Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • মে ১৪, ২০২৩

মৃগতৃষ্ণা

হেদায়েতুল্লাহ
মৃগতৃষ্ণা

অলঙ্করণ: দেব সরকার

মানুষের তৃষ্ণা চিরকালের। আর তা যদি অকারণ আত্মঘাতী হয়, তাতে ঝাঁপ দেওয়ার ইচ্ছে হয় প্রবল। তবে এমন কার হয় জানিনে। আমার কথাই বলি।
একদিন দোকান বসে আছি। তেমন কোন কাজ নেই বলা চলে না। এমন সময় মোবাইল বেজে ওঠে। সবুজ টিপের মতো বোতামে আঙ্গুল ঠেকাতে ঝর ঝর করে বাতাসের মূর্চ্ছনা,কাজলদা, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
কী কথা ? আমি যেন আপ্লুত হই।
ফোনে এসব কথা বলা যায় না।
দোকানে খদ্দেরের ভিড় নেই । আবার একেবারে ফাঁকা না । দু’একজন নাছোড় খদ্দের দরাদরি করছে । তাদের বিরক্তি ঝেড়ে ফেলে দূরালাপ চালিয়ে যাই ।
তবে চলে এসো ।
তা কী করে হয় ?
কেন ?
দোকানের কান আছে ।
তবে ?
এখন স্টেশানে আসতে পারবে ? দুপুরে ফাঁকা থাকে ।
যেতে পারলে তো ভালো হয় কিন্তু দোকান এখনই বন্ধ করি কী করে ? ব্যবসা বলে কথা ।
তাহলে কী হবে ? সিমি ওরফে মোবিনার গলায় যেন হতাশা ।
অন্য উপায় খুঁজি ? আড়াইটে নাগাদ বাড়িতে খেতে যাওয়ার আগে অন্য্ কোথাও–
তোমাকে আর খুঁজতে হবে না । তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলে,সন্ধ্যে নাগাদ এসো ।
স্টেশানে তখন তো বাজার বসে ।
আরে বাবা ! ওখানে না । পার্কের অশথতলা । টুক করে ফোন কেটে দেয় সে ।
খদ্দের সামলাতে মন নেই । তার কথা মনের ভেতর গুনগুন করে ।
সিমির সাথে কীভাবে আলাপ ? আমার মামাতো ভাই রুবেল এমবিএ করে এক বড়ো কোম্পানিতে চাকরি করে । তার বিয়ের রিসেপশানে এসেছে অনেক বান্ধবী । বরবৌএর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পটাপট ছবি তুলছে তারা । একসময় সে এসে দাঁড়ায় । তার গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে পড়ি । এই পরিবেশে আমি হয়তো বেমানান । সে আমাকে চমকে দিয়ে বলে,আপনি কী খুঁজছেন ? আমি আমতা আমতা করি । কীভাবে বলব,তার চোখের ভেতর রয়েছে এক অচেনা পথ । আমার গলা শুকিয়ে যায় । তৃষ্ণায় কাঠ হয় বুঝি ! আমার অবস্থা দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠে । তবে কী জানি আমার সঙ্গে আলাপ জমাতে কসুর করেনি ।
সাঁজেরবেলা একদফা বেচাকেনা হয় । সেসব লাভলোকসান আমার কাছে তুচ্ছ । শহরতলির এই টাউনে পশ্চিমদিকে নতুন পশ এলাকা । সেখানে এক হাউজিং কমপ্লেক্সে থাকে তারা । আমি থাকি পুবদিকে টাউনের ঠিক সীমানায় গাছপালা ঘেরা মান্ধাতা আমলের একতলা বাড়িতে । আমার রূপতৃষ্ণা দোকান অবশ্য বিরাটি টাউনের মধ্যস্থলে নতুন বাজারে ।
এর মধ্যে দিন পনেরো আমাদের দেখা সাক্ষাত নেই । ফোনে ফোনে কথা হয় । আলো আঁধারিতে আমরা পাশাপাশি বসেছি । অশথতলার এদিক বেশ নির্জন । অভ্যস্থ পারফিউমারের বদলে অন্য সুগন্ধে চমকে যাই । আবার ভাবি সুন্দরী মেয়েদের কখন কী খেয়াল চাপে ! তার মুখের দিকে একটু সন্দেহ হয় । বলি,কী ব্যাপার বলতো ? এ তো নতুন দেখছি ।
সেই তো এক জ্বালা !
