Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • এপ্রিল ২৮, ২০২৪

কাঁটাতারের জীবন

আবু নোমান
কাঁটাতারের জীবন

অলঙ্করণ: দেব সরকার

 
বিকেলের মিঠে রোদ ফুরিয়ে এলে জবেদ আলি ঘর্মাক্ত শরীরে সাইকেল থামাল। একটু সামনে গেলেই বিশাল বট গাছটার আশ্রয়ে যেতে পারত। কিন্তু মাঠ পেরলেই পুলিশ কিংবা বিজিবির চোখে পড়ার ভয়। দু পায়ে কাদার উপরের অংশ কিছুটা শুকিয়ে এসেছে। গত চারদিনে গোসল করা হয়ে ওঠেনি।  বৃষ্টি আর ঘামে ভিজে শরীরে এক ধরনের বিশ্রি দুর্গন্ধ, লুঙ্গি স্যাতসেতে ময়লা, এখানে ওখানে সাইকেলের চেনের কালির দাগ স্পষ্ট। পায়ের নখগুলোয় চিটচিটে ময়লা জমেছে। কিছুটা বড়ো হয়েছে, কাটা হয়নি বেশ কয়েক সপ্তাহ। ব্যস্ততার শেষ নেই। নুর পশ্চিমের বাবলা গাছের দিকে ইশারা করে কী যেন দেখাতে চাইল। জবেদ আলি সেদিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ, সূর্যে লালের আভা। বাতাসের একচেটিয়া আধিপত্যে সাদা বালির উপর দিয়ে একধরনের কারুকাজ তৈরি হয়েছে। দুজনের সাইকেলের চেনের উপরের অংশে প্যাডেলের উপর আর হ্যান্ডেলে ব্যাগের ভেতর যা রয়েছে তা নিয়ে যদি শেষপর্যন্ত পৌঁছানো যায়, তবেই কেল্লাফতে। গন্তব্য আপাতত উজিরপুর জলবাজার। জমিনপুর হয়ে উজিরপুর পথটুকু খুব খারাপ নয়, কিন্তু বালির উপর দিয়ে অপ্রচলিত রাস্তায় সাইকেল ঠেলে নিয়ে যাওয়া সহজ নয়।
 
বাবা যখন বেঁচে ছিল, জবেদ আলির এমন সমস্যায় পড়েনি কখনো। তখন সকালে নাস্তার পর স্কুলে অথবা পাড়ার মিন্টু মিয়ার দোকানের পাশে আড্ডায় দুপুর পর্যন্ত চলে যেত। দুপুরে এসে খেয়ে দেয়ে নদীর ধারে জমিতে পটল আর ঝিঞের চাষবাস ঘুরে দেখা, বাবার বকুনির ভয়ে এটুকুই করত সে তখন। ব্যস! অফুরন্ত সময় পার হত কীভাবে, এখন খুব একটা মনে পড়ে না । স্কুলে না যাওয়ার জন্য বাবা কখনো সামান্য বকুনি কিংবা লাঠির ভয় দেখালে মায়ের আশ্রয়ে লুকিয়ে পড়তে দেরি হত না। ছোট বোন ময়নার সাথে খুনসুটি আর ঝগড়া আগের মত এখনো আছে, তবে ধরন পাল্টেছে। ছোট বোন এখন তাকে শাসনও করে। বাবা যখন মারা গেলেন, ময়না তখন পাঁচ বছরের। বাবার মৃত্যুর পর তাদের জীবন যাপন পাল্টে গেল একেবারেই। বন্ধ উপার্জনের পথ। দু-ভাই-বোন অযত্নে অবহেলায় আগাছার মতো বড় হয়। ময়না দিনদিন শুকনো কাঠের মত হয়ে গেল। অসুখ বিসুখে সুন্দর টলটলে মেয়েটির সৌন্দর্যও কমেছে। ইদানিং মাঝে মাঝেই জ্বর হয়। কখনো পেট ব্যথার যন্ত্রণায় শুয়ে থাকে আর কোঁকায়।
 
