- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- মার্চ ৩১, ২০২৪
উপহার
অলংকরণ: দেব সরকার
[মূল গল্প : হোলী কা উপহার] লেখক : মুন্সি প্রেমচন্দ
অনুবাদ : বদরুদ্দোজা হারুন
মৈকুলাল এসেছিল দাবা খেলতে। অমরকান্তি তখন বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি পর্ব সেরে ফেলেছে। মৈকুলাল বলল– কি ব্যাপার? মনে হচ্ছে তুমি কোথাও যাচ্ছ ? এসো না, আগে একটা কিস্তি হয়ে যাক।
অমরকান্তির চুল আঁচড়ানো প্রায় শেষ। চিরুনিটা জায়গায় রেখে দিয়ে বলল— ভাই, হাতে একদম সময় নেই। শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে, তাই আগেভাগে সবকিছু একটু গুছিয়ে রাখছি।
—তা এত আগে করার দরকার কি ? তোমার ভাবি শ্বশুরবাড়ি তো বাড়ির কাছেই। দু-একটা গলি পার হলেই।
— বলেছ ঠিকই, কিন্তু এখন পর্যন্ত তো শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া হয়নি। প্রথমবার যাচ্ছি, তাও নেহাৎ শ্বশুরমশাই বলেছেন তাই।
মৈকুলাল বলল — আধা ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে। সন্ধ্যার পর বের হলেই হবে।
— শ্বশুর বাড়ির নাম শুনেই আমি কেমন যেন শিহরণ বোধ করছি। ভাবি স্ত্রীর কথা শুধু কল্পনায় ভেবেছি। এখন তার সঙ্গে মিলন হবে। সে মিলন যে কেমন জানি না। এতদিন কল্পনার তুলি দিয়ে আমি আমার স্ত্রীর সৌন্দর্য এঁকেছি। কিন্তু বাস্তবে তা কি, এখনো জানিনা।
মৈকুলাল রহস্য করে বলল – প্রিয়তমার মন ভেজানোর জন্য কিছু উপহার নিয়ে যেও। শ্বশুরবাড়ি মাথা উঁচু করেই ঢুকতে হয়, বিশেষ করে এটা যখন প্রথমবার।
অমরকান্তি বলল — আমার বিশেষ অভিজ্ঞতা নেই। তাই উপহারের কথাটা মাথায় আসেনি।
মৈকুলাল বেশ ধমকে দিয়েই বলল — বাহ্ ! ভালো প্রেমিক তুমি, প্রথমবার প্রেমিকার কাছে যাচ্ছ খালি হাতে ?
অমরকান্তি বলল —তা বটে, কি নিয়ে যাই বলতো ? যেটা নিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তার পছন্দ হয়ে যাবে। কম দামে ভালো জিনিস হবে এমন কোন জিনিসের কথা তোমার জানা আছে ? ওদিকে বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাতে হবে। বাবা বলেছেন, তাঁর টাকার খুব দরকার।
জীবনের দাম্পত্য-প্রেম যখন নির্ভর করছে ছোট্ট একটা উপহারের জন্য, তখন টাকাটাকে কোনভাবেই বড় করে দেখলে হবে না। শুরুতেই প্রেমে ধাক্কা খেলে বাকি জীবনেও যে তার প্রভাব পড়বে এ-একরকম নিশ্চিত
অমরকান্তি বাবা মায়ের থেকে আলাদাই থাকত। তাই বাবা মায়ের দায় খুব একটা যে তার মাথার উপর ছিল তা বলা যায় না।
এবার মৈকুলাল একটু কৌতুক করার জন্য বলল– তা তো বটে, বাবা-মার দায়িত্ব তো আর উড়িয়ে যায় না !
