Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪

পেপার কাটিং

নাফিসা খান
পেপার কাটিং

অলঙ্করণ: দেব সরকার

এক হাঁড়ি ঝোলের মধ্যে গোটা দশেক পটলের টুকরো ভাসছে, তার মাঝে দুটো রুগ্ন হাড্ডিসার তেলাপিয়ার মাথা, কয়েকদিন কোমরে ব্যাথায় সে কাঠ কুড়াতে পারিনি, দু’চারটে যা ছিল তা দিয়ে ভাত হলেও তরকারি সম্ভব নয়। সোনাঝুরি কড়াইটাকে চুলায় বসিয়ে ঝুড়ি নিয়ে বার হল, বাড়ি থেকে বাগান খুব বেশি না হলেও, রান্নার মাঝে বারবার ওঠা তার পছন্দ নয়, ওদিকটা যেতেও তার ভালো লাগে না, তবু কোমর নাচাতে নাচাতে সোনা এগোয় ।

এক সময়ে এই বাগানের মালিক ছিল তার দাদু । তারপর ভাগাভাগি, বিক্রিবাট্টার পর তার বাবার ভাগে পড়েছে মাত্র এক বিঘা।বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় সোনাঝুড়ির পাওনা অন্যান্য শরিক অপেক্ষা চোখে ধরার মতো । তাই পান থেকে চুন খসলেই কাকা-জ্যেঠুর চোখ রাঙানি । তাই বাড়ির কাছের বাগানটা এড়িয়েই চলে সে ।

সবে কদিন হলো,সূর্য গ্রীষ্মের তেজ ছড়াতে শুরু করেছে, দূরে এক কোকিল অনবরত তার সঙ্গীকে ডেকে চলেছে, দুই শালিকের লুটোপুটি দেখে সোনাঝুরি মনে মনে খুব হাসলো, সঙ্গী থাকলে জীবন বুঝি এমন মধুর হয়, কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে সোনা ভাবুক হয়ে পড়ে। এসব স্বপ্ন তার জন্য নয়,  সে এসম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল। মনকে আটকাবে কার সাধ্যি, সে প্রচেষ্টায় মানুষ বরাবর পরাজিত। ঝুড়িতে কাঠ গোছানোর ফাঁকে ফাঁকে, চোখ বারবার সেদিকে আটকে যাচ্ছে। বাড়ি ফেরার পর চোখেমুখে সেই ঝলক রয়ে গেল, মা আচ্ করে বলেন,”মুখ পুড়ি এত্তো উড়তিছ ক্যান”?

মায়ের জীর্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে সোনাঝুরি খালি হাসে, আরও কয়েকটা শব্দ পিঠোপিঠি চাপিয়ে মা তাকে শোনায়। কিন্তু, আজ সব কথাই কানের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, মন জুড়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি ।

বেলা গড়িয়েছে, শানের ধার ফাঁকা, সোনাঝুরি পুকুরের জলে গা ভাসিয়ে প্রেমের অনুভবের আস্বাদন গ্রহণে মগ্ন। জলের মাঝে পদ্ম, গাছে কোকিল,পানকৌড়ি সঙ্গে  সূর্যের আলোর সোহাগি রূপে ভরা চিকন স্রোত সোনার শরীর স্পর্শ করে ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ গন্তব্যে। সেদিকে অপলক তাকিয়ে সোনা কল্পনার সংসার সাজতে থাকে। ওদিকে তার ফিরতে দেরি হওয়ায় মা হাক দেয়,”ও সোনা আমি কি না খেয়ে মরবো ” ?

মা এই নামে তাকে ডাকে। গায়ের রঙ ময়লা হলেও সোনার চেহারায় অদ্ভুত মায়া আছে, জাদুকরি চোখ মুখের আদল মুখে এনে দিয়েছে আর্কষণীয় রূপ । মুখের জল মুছে সে চিৎকার করে “কি অদ্ভুত রে তুই , ভাতটা নিজে খুলে খেলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে শুনি,” এরপর বিড়বিড় করতে করতে সিঁড়ি বয়ে উপরে উঠতে গিয়েই বিপত্তি। পা ফঁসকাল। আর বোধ হয় কোমরটা রক্ষা পাবে না। কিন্তু, একি ! বেশ শক্তপোক্ত এ কোন পেশির আশ্রয় ! কোন ক্ষত  নয়, পলক খুলতেই চোখাচুখি।

স্বপ্ন যেন পায়ে হেঁটে গৃহে প্রবেশ করতে চাইছে, গায়ে জড়ানো ভিজে শাড়িটা দিয়ে লজ্জা আড়ালের তড়িঘড়ি চেষ্টা । ছেলেটিকে সে আগে কখনও দেখেনি, এই গ্রামের তো নয়। গোরারঙের মাঝে মায়াবী চোখ, গাল ভর্তি দাঁড়ি,  মিষ্টি হাসির সঙ্গে এই স্পর্শ ভোলার নয়।

খাওয়াদাওয়া পর প্রতিদিন মা-বেটি চুমকির কাজ নিয়ে বসে, দশটা ফুলবডি চুরিদার পিছু মাত্র দুশ টাকা। অর্থ সামান্য হলেও উপায় নেই, জমাজমি ছাড়া বাপ কিছু রেখে যায়নি, তাও বছরে অধিকাংশ সময় বন্ধ্যা পড়ে থাকে। কোমরে ব্যথা, তাই ডাক্তার সেলাইয়ের কাজ বন্ধ করতে বলেছে মাকে। ঘরে ঢুকেই শাড়িটা দ্রুত পাল্টে নেয় সে । বার হতে হবে, আজ মিঠু বৌদি ডিমের টাকা দেবে। সোনাঝুরি ভিজে চুলে একটু সুগন্ধি তেলে লেপে, সেফ্টিপিন সাটা ছেঁড়া চপ্পলে যাত্রা শুরু করে।