যে অফিসে বাবা চাকুরি করত, সেখানে জবেদ আলিকে চিনতো সবাই। সরকারি অফিস হলেও তার বাবার চাকুরি ঠিক সরকারি ছিল না। নির্ধারিত কোনো পদও ছিলো না। যে কারোর কোনো প্রয়োজন হলে সে সাহায্য করত। মাস শেষে একটা পরিমান টাকা দেয়া হতো। এতে অভাব থাকতো না কিন্তু বাড়তি কোনো খরচ করার সুযোগ ছিলো না নাবিদ আলির। কোনো খারাপ অভ্যাস, নেশাদ্রব্য ব্যবহারের কখনো অভ্যাস ছিলো না তার। অবশ্য যে টাকা আয় করত তাতে এত বিলাসিতা করারই বা সুযোগ কোথায় ? টাকা-পয়সা কম থাকলেও অফিসের লোকগুলো নাবিদ আলিকে বিশেষ সমীহ করত। এর কারণ নাবিদ আলির সকল বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান আর একই অফিসে দীর্ঘদিন চাকুরির অভিজ্ঞতা। আর যেটি ছিল-সততা। নাবিদ আলি যেদিন মারা গেল, অফিস থেকে দশ হাজার টাকা পেয়েছিল পরিবার। দাফন-কাফনে কিছুটা খরচ হল। কয়েকদিন চলার পর মায়ের দুশ্চিন্তা আর হতাশার ভাষা বুঝতে জবেদ আলির খুব একটা অসুবিধা হয়নি। অফিস থেকে বলেছিলো, আর কিছুদিন পর আর কিছু টাকা পয়সা দেয়া হবে। কিন্তু সেই টাকার জন্য ঘোরাঘুরি করে করে অবশেষে জবেদ আলির মায়ের মনে হল, ঘোরাঘুরি সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। গাঁয়ের শরিফ মুন্সি মিনমিন শব্দে বলল, নাবিদ আলির টাকা ওরা দেবে না ঠিক আছে, সে অফিসে একটা চাকুরি তো দিতেই পারে। জবেদের মা, এবার গিয়ে না হয় জবেদের জন্য একটা চাকুরির বায়না করে এসো।
 
জবেদের মায়ের চেহারায় সূর্যের আলোর ঝলকানি বেড়ে আবার নিভে গেল। চাওয়া হয়ত যায়, সামান্য টাকাই দিচ্ছে না, ওরা দেবে চাকরি !
 
আরে চেয়েই দেখো না ! আর এভাবে ধার দেনা করে কতদিন চলবে ? আমার কাছে থেকে তো হাজার ত্রিশেক টাকা ধার করেছই, আবার আর কারো কাছে করেছ ? এগুলো কেমন করে শোধ দেবে ভেবেছ কখনো?
 
শরিফ মুন্সির কণ্ঠের অসহিষ্ণুতা জবেদ আলির মায়ের চেহারায় কালি লেপ্টে দিল। জবেদ দেখল, মায়ের ওমন সুন্দর গাল, নাকের ডগা আর কপালের পাশ কেমন লাল হয়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা। মুখে কেমন এক অস্বাভাবিক দৃঢ়তা আর হাতের মুষ্টি শক্তবদ্ধ। জবেদের ডান হাত ধরে শরিফ মুন্সির দিকে তাকিয়ে বলল,  আপনি আমার বড়ভাই। আগে ভাবীই বলতেন সবসময়। অভাবের সময় আপনারা সাহায্য করেছেন এখনো করছেন, ভালো কথা। তাই বলে এভাবে বলবেন না মুন্সি ভাই। জবেদের বাবাকে আপনি বড়ভাই ডেকেছেন, আমার কত রান্নাবান্না খেয়ে কত কি ভালো ভালো কথা বলেছেন, সে কথাগুলো এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন?
 
পরদিনই কয়েকটা বাড়িতে গিয়ে জবেদের মা থালাবাসন মাজা আর কাপড় চোপড় ধোওয়ার কাজ নিল। জবেদের সে সময় কত যে খারাপ লেগেছিল সে কথা সে নিজেও বলতে পারবে না। কিন্তু বাঁচতে হয় সকলকেই। বাঁচার জন্য যে এত কষ্ট করা লাগে এত অপমান সহ্য করতে হয় সে কথা আগে কখনো ভাবেনি জবেদ। টাকা কীভাবে পাওয়া যায়, সে কথা জবেদও ভাবতে পারে, ব্যস এ পর্যন্ত। মায়ের থালা বাসন ধোয়া-মাজা কিংবা কাপড়-চোপড় ধোওয়ায় যে আয় হয় তাতে খেয়ে না খেয়ে হয়তো দিন চলে যাবে, ধার শোধ হবে না ?
 

