Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩

একটি হুলো এবং কাক

নাসির ওয়াদেন
একটি হুলো এবং কাক

অলঙ্করণ: দেব সরকার

 
সূর্য পুবদিকে লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে, কিছুক্ষণের মধ্যে ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা ফুটে উঠলেই পিসি ঘুম থেকে উঠে পড়বে । আলো-আঁধারির মাঝে পাখিদের কুজন কাকলিতে ভরে উঠে পাশের বাঁশবাগান । বাঁশের আগায় কয়েকদিন থেকে একটা কোকিল ঘুরঘুর করছে, পিসি সকালবেলায় ঘুম থেকে আড়মোড়া দিয়ে বসতেই ফাঁকা আকাশে দেখতে পেল কালো পাখিটাকে । পিসি মনে মনে ভাবে, পাখিটার কোনো মতলব আছে । নইলে ওইভাবে প্রত্যেকদিন সকালবেলায় এসে এদিক-ওদিক পাখা মেলে উড়ে কেন ? বাইরে বসন্তের ঢেউ, সারা আকাশ জুড়ে ঠান্ডা-গরমের আবরণ যেন চারিদিককে রোদের চাদর দিয়ে ঘিরে রেখেছে । পাশের পলাশ গাছটার পাতলা পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুলের আগমন বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে। আর কয়েকদিন পরেই পুরো গাছটাই লাল আবিরে ছেড়ে যাবে ।
 
কোকিল তো কুহু কুহু করে ডাকে বসন্তের আগমনে। বসন্ত এলে দোলখেলায় মেতে উঠে ছেলে-বুড়ো, মানুষজন ।‌ আর কোকিলদের মনে নতুন রঙের ঝাপট এসে লাগে । কেউ যেন খুশির বান সরিয়ে দিতে আসছে বসন্তের সময় রেখাকে রাঙিয়ে দিতে । সকালের শীতল আলো এসে পড়েছে বাঁশবাগানের মাথার উপর । কাকেদের বাসায় শুরু হয়েছে সা-রে-গা-মা গানের সুর ।‌ একটা দাঁড়কাক তার পৌরুষকণ্ঠে একটানা ডেকেই চলেছে, কা–কা–কা । দাঁড় কাকটার দায়িত্ব বাসা সামলানো । মহিলা কাকগুলোর গায়ে নতুন আগমনের ঢেউ । সেই ঢেউ যেন শান্ত পুকুরের জলে ছোট্ট একটা ঢিল ছুঁড়ে মারার মতো । এক টুকরো ঢিল একটা শান্ত পুকুরকে কেমন ক্ষেপিয়ে দিতে পারে । সেই ঢেউয়ের তরঙ্গ একের পর এক আঘাত হেনে সূর্যের নরম রোদের কিরণকে বিচ্ছুরিত করে ছবি, প্রতিচ্ছবি আর প্রতিবিম্ব তৈরি করে। জলের উপর প্রতিবিম্বের ছড়াছড়ি। ক্যালাইস্কোপ হয়ে পিসির চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে, যখন পিসি প্রায়ান্ধকারে বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে প্রাতঃকৃত সেরে বাঁশড়ার ডোবায় জলকর্ম সম্পাদন করে ।
 
মহিলা কাকেরা একে একে উড়ে যায় খাবারের খোঁজে। ভোর ভোর বের হয়ে সারা গ্রামটা এক চক্কর ঘুরে আসে । দেখে কোথাও উচ্ছিষ্ট খাবার পড়ে আছে কিনা । তারা সুলুক সন্ধান করে জরিপ করতে থাকে আজকের খাবার কতখানি সংগ্রহ করতে পারবে । বাঁশের ডগায় ডগায় কাকেদের বাসা, মাঠ ঘাট থেকে খড়কুটো যোগাড় করে তারা নিরাপদ জায়গায় বাসা বাঁধে । পাড়ার হুলো বেড়ালটার ভয়ানক দৌরাত্ম্য । পিসি মেহেরজানের খুব পেয়ারের, সন্তান বলতে ওই একটাই, কানা-খোড়া হুলোটা । পিসি হুলোটাকে সকাল সকাল দুধ খাইয়ে বাড়ি পাহারা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে, তবেই হাটে যায় ।
 