বৌদি ঘরে নেই। কুড়ি কিলোমিটার পথ হেঁটে পৌঁছতেই শুনতে পায় সোনাঝুড়ি। আসার সময় আরও কয়েকটা ডিম বেঁধে দিয়েছিল মা,  অগত্যা সেগুলো বৌদির শাশুড়ির হাতে তুলে দেয় সে । সূর্য ঢলতে শুরু করেছে, সন্ধ্যার পর রাস্তায় লাইট থাকে না, সে কাপড় ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মিঠুর শাশুড়ি বড়ো গল্প গেলা মানুষ, কথায় কথায় তাকে আরও মিনিট দশেক আটকে রেখে পঞ্চাশ টাকা হাতে গুজে দিয়ে বলে,”বাকিটা বৌমা হিসাব করে পরে দিয়ে দেবেক্ষণ “।

মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে দ্রুত পা চালায় সোনাঝুরি, দেরি হলে মা বকবে, গ্রামের পরিস্থিতি অনুকূল নয়, অন্ধকার গাঢ় হলেই সোনাঝুরির গা ছমছমে ভাবটা বাড়তে থাকে, হঠাৎ সে লক্ষ্য করে, পথ দেখানোর উদ্দেশ্যে একটা টর্চ জ্বালিয়ে পিছনে পিছনে কেউ হেঁটে আসছে । সে ফেরার কথা ভাবার আগেই মানুষটা তার সামনে এসে দাঁড়ায় ।

শ্বাস বন্ধ হওয়ার জো, বুকের মধ্যে ধুকপুকানির আনাগোনা, সোনাঝুরি বিস্ফারিত চোখে বলে,”আ পো নি ,পনি কোমনে ঝি লে”? কথাগুলো জিভের আড়ষ্টতায় ঠিকঠাক উচ্চারিত হল না,  সে উত্তর দিল ,” তোমার সঙ্গ দিতে চলে এলাম, আপত্তি থাকলে চলে যাচ্ছি “।

এমন সঙ্গে আপত্তি কেন থাকবে, নীরব থাকে সোনাঝুরি। গল্পে গল্পে শেষ হয়ে এল রাস্তা, সোনাঝুরির খুব ইচ্ছে করছিল আরও কিছুক্ষণ তার সঙ্গে থাকার, কিন্তু সকল ইচ্ছের পূরণ সম্ভব নয়। তাছাড়া, পাড়াপর্শীরা দেখলে তিলকে তাল বানিয়ে ছাড়বে।
ঘরে ঢুকতেই মেয়ের চেহারায় আলাদা চমক দেখতে পেলেন সোনার মা, গুরুত্ব দিলেন না। সোনাঝুরি  মুখহাত ধুয়ে   সোজা বিছানায় , তারপর কোল বালিশটা জাপটে ধরে এ যাবৎ গুছিয়ে রাখা আবেগের ভান্ডার খুলে বসল । এতো কথার মাঝে মানুষটার নাম জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তাই সে আদর করে নাম রাখে , স্বপনবাবু।

ভোর হতেই সোনাঝুরি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, কলসির জল এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু,সে ইচ্ছাকৃত নানাপাত্রে জল ঢেলে শেষ করে। আসলে তার মন পড়ে আছে ওই শানপুকুরে । অস্থিরতা  দেখে মা জিজ্ঞাসা করে ,”এই মাগি কি হয়েছ বল দেখি, কাল থেকে কেমনি যেন লাগতেছে”!

“ওসব তোর চোখের দোস, শনিবার পঞ্চায়েতে বিনি পয়সায় চোখ দেখবে, পিসিকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাস”।

“সেকি বাড়িতে থাকে, বিকালেই দেখলাম ব্যাগপত্র গুছকে রওনা দিল”?

সোনা কৌতূহল ভরে জিজ্ঞাসা করে,”কবে ফিরবে কিছু বলছে তোকে “?

“ফুলি মেয়েছেলের নাকি পড়ে গে হাতখানা ভেঙে গেছ, সপ্তাহ দুই লাগবেন “।

তার থেকে বছর খানেকের ছোট হবে পিসির মেয়ে ফুলি, বিয়ের সময় পিসির  নির্দেশ ছিল দূরে থাকার, তার স্পর্শে নাকি অমঙ্গল হবে, সোনাঝুরি সেদিন কষ্টে  ভাতের একটি দানাও মুখে তোলেনি । হঠাৎ দৃশ্যগুলো আজ আবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে সোনাঝুরি থমকে যায়, যে স্বপ্নের দিকে সে  এগিয়ে  চলছে,  তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তাকে থামতে হবে। সে লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাসি থালা নিয়ে ঘাটে যায়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে স্বপনবাবু  হাজির, সোনাঝুরি তাকে না দেখার ভান করে নিজের কাজ সেরে বাড়ি ফেরে।সেও নাছোড়বান্দা কিছুক্ষণ পর  সোজা হেঁশেলে উপস্থিত। সোনাঝুরির খুব কাছাকাছি মুখটা এনে জানতে চায়,”রাগ হইছে “?