নুরু নেতাদের মত হাত উঁচিয়ে বক্তব্য রাখার মত করে বলেছিল, তুই জানিস এই এলাকায় কোনো কাঁটাতারের বেড়া পাবি না। এটাই সুযোগ রে বোকা। আর কোথায় এমন সুযোগ নেই। তুই সোনা মসজিদের দিকে যা, ওখানে বেড়া, শিয়ালমারা দিকে যা, ওখানে বেড়া। আর দেশের যেখানেই যাবি বেশির ভাগ জায়গাতেই বেড়া। ওদেশের সরকার আমাদের এ সুযোগটা দিয়েছে, একটু সুযোগ নিবি না তুই

 
পিপাসা আর ক্ষুধায় ক্লান্ত নুরু সাইকেল শুইয়ে রেখে জবেদকে বলল, তোর কাঁধের ব্যাগ থেকে পাউরুটি আর পানির বোতলটা বের কর। জবেদ আশ্চর্য হয়ে নুরুর দিকে তাকিয়ে থাকল। পাউরুটি তো সে দুপুরেই শেষ হয়েছে। সামনে কোনো দোকানপাট পায়নি যে কিছু খাবার কেনাকাটা করে নেবে। কই বের কর। নুরুর আবার তাগিদ দেয়। জবেদ আশপাশ লক্ষ্য করে বলেই ফেলল, দুপুরেই তো শেষ রে, সবটাই তো খেয়ে ফেললি। নুরু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জবেদের মুখের দিকে। তাইলে দে পানি আছে তো? পানিটাই দে। যে সামান্য পানি ছিলো, জবেদ সেটি নুরুর দিকে এগিয়ে দিল। নুরু জবেদের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল নে আগে তুই খেয়ে নে পরে আমাকে দে।লে লে! আর মায়া দেখাতে হবে না। তুইই সবটুকু খেয়ে নে। জবেদের যে পিপাসা লাগেনি, তা নয়, কিন্তু নুরুর চোখ আর মুখের দিকে তাকিয়ে জবেদ এই কষ্টটুকু সহ্য করতে পারে।
 
এই নুরুই প্রথম বুদ্ধি দিয়েছিল জবেদকে কী করে উপার্জন করতে হয়। হাসানপুর, নারায়ণপুর, বাগডাঙ্গা, জোহরপুর, ঠুঠাপাড়া, সাহাপাড়া, খাকচাপাড়া, বিশরশিয়া, মনোহরপুরের অনেক মানুষ কত ধরনের কাজ-কাম করে জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। কেউ কেউ ফকির থেকে রাজা হয়ে যাচ্ছে। জবেদ চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিলো নুরুর দিকে। নুরু নেতাদের মত হাত উঁচিয়ে বক্তব্য রাখার মত করে বলেছিল, তুই জানিস এই এলাকায় ইন্ডিয়ার কোনো কাঁটাতারের বেড়া পাবি না। এটাই সুযোগ রে বোকা। আর কোথায় এমন সুযোগ নেই। তুই সোনা মসজিদের দিকে যা, ওখানে বেড়া, শিয়ালমারা দিকে যা, ওখানে বেড়া। আর দেশের যেখানেই যাবি বেশির ভাগ জায়গাতেই বেড়া। ইন্ডিয়ার সরকার আমাদের এ সুযোগটা দিয়েছে, একটু সুযোগ নিবি না তুই? এই ধর ইন্ডিয়ার হাসানপুর, মহালদারপাড়া, চাঁদনিচক, দেওয়ানপুর, শোভাপুর থেকে যদি এই মাল নিয়ে এসে উজিরপুর জলবাজারে ছেড়ে দি, তাইলেই ধর বড়লোক হয়ে গেলি। ঢাকা থেকে, সিলেট থেকে যশোর থেকে বড়লোকরা এসে সব কিনে নিয়ে যাবে। তোর মায়ের আর কারো বাড়িতে কাজ করা লাগবে না। ধর তোর বোন ময়নার ভালো চিকিৎসা করাতে পারলি। আর ভালোভাবে বাঁচতে পারলি। আর তোর তো বয়স কম হল নারে বিয়ে সাদি তো করা লাগবে নাকি? আরে গরিবকে কে ভালোবাসে রে, বিয়ে করবে কে ? মেয়ে আর মেয়ের বাপ-মা তো খালি বড়লোকের পিছেপিছেই ঘোরে। তুই গরিব হয়ে থাকলে তো কোনো কাজ হবে না। বড়লোক হবি বুঝলি বড়লোক !
 
