- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪
ছুটি
ছোটগল্প লেখার হাতটা ভারী মিষ্টি মধুপের। চারপাশের বাস্তব আর নিজের জীবনটাকে মিলিয়ে মিশিয়ে এত সুন্দর পরিবেশন করে, গল্পগুলো একেবারে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। পাঠক হিসাবে শুরু হলেও মধুপ আর রিমার সম্পর্কটা এখন বেশ ঘনিষ্ঠ। যদিও এই আকর্ষণের রসায়ন দুজনেরই অজানা।
আর কোন সম্পর্কের জালে নিজেকে জড়াবেনা, এমনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রিমা। মধুপের ভালোবাসার টান সেই সিদ্ধান্তকে কখন যে চুরমার করে দিয়েছে তার খবর রাখা হয়নি। মধুপের সমস্ত দু:খ, কষ্ট, যন্ত্রণা সব কিছুর উপশম হয়ে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায় রিমা। এমন এক আশ্চর্য প্রদীপ হাতে পেতে চায় যার ছোঁয়ায় নিমেষে সত্যি করে ফেলতে পারে মধুপের সব স্বপ্ন, সাকার করে দিতে পারে ওর সমস্ত কল্পনা। মধুপের স্বপ্নের নাগাল পেতে গোগ্রাসে পড়তে থাকে ওর মিষ্টি হাতের ছোটগল্পগুলো। একটা গল্পে অনন্য মধুপকে আবিষ্কার করে রিমা। শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যন্ত্রণায় কাতর একজন মানুষ, প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চায় তার ছোটবেলার ফেলে আসা দিনগুলো। অনুভব করতে চায় জন্মভূমির মাটির আঘ্রাণ, ফিরে পেতে চায় শৈশবের গন্ধ মাখা বাতাসের আস্বাদ।
“জানো রিমা এই বটগাছটার তলায় আমরা কত খেলা করেছি। দাদুর যে বাড়িটায় আমি জন্মেছি, সেখানে হেন ফলের গাছ নেই যে ছিল না”
গল্প শুনতে শুনতে চোখের সামনে দেখতে পায় রিমা। ফর্সা গোলগাল মেয়েটা ছোট ছোট পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে চৌকো উঠোনটায়। আহ্লাদী মুখখানা সারল্যে ভরা। এর কোল থেকে ওর কোলে ঘুরতে ঘুরতে কোন একজনের কাঁধে ঘুমিয়ে পড়েছে পরম নিশ্চিন্তে।
“খুব ইচ্ছে করে জানো মামারবাড়ির এই গ্রামটায় যদি আমার একটা থাকার জায়গা থাকত!”
“এতদিন শহুরে আধুনিকতায় বড় হয়েছ গ্রামে গিয়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবে না মধু?”
“তা হয়তো একটু হবে, কিন্তু শিকড়ে ফিরতে পারার সুখ আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে”
শিকড়ে ফিরতে চাওয়ার দুর্বার আকুলতা রিমাকে নাড়া দিয়ে যায়। কিন্তু মধুর এমন ইচ্ছেপূরণ করার সাধ্য কোথায় ওর? নিজের শিকড়ছেঁড়া জীবনটাকে সাজিয়েগুছিয়ে নিতে গিয়ে সঞ্চয় বলতে তো আর কিছুই নেই। কি নিয়ে এগোবে এত কঠিন পথে?
“আমি স্বপ্ন দেখি জানো, আমার একটা ছোট্ট বাড়ি হবে, তার চারদিকে বাগান, সবরকম ফলের গাছ, সামনে মরসুমি ফুল, পিছনে ছোট একটা সব্জিবাগান…..।”
“সে স্বপ্ন সত্যি করা যায় না মধু?”
“কি যে বলো! এক টুকরো জমি কেনার ক্ষমতাই নেই আমার, তার উপর আবার বাগানবাড়ি।”
“আমরা দুজনে মিলে যদি চেষ্টা করি মধু? পারব না?”