“রাগ ? না তার যে উপায় নেইকো “উদাস কন্ঠ থেকে বেরিয়ে এল।

“তালহে তোমার স্বপনবাবুকে দেখে ,না কোন কথা, না ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা ,কেন “?

“একি এই নামটা তুমি ক্যামনে জানলে ” ?সোনাঝুরি উৎফুল্ল হয়ে জানতে চায়। “যদি বলি তোমার স্বপ্নের মধ্য থেকে চুরি করেছি ” সে উত্তর দেয়।

এমন একজনকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না,  এই মুহূর্ত ঈশ্বর তার জন্য পাঠিয়েছে, এ প্রাপ্য যেন তার আবেগে আল্পুত সোনাঝুরি আলতো কাত করে তার মাথাটা স্বপনবাবুর বুকে রাখার কথা ভাবে, কিন্তু  সাহসে কুলায় না। সেকেন্ড ঘুরতেই মা হাঁক দিলেন ,”সোনা ,ও সোনা বস্তাটা ধর, আমার দ্বারা আর হবে নি কো,বয়স হইছে “।

সোনাঝুরি বস্তাটা নামিয়ে সোজা ঘরে চলে যায়,স্বপনবাবু চৌকির তলায়, মা দেখলে আর রক্ষা নেই। ঘন্টা দুয়েক এভাবে যাওয়ার পর ,ফাঁক বুঝে সে বিদায় নিল ! কিন্তু মেয়ের ছটফটানি দেখে তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন ,”দেখ সোনা এমন কিছু করিসনে, যা সামলাতি পারবিনে কো। এমনিতে শত্তুরের অভাব তার উপর ….,যাক আমি ঝামেলি চাইনে “।

আজ  সোনাঝুরির এড়িয়ে যাওয়ার মতো কিছু করল না  বরঞ্চ তার সম্পর্ক স্বপ্নবাবুর সঙ্গে যতদূর এগিয়েছে, খোলাখুলি মায়ের সামনে রাখল । মায়ের মন ,প্রত্যাশায় গাঁথা । তবে,  ব্যাপারটা তিনি  বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না। তথাপি বলেন,”ঠিক আছে ওকে একদিন আসতি বল “।

দু ♦ ই

মা ডিম বিক্রি ও সেলাইয়ের টাকা দিয়ে ছোটখাটো আয়োজন করেছিলেন। ঘরের আসবাবপত্রের সাথে সেদিন সোনাঝুরিও সেজে ওঠে। পরিচিতদের মধ্যে কেবল পিসিকে ডাকা হল। তিনি সোনাঝুরির মাকে বকাবকি শুরু করেন,”তুই কি আক্কেলের মাথা খাইছিস ! এসব শুনলে পাড়ার লোক হাসাহাসি করবে, ছেলেটা ঘুরে গেলে নাটক শেষ কর “।

সোনাঝুরি বিস্ময়ে পিসির মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে, ওদিকে বিকাল গড়িয়ে তুলসীর প্রদীপটা জ্বলে ওঠেছে, স্বপনবাবুর দেখা নেই। চিন্তায় তার চেহারার কালোভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, শুধু  অন্ধকার নামার অপেক্ষা। তারপর, অর্ধসাড় শরীরটাকে নিয়ে ধীরে ধীরে বাগানের রাস্তায় পা বাড়ায়, নিজেরপ্রতি ঘৃণা রাগ অভিমান চেপে বসেছে, এই অস্বাভাবিক শরীর নিয়ে তার বেঁচে থাকা অর্থহীন। সোনাঝুরি পুকুরের গভীরতায় নামতে থাকে, অকস্মাৎ স্বপনবাবু এসে তাকে টেনে তোলে ,বন্ধুর মৃত্যুর খবর মানুষটাকে  টেনে নিয়ে গিয়েছিল কুমারপুরে,  সময়মতো গাড়ি ধরতে পারিনি। সে তার উপর ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারল না, জীর্ণ দৃষ্টিতে স্বপনবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে,” এ অপমান আর সহ্য হয়না গো , আমাকে ছেড়ে দাও বাবু”।
“যা শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেবো, কিন্তু এরকমটি বলো নাকো, একবার আমার দিকে তাকাও সোনাঝুরি ,সোনাঝুরি …ওই….সোনাঝুরি”।
সোনাঝুরি ভিজে চোখে স্বপনবাবুর দিকে তাকায়, এরপর ধীরে বলে “আমি আর কে হলুম শাস্তি দিবার “।
ঈশ্বর তার সাথে যতোই অবিচার করুক, মানুষটি কিন্তু অমায়িক, এই সম্ভাবকে কোনদিন ত্যাগের কথা মাথায় আনেনি। সেকারণ,  এতোকিছু পরও সে স্বপনবাবু বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে।

দন্দ্ব সত্বেও সোনাঝুরি স্বপনবাবুর সাথে অন্ত্যরঙ্গতা বাড়ায়। কিন্তু, বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলে সে সংযত, স্বপনবাবু বিষয়টা বোঝে না এমন নয়, তবে না বোঝার ভাণেও অদ্ভুত এক তৃপ্তি