অমরকান্তি কথাটা গায়ে মাখল না।
অমরকান্তি ভাবল— তার বন্ধু মৈকুলালের কথাটাই সঠিক। বউকে উপহার দেওয়া একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নারী জাতির মন পেতে এর থেকে সহজ উপায় আর নেই। আর সারা জীবনের দাম্পত্য-প্রেম যখন নির্ভর করছে ছোট্ট একটা উপহারের জন্য, তখন এক্ষেত্রে টাকাটাকে কোনভাবেই বড় করে দেখলে হবে না। জীবনের শুরুতেই প্রেমে ধাক্কা খেলে বাকি জীবনেও যে তার প্রভাব পড়বে এ-একরকম নিশ্চিত । ও বলল—এখন কি যে করি ! হাতে পয়সা-কড়ি তেমন নেই, তাই হোলিতে নিজের জন্য কোন জামাও কিনিনি । তবে তুমি যখন বলছ, তখন বউয়ের জন্য বাজারে যেতে হবে, অবশ্য অল্পের মধ্যে যাতে হয় সেটাও দেখতে হবে।
এরপর দুই বন্ধু কিছু একটা শালা-পরামর্শ করল। তাদের ভাবনা-চিন্তা চলছে তখন দেখা গেল, বাজারের এক পাশে এক পার্সি মহিলা হাল ফ্যাশনের একটা শাড়ি পরে মোটরগাড়ি থেকে নামছে। সেই শাড়ির দিকে দৃষ্টি পড়তেই মৈকুলাল বলে উঠল— পেয়েছি… পেয়েছি। এক্কেবারে সাধারণ আটপৌরে শাড়ি, কিন্তু অমরকান্তি — দেখো-দেখো কি সুন্দর মানাচ্ছে মেয়েটিকে ! ওইরকম একটা শাড়ি তোমার বউকে দিলে নিশ্চয়ই খুব পছন্দ হবে।
— কিন্তু… কত দামের মধ্যে হবে আন্দাজ করতে পারছ ? অমরকান্তি মিউ মিউ করে।
— দেখো এ-রকম শাড়ি দেশি, কোন দোকানে পেয়ে যাবে দামও বেশি হবে না। বড়জোর ২৫ টাকা । তার বেশি তো নয়ই।
শাড়িটা অমরকান্তিরও মনে ধরেছিল। এরকম একটা শাড়ি বউয়ের হাতে তুলে দিলে সে যে কত খুশি হবে ভেবে তার মনে একটা শিহরণ খেলে গেল । তার বউ গৌরবর্না, অতি সুন্দরী এক কন্যা। তার অঙ্গে এরকম একটা শাড়ি দারুণ মানাবে। সে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল — কিন্তু হাশিমের দোকানের সামনে যে এখন পিকেটিং চলছে। যাব কি করে ?
— পিকেটিং চলছে বলে তো হাত-পা গুটিয়ে কেউ বসে আছে ? কেনাকাটা চলছে না ? আরে বাবা ! আমার যা খুশি তাই কিনব – তাতে কার কি বলার আছে, বল?
অমরকান্তি বলল — তোমার কথা আমি অমান্য করছি না । কিন্তু কথা হচ্ছে ওইসব স্বয়ংসেবকদের ভিড় ঠেলে যাব কি করে? আবার দেখো, মজা দেখার জন্য ওদের সঙ্গে বেশ কিছু লোক ভিড়ও করেছে। আর তা ক্রমশই বাড়ছে।
মৈকুলাল এবার একটু বিরক্তি প্রকাশ করেই বলল— এতদিন তোমাকে কিপটে বলে জানতাম; কিন্তু, তুমি যে এত ভীতু, তা জানা ছিল না।
বন্ধুর কথায় অমরকান্তির সুপ্ত পৌরুষ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। না, সে একাই যাবে এবং পছন্দের শাড়িটি কিনে নিয়ে এসে বন্ধুকে তাক লাগিয়ে দিবে।
♦•♦ ♦•♦ ♦•♦
সন্ধ্যা-উত্তীর্ণ আমিনাবাদ শহরকে তখন সুন্দরী নারীর মতো মনে হচ্ছে। কিছুটা ভয় হলেও সে একরকম চোখ বুঝেই হাশিমের দোকানে সামনে এসে হাজির হলো। স্বয়ংসেবকের দল তখনও দোকানের সামনে বসে আছে। একটু হাল্কা হলেও ভিড় রয়েছে।
দোকানের ভেতরে ঢোকার জন্য মনস্থির করেও ফুটপাতের কাছে এসেই সে মনোবল হারিয়ে ফেলল। কিন্তু প্রেমের শক্তি যে দুর্বার! সেই প্রেমই তার মনে সাহস জোগালো। যেমন করেই হোক শাড়িটা কিনতেই হবে। ওই শাড়িটাকে সে তার প্রিয়তমাকে উপহার দিয়ে তার মন জয় করবেই করবে। মনের ক্যানভাসে তখন বিদেশি শাড়ি-পরিহিতা তার সুন্দরি স্ত্রী যেন নেচে নেচে বেড়াচ্ছে !
