Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • জুন ৪, ২০২৩

স্পর্শ

ঋভু চট্টোপাধ্যায়
স্পর্শ

অলঙ্করন: দেব সরকার

—কী করছ ?
— সকালের পুজোর ব্যবস্থা করছি। তোমার কী অবস্থা ?
— আমি টিফিন করে সবাইকে দেব, তারপর রান্না চাপাব। যে জন্যে ফোন করলাম, গতকালও বেরিয়েছিল।
— তাই !
— হ্যাঁ, ওই পাঁচটা নাগাদ বেরোল, আর সাতটা পনেরো কি কুড়িতে বাড়ি ফিরল।
—  এখন অনেক বেশি সময় থাকছে। দাদাকে বলেছ ?
— আর তোমার দাদা, কিছু বললেই আমার ওপর এখনি ক্ষেপে বোম হয়ে যাবে।
— ঠিক আছে, আমি বলব।
— নানা, কিছু বলবার দরকার নেই, এক্ষুনি আমাকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি এত সব জানলে  কি করে ?
— বৌদি, বলছি মায়ের আবার প্রেমটেম হল না তো?
কী করে বলব, বল ?
— ঠিক আছে আমি তো পরের মাসে একবার যাব, তখন না হয় ব্যাপারটা খোলসা করা যাবে। প্রয়োজনে আমরা মায়ের পিছন পিছন গিয়ে দেখব, ফলো করব।

–২–

ব্যালকোনিতে দাঁড়ালেই নিজেকে আরো বেশি একা মনে হয়। আশেপাশে আকাশ ফুটো করে গম্বুজের মত ফ্ল্যাট উঠেছে। যত বড়ো ফ্ল্যাট ততবেশি একা। মাঝে মাঝে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ছেলে বিম্বিসারের বিয়ে হয়ে ঘরে বৌমা শ্রুতি এসেছে। তাও কেমন একা একা। বিম্বি যেদিন শ্রুতির কথা বলল, গোলাপ একবারের জন্যেও অমত করেনি।শ্রুতিরা অব্রাহ্মণ। আসলে বাসব মারা যাওয়ার পর দুবছর এতবড় চারকামরার ফ্ল্যাটে দুজন বাঁচবার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। মেয়ে বিদীপ্তা বছরে একবার আসত সেটা বাসবের জীবদ্দশায়। একবছর মাত্র দুবার এসেছিল। বাসব কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে,‘বাবা, আসতে তো ইচ্ছে করে, নিজের কম্পানিতে কাকে সব ভার দিয়ে আসব বল? তাছাড়া বাবা, খুব কম্পিটিসন। একটু এদিক ওদিক হলেই অন্য কম্পানি গেম খেলে নেবে। বাসব সব বুঝত, অথবা বোঝার ভান করে ঘাড় নাড়ত, আর নীরবে মানুষের থেকে মানুষের সরে যাওয়ার রাস্তা দেখত। বাসব মারা যাওয়ার পর বিদীপ্তা এলেও জামাই প্রণয় আসেনি। বিদীপ্তা গোলাপের কাছে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,‘তোমার জামাইয়ের আসার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু উপায় নেই। একটা টাস্ক এসে পড়ল।’ সে সময় কয়েকটা দিন লোকজন ছিল। তারপর আস্তে আস্তে সব কেমন চলে গেল। ফ্ল্যাটের মধ্যে পড়ে রইল ছেলে বিম্বি আর গোলাপ। বিম্বি অফিস বেরিয়ে যায় সেই সকালে, ফেরে রাতে। এতো বড় ফ্ল্যাটের শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরে থাকে একা গোলাপ। মাঝে মাঝে বই পড়ে, পুরোনো ছবি দেখে। সেই ছবি দেখতে দেখতেই শহর থেকে একটু দূর দিয়ে বয়ে চলা ছোট নদীর তীরে বসে বাসবের বলা কথাগুলো মনে পড়ে। ‘যত দিন নদীটা থাকবে, জানবে ততদিন আমিও আছি, হয়ত শারীরিক নয়, কিন্তু নদীকে স্পর্শ করলেই তুমি আমাকে স্পর্শ করতে পারবে।’ সেদিন বাসবের জন্মদিন ছিল, জন্মবারও, শনিবার। তারপর থেকে প্রতিমাসের শেষ শনিবার বিকাল চারটে সাড়ে চারটের সময় সেজেগুজে নদীর পাড়ে গিয়ে গোলাপ বসে থাকে। জলে পা ডোবালেই শরীরে যৌবন নেমে আসে। চোখ বন্ধ করে বসে থাকবার সময় ঘাড়ের কাছে বাসবের নিঃশ্বাসের স্পর্শ পায়, চুলে বিলিকাটা অনুভব করে। বিম্বিসারের বিয়ের আগে পর্যন্ত গোলপ বিম্বির বাড়ি ফেরবার অনেক আগেই নিজে বাড়ি পৌঁছে যেত। কোনদিন কোনো কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন না পড়লেও ওই একটি দিনেই নদীর সাথে সঙ্গম, মাসের বাকি দিনগুলোর একাকিত্বের সব জ্বালা জুড়িয়ে দিত। প্রথম দু’মাস একদিন করে গেলেও তারপর পনেরোদিন অন্তর নদীর কাছে যেতে আরম্ভ করল। বাকি চোদ্দটা দিন পনেরোতম দিনটাতে যাওয়ার প্রস্তুতি। মাস ছয় পরে এক রবিবার দুপুরে খেতে বসে বিম্বিসার গোলাপকে দেখে বলে,‘বাবা চলে যাওয়ার পর তোমাকে দেখে আমার খুব ভয় করছিল। কেমন যেন মুষড়ে পড়েছিলে। এখন দেখে একটু ভালো লাগছে।’