সাঁজের ম্লান আলোতেও এক ফোঁটা রক্তবিন্দু তার নাকের ওপর জ্বলজ্বল করছে । আমি বলি,হিরের নাকফুলে জ্বালা তো আমার ।
কী যে বলো,তুমি ! বিরক্তির সঙ্গে বলে ।
রক্তাক্ত হয়ে ম্লান গলায় বলি,নেমতন্ন পেলাম না ।
কাজলদা,তুমি এমন নেমতন্ন চেয়েছিলে ? গলায় তার অভিমান ।
নিমেষে নিজেকে হারিয়ে ফেলি । প্রথম দিন থেকে সে আমাকে পাত্তা দেয় । মেয়েদের মন বোঝা ভারি মুশকিল । তবে আমার কথা বলি । সত্যি আমি কি এমন চেয়েছি ? তার জন্যে মমতা জাগে । বিয়ের পরও সে আমার কাছে ছুটে এসেছে । কৃতজ্ঞতায় তার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলি,হনিমুনে কবে যাচ্ছ ?
সেসব কথা বলার জন্যে তোমাকে ডাকিনি ।
সেতো জানি ।
এবার সে অদ্ভুত গলায় বলে,একটা কথা অস্বীকার করতে পারবে ?
কী ?
তুমি আমাকে ভালোবাসো ।
চুপ করে যাই । আমার সামনে পার্কের ধূ ধূ বালি মাঠ নিয়ন আলোয় চিকচিক করছে । যেন এক অলীক জলাশয় । সেদিকে তাকিয়ে ভাবি,একথা তো যে সে কথা নয় ।
আমার কোন কথা বলার আগে সে একটা চুমো দিয়ে বলে,তোমাকে যেজন্যে ডেকেছি-।
আমি বিহ্বল হয়ে বলি,তোমার অশেষ কৃপা !
কৃপা নয় । তোমাকে একটা কাজ করতে হবে ।
শক্ত কাজ কি ?
আমার মাথা ছুঁয়ে বল ।
তোমার কাজে মাথা ছুঁতে হবে ?
তবে এমন শক্ত অশক্তে বাহানা খুঁজছ কেন ?
আমি কিছু বলার আগে তার মোবাইল বেজে ওঠে । বাহারি ব্যাগ খুলে বের করে । স্ক্রিনে এক সুন্দর যুবকের মুখ । কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় । তারপর পার্কের গেটের দিকে পা বাড়ায় । আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি । তার ডাকে যে এসেছি সেকথা যেন বেমালুম ভুলে গেছে । আমার সঙ্গে কোন না বলে সে নিজের খেয়ালমতো চলে গেল । তার আচরণে বিরক্ত হই না । সুন্দরী মেয়েরা এমন হয় ।
সিমির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর দু’একবার তাদের বাড়ি গেছি ।বাবা মিরাটে ব্যবসা করেন । সেখানেই থাকেন বেশি । তার মা’ই আসল গার্জেন । রাতেরবেলা ছবি অ্যান্টিকে ফোনে ধরি,হ্যালো—কাজল বলছি—
বলো—
খবর পেলাম না ।
কী খবর ?
সিমির বিয়ে হয়ে গেল ।
তোমাকে বলিনি বুঝি ?
তাহলে ফোন করি ?
ছবি আণ্টি কিছুখন চুপ করে থাকেন । তারপর বলেন,তুমি কিছু মনে কোরো না । বোধহয় ভুলে গেছিলাম । তুমি একদিন এসো । খাইয়ে দেবো ।
তাঁর কথায় মোটেই খুশি হই নে । রাগ করে ফোন কেটে দিই ।
দুদিন পরে আবার ফোন । কাজলদা,রাগ করলে ?
