিখে এসে মিস্টির দোকানদারি করছে। এখন তার ইচ্ছে হয়েছে পাশাপাশির রাজ্যগুলিতে ফ্র্যাঞ্চাইজি দেবে ‘দরবেশ সুইটস’এর । প্রথমটি সে তার শ্বশুর বাড়ি শিলচরে দেওয়ার কথা ভেবে রেখেছে।তাহলে একমাত্র শালারও একটা হিল্লে হয়ে যায় আর মণ্ডা ম্যাডামকেও খুশি করা যায় যারপরনাই।
শিলচরের নাজিরপট্টিতে একটু বেশি দামেই দোকান একটা পাওয়া যায়। এসব দোকান কেনাবেচার ব্যাপারে তার কাজ শুধু টাকা দেওয়া, বাকি সব বিলি ব্যবস্থা শ্বশুর আর শালার। শিলচর এসে সে আইরংমারার শ্বশুর বাড়িতে বসে চাতলা হাওরের নানা রকমের মাছ খায় আর ধলাইর জঙ্গলে শিকার করতে যায়। এখানে নিষিদ্ধ বলে কিছু নেই, টাকা ছড়ালে সব পাওয়া যায়। হরিণ কচ্ছপ বনরুই বনমোরগ থেকে গৃহপালিত পাঁঠা পাওয়া যায় যখন তখন। তবে দেশি মদে তার রুচি নেই, বিলিতি আসে শিলচরের জিতেন ফ্যাক্টরি থেকে।
কিন্তু হঠাৎ একদিন জঙ্গলের ভিতর দার্বি বাগানের সৌন্দর্য দেখে তার পরিকল্পনা পালটে যায়। এত সুন্দর ছবির মতো সুন্দর সাজানো চা বাগানের সামনে একটি বিশাল ঝিল, আর ঝিলপারে কত প্রজাতির গাছ । গাছের শাখায় কিচিরমিচির পাখির কলতান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসও যে জড়িয়ে আছে বাগানের মর্মে, বোমা পড়ে বাগান নাকি জনশূণ্য হয়ে গেছিল। শালাকে ডেকে বলে,
— ফ্যাঞ্চাইজি ক্যানসেল।
বাগান সংলগ্ন ধলাই বনাঞ্চলে সে জমি কিনবে, কৃষিকাজ করবে। বউ মন্ডা চৌধুরী বলেছিল থাকবে না জঙ্গলে । দরবেশ বলেছিল, হিন্দি সিনেমার নায়ক ধর্মেন্দ্র যদি খান্ডালার গ্রামে বসবাস করে ফার্মিং করতে পারেন, তারা কেন পারবে না। বউকে বলেছিল,
— দালাল লাগাও ।
পাঁচ বিঘে জমি কেনা হয় প্রথম লপ্তে, দাদন দিয়ে দখলও নেওয়া হয় জমির।তবুও অধিকরণ কারকে সপ্তমী বিভক্তিতে ‘কিন্তু’ যুক্ত হয়ে সব পণ্ড হওয়ার মুখে। কেনা হয়েও হয় না আইনি জটিলতায়।
জমির দলিল করতে গিয়ে হয় বিভ্রাট। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সই করতে গিয়েও কলম উঠিয়ে নেন। বলেন,
— নামটা যেন কেমন মনে হচ্ছে উকিল সাহেব?
— কেন স্যার? ঠিকই তো আছে। ক্রেতা সমরেশ চৌধুরী পিতা অমরেশ চৌধুরী।
— সমরেশ কোথায় পেলেন, এ তো দরবেশ। বাংলাদেশি নয় তো?
— এমন নাম তো বলে নি আগে।
বৃদ্ধ উকিলের মনেও সংশয়। হাকিম সাহেব বলেন,
— ভোটার লিস্টে নাম আছে?
— আছে স্যার, ভোটার কার্ড দেখেছি, প্যান কার্ড আধার কার্ড স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড ডেবিট কার্ড ক্রেডিট কার্ড পাশপোর্ট, সব আছে।
— এনআরসিতে নাম আছে?
— না স্যার, ওয়েস্ট বেঙ্গলের ভোটার।
— হোক ওয়েস্ট বেঙ্গল, কনফার্মেশন লেটার ছাড়া ছাড়া যাবে না। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে ঢুকিয়ে দিন।
— ছেড়ে দিন না স্যার, বিরাট ধনী মানুষ। বর্ধমানের ‘দরবেশ সুইটস’এর মালিক ।
— ঠিক আছে, লাঞ্চের পর নিয়ে আসুন চেম্বারে, ইন্টারোগেট করে দেখি।
দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর শুরু হয় তদন্ত।
— নাম?
— দরবেশ চৌধুরী।
— হিন্দু না মুসলমান?
— লেখা আছে দলিলে।
— মুখে বলুন?
— হিন্দু ।
— দরবেশ তো মুসলমান নাম।
— দরবেশ বর্ধমানের বিখ্যাত মিষ্টি। বাউল ফকিরদের আলখাল্লার মতো নানান রঙের বোঁদের নাড়ু।
— বিদেশে পড়াশুনা করেছেন?
— হ্যাঁ, সুইজারল্যান্ডে
— পাকিস্তান গেছেন?
— না।
— বাংলাদেশ?
— গেছি।
— কোথায় গেছেন ?
— সিলেট।
— সিলেট কেন? দেশের বাড়ি দেখতে?
— জি না। আমি পশ্চিমবাংলার বাঙালি। শ্বশুরবাড়ির দেশে বেড়াতে গেছি।
— কী কী দেখলেন মথুরাপুরিতে?
