- গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
- মে ২১, ২০২৩
নদীপাড়ের ছেলে, সন্তু আর খোঁড়া ফণীর মা
এই যুগটাই তো কথা বলার। চারিদিকে শুধু এই মিটিং, ওই মিটিং। মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী, বাইল্যাটারাল সামিট থেকে রাষ্ট্রসংঘ সব জায়গায় কেবল কথা আর কথা

– লোকটাকে প্রথম দেখেছিল মাগারাম। ওই আমাকে খবরটা দেয়। আমিও এসে দেখি চুপচাপ বটগাছের তলায় স্থির বসে আছ। ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করি। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। দেখে মনে হচ্ছিল যেন ধ্যান করছে৷ আমি এর বেশি আর সত্যিই কিছু জানি না।
বটকৃষ্ণ কথাগুলো বলে হাঁফাতে লাগল। ও পড়েছে বিষম ফ্যাসাদে। কী কুক্ষণেই না অমল দেবনাথকে ও এই খবর দিতে গিয়েছিল! গ্রামশুদ্ধ সকলে এখন ভাবছে ও লোকটার বিষয়ে সব কিছু জানে। লোকটাকে যে প্রথম দেখেছিল মাগারাম ধীবর সেকথা কেউই জানত না।
অমল দেবনাথ বললেন, মাগারামকে জিজ্ঞেস করে কি আর এর ঠিকুজি-কুলজি জানা যাবে! ও নিজেই জানে না ও কী দেখে, কী শোনে, কী বলে এমনকি কোথায় থাকে! যা নেই তা ও দেখে, যা আছে, তা দেখে না।
এই কথাটা অমল দেবনাথ ঠিকই বলছেন। মাগারামকে জিজ্ঞেস করে এই লোকটার সম্বন্ধে কিছুই জানা যাবে না। বটকৃষ্ণ সে চেষ্টাও করেনি। মাগারাম যখন ওকে বলেছিল যে, একটা অদ্ভুত লোক গত দু-দিন ধরে নদীর পাড়ে বটগাছের তলায় বসে আছে তখন ও এমনকি মাগারামকে জিজ্ঞেসও করেনি যে, লোকটার ব্যাপারে ও কিছু জানে কি না। বটকৃষ্ণ নিজেই চলে এসেছিল লোকটাকে দেখতে। অবশ্য লোক না-বলে ছেলে বলাই ভালো। বটকৃষ্ণ যদি লোক হয়, তাহলে তো ওই লোকটা ছেলেই। বটকৃষ্ণর বয়স হল সাতষট্টি আটষট্টি প্রায়। তাহলে তো সাতাশ-আটাশ বছর বয়সের একটা লোক ছেলেই হল। কেন যে ছেলেটা গত দুদিন ধরে এসে ওদের গ্রামে ঠাঁই গেড়েছে কেউ বুঝতে পারছে না। খুব বেশি ডাকাডাকি করলে চোখ খুলে একবার তাকাচ্ছে তারপর আবার চোখ বন্ধ করে বসেই থাকছে। ওদের গ্রামের দাগি চোর পচা বাউরি গতকাল রাত্রিবেলায় লোকটাকে মাপতে গিয়েছিল। একটু আগে এই ভরা সভায় পচা বাউরিও বলেছে যে, এমন লোক সে দেখেনি। সারারাত একটি বারের জন্যেও শুয়ে পড়েনি লোকটা। ঠায় বসেছিল। মাঝে একবার দুবার চোখ খুলে পিটপিট করে চেয়েছিল কেবল।