আমি গম্ভীরভাবে বলি,তুমি এখন পরস্ত্রী ।
সে তো সামাজিকভাবে । তোমাকে কী বোঝাব,বলো ? তার গলায় যেন দুঃখের সুর ।
আমার ভেতরটা মুচড়ে ওঠে । তার বিন্দুমাত্র দুঃখ সইতে পারিনে । রাগ অভিমান ছবি আণ্টির অপমান সব কোথায় জল হয়ে বেরিয়ে যায় ।বলি,লক্ষ্মীটি,চিন্তা করো না ।আমি সময়মতো দেখা করব ।
আমার আবার লেজুড় আছে ।তবু কথা দিলাম । নীল মায়ায় মুগ্ধ আমি এক পথচারি । বিরাটি রবীন্দ্রসদনে তাদের একটা ফাংশান আছে । তানিয়া একটা এনজিওতে কাজ করে। আজ তাদের বার্ষিক অনুষ্ঠান । আমাকে নেমতন্ন করেছে তানিয়া । সে পরে দেখা যাবে । দিলখুশা ক্যান্টিনে পর্দা ঢাকা কেবিনে পাশাপাশি বসি ।
বিকেলের মাঝামাঝি । এখনো তেমন ভিড় জমে ওঠেনি । তবু সে বলে,কাজলদা,বাতাসের কান আছে ।
তবে আমার কানে কানে কানে বল । আমি মাথা এগিয়ে দিই । সিমি ঝুঁকে এসে আমার কানে মধুকণ্ঠে যেন বিষ ঢালে । তড়াক করে লাফ মেরে উঠি । আজ সে সবুজ সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে । বিকেলের ম্লান আলোয় তা অন্যরূপ মনে হচ্ছে । দু’হাতে মাথা চাপড়ে বলি,এও কি সম্ভব ?
সিমির ভেতর সেই ছটফটে ভাব আজ নেই । সে ঠান্ডা গলায় বলে,আমার কাজে তোমার আবার সম্ভব অসম্ভব কি ?
ভালো করে ভেবে দেখো । বিচলিত হয়ে বলি ।
অনেক ভেবেচিন্তে তবে বলছি । খেজুর পাতার ফাঁকে তীক্ষ্ণ বিষের শ্বাস ।
এ পথ ছেড়ে তুমি অন্য পথ ধরো । আমি সুপরামর্শ দিতে চাই ।
যেমন—?
ডিভোর্স দাও ।
বাপ-মায়ের পছন্দ করা পাত্র । ফেলি কী করে ?
তোমার পছন্দ জানাও ।
সে রকম কোন জায়গা নেই । তার বিরুদ্ধে কী বলব ?
তার মানে ?
সে মদ খায় না । ড্রাগ নেয় না । ভালো চাকরি করে । কোন মেয়ে বন্ধু নেই ।
তোমার তাহলে অপছন্দ কেন ?
আমরা মেয়েরা যে কী চাই তা তুমি জানো না ।
কিন্তু এতো এক বিপজ্জনক পথ !
সিমি খিল খিল করে হেসে ওঠে । তার সবুজ শরীর থেকে একটা আভা বেরিয়ে আসে । সেদিকে তাকিয়ে আমি স্পর্শ করতে ভয় পাই । আমার মুখের অবস্থা দেখে সে বলে,তুমি একটা হাঁদারাম ! আমার সঙ্গে মিশছো অথচ কিছু টের পেলে না ।

সিমি নিঃশব্দে এসে দরজা খুলে দেয়।চকিতে সে চোখের ইশারা করে।বেডরুমের দরজা হা হা করে খোলা।এই প্রথম একটু কেঁপে উঠি।প্রাকটিশ করা আর মাঠে নামা যে এক না ! নিজেকে শক্ত করি।

আমি আতান্তরে পড়ি । মনে অনেক কথার উদয় হয় । আমার মতো একটা সাধারণ ছেলের জন্যে সিমি এত ত্যাগ স্বীকার করতে চাইছে ? আমার ভেতর ভিজে বারুদ যেন জ্বলে উঠতে চায় । কোন বাধা আমাকে আটকাতে পারবে না । আমি তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলি,তুমি যা চাইবে আমি তা করব ।
আমি যখন রবীন্দ্রভবনে পৌঁছাই তার অনেক আগে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে । আমাকে দেখে রাগ করে না তানিয়া । বরং সহানুভূতির গলায় বলে,আহা ! এমন দেরি করে ফেললে।