সে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে দোকানের ভিড় ঠেলে না গিয়ে, পিছনের দরজা দিয়ে দোকানে ঢুকলো। একটা একটা করে শাড়ি দেখে দেখে সে শেষ পর্যন্ত মিনিট ২০-২৫ এর মধ্যে তার পছন্দের শাড়িটা পেয়ে গেল।
এবার তার বের হয়ে আসার পালা । সে দেখল দোকানের সামনে ভিড় অনেকটাই পাতলা হয়ে গিয়েছে। তবে গোটা তিনেক স্বেচ্ছাসেবককে তখনও সামনে দাঁড়িয়ে। সে সামান্য একটু চিন্তা করে নিলো। তারপর তীব্র গতিতে দোকান থেকে বের হয়ে চলতে শুরু করে দিলো।
সেই সময় এক বৃদ্ধা মহিলা লাঠি হাতে টুকটুক করে ওই পথে চলছিলো। দুর্ভাগ্যবশত তার সঙ্গে অমরকান্তির হঠাৎ ধাক্কা লেগে গেলো। বৃদ্ধা মাটিতে পড়েই চিৎকার করে তাকে গালাগালি দিতে শুরু করলো— অভাগার ব্যাটা, চোখের মাথা খেয়েছো নাকি দেখে পথ চলতে পারো না ? ওরে আমার মতো তোকেও একদিন বৃদ্ধ হতে হবে, এই যৌবনের তেজ তখন আর থাকবে না। আমাকে তুই ধাক্কা দিয়েছিস, তখন তোকেও কেউ না কেউ এমন করে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে।
বৃদ্ধার চিৎকার ও তিরস্কারে অমরকান্তির চলার গতির থেমে যায়। সে দ্রুত বৃদ্ধাকে মাটি থেকে তুলে দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নেয়।
এর মধ্যেই তিনজন স্বেচ্ছাসেবক তার পেছনে এসে তাকে ঘিরে ফেলেছে। একজন শাড়ির প্যাকেটে হাত দিয়ে বলল— বিদেশি জিনিস বর্জন করতে বলা হয়েছে আপনি জানেন না ? তারপরও কিনলেন কেন ? কখন থেকে আপনাকে ডাকছি আর আপনি কানে তুলে নিয়ে আছেন, শুনতেই পেলেন না ।
দ্বিতীয় জন বলল — আপনি তো চোরের মত শাড়িটি নিয়ে চুপিচুপি পালাচ্ছিলেন মশাই ? নেহাৎ ওই বৃদ্ধার সঙ্গে ধাক্কা না লাগলে আপনি তো এতক্ষণ পগার পার হয়ে যেতেন। আপনার পাত্তা পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ত ।
তৃতীয় — হাজার হাজার নিরীহ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জেলে ভ’রে দেওয়া হচ্ছে। সারাদেশে আগুন জ্বলছে। তবু আপনাদের মত কিছু লোকের এখানো বিলাতি জিনিস কেনার মোহ গেল না !
অমরকান্তি এসব কথার উত্তর না দিয়ে শাড়ির প্যাকেটটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলল— তোমরা আমাকে যেতে দিবে কিনা তাই বল ?
প্রথম স্বয়ংসেবক তৎক্ষণাৎ তার বুক থেকে কাপড়টা কেড়ে নিয়ে বলল —অবশ্যই যেতে দেব, কিন্তু এই বিলাতি জিনিসটি নিয়ে নয় ।
অমরকান্তি তখন শাড়িটা স্বেচ্ছাসেবকের হাত থেকে একরকম ছিনিয়ে নিয়ে বলল — তোমাদের কোন অধিকারই নাই আমাকে আটকাবার । জিনিসটা আমার, আমি এটা নিয়েই তবে যাব।
এই বলে সে সামনের দিকে পা বাড়াতেই দু’জন স্বেচ্ছাসেবক কাছে এসে তার পথ আটকে দিল।
অমরকান্তি এবার সত্যিই বিপাকে পড়ল। এতক্ষণ মনে মনে যে ভয়টা সে করছিল সেটাই সত্যে পরিণত হলো।
এর মধ্যে বেশ কয়েকজন হুজুগে লোক মজা জন্য ভিড় জমিয়ে ফেলেছে । তাদের মধ্যে একজন আবার টিপ্পনি কেটে বলল — মনে হচ্ছে সজ্জন ভালোমানুষ !