সে বাড়ি ফিরতে পরিবারের সব আলোচনা থেমে যায়। মায়ের আচরণ দেখে  তার মনে হয় মায়ের মতিভ্রম ঘটেছে, পরিবারের লোকজন চলে গেলে মা তার পাশে গিয়ে মাথায় হাত বোলাতে থাকে, সোনাঝুরি মাকে জিজ্ঞাসা করে,”তুইও কি ওদের মতো ভাবছিস “?
মেয়ে কষ্ট পাবে,  মা ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে “কথা হয়েছে তোদের”?
“হুম “।
মুখ দেখে বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার মাথায় কি চলছে, তবে তিনি কথা না বাড়িয়ে লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস সঙ্গে নিয়ে  শাড়ির আঁচলটা মাথায় তুলে ঘাটের রাস্তা ধরলেন।  সেই শেষ আর ফেরনি, আত্মহত্যা না হলেও, এই সমস্ত ঘটনার এক নিষ্ঠুর সমীকরণ ছিল তার মৃত্যু ।
আপন বোলতে এই সংসারে  মা’কেই সে চিনে ছিল, তখন সে খুব ছোট সবে বর্ণপরিচয় শেষ করে স্কুলে ভর্তি হয়েছে,  সকালে উঠে বাবাকে দেখল ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৈরি,  বাবার সঙ্গে আরও কয়েকজন রয়েছে, মা ব্যস্ত, কাকাও লোকগুলোর সাথে গল্পে  মগ্ন । তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো আছেন বাবা, বাবার হাতের কাজ একটু কমতে সোনাঝুরি জিজ্ঞাসা করে,”বাবা তুমি কোথায় যাচ্ছো “?
উত্তর নেই, প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই তিনি ঝাজিয়ে উঠে বলেন ” গৌরী ওকে ভিতরে নিয়ে যা, তোকে বলেছি না শুভ কাজে যাওয়ার আগে ওকে সামনে আনবি নে “।
“ওর কি এতো বুঝ হয়েছে”!
“তাহলে সেভাবে বোঝা ,যাতে ও বোঝে “।
সেই ভরা  চোখে শেষ দেখেছিল বাবাকে। শহরে গিয়ে তিনি অন্যত্র ঘর বসায়, এরপর মাঝেসাঝে গ্রামের পা রাখলেও সোনাঝুরির সাহস হয়নি বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর।

শেষকৃত্য সেরে সোনাঝুরি পুকুরের জলে নিজেকে চুবিয়ে ঘরে ফেরে, কাকিমা এক থালা ভাত ডাল ও আলুছানা নিয়ে তার সামনে ধরল । অন্ন গলা দিয়ে না গেলেও সে মুঠো দুই টুসে থালাটা দূরে সরিয়ে রাখে। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলেও তার চোখ পাতা একই জায়গায় স্থির। হঠাৎ মাথার জানালা দিকে  চোখ যেতেই সে  স্বপনবাবুকে দেখতে পায়। সোনাঝুরি বিছানা ছেড়ে তার কাছে এলো।স্বপনবাবু আশ্বাস দিয়ে বলে ,”আমি সবসময় তোমার পাশে আছি, একদম চিন্তা করো না,  তুমি ঘুমাও ” !
“আসছে কই, আমার যে সব শেষ বাবু “!
“আমি তো আছি “।
এক সেকেন্ডের ব্যবধান, কথাটা ঠোঁটে এলেও সোনাঝুরি ভয়ে থেমে যায়। পিসি ভুল কিছু বলেনি, তার সম্পর্কে সবকিছু জানার পর স্বপনবাবুর আচরণ কি এরকম থাকবে ? সেকি তাকে এভাবে আগলে রাখতে চাইবে?

সম্ভব নয়, দ্বন্দ্বের সত্বেও সোনাঝুরি স্বপনবাবুর সাথে অন্ত্যরঙ্গতা বাড়ায়। কিন্তু, বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলে সে সংযত, স্বপনবাবু বিষয়টা বোঝে না এমন নয়, তবে না বোঝার ভাণেও অদ্ভুত এক তৃপ্তি, এই তৃপ্তি বুকে ভরে স্বপনবাবুও তার ভালোমন্দের নিত্যসঙ্গী।

তি♦ন

জুন মাসের শুরু, বর্ষার অগ্রিম পর্দাপণে গ্রামে ডেঙ্গু মহামারি আকারে নিয়েছে।পিসির বাড়িতে ছাগল গরু থাকায় মশা মাছির বেশ উৎপাত, আগে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখলেও বয়স হয়েছে একা সবটা সামলাতে পারে না। তাছাড়া, মেয়ের বিয়ের পর এই অবলাদের নিয়ে তার দিন কাটে।
অসুখের কবলে পড়ে পিসির অবস্থা রাতারাতি শোচনীয় হয়ে পড়ে, গ্রামে চিকিৎসাকেন্দ্রে আর সম্ভব নয়, তাকে পাঠানো হল সদর হসপাতালে।
খুব ছোট থাকতে একবার মায়ের সাথে এসেছিল শহরে বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না সিনেমা দেখতে, পাড়ার ক্লাবের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে সে মাঝে মাঝে টিভি দেখতো, সাদা-কালো চেহারার বেশ উঁচুলম্বা এক নায়কে তার ভালো লাগে, ফুলি বলেছিল ওনার নাম উত্তম কুমার, নামটা তার আজও মনে রেখেছে সে। এখন আর সিনেমা দেখার ধৈর্য্য  নেই। তবে গেল রবিবার স্বপনবাবু তাকে একটা ছোট ফোন এনে দিয়েছে, সেখানে একটু-আধটু গান শোনা যায় । শহরের পরিবর্তিত চেহারার দিকে নজর দেওয়ার সময় হল না তার। একে পিসির জন্য উৎকন্ঠা ,তার উপর অতি ব্যস্ত পরিবেশ। তারপর, যেনতেন প্রকারে  ভর্তি সম্ভব হলেও বেড পাওয়া গেল না, হসপিটালের মেঝেতে কোনক্রমে বিছানা পেতে সুরাহার অপেক্ষা।