সে এমন নিপাট মেয়ে যে আমাকে কোন অজুহাত খাড়া করতে হয় না । তাদের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আমরা একসঙ্গে ফিরি । আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে অনেক কথা হয় । আমার পাড়া থেকে সে একটু দূরে থাকে । বাড়ির কাছে এসে সে থমকে দাঁড়ায় ।তারপর চুমো খেয়ে বলে,বড়ো ভাইয়ের সংসারে থাকতে আর ভালো লাগে না ।
এই প্রথম তার উষ্ণতা টের পেলুম ।
আমার রূপসজ্জা মেয়েদের রূপের তৃষ্ণা মেটানোর এম্পোরিয়াম । পরচুল থেকে শুরু করে সব কিছু এখানে পাওয়া যায় । বাঁদিকে বল্টুর গ্যারেজ । মোটর বাইক সারানোর আড়ালে অন্য খেলা । তার সঙ্গে গোপন কথা বলি । সব শুনে সে বলে,কাজলদা,তুমি ভালো ছেলে । এসব লাইনে এসো না ।
বল্টুর কথা শুনে মাথা নিচু করে চলে আসি । আমার পিতাশ্রী রিটায়ার স্কুল মাস্টার । বাজারে সুনামের অভাব নেই । বড়োভাই আইটি সেক্টারে উঁচু পদে আছে । আমি ভূগোলে এম এ পাশ । চাকরি পাইনি । বাবার রিটায়ারমেন্টের টাকাপয়সা নিয়ে ব্যবসায় নেমেছি । কী করব ধন্দের মধ্যে পড়ে আছি । তানিয়ার সঙ্গে একবার পরামর্শ করব ? কী বোকার মতো ভাবছি । নিজেকে সামাল দিই । সিমির কথা ঘুণাক্ষরে তার সামনে উচ্চারণ করা ঠিক হবে ? হাজার হোক সে একজন মেয়ে ।
কয়েকদিন বাদে আবার সিমির ফোন ।কাজলদা,কতোটা এগোলে ?
আমি আমতা আমতা করে বলি,আরেকবার ভেবে দেখো । তুমি তাকে না দাও,সে তোমাকে ডিভোর্স দিক ।
অনেক পুরুষের গল্প শুনিয়েছি।সে বিশ্বাস করেনি।
তোমাকে ভালোবাসে।তাই এমন ভাবছে।তোমার জীবনে সে একমাত্তর পুরুষ।
আমি কোন নির্দ্দিষ্ট পুরুষের নই।
তার কথা শুনে মরু বাতাস বইতে থাকে।আমার ভেতর চৈতালি ঘূ্র্ণি আছড়ে পড়ে । বিয়ে হয়েছে তাই কী ! যে কোন নির্দ্দিষ্ট পুরুষের না, সে কি আমার কাছে অধরা হবে ? আমি পুলকিত গলায় বলি, তোমার কাজ সমাধা হবে।
আমি জানি,তোমার মতো পুরুষই একাজ পারবে । ফোন রেখে দেয় সে ।
পরদিন বল্টুকে বলি,ভাই ! আমরা পাশাপাশি থাকি।ভালোমন্দ বলে কিছু হয় না।সব আপেক্ষিক ।
বেশি কথা সে বলে না।গুটখার পিক ফেল ইশারা করে।তার গ্যারেজের পেছনে আঁধারের গোপনঘর আছে।সেখানে দুজনে হাজির হই।
এর মধ্যে সিমির সঙ্গে কয়েকদফা দেখা হয়েছে।সে আমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে।আমার কোন অসুবিধে হবে না।প্লানমাফিক সব রেডি থাকবে।শুধু বেল বাজাব আর কাজ সেরে চলে আসব।
তানিয়া মাঝে মাঝে দোকানে আসে।একদিন দেখা হতে বলে,তুমি কোথায় যাও বলতো ?কোন কৈফিয়ত না।কোন তাগাদা না।উত্তর দিলেও হয়।না দিলেও হয়।অবশ্য এ প্রশ্ন করার অধিকার তার আছে।সে আমার বাগদত্তা।আমি ব্যবসায় দাঁড়িয়ে গেলে আমরা পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নেব।বলি তাকে,আমার কিছু ব্যক্তিগত কাজ আছে।স্বভাবগতভাবে সে কোন কৌতূহল প্রকাশ করে না।