অন্যজন বলল—এরাই আবার সমাজের সচেতন মানুষ হিসেবে নিজেদের দাবি করে।
ভীষন বিরক্ত হয়ে অমরকান্তি এবার বলল—আমি না চাইলেও আপনারা আমাকে বাধ্য করছেন থানায় যেতে, পুলিশের কাছে নালিশ জানতে।
একজন বেশ দাপটের সঙ্গে বলল — হ্যাঁ, হ্যাঁ তাই যান। গিয়ে পারেন তো আমাদের সকলকেই একসঙ্গে ফাঁসিতে লটকান।
ঠিক সেই সময় এক সুন্দরী যুবতীকে সেখানে হাজির হতে দেখা গেল। পরনে তার খদ্দরের শাড়ি, হাতে একটা ঝোলানো ব্যাগ, তারমধ্যেই তার স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্য উঁকি দিচ্ছে।
সে এসে বলল — কি ব্যাপার ভাইসব, তোমরা কি কারণে এই ভদ্রলোককে ঝামেলার মধ্যে ফেলেছ ?
যুবতী মেয়েটির কাছে সহানুভূতির কথা শুনে স্বস্তি পেল অমরকান্তি।
সে মেয়েটির দিকে এগিয়ে এসে বলল— জানেন এরা আমার কাপড়ের প্যাকেটটা ছিনিয়ে চলে গেছে । এ-তো দিনে দুপুরে ডাকাতি! সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ! একে কখনো সত্যাগ্রহ বা দেশপ্রেম বলা যায় না।
মেয়েটির এবার সহানুভূতি জানিয়ে বলল — চিন্তা করবেন না। আপনার কাপড়ের প্যাকেটটি কারও কাছে নিশ্চয়ই কোথাও আছে ; আপনি ঠিকই পেয়ে যাবেন । তা কি ধরনের কাপড় ছিল ?
অমরকান্তি কিছু বলার আগে একজন স্বয়ংসেবক এগিয়ে শেষ নিজে থেকেই বলল— জানেন দিদি, ইনি হাশেমের দোকান থেকে বিদেশি কাপড় কিনেছেন !
— যারই দোকান থেকেই কিনুন, ওর কাপড়ের প্যাকেট কেড়ে নেওয়ার অধিকার তোমাদের নেই। শিগগিরই ফিরিয়ে দাও । কার কাছে আছে ?
কিছুক্ষণের মধ্যেই অমরকান্তির কাছে কাপড়ের প্যাকেটটা ফিরে এলো– যেমন করে সেটি উধাও হয়ে গিয়েছিল।
আর তারপরই ভোজবাজির মতো ব্যাপারটি ঘটল। স্বয়ংসেবকরা সব মুহূর্তের মধ্যে স্থান ফাঁকা করে চলে গেল।
অমরকান্তি মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল— জানেন, আপনি এই সময় না এলে আমার কি হাল হত ? ওরা শাড়িটা তো ছিনতাই করেইছিল, সেই সঙ্গে আমাকেও উধাও করার পরিকল্পনা ছিল ওদের।
মেয়েটি চারিদিকে চেয়ে কেউ কোথাও নাই দেখে, এবার আপনজনের মত অমরকান্তিকে তিরস্কার স্বরেই বলল —জনমতকে সকলেরই সম্মান জানানো উচিত। আপনারা তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন ওরা আমাদের উপর কি ভয়ঙ্করভাবে অত্যাচার চালাচ্ছে। তবুও আপনারা সচেতন হচ্ছেন না !
কথাগুলো বলে মেয়েটি একটুখানি থামল। তারপর খেদমিশ্রিত কণ্ঠে আবার বলল — কাকে কি আর বলছি ! যারা বুঝেও না বোঝার ভান করে, তাদের আর আমি কি করে বোঝাবো !
অমরকান্তির মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মৈকুলালের সঙ্গে তার ভাবী স্ত্রীর মধুর আলাপনের যে চিত্রকল্প সে মনের মধ্যে তৈরি করে রেখেছিল, এই মুহূর্তে সে সব ভুলে গেল। বরং এই সুন্দরী মহিলার বিশ্বাস অর্জন করার জন্য সে বলল —বিশ্বাস করুন এক মহিলার ভালোলাগার আবদার মেটানোর জন্যই আমাকে এসব করতে হয়েছে।
—তা আপনার সেই ভদ্রমহিলাকে বুঝিয়ে সুুঝিয়ে বলতে পারলে তিনি কি মানতেন না ?