সন্ধ্যা নামার আগে বাকিরা চলে যায়  সোনাঝুরিকে রেখে, ছোটকাকু থাকছেন তবে ফিমেল ওয়ার্ডে রাতে তার ডোকা বারন, রাতভোর উৎকন্ঠার পর পিসি সকালের দিকে একটু স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে। এই সুযোগে সোনাঝুরি বেড়িয়েছিল চায়ের সন্ধানে, অকস্মাৎ সে  ধাক্কা খায় এক ব্যক্তির সাথে, চেহারা উঁচুলম্বা, পরণে রয়েছে  লাল শার্ট ও জিন্স। সোনাঝুরি অপ্রস্তুত চেহারা দেখে সে  বলে,”সরি ,সরি ম্যাডাম ,আপনার লাগেনি তো “।

সোনাঝুরি লজ্জা পায়, হাসি আটকাতে পারে না।ইতিপূর্বে ইংরাজী শব্দ শুনলেও ,কেউ এরকম তার উদ্দেশ্যে সরিটরি বলেনি। সোনাঝুরির সহজ-সরল হাসিতে তার ধারণাও পরিস্কার হয় । সেকারণ বেশি ভণিতা না করে সে সরাসরি বলে, ” আমি তাহিদ আলম, পাশে থাকি। গ্রাম থেকে এসেছেন বোধহয় “?
“হুম, হাসনাবাদ “সোনাঝুরি ভারী গলায় উত্তর দেয়।
“কে আছেন আপনার”? সোনাঝুরি অপরিচিত মানুষটির একের পর প্রশ্নের উত্তর গড়গড় করে দেওয়ার পর থেমে যায়,  মা বলতেন অপরিচিত মানুষের সাথে বেশি কথা বোলতে নেই, বোধহয় একটু বেশি বলা হয়ে গেল ,সে থেমে যায়।তাহিদ আগ্রহ সহকারে বলে,”কি হল থেমে গেলে যে”?
“অনেকক্ষুণ হল, পিসি একা রইছে, আমাকে যেতি  হবে “।
“সে তো যাবে, কিন্তু বলে যাও আবার কখন দেখা পাবো “?
সোনাঝুরি হেসে চলে যায়, দুপুরে ডাক্তার জানায় পিসি ঠিক আছে, আর কোন ভয় নেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আগামীকাল ছুটি দেওয়া হবে। সে স্বত্বি পেল ,হসপিটালের পরিবেশ তার আর ভালো লাগছে না, তার উপর মাথাও ধরেছে ।
বিকাল চারটে ভিজিং ওয়ার, পিসির মেয়ে-জমাই এল, সোনাঝুরি সুযোগ বুঝে ফুলিকে বলে,”তুই আজকির রাতটা থেকে ঝা, আমি কাল সকালে চইলে আসবো “।
“না,না, আমার শাশুড়ি বিছানায় পড়ে”ফুলি দায় এড়িয়ে যায় । অগত্যা তাকে থাকতে হয় । ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার স্বপনবাবুকে সে  কল করেছে  কিন্তু নেটওয়ার্ক গোলযোগের জন্য কথা হয়নি। সারাদিন সে চিন্তা মাথায় ঘোরাঘুরি করছে, রাতেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হল না।সেকারণ ,ভোরের আলো ফোটার আগে সোনাঝুরি ব্যস্ত হয়ে ওঠে বাড়ি ফেরার জন্য,ব্যাগপত্রও গোছগাছ সম্পন্ন।

সোনাঝুরি পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে, বাগান পেরিয়ে মাঠ, মাঠের পাশে রেল লাইন, সেখানে থাকে স্বপনবাবু , সে আগেও বেশ কয়েকবার গিয়েছে, কিন্তু জলজ্যান্ত বাড়িটা পড়ে আছে ,দরজা ভাঙা, ভিতরে কেউ নেই

হসপিটাল থেকে অনতিদূরে প্রায় পঞ্চাশ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে  নিয়ে তাদের এক সংস্থা আছে, নতুন কারুকে পেলে, তাদের উদ্দেশ্যে থাকে তাকে দলভুক্ত করে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি , একই উদ্দেশ্য নিয়ে তাহিদ তার জন্য অপেক্ষা করছিল। বেলা গড়িয়ে যাওয়া সে আশাহত হয় , প্রস্থানের কথা মনস্থির করে , ডানপা এগোতেই সোনাঝুরির গলার আওয়াজ পেয়ে সে থেমে যায় । আসলে, তার সংস্পর্শে এসে সোনাঝুরির মধ্যেও অদ্ভুত এক স্বত্বি অনুভব আর্বিভাব ঘটেছে।