বটকৃষ্ণদের গ্রামে এইরকম অশান্তি হয়নি বহুদিন। শ্যামলী নদীর তীরে ওদের গ্রাম। একটু দূরেই পাঁচমুড়া পাহাড়। ওদের গ্রামটা ছবির মতো সুন্দর। সাকুল্যে ষাট-সত্তর ঘর মানুষের বাস। বটকৃষ্ণ মনেই করতে পারছে না ছোটোবেলা থেকে আজ পর্যন্ত ওদের গ্রামে কোনো বড়ো রকমের গণ্ডগোল কেউ দেখেছে বলে। ছোটখাটো যেসব ঝামেলা-ঝঞ্জাট আগে হয়েছে সেগুলো সবই মিটে গেছে কথা বলেই। এই যেমন পচা বাউরির বাবা সোজা বাউরিও ছিল চোর। ওদের গ্রামের দীর্ঘদিনের নিয়মই হল গ্রামে যে-কজন চোর আছে তারা কিছুতেই গ্রামের মানুষদের বাড়িতে চুরি করতে পারবে না। পচা বাউরির বাবা সোজা বাউরি একবার এই নিয়ম ভেঙে ফেলেছিল। তখন ওদের গ্রামের মোড়ল ছিল অমল দেবনাথের বাবা কমল দেবনাথ। সোজা বাউরি কমল দেবনাথের বাড়ি থেকেই চুরি করেছিল এক কাঁদি সিঙ্গাপুরী কলা, একটা বালতি আর একটা লোটা। সিঙ্গাপুরী কলা বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে ধরাও পড়েছিল সোজা বাউরি। আজকের মতোই আটচালাতে বসেছিল সভা। সেই সভাতে কমল দেবনাথই কিন্তু সোজা বাউরিকে মাফ করে দিয়েছিল। সোজা বাউরি বলেছিল যে, গত ১০ দিন ধরে অন্য গ্রামে কোথাও কোনোকিছুই ও চুরি করতে পারছিল না। তাই বাধ্য হয়েই কমল দেবনাথের বাড়িতে চুরি করেছিল কারণ গরিব কোনো মানুষের বাড়িতে চুরি করতে ওর ইচ্ছে করেনি। এই কথা শুনেই কমল দেবনাথ ওকে মাফ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, খেতে না-পেলে মানুষ তো চুরি করবেই আর তুই যে গরিবের বাড়িতে চুরি করিসনি এটার জন্য তোকে আমি আরও দশটা টাকা দেব। ওদের গ্রামে এটাই ছিল বটকৃষ্ণর আজ অবধি দেখা বড়ো একটা ঝামেলা। কিন্তু সেই ঝামেলাও কথা বলেই মিটে গিয়েছিল। ওদের গ্রামের সবাই কথা বলাতে খুব বিশ্বাসী। যা কিছু গোলমাল, যা কিছু ঝামেলা কথা বললেই তো মিটে যেতে পারে। কথার মতো শক্তিশালী আর কোনো অস্ত্র কি মানুষ আজও আবিষ্কার করতে পেরেছে? বটকৃষ্ণ শুনেছে যে ওদের গ্রামের এই কথা বলার প্রথা আজকের নিয়ম নয়৷ কোন আদিকাল থেকে ওদের গ্রামে এটাই দস্তুর। হবে সব মিলিয়ে ছ-সাত পুরুষের ব্যাপার। অবশ্য এই প্রথাটা খারাপ নয় মোটেই। এই যে ওদের গ্রামে গোলমাল-ঝামেলা তেমন কিছু হয় না সে তো ওরা সারাক্ষণ একে অপরের সঙ্গে কথা বলে বলেই। গ্রামে সকাল থেকে যার সঙ্গেই দেখা হোক না কেন কথা না-বলে এড়িয়ে যাওয়ার জো-টি নেই। মিষ্টি একটু হাসি দিলেও হবে না। বলতেই হবে দু-চারটে কথা। এটাই নিয়ম। এইরকম একটা গ্রামে যদি দু-দিন ধরে এসে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে একটা মানুষ যে একটা শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করছে না তাহলে তা চিন্তার বিষয় বই কী!