— না, তার সঙ্গে আমার এখনো দেখা হয়নি। দেখা হলে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলবো। যে যাই বলুক পুরুষরা তো এখনো মেয়েদের ইচ্ছার দাস, যদি সে মেয়ে তার প্রেমিকা বা স্ত্রী হয়।
মেয়েটির ঈষৎ কৌতুক দেখিয়ে তখন বলল— দয়া করে যদি আপনার বাড়িটা কোথায় একটু বলেন।
— সৈয়দগঞ্জ ।
শোনামাত্রই একটু নরম স্বরে মেয়েটি বলল —আপনার নামটা জানতে পারি কি?
— আমার নাম অমরকান্তি।
শোনামাত্রই মেয়েটি তার মাথার ঘোমটা ভালো করে টেনে দিল। তারপর কিছুটা লজ্জিত হয়ে প্রেমপূর্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল — আমি যতদূর জানি তাতে আপনার স্ত্রী এখনো পর্যন্ত তো আপনার বাড়ি যাননি। তাহলে কার আবদারে এত ঝুঁকি নিয়ে ওই বিলিতি জিনিস কিনতে এসেছিলেন বলুন ত ? সে কি আপনার কাছে কোন বিশেষ আবদার রেখেছিল?
মেয়েটির অন্তরঙ্গতার পরিচয় পেয়ে অমরকান্তি সাহস করে বলল— আপনি কোথায় থাকেন ম্যাডাম, দয়া করে একটু বলবেন কি?
মেয়েটি মুচকি হেসে বলল —খাসিয়ারমুন্ডি।
—আপনার নাম কি সুখদা দেবী ?
— ওই নামে অনেক মেয়েই তো আছে।
— আপনার বাবার নাম কি জালাদেওজি ?
— ওই নামে বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক ওখানে থাকেন।
অমরকান্তির আর বুঝতে কিছু বাকি থাকল না। তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে পকেট থেকে দেশলাই বের করে শাড়িটা পুড়িয়ে ফেলল।
সুখদা তার কাণ্ডকারখানা চেয়ে চেয়ে দেখল । মুখে কিছু বলল না।
অমরকান্তি স্থান ত্যাগ করার উদ্যোগ নিতেই সে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল— কাল সকালে আসছেন তো?
অমরকান্তি আবেগ-রুদ্ধ কণ্ঠে বলল – আমি এদেশের মানুষ, এদেশের জনমতের বাইরে গিয়ে যে পাপ করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত করা জরুরি।
অমরকান্তি সুখদাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
♦•♦ ♦•♦ ♦•♦
দেশব্যাপী উৎসবের মরশুম হলেও আজ এখানে বসন্ত উৎসব বলে কিছু নেই। বিদেশী দোকানগুলোর সামনে যথারীতি পিকেটিং হয়েছে। কিছু লোক সমর্থন করার জন্য স্বেচ্ছায় এসেছে, আর কিছু লোক এসেছে তামাশা দেখতে। অমরকান্তি কিন্তু আজ এসেছে অন্য রূপে, অন্য ভঙ্গিতে। পরিচ্ছদে-মেজাজে তাকে আজ আর চেনা যাচ্ছে না । তার পরনে খদ্দরের ধুতি আর কুর্তা, হাতে তেরঙ্গা পতাকা। পত্-পত্ করে পতাটিকে উড়তে দেখে একজন স্বেচ্ছাসেবী তার দিকে এগিয়ে এসে বলল – কি ব্যাপার বলতো? তোমার ভেতর আমূল পরিবর্তন ! কাল তোমার উগ্রমূর্তি আর আজ তোমার একদম শান্ত সৌম্যমূর্তি ! এখন আমাদেরই তোমাকে সমীহ করতে ইচ্ছে করছে। তবে একটি করে তোমাকে বলি, ঠিক সময় আমাদের নেত্রী সুখদা দেবী চলে না আসলে উটকো লোকদের হাতে তোমার যে কি হাল হতো ভাবতেও পারছি না !