তার বয়স তখন এই এগারো-বারোর আশপাশে, শহর থেকে একদল হিজারা আসে তাকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সোনাঝুরির মা তাকে আঁকড়ে ধরে, অনেক আকুতির পর তারা সোনাঝুরিকে রেখে যায়। তাদের কাছে শুনেছিল, তার মতো লিঙ্গধারীদের সঙ্ঘবদ্ধ থাকার কথা, কয়েকবার কৌতূহল জাগলেও মায়ের কথা চিন্তা করে সে নিজের সব সত্বাকে থামিয়ে রেখেছিল। কিন্তু, এতো নিকটে এসে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না,  সোনাঝুরি সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে। তাহিদ প্রথমে রাজি না হলেও পরে নিয়ে যায়।

মহল্লা তো নয়, ছোটখাটো একটা পাড়া, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বিশাল এক ইমারত, সেখানে একত্রে অনেকে থাকে। তাহিদের বাড়ি অবশ্য একটু দূরে, তারা আশপাশে আরও কয়েকজন নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। এসব দেখে তার মনে হয়,  এতোদিন তাকে মিছে প্রত্যাশা আটকে রেখেছিল, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার সঙ্গে কোন দ্বন্দ্ব থাকা উচিত, মানুষগুলো তো ভালোই আছে। কিন্তু, তার মন অস্থির। পরক্ষণে নিজ বাসভূমির মায়া তাকে আচ্ছন্ন করে সঙ্গে স্বপনবাবুর সাথে কাটানো মুহূর্ত।

হসপিটাল থেকে ফেরার পর তাহিদ রীতিমতো দায়িত্ব সহকারে প্রতিদিন তার খোঁজখবর নেয়। বলাবহুল্য, সম্পর্কে ভরসার পরিমান বাড়ছে,  সোনাঝুরি খোলা মনে তাকে স্বপনবাবুর সম্পর্কে বলে।তাহিদ নাছোড়বান্দা জেদ করে বলে” ছবি পাঠাও”।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে সোনাঝুরি স্বপনবাবুকে পরিপাটি হয়ে বারান্দায় দাঁড়াতে বলে, তারপর গোটা দুই ক্লিক, ছবিও নেহাত মন্দ ওঠেনি। কিন্তু, সেটা দেখার পর তাহিদ বলে,”তুমি কি আমাকে বোকা বানাচ্ছো”?
বিস্ময়ে সোনা জিজ্ঞাসা করে,”কেন”?
” ওয়াসআপটা  দেখো “!
একের পর এক ফরওয়ার্ড ম্যাসেজ,  ছবিতে থাকা তাদের পুরানো দালান, বাথরুম, পূব- পশ্চিম দেওয়ালের ঘুটে, ফুলিদের আমগাছের ডাল সবই চোখে পড়ল, কিন্তু স্বপনবাবু কোথায়?

তড়িঘড়ি সে গ্যালারিতে যায়, একি সমস্ত ছবিতে সে একা, স্বপনবাবু নেই । সোনাঝুরি মোবাইল ফেলে বিধস্তাবস্থায় শানপুকুরের দিকে ছুটে যায়,  প্রকৃতি উত্তাল, বাড়ছে মেঘের গর্জন, সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে ….বাবু ……বাবু …..বাবু
উত্তর নেই, সোনাঝুরি পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে, বাগান পেরিয়ে মাঠ, মাঠের পাশে রেল লাইন, সেখানে থাকে স্বপনবাবু , সে আগেও বেশ কয়েকবার গিয়েছে, কিন্তু জলজ্যান্ত বাড়িটা পড়ে আছে ,দরজা ভাঙা, ভিতরে কেউ নেই, হঠাৎ পিছন থেকে কেউ তার মাথায় আঘাত করে, সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

ভরদুপুরে তাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে বাড়ির লোকেরা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ওঝাকে খবর দেয়,  এরপর দড়ি দিয়ে বেঁধে সোনাঝুরিকে শীতলা তলায় হাজির করা হল। ঝাড়ফুক দিয়ে ওঝার মন ভরলো না, তিনি চোখ পাকিয়ে বলেন “খুব সাংঘাতিক ভূত তততততত, সময় লাগবে, অভুক্তও থাকতে হবে তিন-চারদিন, ও বাঁধা থাকবে”। এরপর ওঝা লাঠি উঁচু করে সকল গ্রামবাসীদের হুসিয়ারি দেয়,খবরদ্দার,  কেউ কাছে যাবে না”।

এই ধাক্কায় সে অসার হয়ে পড়েছে,  অভিব্যাক্তি প্রকাশের ইচ্ছেও নেই।পরিবারের কাছে বড়ো সুযোগ, তারা সোনাঝুরিকে একা রেখে চলে যায়।

সন্ধ্যা পেরেতোই হাঁটুর বয়সি একদল ছেলেপুলে তার আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে থাকে, সোনাঝুরি সচেতন। কিন্তু, ক্লান্তিতে তার চোখ লেগে আসে। হঠাৎ ব্লাউজের ভিতর গরম স্পর্শ, সোনাঝুরি আঁতকে ওঠে, একজন সোনার মুখ চেপে ধরে, পিছন থেকে অপরজন এসে সোনার সারা শরীরে হাত লাগায়, সোনাঝুরির অসহায় চিৎকার গ্রামবাসীদের কানে পৌঁছালো না।সকালে সে বিষয়টি পিসিকে বলে। প্রত্যুত্তরে পিসি জবাব দেয় “তোর আবার কি এরজ্জোত রে ,তুই তো হিজরে “?