হাট থেকে শাক-সবজি আর কিছু খুচরো মাছ কিনে পাশের গাঁয়ে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে থাকে । সেখানে সবজি বিক্রি করে অ-বিক্রিত সবজিগুলোকে নিজের গাঁয়ে এসে বিক্রি করে। গাঁয়ের মেয়ে বউগুলো বড় ধ্যাগাবাজ । কিছুতেই ন্যায্য দাম দিয়ে কিনতে চাইবে না । মালাই-দলাই করে তবেই তারা আনাজ-সবজি কিনবে ।
 

আকাশের দিকে তাকায় পিসি। দেখতে পেল সেই কোকিলটাকে উড়ে বেড়াতে । তাই দেখে পিসি হাঁক ছাড়ে, হতচ্ছাড়া ! তোর ঘরদোর নাই বুঝি ? কেবলই ঘুরঘুর করছিস। তা তোর মতলবটা কি শুনি ?

 
— বুবু, ওজন ঠিক করে দাও। হাতের আঙুলটা উপরে তোলো দিকিন— বলল মোড়ল গিন্নি।
 
— এইতো, এইতো। ঠিকই তো দিচ্ছি। কম দিবক নাই দিদি। উপরওয়ালা দাঁড়াঙ্ দেখছে। তিনি ক্ষেমা করবেন না। বলে হাতের আঙ্গুল তুলে দাঁড়িপাল্লার দিকে তাকায় পিসি ।
 
— না, না, তা বলছি না বুবু। আজকাল  ঠকানো লোকের অভাব নেই। ওই যে হলদিওয়ালার কাছে সেদিনে পাঁচ সের  গোটা হলদি কিনলাম। বাড়িতে মোড়ল ওজন করে দেখছে সাড়ে চার সের হলো, কাকে বিশ্বাস করবো, তুমিই বলো ? বলল গিন্নিমা।
 
— সবাই কি এক হয় দিদি ! বলে মোড়ল গিন্নির দিকে তাকিয় পিসি বলে, ল্যাও, ল্যাও। ধরো দিদি, আমাকে আবার সব মাল বেচতে হবে তো।
 
— না বুবু, তোমাকে বলছি না। মানুষকে বিশ্বাস করা খুব কঠিন।
 
সবজির ঝুড়ি মাথায় তুলে পিসি পা বাড়িয়ে দিল অন্য পাড়ার দিকে।
 

•২•

পিসির শরীরে জ্বর। সারাদিন খেয়ে না-খেয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে টো টো করে ঘুরে শরীরখানা দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিছানায় শুয়ে থাকে দিনরাত। হুলো বেড়ালটা পিসির চারপাশে ঘুরঘুর করে আর মেও মেও করে ডাকে। পাশের বাড়ির লোকেরা দয়া করে দুবেলা লাহারি, মুড়ি দিয়ে যায়। ক্ষুদ-কুড়ো যা পায়,তাই খেয়ে দিন কাটে।
 
একদিন আরমান ডাক্তার এসে পিসিকে দেখে গেল।  পিসির রোগ পরীক্ষা করে এক শিশি লাল ওষুধ ও অন্য এক শিশিতে হজমের সিরাপ দিয়ে চলে যায়। পিসির নিউমোনিয়া হয়েছে। গত শীতের প্রচন্ড ঠান্ডায় প্রতিদিন ভোরবেলায় হাটে যাওয়ার জন্যেই  ঠান্ডা লেগে কাশিটা বেড়ে গেছে। সেই ঠাণ্ডা কাশি থেকেই তার নিমোনিয়া অসুখ বেঁধেছে শরীরে। পিসি খ্যাক্ খ্যাক্ করে বার কয়েক কাশতেই কাশিতে সামান্য রক্ত উঠল।  সে তখন বিছানা থেকে কোনরকমে উঠে উঠানের এককোণে গিয়ে আবার খক্ করে কেসে ফেলল। টকটকে তাজা একটু রক্ত এসে পড়ল মাটির উপর।
 
আকাশের দিকে তাকায় পিসি। দেখতে পেল সেই কোকিলটাকে উড়ে বেড়াতে । তাই দেখে পিসি হাঁক ছাড়ে, হতচ্ছাড়া ! তোর ঘরদোর নাই বুঝি ? কেবলই ঘুরঘুর করছিস। তা তোর মতলবটা কি শুনি ?
 