একরাশ বিস্ময় নিয়ে রিমার দিকে তাকায় মধুপ। কি বলছে ও? অবিশ্বাস্য হলেও যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে ওর কথা। সত্যিই কি সম্ভব আস্ত একটা বাড়ি তৈরী করা! রিমার কথায় ভরসা পায় মধুপ। রিমার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে। প্রত্যয়ের এই গভীরতার মর্যাদা রাখতে নিজেকে প্রস্তুত করে রিমা।
হন্যে হয়ে জমি খোঁজা দিয়ে শূণ্য থেকে শুরু হয় স্বপ্নের জালবোনা। যতই গ্রাম হোক না কেন সাধ আর সাধ্যের তাল মিলিয়ে জমি পাওয়া সহজ কাজ নয়। অগত্যা দ্বারস্থ হতে হয় জমি বেচাকেনার কারবারিদের। এধরণের মানুষের সান্নিধ্যে এই প্রথম আসা দুজনের। কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় ভয়, আশংকা, উদ্বেগ কিছুই আর হয় না। রিমার স্বপ্নের গতি অত্যন্ত ক্ষিপ্র। জমি কোথায় তার ঠিক নেই বাড়ির নাম দিয়ে বসে ‘মধুরিমা’। নামটা মন্দ লাগেনা মধুপের। শিকড় হারানোর যন্ত্রণাটা আরো চাগাড় দিয়ে ওঠে।
নতুন বাড়িতে থাকার প্রথম দিনটা চুড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল। সন্ধ্যে একটু গাঢ় হতেই দেখা দিল প্রাক পূর্ণিমার টোল খাওয়া চাঁদ। জ্যোৎস্নামাখা দুধসাদা ‘মধুরিমা’ – ঠিক যেমন কল্পনা করেছিল দুজনে। দক্ষিণের খোলা বারান্দায় অন্ধকারে বসে মধুপের মুখের দিকে তাকায় রিমা
অনেক খোঁজাখুঁজি,দরকষাকষি, ভাবনাচিন্তা করে পছন্দসই জমি একটা পাওয়া গেল ‘মধুরিমা’র জন্য। এবার পালা রেস্তো জোগাড় করার। সময়মত টাকার জোগাড় না হলে হাতছাড়া হবে জমিটা। এ কিছুতেই হতে দেবে না রিমা। দুজনে মিলে অনেক আলোচনা করে কুড়িয়ে বাড়িয়ে কোনরকমে কেনা হল জমিটা। ভেঙে ফেলতে হল ভবিষ্যতের বেশ কিছুটা সঞ্চয়। রিমার অবশ্য সে নিয়ে কোন ভাবনা নেই। ওর না আছে ভূত, না ভবিষ্যৎ। মধুপ একটু চিন্তায় পড়েছিল বটে। অর্থ ছাড়া এ পৃথিবীতে ভরসা করার মত ওর আর কিছু নেই। জমিটা দেখামাত্রই কত পরিকল্পনা করে ফেলেছে মধুপ। এইখানে ফুলের গাছ হবে, এই জায়গায় বকুলবীথি, এই কোণায় আমগাছ, এখানে সব্জিবাগান, দক্ষিণে বারান্দা। বাড়ি বানানোর অভিজ্ঞতা দুজনের কারোরই নেই। হ্যাপাও তো কিছু কম নয়। রেজিস্ট্রি অফিসে হয়রানি, জেলা পরিষদ সদস্যের টালবাহানা, এলাকার দাদাদের চোখরাঙানি সবকিছুই সহ্য করতে হচ্ছে। দুজনে একসাথে লড়াই করছে এটাই যা রক্ষে। অন্য কারও সাহায্য নেওয়ার খুব একটা পক্ষপাতী নয় দুজনের কেউই।
বালুতটে ঝিনুক কুড়োনোর মত এদিক ওদিক থেকে টাকার সন্ধান করে চলেছে মধু-রিমা। সেই সঙ্গে কল্পনার ক্যানভাসে তুলির টান দিয়ে চলেছে মধুপ।
“আচ্ছা রিমা মাটির ঘর আর খড়ের চাল করলে কেমন হয়?”
“দারুণ রোমাঞ্চকর হয় বটে কিন্তু প্রতিবছর এর রক্ষণাবেক্ষণ খুব খরচ সাপেক্ষ হবে”
“সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছ”
রিমার প্রতিটা কথায় মধুপের অগাধ ভরসা। প্রথমেই ঠিক হয়েছে সমস্ত সম্পত্তিটা দুজনের এবং দুজনেই সমান যোগদান দেবে এ সম্পত্তি বানাতে। ঝিনুকের সংখ্যায় কারো কমবেশি হবে না। নিজেরটুকু গুছিয়ে নেওয়ার দুনিয়ায় এক বিরল সিদ্ধান্ত বটে।
সেদিন গল্প করতে করতে কাগজে কি যেন একটা আঁকছিল মধুপ। হঠাৎ রিমার দিকে ঘুরিয়ে ধরল কাগজখানা।
“আমি খুব ভালো আঁকতে পারিনা তবু দেখো তো রিমা বাড়িটা যদি এরকম হয়?”