অমরকান্তি খানিকটা কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিতে বলল — তার জন্য তোমাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি ভাই। আজকে তোমাদের মধ্যে আমি থাকতে চাই। তোমাদের মতো শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন কয়েকজন বন্ধু চাই। আমার কালকের পথ আর আজকের পথ এক নয় ।
—কিন্তু তোমার আজ এখানে আসা কোনমতেই উচিত হয়নি। আমাদের নেত্রী শুভদা-বোন সাফ বলে দিয়েছে, তোমার মত উটকো লোকদের যেন কোনমতেই এখানে আসতে দেওয়া না হয়।
অমরকান্তি ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলল— যুক্তি হিসেবে তিনি হয়তো ঠিকই বলেছেন। তিনি একজন মহিলা হয়েও দেশের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলছেন। তার সিকি ভাগও আমরা অনেক পুরুষ হয়েও করতে পারিনি। ঈশ্বর তাকে মেয়ে হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু ইস্পাত-কঠিন মন দিয়েছেন। তাই তিনি হয়তো পরীক্ষার জন্য ওইরকম বলেছেন। আমি সে পরীক্ষা দিতে রাজি আছি। তোমরা যে কোনভাবেই আমাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারো।
সকলকে অবাক করে দিয়ে সে বলল – আজ আমাদের দলে যে নতুন স্বেচ্ছাসেবক বন্ধু এসেছে, তাকে বরণ করে নেয়ার জন্য আমার আসতে একটু দেরি হলো। কারণ তার জন্য নিজ হাতে এই মালাটি আমাকে তৈরি করতে হয়েছে।
এইসব কথাবার্তার মধ্যেই হঠাৎ পুলিশের ভ্যান এসে পড়ল। ভ্যান গাড়ি থেকে একজন সাব-ইন্সপেক্টর নেমে কোন ভূমিকা না করে বলল –আমি তোমাদের সকলকে গ্রেফতার করলাম। কেউ কিছু বলার আগেই অমরকান্তি প্রথম কথা বলল —আমরা শান্তিপূর্ণভাবে পিকেটিং করতে এসেছি। গ্রেফতারকে আমরা ভয় পাই না ।
সঙ্গে সঙ্গে অমরকান্তিকে ঘিরে চারিদিক থেকে আওয়াজ উঠলো —বন্দেমাতরম।
স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে গ্রেপ্তারবরণের একটা উল্লাস দেখা গেল। এমনকি যারা তামাশা দেখতে এসেছিল তাদের মধ্যেও অনেকেই এগিয়ে এসে আওয়াজ তুলল – বন্দেমাতরম।
ততক্ষণে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে। সকলের আগে দর্শকদের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে পুলিশ-ভ্যানে উঠল অমরকান্তি। তারপর অন্য স্বেচ্ছাসেবকরা একে একে স্বেচ্ছায় উঠতে লাগল।
সকলের ওঠা শেষ হলে অমরকান্তি আওয়াজ তুলল – বন্দেমাতরম।
স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে গাড়ি যখন ছাড়তে যাবে, ঠিক সেই সময় দূর থেকে দেখা গেল সুখদা ছুটে আসছে। পুলিশ তাকে চিনত। তাই গাড়ি ছাড়তে গিয়েও একটু অপেক্ষা করলো।
তার হাতে সুন্দর একটি ফুলের মালা। সে সকলকে অবাক করে দিয়ে বলল – আজ আমাদের দলে যে নতুন স্বেচ্ছাসেবক বন্ধু এসেছে, তাকে বরণ করে নেয়ার জন্য আমার আসতে একটু দেরি হলো। কারণ তার জন্য নিজ হাতে এই মালাটি আমাকে তৈরি করতে হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবদের অনুরোধে অমরকান্তি এবার গাড়ি থেকে নেমে আসছে বাধ্য হল। সুখদা তার গলায় প্রেমের অর্ঘ্যস্বরূপ মালাটি পরিয়ে দিয়ে, যথাসম্ভব আবেগকে সংযত রেখে ফিসফিস করে বলল – আমি জানতাম তুমি আসবেই। অমরকান্তি চোখ বন্ধ করে শুধু মৃদু হাসল। তারপর দুই হাত তুলে জনতার উদ্দেশ্যে একবার প্রণাম জানিয়ে পুলিশের ভ্যানে গিয়ে উঠল।
গাড়ি স্টার্ট দিল। সুখদা পরম সুখে দুই চোখ একবার বন্ধ করে, পরক্ষনেই চলন্ত গাড়ির দিকে নীরবে চেয়ে রইলো। গাড়িটি অদৃশ্য হতেই শ্রাবণের বারিধারার মতো অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়তে লাগলো তার দুই গাল বেয়ে। সে কিছুতেই নিজেকে আর সংযত করতে পারল না। সে দ্রুত রুমাল বের করে তার চোখ ঢাকল। অন্য কেউ টেরও পেল না।
♦•♦♦•♦ ♦•♦♦•♦
❤ Support Us