কোকিলটি উড়ে গিয়ে একটি কাকের বাসায় বসে পড়ে। দারোয়ান পুরুষ কাকটি তখন খুব সম্ভবত পাশের বাড়িতে উচ্ছিষ্ট সংগ্রহে ব্যস্ত। গতকাল রাতে পাশের বাড়ির ছেলেটার মুসলমানি হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনের আগমনে একটা ভুরিভোজের আয়োজনের ব্যবস্থা ছিল।
 
কিছুক্ষণ পরেই কোকিলটা বাসা থেকে উড়ে গেল উত্তর দিকে। পিসি একদৃষ্টে ওই দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে মনে চিন্তা করে— না, কই তো ? পাখিটা ডিম ঠোঁটে করে তুলে নিয়ে গেল না। বাসায় কোকিলটা তবে কি খুঁজছিল? হাজার প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করতে থাকে।
 
হুলো বেড়ালটা ততক্ষণে পাঁচিল টপকে ছমনলালের বাড়ি থেকে একটা মস্ত বড় ইঁদুর ধরে এনে উঠোনের একপাশে ছায়ায় বসে দিব্যি ভোজন কার্য সারছে। খেয়েদেয়ে নিমগাছটার ছায়ায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। সাতপাঁচ না-ভেবে পিসি ধীরে ধীরে হেঁটে এসে বিছানার উপর বসলো। আকাশটা ভারী লাগছে। এই ফাগুনের মাটিতে বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে পিসির।  মনে মনে ভাবে ফাগুনের পানি আগুন । আমগাছের মইলগুলো সব পুড়ে যাবে। কথায় আছে, আগুনে বৃষ্টি, আমের নস্টি, চোতের পানি নয়নের মণি। আকাশ গুড় গুড়  করে ডাকছে। পশ্চিম দিকের ঝঞ্ঝা এসে বেশ খানিকটা বৃষ্টি হয়ে উঠানটাকেই ভরে দিল।
 
ছমনলালের বউ এসে বুড়িকে এক টুকি লাহারি আর আধ বাটি গুড় দিতে এসেছে। মুড়ির টুকি আর গুড়ের বাটি বিছানার পাশে হাতে নিয়ে হাঁক দেয়, দিদি উ-ঠো । একটু কিছু খেয়ে নাও। শরীরের যা হাল করেছো, তাতে অসুখ বাড়বে। একটু খাওয়া দাওয়া করো, বুঝেছো ! বলে, খাবারটা পিসির বিছানার পাশে রেখে দিয়ে পাশেই একটা মাটির কলসি থেকে একগ্লাস জল এনে রাখলো তার সামনে।
 
— দিদি তোমার তো ন্যাবা হয়েছে। শেরালি গোমস্তার কাছ থেকে একটা ন্যাবার মালা এনেছি। কোমরে জড়ানো শাড়ির আঁচল থেকে বের করে আনে মালাটি। তারপর বলল, এটা গলায় পিধি ল্যাও দিদি। এতে ন্যাবারোগ সেরে যাবে। দ্যাখ, চোখগুলান কেমন হোলদ্যা হোলছে, পেছাবো বুঝি হলদে হচ্ছে, তাই না দিদি ?
 
— হ্যাঁ বহিন, তুমি ঠিকই কইয়াছো। কতদিন থেকে কেমন হলদা, হলদা পেছাব হোছে। আখের রস খেতে হবে।
 
— তা ঠিক !  দাঁড়াও, তোমার দাদাবাবুকে বুলি শালগড়্যা থেকি দু গেলাস আখের রস এনে দিতে বলবো ।
 
— দেখো, যদি আনতে পারো, তাহলে খুব উপকার হয়। বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে পিসি। অর্থাৎ মেহেরজান বেওয়া।
 
— তুমি ভেবোনা দিদি, আমি একটা ব্যবস্থা করছি, বলেই চলে গেল ছমনলালের বউ।
 
বিছানার উপর বসে পড়ে পিসি খক্ খক্ করে বার কয়েক কেশে ফেলে। বিড়ালটা ততক্ষণে তার কাছে এসে বসেছিল, একেবারে বিছানার ধার ঘেঁসে। বুড়ি গ্লাসটা তুলে নিয়ে এক ঢোক জল গিলে মুড়ি চিবুতে লাগলো। নতুন গুড়ের স্বাদ তার অমৃত বলে মনে হয়।দুই চোখ দিয়ে জল ঝরঝর করে বের হতে থাকে তার।
 