গোলাপ মুচকি হেসে উত্তর দেয়,‘প্রথম কয়েকটা দিন কী রকম সব গোলমাল হয়ে গেছিল। এখন সব ঠিক আছে বলব না, তবে মনে হয় যেন তোর বাবা আমার সঙ্গেই রয়েছে, আমার সাথে আমার পাশে।’

—৩—

— শুনছ, একটা কথা অনেকদিন ধরেই তোমাকে বলবার জন্যে ভাবছি, কিন্তু যদি রেগে যাও তাই বলতে…
— বল বল অতো ন্যাকামি করতে হবে না।
— মা প্রতিমাসের দুটো শনিবার বিকেলের দিকে কোথাও বেরিয়ে যান, ফেরেন সন্ধেবেলা।
— তো ?
— মানে আমি জিজ্ঞেস করেছি, উত্তর পাইনি। মা এড়িয়ে গেছেন।
— তোমার জিজ্ঞেস করবার দরকারটাই বা কী ? তুমি যে হুটহাট সেজেগুজে এখানে ওখানে বেরিয়ে যাও মা কি তোমাকে কোনদিন কিছু জিজ্ঞেস করে?
শ্রুতি একটু আমতা আমতা করে উত্তর দেয়,‘তা করেনি, তবে আমি অন্য কথা ভাবছিলাম।’
— তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না। শ্রুতি ঘাড় ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলে উঠল,‘পাশের স্ট্রিটে কনকের মায়ের কেশটা জানো? পাড়াতে এক্কেবারে ঢিঢি পড়ে গেছে।
— শ্রুতি ! নিজের লিমিট ছাড়াবে না। রেগে উঠল বিম্বিসার।
একটু পরেই নিজেকে সামাল দিয়ে শ্রুতির মুখের দিকে তাকিযে বলল,‘কী বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো। ওই রকম অর্ধেকটা বোলো না।’
— আমার অর্ধেক বা পুরো, তুমি কি কখনও শুনেছ ? তোমার কাছে মা মানে তো…
— কী বলতে চাও বলো।
— আমি আবার কী বলব, কয়েকদিন আগেই তোমার বোনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল…
— ও, তুমি একা নও, মন্থরাও রয়েছে।
— সে তুমি যাই বল, তোমার বোন কিন্তু তোমার থেকে অনেক বেশি প্র্যাকটিক্যাল, সত্য মিথ্যার একটা বোধ রয়েছে।
— কি কথাবার্তা হল ?
— নিন্দে মন্দ করিনি, ভালো কথায় বলছিলাম যে, তোমার মা হুটহাট করে বেরিয়ে যাচ্ছে বদনাম রটতে তো দেরি লাগে না। তোমার মা এখনও বেশ সুন্দরী, এখনও সাইকেল রানিং…
— তোমরা খুব নোংরা, এটাই মনে হয় তোমাদের শিক্ষা, আমি তোমার মায়ের ব্যাপারে কিছু ভাবিনা, অথচ তুমি! ভাবেতে ঘেন্না লাগছে।
— দুটো স্ট্রিট পরেই পঞ্চান্ন বছরের একটা বুড়ি পাশের বাড়ির একটা ছেলের সাথে পালিয়েছে, শুনেছ ? তাঁরও ছেলে ছেলের বৌ, নাতি নাতনি সব আছে।
বিম্বিসার উত্তর না দিয়ে মুখ দিয়ে বিরক্তির স্বর প্রকাশ করে বলে উঠল,‘তুমি একটা কাজের ব্যবস্থা কর, আর তোমার ননদটিকেও একটা ব্যবস্থা করতে বলো।’