বল্টুর গ্যারেজের পিছনে সময় কাটে।সে আমার গুরু।তার কাছে কয়েকদিন প্রাকটিশ করার পর আত্মবিশ্বাস চিকচিক করে।
রানা ধনীলোকের ছেলে।মস্ত তাদের ব্যবসা।শহরে তাদের বাড়ি আছে।কিন্তু শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি থাকতে হবে।ছবি আন্টির শর্ত। তাই রানা এখানে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে।
সেদিন সাঁজবেলা তিথি নক্ষত্র অনুযায়ী বেরিয়ে পড়ি।এদিকটা রেসিরেন্টশিয়াল।ঘনঘন গাছপালা।ভিড়ভাট্টা তেমন নেই।কথামতো বেল বাজাই।আমার পকেটে বল্টুর সবচেয়ে দামি সচল ঘোড়া।আজকে রোববার।তাই বোধহয় আরো নির্জন।সিমি নিঃশব্দে এসে দরজা খুলে দেয়।চকিতে সে চোখের ইশারা করে।বেডরুমের দরজা হা হা করে খোলা।এই প্রথম একটু কেঁপে উঠি।প্রাকটিশ করা আর মাঠে নামা যে এক না ! নিজেকে শক্ত করি।ওই তো ঘুমে অচেতন পড়ে আছে রানা।প্লানমতো কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে সিমি।আমাকে শুধু ফাঁকা মাঠে গোল করতে হবে।যা আছে কপালে ! তবে খোলা চোখে কাজ করতে পারলুম না।নিশানা তো ঠিক আছে।চোখ বুঁজে ঘোড়া চালাই।ফট করে একটা বেলুন ফাটার শব্দ।তারপর প্রাণপণে পলায়ন।তবে আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন।বাইরে পা দিতে না দিতে লোড়শেডিং।
কাছে রাখার সাহস হয় না।সে রাতেই বল্টুকে তার অস্ত্র ফেরত দিই।সারারাত ঘুমুতে পারিনে।মা কয়েকবার খাওয়ার জন্যে তাগাদা দিতে এসে ফিরে গেছে।শরীর খারাপের নাম করে মটকা মেরে পড়ে থাকি।
দুদিন মোবাইল বন্ধ রেখে বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকি।মাকে শরীর খারাপের অজুহাত তো দেওয়াই আছে।তবে বুঝি স্বস্তি নেই।সব সময় মনে হয়,এই বুঝি পুলিশের গাড়ি এল।নিরুপদ্রবে দুদিন কেটে গেল।একটুখানি বল পাই।মনে হল,যতটুকু স্বাভাবিক থাকা যায়।আবার দোকান খুলি।বল্টুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়।কিন্তু নির্বিকার থাকি।বাজারে অনেক কথা কানে আসে।অতিরিক্ত আগ্রহ দেখাইনে।মাঝে মাঝে অনুশোচনা হয়।এমন কাজ ঠিক হল ? বাজারে খবর চাউর হয়েছে লোডশেডিংএর ফাঁকে ফ্ল্যাট বাড়িতে ডাকাত পড়েছে।গৃহকর্ত্রী বাধা দেওয়ায় ডাকাত গুলি ছুঁড়ে পালিয়েছে।মনে মনে স্বস্তি পাই।যোগসাজশের কথা কেউ জানতে পারেনি।
আরো কয়েকদিন কেটে যায়।তানিয়া এসে বলে,তুমি এমন আনমনা কেন ? তাকে আমার ভবিষ্যত ভাবনার বিভিন্ন গল্প বলি।যাই হোক এবছরে বিয়েটা সেরে ফেলব।তাকে সান্ত্বনা দিই।সে খুশি মনে চলে যায়।
এর মধ্যে বার দুয়েক সিমিকে ধরার চেষ্টা করি।কিন্তু সে পরিসেবা সীমার বাইরে।
পরদিন অন্যমনস্কভাবে ফোন করি।এবার পরিসেবা সীমার ভেতর থেকে উত্তর আসে,তোমাকেই তো ফোন করতে যাচ্ছি।
গলাটা কেমন শুকিয়ে ওঠে।একটা অজানা ভয় আচমকা চাগিয়ে ওঠে।কোনমতে জিজ্ঞেস করি,কী ব্যাপার ?