ছেলেটার এই চুপচাপ বসে থাকা নিয়ে ঘোঁট পাকিয়েছে রাজু বিশ্বাসের ছেলে সন্তু বিশ্বাস। সন্তুর জন্যই আজকের এই সভা। সন্তু কলেজে পড়ে। তার গায়ে শহরের হাওয়া ইতিমধ্যেই লেগেছে। সন্তু শংকরের মতো একেবারেই নয়। শংকর ছিল বটকৃষ্ণর বয়সি। ওদের গ্রাম থেকে শংকরই প্রথম কলেজে পড়তে যায়। কিন্তু শংকরের গায়ে শহরের হাওয়া লাগেনি। সন্তুর গায়ে লেগেছে। সন্তু কিছুদিন আগে গ্রামে এসেছিল ওর এক মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে। তার চালচলন, কায়দাকানুনই আলাদা। প্যান্ট পরা মেয়েছেলে নিজের চোখে বটকৃষ্ণ সেই প্রথম দেখেছিল। ওর মনে আছে এমনকি একদিন সন্তু ওকে পর্যন্ত একটু অপমান করেছিল। এই আটচালাতে বসেই বটকৃষ্ণ ছেলেছোকরাদের নিজের যৌবনের গল্প বলছিল। বলছিল, সে একটা দিন ছিল বটে! ওদের ছোটোবেলায় মাঘী পূর্ণিমার রাতে শ্যামলী নদীর পাড়ে ফি-বছর পরিরা আসত। তাদের কেউ কেউ দেখতে পেত। সবাই না। ছেলেগুলো জিজ্ঞেস করেছিল বটকৃষ্ণ নিজে কোনোদিন পরিদের দেখেছিল কি না। বটকৃষ্ণ বলেছিল যে, অবশ্যই দেখেছিল। তবে পরিদের দেখতে-পাওয়া লোকজনদের মধ্যে বটকৃষ্ণ, কালো মানিক আর কানকাটা দাশুই কেবল আজও বেঁচে আছে। মাগারাম বলে বটে ও পরিদের দেখেছে, তবে ওর কথাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনা যাবে না। যা নেই তা ও দেখে, যা আছে তা দেখে না। ছেলেছোকরাগুলোকে বটকৃষ্ণ বলেছিল যে, কালো মানিক আর কানকাটা দাশুকেও ওরা জিজ্ঞেস করতে পারে যে, তারা পরি দেখেছিল কি না। ও যখন এইসব কথা বলছিল তখন আটচালাতে এসে বসেছিল সন্তু। প্রথমে চুপচাপ বটকৃষ্ণর কথা শুনছিল সন্তু। তারপর একসময় ছেলেছোকরাগুলোকে বলেছিল, এইসব কথা একেবারেই বিশ্বাস করবে না। পরি-টরি বলে কিছুই হয় না। আমরা পরিদের কল্পনা করি কেবল। এটুকু বলেই কেবল থেমে যায়নি সন্তু। বটকৃষ্ণকেও বলেছিল, কেন তুমি শুধু শুধু ছেলেগুলোকে মিথ্যে বলছ? পরিরা তখন আসলে, এখনও আসত। এখন আসে না কেন? বটকৃষ্ণ বলেছিল, সেই জল হাওয়া কি আর আছে বাবা? বাতাস নষ্ট হয়ে গেছে, জল নষ্ট হয়ে গেছে। এত দূষণ! পরিরা খুব সূক্ষ্ম জীব। শ্যামনগরের কারখানাগুলো হতে শুরু করল যখন তখন থেকেই আর পরিদের আমরা দেখতে পেতাম না। সন্তু সবার সামনে ওকে বলেছিল, ঢপ দিও না খুড়া। ছেলেপুলেগুলোর মাথা খেও না। সন্তু ছেলেটা বড্ড বেয়াড়া। গুরুজনদের সম্মান করতে জানে না।
এই যে ছেলেটা চুপচাপ কথা না-বলে বসে আছে নদীর পাড়ে বটগাছের তলায়, এটা নিয়ে সন্তুই সবচেয়ে বেশি চেঁচামেচি শুরু করেছে। অমল দেবনাথকে গিয়ে বলেছে, দিনকাল ভালো নয়, ওই ছেলেটা যে পুলিশের চর নয় কিংবা একজন উগ্রপন্থী নয় কে বলতে পারে! শহরে এসব নাকি হামেশাই হয়। পুলিশের চর এইরকম ছদ্মবেশে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে বেড়ায়। ডেরা বাঁধে উগ্রপন্থীরাও। কাজেই দু-দিন হয়ে গেল লোকটার যখন নড়নচড়ন নেই তখন গ্রামেরই সবার কিছু একটা করা উচিত। তাই বসেছে আজকের সভা। কত কথাই না সবাই বলছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতে বসেছে। সভা আর শেষ হয় না।