সে এতোটুকু বিস্মিত হল না, এটা যে প্রথম নয়, পিসি বরাবর তার দুর্বলতা নিয়ে কটাক্ষ করে এসেছে। তার থেকে সাহায্যের প্রত্যাশা করা ভুল। তবে,  পিসি ছিল বেশ ঝানু, তার চিন্তার পরিধি অপেক্ষা আরও কয়েকধাপ এগিয়ে,  তিনি ওঝাকে কড়া বার্তা দেয়, ” আজকে একটা হেস্তনেস্ত করুন। আর একটা জিনিস কাজ পছন্দ হলে কিন্তু পেমেন্ট ফুল পাবেন”।
“চিন্তা করিসনে মা, তুই বাস টাকাটা গুণে রাখিস” !

কথা রেখে ওঝা খুর নিয়ে ময়দানে নেমে পড়ে, সোনাঝুরি প্রতিবাদ করেও রক্ষা পেল না, তার মাথা কামিয়ে তাকে গ্রাম রাস্তায় ঘোরানো শুরু হল, বিকাল গড়িয়ে সূর্য পশ্চিমাকাশ বয়ে নেমে পড়েছে, তার প্রতি মায়া দেখানোর জন্য কেউ এগিয়ে এল না।
তবে, কথায় বলে যার কেউ নেই তার ঈশ্বর আছেন,  দ্বিতীয় দিনের মাথায়  তার কলের কোন উত্তর না পেয়ে তাহিদ চিন্তত্ব হয়ে পড়ে। পরিবারের এই চক্রান্তের বাইরে ছিল কেবল সোনাঝুরির ছোটকাকা। কিন্তু, বাকিদের ভয়ে মুখ খুলতে পারছিল  না।

সকলের আড়ালে সে তাহিদের ফোনটা ধরে তাকে সব জানায়, তাহিদ পুরো টিমটাম সাজিয়ে পুলিশ নিয়ে হাজির হয়। বলাবাহুল্য, তাদের দেখে গ্রামবাসীদের অধিকাংশ পালিয়ে যায়, এই ঘটনায় ওঝা সমেত আরও কয়েকজন গ্রেফতার হয়।
এই পরিস্থিতিতে সোনাঝুরিকে একা ফেলে যাওয়া ঠিক হবে না, সে সোনাঝুরিকে সঙ্গে নিয়ে আসে। বিগত দিনের ধকল ও মানসিক চাপে  সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাহিদ বাড়ি ঢোকার পূর্বে তাকে ক্লিনিকে নিয়ে যায়,  সেখান ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দেয়।

তার  জীবনের সমস্ত আশা বিলুপ্ত হয়েছে, বুকের ভিতরটা খা খা করছে, এই বিশাল শূন্যতা নিয়ে বেঁচে থাকা দুরহ।মহল্লায় এসে  সে তাহিদকে বলে ,”কেন বাঁচালে আমাকে “?
“আমার জন্য ” সোনাঝুরি বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকায়। মহল্লায় নতুন কেউ এলে স্বাভাবিক নিয়মে ভিড় জমে। তাকে দেখার জন্য যারা এসেছিল তাহিদ তাদের দিকে তাকিয়ে সংযুক্ত করে,” তুমি কি মনে করো কষ্টে কেবল তুমি একা কাটাচ্ছো , এদেরকে দেখো, কতো ক্ষত লুকিয়ে রেখেছে নিজেদের কাছেও তার হিসাব নেই।  নিজেকে গ্রহণ করা শেখো, এভাবে পালিয়ে আসলে কোন লাভ হবে না”।
“আমার এসব শুনতি ভালগাতেছে না একদম, আমাকে যেতে দাও “।
“আহা,কচি খুকি যেন, এই তাহিদ ওকে আমাদের কাছে ছেড়ে দে তারপর দেখতিছি “একজন পাশ থকে বলে।
“হেমা দি প্লিজ ওকে একটু সময় দাও”!
” তুই বলছিস বলে ছেড়ে দিলাম, এতো ন্যাকামো আমার বাপু ভালো লাগে না “সে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দেয়।
মহল্লায় সকলের জন্য একটি কামরা বরাদ্দ, আপাতত ফাঁকা ঘর নেই। তাহিদা তাকে নিজের বাড়িতে রেখে দেয়। তাহিদ প্রথমজীবনে নাচগানের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, এখন বড়ো হোটেলের মালিক। এখানকার সকলেই তাকে কমবেশি শ্রদ্ধা করে। মাস ছয়েক আগে সে অপারেশেনের মাধ্যমে লিঙ্গের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, এখন স্বাভাবিক এক পুরুষের মতো জীবনধারণের সুযোগ পেলেও মহল্লা ছাড়েনি, হাজার হোক এই মানুষগুলোকে সে তার ভালোমন্দতে পেয়েছে।
তাহিদ, একজনকে রেখে দেয় তার দেখাশুনার কাজে। মেয়েটির নাম পদ্মা, সে পাশের পাড়াতে থাকে,বাবা নেই, মা বড়ো মিঞা অর্থাৎ মহল্লার সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ হিজরার বাড়িতে রান্নার কাজ করে ।