তোমাকে একটা সুখবর দেবো।
কী ? কী !
বেশি কিছু কথা না।রানা এবার ডিভোর্স দিতে রাজি হয়েছে।
ইয়ে—মানে—রানা—আমি যেন আকাশ থেকে পড়ি।
তুমি অমন করছ কেন ?
মানে । রানা এখন কোথায়— কোথায় ?
দিব্যি বহাল তবিয়তে আছে।
উফঃ ! বুকের ভেতর থেকে পাষাণভার নেমে যায়।একটা অপরাধবোধ কুরে কুরে খাচ্ছিল।আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করি,সেদিন তাহলে কী হয়েছিল?
কী আর হবে? তুমি দেয়ালে গুলি করে পালিয়েছ।
তোমার রাগ হয়নি ? আমি তার মনোভাব আঁচ করার চেষ্টা করি ।
কিন্তু এখন আর নেই । মরুদ্যানের শীতল বাতাস বইয়ে দেয় সে ।
কেন ?
একটু আগেই তো বললুম । সে আর কোন কথা না বলে ফোন রেখে দেয় ।
মনে ফূর্তি নিয়ে বাড়ি ফিরি।একবার বেঁচে গেছি।সিমির সংস্পর্শে আর থাকব না।সে বার কতক ফোন করে।আমি কেটে দিই।হঠাৎ তিনদিনের মাথায় বাড়ির দরজায় কড়া নাড়া।ভোরবেলা কে এলো ? দরজা খুলে চমকে উঠি।তানিয়া মাঝে মাঝে এমন আসে।কিন্তু সে না।সকালে বকুলের গন্ধে যেমন মন ভরে ওঠে তেমনি তাকে দেখে লাগল।সমস্ত বিরাগ কোথায় কেটে গেল।সিমি দোয়েলের মতো মধুর কণ্ঠে বলে,কাজলদা,তোমাকে জ্বালাতন করতে এলুম !
কী যে বল,তুমি ! সাদরে তাকে ঘরে বসাই।
তোমাকে একটা কথা পাকাপাকি জানাতে এসেছি।
ডিভোর্সের পর কি করবে তাই ? আমার মধ্যে আকাশকুসুম কল্পনা জাগে ।
সে তো অবশ্যই !
ইতিমধ্যে মা দু’কাপ চা করে এনে দিয়েছে । চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলি,আমরা তাহলে সব ঠিকঠাক করি ?
সে একটু গম্ভীর হয়ে বলে,রানা অবশ্য একটা শর্ত দিয়েছে ।
কী শর্ত ? আমি সচকিত হই ।
সিমি আমার মাথায় বিলি কাটতে কাটতে অনেক কথা বলে । যাওয়ার সময় মাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমো খায় । সে চলে গেলে মা বলে, এ যে তানিয়া না । তবে মেয়েটা বেশ !