হারা বাগদী এমনিতে লোক ভালো। তবে মাথায় কোনো কিছু একবার ঢুকলে আর কিছুতেই বেরোতে চায় না। একই কথা বারবার ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে। সে বলল, যা শুনলাম লোকটা তো কালা নয়। বোবা হতে পারে। তবে বোবারা সাধারণত কালাই হয়। আমার ঠাকুমা বলত বোবা-কালা লোক। তার মানে যে কালা সে বোবা আর যে বোবা সে কালা। আমার তো বাপু এই লোকটার রকমসকম একেবারেই ভালো ঠেকছে না।
আটচালার এই সভাগুলোতে মেয়েরা সাধারণত আসে না। আসলে আসতেই পারে। নিষেধ কেউ করবে না। কিন্তু এটাই প্রায় নিয়ম হয়ে গেছে। খোঁড়া ফণীর মা অবশ্য আসবেই আসবে। খোঁড়া ফণীর মা বলল, আমার কিন্তু বাপু ছেলেটার জন্য বড়ো চিন্তাই হচ্ছে। দু-দিন ধরে না খেয়েদেয়ে বটগাছের তলায় বসে আছে। ওকে আগে খাওয়ানোর ব্যবস্থা কর তারপরে বিচার করবে ও পুলিশের চর না উগ্রপন্থী। মরে গেলে তখন পুলিশই আমাদের ধরবে কিন্তু।
ওদের গ্রামে ইদানীং কালের মধ্যে পুলিশ আসেনি। কমবয়সি ছেলে ছোকরারা তাই পুলিশ কী জিনিস তা জানেই না। বটকৃষ্ণ জানে। খোঁড়া ফণীর মাও জানে। বছর চল্লিশ আগের সেইসব সন্ধে আর রাত কি ওরা ভুলে যেতে পারে! জিপ গাড়ি করে সাত-আটজন পুলিশ এসে দাঁড়াত এক এক সন্ধেবেলা। বাঘের চোখের মতো জিপ গাড়ির হেডলাইট জ্বলত। পুলিশ আসত শংকরের বন্ধু র্যান্টাকে খুঁজতে। শঙ্কর বটকৃষ্ণকে বলেছিল যে, র্যান্টার বাবা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক। বরানগর বা টরানগর নামে কোন একটা জায়গায় ওদের বাড়ি ছিল। বিদ্যাসাগরের মূর্তির মাথা কেটে দিয়েছিল বলে পুলিশ র্যান্টাকে খুঁজছিল। শংকর তাই র্যান্টাকে ওদের গ্রামে নিয়ে এসেছিল লুকিয়ে রাখতে। বেশ কিছুদিন লুকিয়ে থাকার জন্য সত্যিই ওদের গ্রামের মতো আদর্শ জায়গা আর কিছু হতেই পারে না।
শঙ্করের বাড়িতেই র্যান্টা থাকত। তবে মাঝে মাঝেই অন্যদের বাড়িতেও দুপুর বা রাতের খাবার খেত। প্রায়ই র্যান্টাকে দুপুর আর রাত্রিবেলা খাবার খাওয়াত খোঁড়া ফণীর মা। মাঝে মাঝে অন্য আরও কেউ কেউ। র্যান্টাকে ওদের গ্রাম বেশ ভালোই বেসে ফেলেছিল। র্যান্টাও ভালোবেসে ফেলেছিল ওদের গ্রামটাকে। বটকৃষ্ণর সঙ্গেও খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল র্যান্টার। বটকৃষ্ণর বেশ মনে আছে একবার মাঘী পূর্ণিমার রাতে র্যান্টাকে বটকৃষ্ণ পরি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। সবাই ভেবেছিল র্যান্টা পরি দেখতে পাবে না। র্যান্টা কিন্তু পরিদের দেখতে পেয়েছিল। যাওয়ার সময় পরিরা র্যান্টাকে একটা কলম আর একটা পিস্তল দিয়ে গিয়েছিল। এ বটকৃষ্ণর নিজের চোখে দেখা। সন্তুর মতো ছেলেপুলেরা এইসব কথা বিশ্বাসই করবে না।