চা♦র

শহুরে বৃষ্টি দেখার সুযোগ আগে কোনদিন তার হয়নি, সোনাঝুরি একটু ঘাবড়ে যায়, এখনও রাস্তা চেনা হয়ে ওঠেনি। পদ্মা অবশ্য সব চেনা, সেই সাহস দিয়ে নিয়ে আসে শাড়ি মার্কেটে। পছন্দ মতো দুটো তাঁত বেনারসী কেনার পর ইচ্ছে ছিল রেস্তোঁরায় বসে মোমো খাবে, কিন্তু মার্কেট থেকে বার হওয়ার আগেই বৃষ্টি নাম , সঙ্গে ঝোড়ো হওয়া । পদ্মা শশব্যস্ত হয়ে বলে”দিদি দাঁড়িয়ে যাও ,নাহলে পুরো ভিজে যাবে” ।
সোনাঝুরি ব্যাগপত্র সামলে দাঁড়ানোর জন্য এক সাইড বেছে নেয়, প্রায় মিনিট পনেরো পর পদ্মা বলে দিদি ফোনটা দাও তো, মাকে একটা কল করে  জানিয়ে দিই আমাদের দেরী হবে! সোনাঝুরি হাতটা ব্যাগের মধ্যে ডোকায়, কিন্তু ফোন যে জায়গায় নেই, নিশ্চয় টাকা বার করার সময়  দোকানে পড়েছে ,পদ্মা  তার কথা শুনে  দৌড় লাগায়।

সোনাঝুরি অপেক্ষায়, হঠাৎ তার চোখ আটকায় দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির চেহারায় । একি এটা কি সম্ভব ,হুবহু একই চেহারা, সোনা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়, ভদ্রলোক তাকে দেখে প্রথমে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও, সোনাঝুরির গলার শব্দশুনে কয়েকধাপ পিছিয়ে যায়।
সোনাঝুরি চেহারার মার্ধুর্য দেখে চট করে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু ভারী গলার শব্দ শুনে বোঝা যায় সে তৃতীয় লিঙ্গ ভুক্ত। সোনা আরও দুপা এগিয়ে বলে,”বাবু ,আমার বিশ্বাস ছিল তুমি আসবে ,বাবু”!
“কে আপনি, “ভদ্রলোক সোনাঝুরিকে এড়িয়ে সামান্য  সরে দাঁড়ায়।  সোনাঝুরি লোকটির কাছে কাকুতিমিনতি শুরু করে, পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণে বাইরে পদ্মা তাহিদকে কল করে, সে কাছাকাছি ছিল ।
সোনাঝুরি প্রস্তুত নয়, তাহিদ বহুবার বলে,”সোনা ,প্লিজ থামো , সবাই দেখছে ,সোনা…সোনা এটা কি করছো “!
সোনাঝুরি অবিচল, বাধ্য হয়ে তাহিদ তার ডানগালে এক থাপ্পর কষায়। অঝোরে কাঁন্নায় সে ভেঙে পড়ে ।
ওদিকে, ভদ্রলোক ভীষণ বিরক্ত। তাহিদা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যদিও বলে,”সরি দাদা ,আসলে ওর মানসিক অবস্থা ভালো না,ক্ষমা করবেন “।
“আরে ভাই, এদেরকে নিয়ে বাইরে বার হয়েছেন কেন “? তাহিদ হাতজোড় করে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এলেও সোনাঝুরি  লজ্জায় পড়ে যায়, বাড়ি ফিরে সে তাহিদকে বলে,” কেন জানিনে এগুলো থেকে আমি বেরগে যেতে পারছিনে, ক্ষমা করে দিও আমার জন্যি তোমার হাতজোড় হয়েছে “!
“আমি জানি তুমি চেষ্টা করছো, সঙ্গে এটাও বুঝি মন থেকে ভালোবাসার মানুষকে মুছে ফেলা সহজ নয় “।
সোনাঝুরির স্বত্বির নিশ্বাস নেয়, আজ নিছক কল্পনা নয় বাস্তব তার সংস্পর্শে, যাকে ছোঁয়া যায় ,অনুভবও করা যায়। সে তাহিদের দিকে মিষ্ঠি হাসি উপহার দেয়।
পদ্মা আজ রাতে আর থাকতে চাইলো না, গ্রাম থেকে ওর কাকা-জ্যেঠুরা এসেছে ,যাওয়া আগে সোনাঝুরি কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলে,”কাল কিন্তু আসতে দেরী হবে “।
“ঠিক আছে ,তবে তুই আসিস কিন্তু “।
ভোরের আলো অনেক আগেই ফুটেছে, তবে সোনাঝুরি বিছানায়, পদ্মার আসতে এখনও ঢের দেরী, মিনিট কুড়ি পরে উঠবো ,সে এ কথা ভেবে পাশ ফেরে । হঠাৎ দরজায় ধাক্কা ,”ও দিদি ,দিদি ওঠো ,দরজা খলো “!

সোনাঝুরি তড়িঘড়ি নীচে নেমে তালা খোলে, পদ্মা হাপাতে হাপাতে এক পেপারে টুকরো তার হাতে দেয়।
সোনাঝুরি হতবম্ভ, শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মানুষের কতো রূপ, আজ থেকে সোনাঝুরিও সাক্ষী হল এমন এক রূপের। চোখের জল সে আটকে রাখতে পারল না । তাহিদ কৌতূহল বশত টুকরোটা হাতে নেয়, তারপর পড়া শুরু করে,” প্রযোজক আবির ভট্টাচার্য নিজের ব্যক্তিগত উপলদ্ধিকে এই সিনেমায় তুলে ধরেছেন, শুধু পুরস্কার নয়, এই মানসিকতার জন্য তাকে কুর্নিশ জানাই “।

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦


  • Tags:
❤ Support Us
Advertisement
2024 Lakshman Seth
Advertisement
2024 Lakshman Seth
Advertisement
error: Content is protected !!