মধুপ যেমন এঁকেছে বাড়ি সেরকমই হবে। অন্য কিছু ভাবার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। ওদের কল্পনার কাঠামোয় মাটির প্রলেপ দিতে এগিয়ে এলো ইন্দ্র। স্থাবর সম্পত্তির বিষয়ে অক্ষরজ্ঞানহীন দুই দিদির বাড়ি বানানোর যাবতীয় দায়িত্ব তুলে নিল নিজের ঘাড়ে। মাটির ঢিপি সর্বস্ব একখন্ড জমি ঘিরে দেওয়া হল কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে। পরিষ্কার হল মধু-রিমার মহালের সীমানা।
শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে রিমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরেছে মধুপ। একটি শব্দও নেই তবু কত কথা বলে চলেছে দুজনে। শিকড়ে ফেরার স্বপ্ন ডানা মেলতে শুরু করেছে একটু একটু করে। ‘মধুরিমা’ ভ্রূণ থেকে পূর্ণ অবয়বের দিকে এগিয়ে চলেছে পায়ে পায়ে।
“দক্ষিণের বারান্দাটা একদম খোলা রাখব আমরা। কোন আড়াল দেব না। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। দারুণ হবে তাই না রিমা!”
“বেশ তাইই হোক”
এটা হবে ওটা হবে না, এটা ভালো ওটা মন্দ, ডাইনিং টেবিল গোল নয় ওভাল, খাটের সাইজ কুইন নয় কিং, এই সব করতে করতে এগিয়ে চলতে লাগল মধুরিমা। রিমা আর মধুপ প্রতিদিনের ভাঙাগড়া দেখতে পায়না। ওদের এক দেশে চাষ আর এক দেশে বাস। এই সুযোগে খানিকটা মাষ্টার হয়ে ওঠে ইন্দ্র। থেকে থেকেই ফোন করে— ” দিদি এত টাকা পাঠাতে হবে”
সরল বিশ্বাসী মধুপ নির্দ্বিধায় মিটিয়ে চলে ফরমাইশ। মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে রিমাকে— “একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না রিমা!” রিমা উত্তর করে না। কিছুটা পছন্দ হল কিছুটা হল না। মধু অনুযোগ জানায় রিমার কাছে। রিমার একটু অভিমানই হয়। তাকে বলে কি হবে? সে কি ওসবের কিছু বোঝে ছাই! নিজে বললেই তো পারত! মনে মনে একটু কষ্টও পায়। এত চেষ্টা করেও মধুকে সে খুশি করতে পারল না। পারল না স্বপ্নলোকের সেই চাবিটা মধুর হাতে তুলে দিতে যা দিয়ে সে তার স্মৃতির প্যান্ডোরা বক্সটা খুব সহজে খুলে ফেলতে পারে।
সকলের কাছে মিসআন্ডারস্টুড হওয়াটা রিমার ভবিতব্য। জীবনে মাত্র দু’এক জন মানুষকে মনে ধরেছে তার। আর তাদের জন্য নিঙড়ে দিতে চেয়েছে নিজেকে, নি:শেষ করে দিতে চেয়েছে নিজের সবটুকু। তবু কোথাও যেন কিছু খামতি রয়ে গিয়েছে। আসলে কারো নিজের কেউ হয়ে ওঠার ভাগ্য বিধাতা রিমাকে দেননি। কেমন যেন বেয়াড়া বেখাপ্পা একটা মানুষ রিমা – ম্যাডাম মিসআন্ডারস্টুড।
মধুর ধ্যান জ্ঞান এখন শুধুই হরিমোহনপুর। সেখানেই যে রোজ রঙীন হয়ে উঠছে তার স্বপ্ন। প্রথমে কঠিন লোহার কাঠামো, তার উপর নরম বালি সিমেন্টের আস্তরণ।
“মধুরিমা খুব সাধারণ জিনিস দিয়ে সাজাবো আমরা।”