•৩•

দিনকয়েক থেকেই বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারে না পিসি। এ জন্মে আপন বলতে কেউ নেই। ছিল একটা ছেলে, দশ বছর বয়সের। ওলাওঠা রোগে মারা যায়। পিসেমশাই দাদন ঘাটতে যেত দুর্গাপুরে। তখন দুর্গাপুরে নতুন বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে। মানিকপুরের ওসমান-গুলজারদের সাথে পিসেও গেছিল ক্যানেলের কাজ করতে। সেখানেই বছর দুই কাজ করে এসে কিছু টাকাও জমা করে। সেই টাকা দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে বসতবাড়িখানা তৈরি করেছিল। একদিন দুর্গাপুরে কাজ করতে করতেই  অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। চিকিৎসা করনের পরেও আর বাড়ি ফেরা হয়নি। একথা গাঁয়ের লোকেরা জানে।
 
সেদিন থেকেই পিসি একেলা। নতুন করে বাঁচার ইচ্ছে যেন তার হারিয়ে গেছে। তবু ডিহিখানাকে আগলে রেখে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল পিসি। কোথা থেকে এক মা-মরা বেড়াল ছানাটাকে কুড়িয়ে এনে আদর যত্নে সুস্থ করে বড়ো করে তুলেছিল, সেদিন থেকেই পিসির মায়া পড়ে যায় ওই অবলা জীবটার উপর। হুলোটাও তখন থেকেই পিসিকে আপন মা মনে করে ডাকে।
 
গাঁয়ে রটে গেল খবরটা। চারিদিক থেকে লোকজন এসে ভিড় জমালো পিসির আঙিনায়। লোকে লোকারণ্য । তার ছোট্ট বাসঘরখানির একপাশে একটা বেতের চেয়ারে বসে আছেন মোড়ল মশাই। তার সাথে হাজির মাণিক আর হরোজ। ওরা মোড়লের খাস লোক। তার কথায় প্রাণ দিতে পারে, আবার প্রাণও নিতে পারে। হরোজ বলে, চাচার নুন খেয়েছি, নুন গাইতেই হবে। তাঁর কথায় খুন করতেও পারি।
 
মাণিক বলে, নেমকহারাম হতে পারবনি। কাকার জন্যিই বেঁচে আছি। কাকা যদি সেদিনে তাকে তাঁর বাড়িতে বাগাল না রাখতো, তাহলে ওই কবেই সে মরে ভূত হয়ে যেত। কাকার দয়ায় দুমুঠো খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি। তাই ঋণশোধ করতে, কাকা যা বলবৈ তাই করবোক্ ।
 
মাণিকের মনে পড়ে, যেদিন মাণিকের বাবা অঘোরী রবিদাস, খাবারের অভাবে ছেলেপুলেদের দুমুঠো খেতে দিতে না পারায় একদিন রাতের আঁধারে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। কত বর্ষা গেল, কত শীত কাটল, কত বসন্তে ওদের পাড়ার শিমুল গাছে ফুল ফুটল, হর বছর চৈত্র মাসে খ্যাসারির ডাল দিয়ে বড়া-পিঠে খেলো, তার হিসেব নেই। তবুও অঘোরীকে বাড়ি ফিরে আসতে দিল না তার নিত্যদিনের অভাব-রাক্ষসেরা। তাকে গিলে খেয়ে নিলো অভাবের নদীতে, ক্ষুধার অমল হ্রদে, দারিদ্র্য-নামক সমুদ্রের গভীর তলপেটে।
 
হরোজ পিসির মুখে হাত দিয়ে দেখে বলল, মুড়োল চাচা, বুড়ির দম আছে মুনে হচ্ছে !
 
কথাটা শুনেই মোড়ল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। শুধায়, কী বলছিস, মরে যায়নি ?
 