—৪—

সব কিছু কেমন যেন রহস্যময় লাগছে। বিম্বি কোনো প্রশ্ন করে না, আগেও করেনি, আগে বহুবার বিম্বি ঘরে থাকা অবস্থাতে বাইরে বেরিয়েছে ওই যেমন বলতে হয়,‘আমি একটু আসছি।’ সেদিন করল। গোলাপ শাড়ি পরে বের হবে ঠিক সেসময় জিজ্ঞেস করে বসল, ‘মা কি কোথাও বেরুচ্ছ?’
গোলাপ প্রথমে একটু থতমত করে উত্তর দিল,‘হ্যাঁ। মানে ওই একটু দরকার আছে।’
— বাসে যাবে নাকি ?
— হ্যাঁ, ঐ বাস অটো মিলে। তা কেন, আমি গাড়ি বের করছি।
— না না ঠিক আছে। তুই বিশ্রাম কর এই ফিরলি।
গোলাপ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেও খটকা লেগে রইল। ‘বিম্বি কখনো এরকম কোনো প্রশ্ন করেনি। তাহলে কি সন্দেহ করছে? সন্দেহ করলে কি করবে, মায়ের কোনো সম্পর্ক? এবার হাসি পাচ্ছে, সত্যি যেদিন ওরা জানবে, অবাক হয়ে যাবে। কিন্তু ওদের কি জানানো উচিত? জেনে যাওযার পরে তো হো হো করে হেসে উঠবে, পাগল ভাববে।

—৫—

কিছু বোঝা যাচ্ছে না। দীপা যেভাবে বলছে, তাতে তো সব হিসাব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। মা যেন কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে। বাবা বেঁচে থাকবার সময় মায়ের মধ্যে কোনো রকম আপত্তিকর কিছু দেখা যায়নি। বাবা মায়ের সঙ্গে সে রকম ঝগড়া করবার ঘটনাও মনে পড়ে না। মা তো চিরকাল এই সংসারটাকে নিজের আঁচলের ছায়ায় পাহারা দিয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পরেও স্বাভাবিক শোক কাটিয়ে উঠে বেশ শক্ত ভাবেই দাঁড়িয়ে বিম্বির বিয়ে দিয়েছে। কোনো অযাচিত কাকু, বা মামার উপদ্রব নজেরে পড়েনি। তাহলে মা কি কোথাও পার্ট টাইম চাকরি করছে ? শুধু মাসে দুটো শনিবার কেন ? কিছু কি শিখছে, গান,আবৃত্তি, কম্পিউটার ! রঘু কম্পিউটার সেন্টারে অনেক বুড়ো বুড়ি কম্পিটার শেখেন, বিম্বি নিজে বহুবার দেখেছে। তাহলে কি মা এখন কম্পিউটার শিখছে? উফঃ পাগল পাগল লাগছে। কয়েকদিনের মধ্যে বোন আসবে, ওর সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হবে।

—৬—

বুড়ো বয়সে মাঝে মাঝে মানুষের মতিভ্রম হয়। কোথাও কিছু নেই কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে যাচ্ছে, অঘটন ঘটলে প্রণয়ের কাছে মুখ দেখাতে পারা যাবে না। একেই শ্বশুরবাড়ি আসাটাকে এক্কেবারেই পছন্দ করে না। মেয়েদুটোও বড়ো হচ্ছে। আচমকা কিছু হলে তো এক্কেবারে সবার ক্ষতি। বৌদির সাথে তো কথা হচ্ছে। কিন্তু দাদা কতটা শুনবে, সন্দেহ আছে। দেখি কয়েকদিনের জন্য ঘুরে আসা যাক। মেয়েদুটোর হস্টেলের ছুটির কোন চান্স নেই, মাকে নিয়ে দাদা বৌদির মধ্যে  না অশান্তি আরম্ভ হয়ে যায়। যাক যাওয়া তো হচ্ছে, দেখা যাক কত দূর কী করতে পারি। মায়ের সঙ্গেও খোলাখুলি কথা বলা দরকার।

—৭—

তোমাদের সব আলোচনা শুনলাম, একটা ব্যাপার তো মানবে যা বলছ, ভাবছ সবটাই অনুমান। কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। আমার অন্তত তাই মনে হচ্ছে। মাকে সোজাসুজি প্রশ্নও করা যায় না, তাহলে কী করা যাবে ?