ঘাড় নেড়ে সায় দেয় রিমা। অসাধারণ কিছু করার সাধ্যই বা কোথায়! এইটুকু করতেই আনা পয়সার হিসেব করতে হচ্ছে দুজনকেই। কোথা থেকে দু’পয়সা উদ্বৃত্ত হলেই তা তুলে রাখা হচ্ছে মধুরিমার জন্য।
“কতদিন কোথাও বেড়াতে যাইনি”
রিমার গলা জড়িয়ে আব্দার করে মধুপ। রিমার গলা বুজে আসে। বুকের কষ্ট সামলে ধমক দিয়ে ওঠে— “সব একসাথে হয় না মধু। এখন আমাদের বেড়ানোর একটাই জায়গা — হরিমোহনপুর” ধমক খেয়ে চুপ করে যায় মধুপ। মুখ ঘুরিয়ে কোনরকমে চোখের জল আড়াল করে রিমা।
হালকা হলুদ দেওয়ালটায় ফুটলাইটের আলো এসে পড়ছে। ঘরটা যেন ইন্দ্রমহল। ওই হলুদ চিত্রপটে কত রকম রঙের তুলি বোলাচ্ছে রিমা। নিজেকে উজাড় করে দিতে পারার প্রশান্তির আবেশ রিমার দুচোখ ছুঁয়ে যায়
মধুরিমা তৈরী হওয়াটা কেমন ঠাকুর দালানে প্রতিমা গড়ার মত। কাঠামোর উপর মাটির প্রলেপ দিয়ে তারপর চলছে সাজানোর পালা। সমস্তটা গড়ার মাঝে প্রায়ই দুজনে আসে হরিমোহনপুর। পঁচিশ নম্বর মধুবংশীর গলির মত একটা এঁদো ঘরে এসে ওঠে। সে ঘর যেন কয়েদখানা। না ঢোকে আলো, না বাতাস। ঐ ঘরের শক্ত বিছানায় শুয়ে মধুরিমার স্বর্গসুখ খুঁজে বেড়ায় দুজনে। প্রতিমার চক্ষুদানের মত রঙের প্রলেপ পড়ে মধুরিমায়। স্বপ্নের তাল কেটে যায় ফোনের আওয়াজে। ইন্দ্রর ফোন— “দিদি আপনাদের বাড়ি তো প্রায় শেষ করে এনেছি, আমাকে লাখ তিনেক টাকা পাঠিয়ে দিয়েন”।
“এক সাথে তিইইইন লাখ!!!!” আর্তনাদ করে ওঠে মধুপ। ওর মাথায় হাত রাখে রিমা।
“এটা তো হবেই মধু! এইজন্যই তো আমরা সব শখ আহ্লাদ ছেড়ে একটু একটু করে টাকা রাখলাম”
রিমার কথায় শান্ত হলেও মন বড় উচাটন মধুপের। শেষ পর্যন্ত পারবো তো! পাশে দাঁড়িয়ে আশ্বস্ত করে রিমা—”পারবে মধু ঠিক পারবে”
সারাদিন মশগুল থাকতে থাকতে হঠাৎ একদিন তৈরী হয়ে গেল মধুরিমা। মধুপ আর রিমার সন্তান। যাকে নিয়ে ওরা নিরন্তর রূপকথা রচনা করে চলে। সমস্ত ছবিই ক্যানভাসে ফুটেছে। যেমন ওরা এঁকেছিল। কোথাও যে একটু আধটু গোলমাল হয়নি তা নয়, তবে মোটের উপর পরীক্ষায় ভালোভাবেই পাস করে গেছে ইন্দ্র।
প্রত্যেকবার হরিমোহনপুর থেকে ফেরার পথে ছোটবেলায় খেলা করা সেই বটতলায় একবার দাঁড়ায় মধুপ। লম্বা শ্বাস নিয়ে বুকে ভরে নেয় শিকড়ের গন্ধ ভরা নির্মল বাতাস। অনেক চেষ্টা করেও রিমার কাছে লুকোতে পারেনা দুফোঁটা চোখের জল। রিমা মনোবল বাড়াতে থাকে। একদিন এই চোখের জল নিশ্চয়ই হাসিতে বদলে যাবে।
আজ সেই ইচ্ছেপূরণের দিন। বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছে মধুপ। পালকের মত আঙুল চালিয়ে দিচ্ছে মনের মত করে রাঙানো দেওয়ালগুলোয়। আনন্দে আত্মহারা মধুপের গলায় উঠছে সুরের ঝংকার। শিকড়ে ফেরার আনন্দে মাতোয়ারা এই মানুষটাকে দেখে এবার চোখে জল আসে রিমার। বন্ধুকৃত্য করতে পারার এই সুযোগটুকু দেওয়ার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায় রিমা।