পুলিশ ঘন ঘন এলেও সেসময়ে র্যান্টাকে কিন্তু পুলিশ ধরতে পারেনি। ওদের গ্রামের সবাই মিলে র্যান্টাকে বেশ কায়দা করেই লুকিয়ে ফেলতে পেরেছিল। পুলিশ কিছুতেই র্যান্টার খোঁজ পেত না। অনেক বাড়িতে ঢুকে মুশকো মুশকো লোকগুলো এমনকি রান্নাঘরের কলসি, কুঁজো ভেঙে দিত লাথি মেরে। তবু র্যান্টার খোঁজ পুলিশ পায়নি। তারপর একদিন হাওয়াতে বুদবুদের মিলিয়ে যাওয়ার মতো উবে গেল র্যান্টা আর শংকর। শংকরের মা কিছুদিন শংকরের জন্য কাঁদত। তারপর একসময় কান্না থামাল। আলপথ দিয়ে দুপুর বেলা শংকরের বাবার জন্য আগের মতোই শংকরের মাকে খাবার পৌঁছে দিতে বটকৃষ্ণ দেখেছিল ছ-মাসের মাথায়। এসব সেই কোন কালের কথা। খোঁড়া ফণির মা পুলিশের প্রসঙ্গ তোলায় বটকৃষ্ণর সব মনে পড়ে গেল।
খোঁড়া ফণীর মায়ের কথা শুনে সন্তু বলল, আরে দু-দিন না খেলে কেউ মারা যায় না। তবে ছেলেটা যদি সত্যিই পুলিশের চর হয়, তাহলে জানতে হবে এখানে কেন এসেছে। আমাদের গ্রামে তো কোনো অশান্তি নেই। আর উগ্রপন্থী হলে তো আমাদের ভোগান্তির শেষ থাকবে না। আমার মনে হয় আমাদের সবাই মিলে গিয়ে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা উচিত। জানা উচিত ব্যাপারটা কী।
সেই মতোই সিদ্ধান্ত হল। সন্তুর কথাই মেনে নিল সবাই। সবাই এবার চলেছে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলবে বলে। রাত হয়েছে। চাঁদ উঠেছে। চমৎকার জ্যোৎস্না। সেই জ্যোৎস্নার মধ্যেই হাঁটছে ওরা। সবার আগে অমল দেবনাথ। তারপর সন্তু। তারপর খোঁড়া ফণীর মা। তারপর বটকৃষ্ণ। লাইনের একেবারে শেষে মাগারাম ধীবর।
জনা তিরিশের দলটা যখন শ্যামলী নদীর পাড়ে গিয়ে পৌঁছল তখনও ছেলেটা চোখ বুজে বটগাছের তলায় স্থির হয়ে বসে আছে পদ্মাসনে। অমল দেবনাথ বেশ গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন এই ছেলে, তোমার মতলব কী? আমাদের গ্রামে এসেছ কী করতে? এই প্রশ্নে ছেলেটার কোন হেলদোল হল বলে মনেই হল না। যেমন চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসেছিল তেমনই বসে থাকল। এরপর কথা বলল সন্তু, আপনি যদি এভাবে গোঁয়ারের মতো চুপ করে বসে থাকেন, তাহলে আমরা কিন্তু পুলিশে খবর দিতে বাধ্য হব। এতেও ছেলেটা বিন্দুমাত্র নড়েচড়ে উঠল না। এবার মুখ খুলল খোঁড়া ফণীর মা। বলল, ও বাবা, খাওয়া-দাওয়া করবে না? না-খেয়ে এভাবে বসে থাকলে তো মরে যাবে গো !
ছেলেটা এবার চোখ খুলল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মুখও। বলল, দু-চার দিন না খেলে কেউ মরে না মা।
সন্তু বলল, এইতো মুখ খুলেছ। মানে বোবা-কালা নও। তাহলে এই কদিন ধরে নাটক করছিলে কেন? তোমার ব্যাপারটা কী স্পষ্ট করে খুলে বলুন তো। কী উদ্দেশ্য তোমার?