বুঝতে পারিনে কী করব ? আবার রানার মুখোমুখি হতে হবে আমাকে কোন অস্ত্রপাতি নিয়ে নয় । সে শুধু আমাকে চোখের দেখা দেখবে । তারপর বিচ্ছেদের কথা ভাববে । সিমির সঙ্গে রানার এমন কথা হয়েছে ।
পথের রহস্য জানার জন্যে মানুষ অজানা ভবিষ্যতে পাড়ি দেয় । জীবনের রহস্য জানার জন্যে মানুষ নিজেকে বিপন্ন করে । আমার আর কী হবে ? বড়ো জোর পুলিশে ধরিয়ে দেবে । সিমির জন্যে সব রকম ঝুঁকি নিতে রাজি ।

চকিতে মস্ত বাইকটা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় । হেলমেট পরা চালককে ঠিকমতো চেনা যায় না । কিন্তু পেছনে যে বসে আছে তাকে যেন চেনার মতো সন্দেহ হয় । বাতাসে উড়ন্ত চুল জটিল এক ধাঁধাঁর সৃ্ষ্টি করে । কৌতূহল আমাকে তাড়া করে । পাশে রাখা হাড় জিরজিরে মোপেডে চড়ে বসি । রাস্তার দুধারে ত্রিফলা বাতিগুলো পরপর চোখ মেলে পথের ঠিকানা দেয় ।

রানাদের নিউটাউনে নতুন গাড়ির শোরুম ।বুধবার বন্ধ থাকে । আজ সেই বুধবার । সকালবেলা বেরিয়ে পড়ি । তাদের হাউজিংএ এবার গার্ড বসেছে । নামধাম লিখে ভেতরে ঢুকি । দোতলার ফ্ল্যাটে কম্পমান হাতে বেলের সুইচ টিপি । সিমি নয় এক সুদর্শন যুবক হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলে দেয় । তারপর ভুরু কুঁচকে তাকায় । ক্ষণিকের জন্যে একটা বিষণ্ণতা আমাকে গ্রাস করে । এই যদি রানা হয় তবে আমি কে ! কী আমার যোগ্যতা ! সেদিন ঝোঁকের মাথায় এতসব ভাবিনি । এর হাত থেকে মুক্তি চাইছে যে সে তো পাগলি ছাড়া আরকি !
আরে কাজলদা যে ! রানার পেছনে কখন সিমি এসে হাজির । রানাও আপ্যায়ন করে ।
ভেতরে এসো,কাজলদা !
আমি মাথা নত করে ঘরে ঢুকি । রানা একটা সিগারেট ধরিয়ে ড্রয়িংরুমের ভেতর পায়চারি করে । তারপর স্বগোক্তির মতো বলে,সেদিন আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলুম । তাই টের পাইনি । তুমি সত্যি এসেছিলে ?
আমি বিদ্যুৎস্পৃ্ষ্টের মতো চমকে উঠে দাঁড়াই । পালিয়ে যাব নাকি ?
রানা আমার দিকে তাকিয়ে বলে,আহা ! বসো ! বসো ! সিমি আমাকে সব বলেছে । আমি শুধু দেখতে চেয়েছি তোমার মধ্যে সেই অদম্য ভালোবাসাটুকু যা তোমাকে মরিয়া করে তুলেছে । ধন্য তুমি । তোমার মধ্যে আমি তা চাক্ষুষ করছি । আমি হেরে গেছি । তোমার মধ্যে রয়েছে সেই শ্বাশত প্রেমিক যে দুস্তর মরুভূমি পাড়ি দিতে দ্বিধা করে না । ধন্য তুমি !
এত সহজে নিস্কৃতি পাব ভাবিনি । তার চেয়ে বড়োকথা সিমি এখন মু্ক্ত । এতদিনে মনের তৃষ্ণা বুঝি ঘুচবে । তানিয়া এসে ঘুনঘুন করে পাত্তা দিইনে । তার মধ্যে নারী সত্ত্বা ছাড়া আর কি আছে ?
দোকানপাট আর ব্যবসার কাজে মন দিই । আশেপাশে নতুন নতুন হাউজিং উঠছে । বল্টু করিৎকর্মা ছেলে । সব খোঁজখবর রাখে । আমরা যৌথভাবে ইঁট বালি পাথরের ব্যবসা শুরু করব কিনা ভাবছি । আর অন্যদিকে আমি তার জন্যে অপেক্ষা করে আছি ।
কোথাকার পানি কোথায় গড়িয়েছে জানিনে । ধাতস্থ হতে সময় তো লাগবে । কোন তাড়াহুড়ো নেই আমার । তানিয়াকে জবাব দিয়ে দেবো । শেষ পর্যন্ত ফোন এলো । চেনাজনেরই গলা ।কাজল নাকি ?
আমি সোৎসাহে বলি,বলুন অ্যান্টি—!
তুমি এমন অমানুষ দেকছি—
আমি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যাই । আমতা আমতা করে বলি,এসব কী বলছেন ?