— হ্যা, গো চাচা, এখনো নিশ্বাস পড়ছে। এখনই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার কাকা।হয় তো, তাহলে বেঁচি যেতে পারে। আমি বরং তোমার মোষজোড়া নিয়ে আসি। গাড়িটাতে বাঁধছি, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।
 
গাড়িখানা এসে গেছে বাড়ির বাইরে। তোড়জোড় করে কয়েকজন হাত ধরাধরি করে পিসিকে আধমড়া অবস্থায় গাড়িতে তুলে দিল। তার আগেই গাড়িতে খড় দিয়ে উঁচু করা হয়েছে। একখানা সতেরঞ্চি বিছিয়ে বিছানা বানানো হয়েছে, যাতে পিসির শরীরে কোন আচড় না লাগে। গাড়িতে তোলা মাত্রই হুলোটা চারিদিকে ছোটাছুটি করতে লাগলো। মিউ মিউ করে কী যেন বলতে চাইছে।
 
মানুষজন তখন পিসিকে নিয়েই ব্যস্ত। তার দিকে খেয়াল নেই কারো।
 
মোড়ল মশাই ছমনলালকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেল। বলল,  ছমন ! তুমিই ওর নিকট প্রতিবেশী। তোমার সাথে লেনাদেনা ছিল। ওর তো অবস্থা শেষের দিকে, কিছু টাকাপয়সা দাও, চিকিৎসা তো করাতে হবে।
 
ছমনলাল বলে, কোথায় টাকা পাবো মোড়ল ভাই। আমার হাতে তো কিছুই নাই। যা ছিল তা তো আপনিই জানেন, ওর চিকিৎসা করাতেই অনেক টাকা খরচ করে ফেলেছি।
 
— জানি। তুমি বিনিময়ে তার যেটুকু সম্পত্তি ছিল, সবটুকু লিখে নিয়েছো। এখন আরও কিছু দাও। বসতবাটিটা না হয় তোমাকেই দেবো।
 
— বসতবাড়ি ! বলে চমকে উঠে ছমনলাল।
 
— চমকে উঠলে যে ছমন ? যেখানে তুমি, আমি সবাই আমরা দাঁড়িয়ে আছি ।
 
এতক্ষণ ছমনলালের বউ আড়িপেতে কথাগুলো শুনছিল। দুজনের কথোপকথনের মাঝে তৃতীয় কোন ব্যক্তি ছিল না। অন্যেরা সবাই পিসিকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য ব্যস্ত। মানিক মোষ দুটোকে গাড়িতে জুড়ে দিতে উদ্গ্রীব। হরোজ পিসিকে চেপে ধরে বসে আছে গাড়ির উপর।
 
ছমনলালের বউ চিৎকার করে ওঠে এবং বলে, না, না, মোড়ল চাচা, আমরা আর টাকা দিতে পারব না। অনেক দিয়েছি আর না ।
 
— কেন বিনা কারণে তো দিচ্ছ না ? বসতবাড়ির বদলে টাকা দেবে ?
 
— কিন্তু ! বলে থামলো ছমনলাল।
 
— কোন কিন্তু নয়।কমিশন এনে আজকেই তোমার নামে বাড়িটা রেজিস্টে করে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। দরকার পড়লে হাসপাতালেই কমিশন নিয়ে আসব, তোমার পাকা ব্যবস্থা করে দেব।কী বলো তোমরা ? বলে সকলকে এই ব্যাপারটা জানালো মোড়ল।
 
সকলেই সম্মতি দিলো।
 
ছমনলালের মুখে কোন রা শব্দ নেই, ভোঁতা মুখে কুলুপ এঁটে বসে রেখেছে। মনে মনে ভাবে, বুড়ি মরলো না কেন। মরে গেলে সব লেঠা চুকে যেত। ছমনলালের বউ এইবার মুখ খুলল। সে যা বলল, তার অর্থ এইরকম যে ছমনলাল আর তার বউ মিলে বুড়িকে মুড়ি-গুড় খাইয়ে, চিকিৎসার নাম করে অনেক আগেই বসতবাড়িটা রেজেস্ট্রি করে নিয়েছে।
 
— বসত বাড়ি বলে তবে,তার কিছুই নেই, এতদিন ধরে নিজের বাড়িতে থেকেও সে বাস্তুহারা। বেশ কিছুদিন থেকেই সে আশ্রিতা হয়েই পড়ে আছে।
 
মোড়ল ও উপস্থিত লোকজন হতভম্ব হয়ে পড়ল।
 
মাণিক তাড়া দেয়, জলদি করো কাকা, বুড়ি বুঝি মরেই যাচ্ছে।
 

♦♦♦♦♦—♦♦♦♦♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!