ছেলেটা বলল, আমার উদ্দেশ্য কিছুই নেই। শুনেছিলাম যে আপনাদের গ্রামে নাকি কথা না বললে বেঁচে থাকাই যায় না। তাই এসে একবার দেখলাম যে কথা না বলে আমি কটা দিন এখানে থাকতে পারি কি না।
সন্তু বলল, মানে?
–মানে আর কিছুই নেই। এ আমার নিজেই নিজের পরীক্ষা নেওয়া মনে করুন। কথা বলে পৃথিবীর অনেক সমস্যা মিটে যায় ঠিক। এই যুগটাই তো কথা বলার। চারিদিকে শুধু এই মিটিং, ওই মিটিং। মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী, বাইল্যাটারাল সামিট থেকে রাষ্ট্রসংঘ সব জায়গায় কেবল কথা আর কথা। আমি একটু কদিন চুপ থেকে দেখলাম নীরবতার ক্ষমতা কতটুকু। মানে নীরবতা মানুষকে ডিস্টার্ব করতে পারে কি না।
এই কথা শুনে সন্তু কেমন যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেল। মুখে রা কাড়ল না।
অমল দেবনাথ বললেন, তো, কী দেখলে হে ছোকরা?
ছেলেটা বলল, কথার পৃথিবী আসলে অবিশ্বাসে মোড়া। বিশ্বাস আছে নীরবতার পৃথিবীতেই।
ছেলেটা যখন এই কথাগুলো বলছে তখন মনে হল যেন জ্যোৎস্না আরো গাঢ় হয়ে উঠল। স্ফটিকের মতো নয়, কেমন যেন কুয়াশার মতো লাগছে চরাচরপ্লাবী জ্যোৎস্নাকে।
এরই মধ্যে হঠাৎ সকলের চোখের সামনে থেকেই ছেলেটা কেমন করে যেন ভ্যানিশ হয়ে গেল। উবে গেল মুহূর্তে।
মাগারাম ধীবর দাঁড়িয়েছিল বটকৃষ্ণর ঠিক পাশে। ফিশফিশ করে সে বটকৃষ্ণকে বলল, আমি যা দেখলাম, তুমিও কি তাই দেখলে খুড়া?
বটকৃষ্ণ ফিশফিশ করে বলল, কী দেখলি?
মাগারাম বলল, সাত আট জন পরি এসে তুলে নিয়ে গেল ছেলেটাকে।
বটকৃষ্ণ বলল, তাই তো আমিও দেখলাম রে।
সে আর কিছু বলার আগেই দেখল সন্তু বলছে, ভয় পেয়ে পালাল। ব্যাটা নিশ্চয়ই দুনম্বরী।ম্যাজিক-ফ্যাজিক জানে।
বটকৃষ্ণ বুঝতে পারল যে, ও আর মাগারাম ধীবর যা দেখেছে তা আর কেউই দেখতে পায়নি।
ও ফিশফিশ করে মাগারামকে বলল, যা দেখেছিস, দেখেছিস, কাউকে আর বলতে হবে না। আবার সবাই তোকে পাগল বলবে।
মাগারাম কোন কথা বলল না। ঘাড়ও নাড়ল না। তবে মনে হল যে, ওর কথাটা মাগারামের মনে ধরেছে।
কুয়াশার মতো জ্যোৎস্নায় সারিবদ্ধ ভাবে ওরা ফিরে আসছে। সবার আগে সন্তু। তারপরে অমল দেবনাথ। তারপরে মাগারাম, বটকৃষ্ণ। সবার শেষে খোঁড়া ফণীর মা। সে বিড়বিড় করেই চলেছে, জোয়ান ছেলে, না খেলে কি শরীর থাকবে? এই রোদগরমে পান্তা ভাতের সঙ্গে দুটো কাঁচা পেঁয়াজ খেলে শরীর ঠান্ডা থাকত। কে শোনে কার কথা! জোয়ান ছেলে। তেজ খুব। দুটো ভাত খেলে কি এমন ক্ষতি হত গা?
নিজের মনেই বিড়বিড় করে চলেছে খোঁড়া ফণীর মা। কেউ তার কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না।
♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦
❤ Support Us