ধেড়ে খোকা ন্যাকা সাজছে ! তোমার পাল্লায় পড়ে আমার মেয়ে সর্বানাশের পথে পা দিয়েছে । তোমাকে জেলে পাঠানো উচিত ।
তাঁর এসব কথা কে শুনছে ! আমি মিউট অপশানে চলে যাই । সিমি এখন যথেষ্ট বড়ো হয়েছে । তার স্বাধীন সত্ত্বা আছে । আমি মনে মনে হেসে ফেলি ।
ছবি অ্যান্টির কথায় কিছু যায় আসে না । পাখি তো আমার খাঁচায় বন্দি । একদিন দুদিন করে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল । না কোন ফোন আসে না যায় । মনের ভেতর মরু ঝড় ওঠে । বাইক নিয়ে সারা শহরতলি ঘুরপাক খাই । তাদের বাড়ি চেনা থাকলেও যাওয়ার সাহস হয় না । ছবি অ্যান্টিকে বড়ো দজ্জাল মনে হয় ।
সেদিন রোববার । ওবেলা দোকান বন্ধ । বিরাটির দখিন গা দিয়ে চলে গেছে হাইওয়ে । আমাদের বাজার থেকে একটা রাস্তা তার সাথে মিশেছে । সাঁজের ম্লান আলোয় সেই মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি । যেমন দিকভ্রান্ত পথিক দাঁড়িয়ে থাকে । হঠাৎ একটা গর্জন । কোন মরুসিংহ যেন শহরতলির রাস্তা থেকে বেরিয়ে হাইওয়ের মোড়ে পশ্চিমদিকে বাঁক নিল । আমার ঘোর কেটে যায় ।
চকিতে মস্ত বাইকটা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় । হেলমেট পরা চালককে ঠিকমতো চেনা যায় না । কিন্তু পেছনে যে বসে আছে তাকে যেন চেনার মতো সন্দেহ হয় । বাতাসে উড়ন্ত চুল জটিল এক ধাঁধাঁর সৃ্ষ্টি করে । কৌতূহল আমাকে তাড়া করে । পাশে রাখা হাড় জিরজিরে মোপেডে চড়ে বসি । রাস্তার দুধারে ত্রিফলা বাতিগুলো পরপর চোখ মেলে পথের ঠিকানা দেয় ।
তাদের পিছু নিই । কিছুদূর যাওয়ার পর লালবাতির নিষেধ । আমার ক্লান্ত বাইক অচিরে ধরে ফেলবে । কাছাকাছি যেতেসিমি বোধহয় পরিচিত মোপেডের শব্দ শুনে একবার পেছন ফিরে তাকায় । হাত দিয়ে তাকে কিছু ইশারা করার আগেই এক ট্রাক বালির ঝড়ের মতো মাঝে এসে দাঁড়ায় । বাতি আবার সবুজ হয়েছে । ঝড় পেরিয়ে আর নাগাল পাইনে। তখন তারা দূরে—অনেক দূরে—
ক্লান্ত প্রাণ ফিরে আসি । কিন্তু চেনা পথে কোন স্বস্তি নেই । বাড়িতে মন টেঁকে না । দোকানদারি করা সম্ভব হয় না । কী করব ?চারিদিকে যেন মৃত্যু-নেকড়ের ছায়া । রোজ ভাবি,আজ রাত আর কাটবে না । একটা দুস্তর পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তৃষ্ণার্ত হয়ে মরতে বসেছি নাকি ? মা উদ্বিগ্ন মুখে শিয়রে বসে থাকে । তাকে কী করে বোঝাই একটা তৃষ্ণা আমাকে আত্মহননের পথে নামিয়েছে ।
শেষে আমার কথা বলি।আপনারা চমকে উঠবেন না । তবে এতসব কিছুই ঘটেনি । রানা সিমিকে নিয়ে সিঙ্গাপুর গেছে মধুচন্দ্রিমায় । তার আগে ছবি অ্যান্টি একদিন আমাকে আপ্যায়ণ করে খাইয়েছেন । তবে কী একটা অজানা কারণে তানিয়া ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেছে উত্তরবঙ্গে ।সে ফোন ধরে না ।হোয়াট’স অ্যাপে মেসেজ পাঠালে দুটো নীল দাগ ওঠে না ।

 

♣—♣  ♣—♣  ♣—♣


  • Tags:
❤ Support Us
Advertisement
2024 Debasish
Advertisement
2024 Lakshman Seth
Advertisement
error: Content is protected !!