— সেটা তুই ভাব, আমি আর বৌদি, তোকে ব্যাপারটা জানালাম, এখন কিছু একটা সমস্যা হলে আমাদেরকেই তো সামলাতে হবে। তার থেকে…

— কিন্তু কি করা যেতে পারে, বল, মার বয়স বাড়ছে। হঠাৎ উত্তেজনাতে শরীর খারাপ হয়ে গেলে কী হবে, বল তো ?

— না না তুমি ওরকম ভাবে বলবে কেন, দীপু যা বলছে শোন। মা প্রতিমাসের প্রথম আর তৃতীয় শনিবার বেরিয়ে যান। ঠিক চারটে থেকে চারটে পনেরোর মধ্যে বেরোন আর ফেরেন সাতটা থেকে সাতটা পনেরো বা সাড়ে সাতটায়। আমরা যদি পিছু নি, ধর আগে থেকেই তিনজনে বেরিয়ে গেলাম, মা আরেকটা চাবি নিয়ে যাবে, এবার মাকে একটু ফলো করব।

— মা কিসে করে যায় ?

— অটো বা টোটোতে।

— তুমি কিভাবে জানলে ?

— পাশের বাড়ির বৌদি একদিন বলেছিল। কোথা থেকে ফিরছেন জিজ্ঞেসও করেছিল। মা নাকি জবাব দেয়নি, হেসে এড়িয়ে গেছে।

 

—৮—

-মা, তুমি সন্ধেবেলা একা একা এই ফাঁকা জায়গায় বসে কী করছ ?

গোলাপ বিম্বিসারের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বসে রইল। বিম্বির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দীপু জিজ্ঞেস করল,‘মা কী হল, কিছু বল……’

একটা লম্বা শ্বাস ফেলল গোলাপ। ‘আমাদের বিয়ের এক বাস পরেই এক বিকালে এখানে ঘুরতে এনে তোর বাবা বলেছিল, যতদিন নদীটা থাকবে ততদিন জানবি আমিও আছি। আমি তাই চলে আসি। আমি জলে পা ছোঁয়লেই মনে হয় তোদের বাবা আমাকে ছুঁয়ে আছে। নদীটা রোগা হয়ে গেছে, আগে এক্কেবারে অন্যরকমের ছিল। বাঁধানো ঘাট ছিল। আমরা প্রায়ই বিকালের দিকে এখানে এসে বসতাম। ও যতদিন ছিল ততদিন অত কিছু ভাবিনি। কিন্তু মারা যাওয়ার পর নিয়ম করে আসতে আরম্ভ করলাম। এর জন্য তোরা হয়ত অনেক কিছু ভাবতে আরম্ভ করেছিস। কিন্তু ওর মৃত্যুশোক ভুলতে পারিনা, এখানে এলেই মনে হয়, সে আমার কাছে আছে, ওঁর স্পর্শ, ঘ্রাণ, নিঃশ্বাস আমাকে ছুঁয়ে থাকে, একটু শান্তি পাই, সম্ভবত একধরণের আনন্দ টের পাই, ওকে তখন আর খুঁজতে হয় না, নিজে এসেই ধরা দেয়।

বিকালের ঘাড়ে সন্ধে নিঃশ্বাস ফেলতে আরম্ভ করল। সামনে ক্ষীণকায় বয়ে চলা একটা নদীর তীরে একজন, আরো বাকি তিনজনের কেউই কোনো কথা বলছে না। অন্ধকার বুঝতে দেয় না, কারোর চোখ থেকে নোনতা জল ঝরে পড়ছে ?

 

♦♣—♦♣—♦♣—♦♣


  • Tags:
❤ Support Us
Advertisement
2024 Lakshman Seth
Advertisement
2024 Debasish
Advertisement
error: Content is protected !!