— দেখলাম দরবেশের বাড়ি।
— আপনার বাড়ি?
— দরবেশ শাহজালালের মাজার। আপনি গেছেন?
— এক আশ্চর্য কূপ আছে দরগা মহল্লার ভিতর। যেখানে বড়ো বড়ো দুই সোনার গজার মাছ খেলা করে, সাড়ে সাতশ বছরের পুরোনো। মক্কার জমজম কূপের সঙ্গে দরগার কুয়োর যোগ আছে। ওখান থেকে একজন টাকা ভর্তি স্যুটকেস পাঠিয়েছিলেন, সিলেটে ভেসে উঠেছিল গজার মাছের পিঠে ভর করে।
— যতসব গাঁজাখুরি গল্প ।
— না স্যার, চমৎকার হয়েছিল, সেই টাকা দিয়ে লোকটি টাংগুয়ার হাওরের পারে মসজিদ বানিয়েছিল। এখনও লোকে ওই দেবালয়কে লন্ডনি মসজিদ বলে।
— আপনিও কি দার্বি বাগানে মসজিদ বানাবেন?
— না না। একটা কুয়া বানাব, আমার জমিতে জলের কোনও উৎস নেই।
— আপনার জমি? উঁহু আশা নেই। তবে বুঝলাম দরবেশ নামের উৎস। তা আলি না মোল্লা?
— কিসের আলি মোল্লা?
— আপনার?
— আমরা চৌধুরী ব্রাহ্মণ, গোত্র পদবি শর্মা।
— প্রমাণ আছে?
— আছে। দিয়েছি পাঁচ প্রকার। আরও দিতে পারি সফট কপি।
— সব বাতিল হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বৈধ নাগরিকত্বের সংশাপত্র দিলে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালকে দেখাবেন। এখনই ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢোকাচ্ছি না, তবে প্রতি সোমবার ধলাই থানায় গিয়ে সই করে আসতে হবে।
জজের আদেশে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় দুজন পুলিশও মোতায়েন হয় দরবেশ বাড়ির প্রধান ফটকে। এক সর্বক্ষণের সহায়ক আর কূয়াকাটার চার শ্রমিক শুধু বাইরে বেরোতে পারে। পাঁচ বিঘা জমির উপর এক ছোটো ঘরে থাকে দরবেশ চৌধুরী বউ বাচ্চা নিয়ে। এক মাসের মাথায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসেছিল। ঘটা করে গঙ্গাপূজা হয়েছিল, শালা অদ্বৈত বলেছিল জজসাহেবকে নিমন্ত্রন করতে। উকিলবাবু জজসাহেব দুজনই বলেছিলেন আসবেন, কেউই আসেননি। ইন্দারায় জল উঠেছিল ভুসভুমিয়ে, পুজোর পর দরবেশ তাদের টাকা পয়সা জামা কাপড় সব সুটকেশে ভরে কূয়ার জলে সমর্পণ করে। পরদিন শিলচরের সবকটা দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় অভিনব এই জলপূজা আর সমর্পণের খবর ছাপা হয়। লোকসাহিত্যের অধ্যাপক নির্মলেন্দু বিশ্বাস তার সংযোজনীতে জানান সিলেট কাছাড়ে এরকম প্রথা চলে আসছে প্রাচীন কাল থেকে, যেমন চলছে নৌকা পূজার দেশাচার। সঙ্গে দরবেশের নাগরিকত্ব নিয়ে কোর্টকাছারির কথাও লেখা হয়।
জজ সাহেব উকিল বাবুকে ডেকে বলেন,
— ক্রেজি!
— স্যার।
— লোকটার মতলব কী?
— কী করে বলব স্যার, আমরা তো যাই নি!
— আপনি তো ওর উকিল, যেতে পারতেন।
— দলিলের উকিল, বিদেশির নয়।
— না না, একজন মানুষকে প্রমাণ ছাড়া আপনি বিদেশি বলতে পারেন না।
— আপনিই তো বললেন, আমি বলি নি।
-— তা ঠিক। চাকরি করি, বুঝেনই তো! তারপর এরকম ঝামেলার নাম। তা লোকটা পাতকূয়া থেকে মালপত্র উঠিয়েছে, টাকা পয়সা? এরপর কী করবে, জানেন কিছু?
— না স্যার।
— তা হলে কি অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট একটা বের করে দেব?
সংবাদমাধ্যমের খবর
টিভি নিউজ।
“এই মাত্র বিশ্বস্তসূত্রে খবর পাওয়া গেল, বিদেশি সন্দেহে নজরবন্দি হওয়া দরবেশ চৌধুরী নামের এক যুবক তার পত্নী ও শিশুকন্যা সহ নবনির্মিত পাতকূয়ার ভিতর ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। খবরের সত্যতা ‘টিভি এখন’এর পক্ষ থেকে যাচাই করা সম্ভব হয় নি। “
সংবাদপত্রের খবর।
টিভি খবরের পরদিন দৈনিক পত্র পত্রিকায় যাচাই করা সংবাদ পরিবেশিত হয় এই রকম,
“ডুবুরি লাগিয়ে কূয়ার ভিতর থেকে লাশ কিংবা টাকা পয়সা কাপড় চোপড় সুটকেশ কিছুই উদ্ধার করা যায় নি।
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে দরবেশ চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে রাজ্য প্রশাসনের তরফ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে কার্জন গেটের পাশে ‘দরবেশ সুইটস’ নামের কোনো মিষ্টির দোকান কোনও কালে ছিল না।”
♦♦♦♦ ♦♦♦♦ ♦♦♦♦ ♦♦♦♦
❤ Support Us