নতুন বাড়িতে থাকার প্রথম দিনটা চুড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল। সন্ধ্যে একটু গাঢ় হতেই দেখা দিল প্রাক পূর্ণিমার টোল খাওয়া চাঁদ। জ্যোৎস্নামাখা দুধসাদা ‘মধুরিমা’ – ঠিক যেমন কল্পনা করেছিল দুজনে। দক্ষিণের খোলা বারান্দায় অন্ধকারে বসে মধুপের মুখের দিকে তাকায় রিমা। ধ্রুবতারার মত উদ্ভাসিত সে মুখে স্বপ্নপূরণের প্রশান্তির রূপটান। প্রাণ ভরে গেল রিমার। মনে পড়ে গেল মধুপের ছোটগল্পের বাছাই করা শব্দগুলো।
হালকা ফুটলাইটের আলোয় সাদা চাদরে মোড়া বিছানাটা যেন উদ্বাহু কীর্তনীয়া। এমন মাদকতা আগে কখনও অনুভব করেনি রিমা। নিজের বাড়িতে নিজের মানুষকে নিবিড় করে পাওয়ার ভাবনা শিহরণ জাগায় সারা শরীরে। কত পরিকল্পনা করে রেখেছে মধুপ।
“প্রথম যেদিন ওই বাড়িটায় থাকব, আমরা সারারাত গল্প করব। জ্যোৎস্নার মৃদু আলোয় আবিষ্কার করব আমার অর্ধেক আকাশকে।”
রিমার মনে লেগেছিল রঙের ছোঁয়া। আবিষ্কার করার মত কিই বা আছে তার! আর যদি বা থেকেও থাকে কেউ তো কখনো আবিষ্কার করতে চায়নি! আজ তার মধ্যে কি খুঁজে পেল মধু? বরাবর নিজেকে এই প্রশ্ন করেছে। আজ উত্তর পাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে রিমা। হয়তো বা এখনই, কিংবা একটু পরে। নববধূর মত নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে রিমা। প্রেমাস্পদের স্পর্শসুখের অপেক্ষায়। হালকা হলুদ দেওয়ালটায় ফুটলাইটের আলো এসে পড়ছে। ঘরটা যেন ইন্দ্রমহল। ওই হলুদ চিত্রপটে কত রকম রঙের তুলি বোলাচ্ছে রিমা। নিজেকে উজাড় করে দিতে পারার প্রশান্তির আবেশ রিমার দুচোখ ছুঁয়ে যায়। চোখ পড়ে মধুপের ক্লান্ত শরীরটার দিকে। সারাদিনের ধকলে পরিশ্রান্ত মধুপ ঢুকে পড়েছে ঘুমের দেশের কানাগলিতে। সহজে বেরোবার রাস্তা মিলবে না তার।
রিমা ঝুঁকে রয়েছে মধুপের মুখের উপর। কেমন নির্মল শিশুর সারল্য ওই মুখে। কোঁকড়ানো চুলে বিলি কাটে রিমা। বড় মায়া হয় মধুর মুখটা দেখে। অনেক জমানো অভিমান এক লহমায় ভুলিয়ে দেয় ওই ঘুমন্ত মায়াভরা মুখটা। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে। নিজের মনে বলে — “মধু তোমায় কথা দিয়েছিলাম তোমার ঘরে ফেরার অভিযানে শেষ অবধি পাশে থাকব। ফিরে এসেছ তুমি। তোমার জন্মভূমি আজ স্বাগতম জানিয়েছে তোমায়। তোমার কল্পনার নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হয়েছে আজ। এবার তাহলে আমার ছুটি।”
গভীর ঘুমের ঘোরে আচমকা রিমাকে আঁকড়ে ধরেছে মধু। অস্পষ্ট জড়ানো স্বরে বোধহয় বলছে – “না”।
দেওয়ালের ধেড়ে টিকটিকিটা গম্ভীর গলায় বলে উঠল — ঠিক ঠিক ঠিক। ব্যাটার ছেলে কোনটাকে যে ঠিক বলে বুঝে উঠতে পারে না রিমা। আলো আঁধারিতে মধুর মুখে ফুটে উঠেছে এক ঝলক হাসি।
♦—♦···♦—♦♦—♦···♦—♦
❤ Support Us