জবেদ হাসে আর বলে, এগুলো আমি পারব নারে।
 
আরে আমাদের গতরে তো শক্তি আছে রে। নুরু ঠাট্টা ফুর্তির খেলা থামিয়ে একদিন বলল, কী করবি বল? জাল টাকার ব্যবসা করবি ? ওপার থেকে মদ, গাঁজা, হিরোইন-ইয়াবা, ফেনসিডিল আনবি ? ওপারের গ্রামে পার করবি? না মোবাইল আনবি? আরো বুদ্ধি আছে যেমন ধর অস্ত্র মানে পিস্তল, চাকু। এতে খুব রিস্ক আছে। এটা এখন বাদই দে। আর তুই চাইলে সেটাও করা যাবে।
 
জবেদ ভাবে, পড়াশোনায় তার ইচ্ছেটা একটু কম ছিল ঠিকই, কিন্তু একটু যদি পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারত, তবে হয়তো বাবার অফিসে তার চাকুরিটা কোনোমতে হয়েই যেত। চাকুরিটা যদি তার হত, তবে সবার আগে মায়ের অন্যের বাড়ির ধোয়ামোছার কাজটি ছাড়িয়ে দিত। বোনের চিকিৎসা দুই নম্বরে। আর তার পরেই শরিফ মুন্সির ধারটার শোধ করে একদম সাফসুতুরো হয়ে যেতে পারত। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অর্থ হলো কারো কাছে ধার না থাকা। কারো কাছে কোনো কিছু না চাওয়া। তাহলেই দেখবি বেঁচে থাকার মজাটাই আলাদা। তুই গরিব হতে পারিস, তোর মাথাটা থাকবে সবথেকে উঁচু। তুই যদি সৎ থাকিস কোনো মানুষই তোকে ছোট ভাবতে পারবে না। এমনকি তুই যতই গরিব হোস না কেন?— এগুলো তার বাবার কথা। ভীষণভাবে বাবাকে মনে পড়ে জবেদের। কোনোদিন কোনো অন্যায় কাজে জড়াবি না। এক বেলা না খেয়ে থাক, কিন্তু অন্যায়ের টাকা ঘরে তুলবি না। সেই বাবাটাই তো যখন নেই তখন কি সে কথাগুলো আর টিকে থাকবে? জবেদ একদিন গিয়ে নুরুর কথাগুলো মায়ের কাছে পাড়লো। মা দেখো, তোমার অন্যের বাড়িতে থালাবাসন-কোসন ধোওয়া চলবে না। আমার বাবা তোমাকে কখনো এ কাজ করতে দিয়েছে?
 
তো? কীভাবে সংসার চলবে? তোরা খাবি কী?
 
সে বুদ্ধি একটি পেয়েছি। নুরুর কাছে। সে নাকি আগে থেকে এ লাইনে আছে। আমি বলি কী, ওপার থেকে হেরোইন, ফেনসিডিল এনে যদি… জবেদের কথা শেষ হয় না।
 
চুপ থাক। তুই আমাকে তোর মদের ব্যবসার পচা টাকায় ভাত খাওয়াবি এই তোর বুদ্ধি? জীবনে না খেয়ে মরলেও ও কাজে যাবি না তুই। আমার কাছে থালা বাসন ধুয়ে টাকা উপার্জন অনেক সম্মানের। কারো কাছে তো চেয়ে খাচ্ছি না। আর মদের ব্যবসাও করছি না। খবরদার আর এ তাল তুলবি না।
 
জবেদ চুপসে যায়। পরদিনই মা একটি কাগজ দেয় জবেদকে। এই দেখ তোর চাকুরির কাগজ এটা। তোর বাবার অফিস তোকে একটা চাকুরি দিয়েছে। বলেছে, আপাতত কাজ করতে থাক। তোর বাবার মত করতে পারলে তখন কিছু টাকা বাড়িয়ে দেবে।
 
জবেদ ভীষণ আনন্দিত। চাকুরি হয়েছে তার। সকালে সে অফিসে যায়। সন্ধ্যায় আসে। মাস শেষে বেতন পায়। খুবই অল্প। কিন্তু তবুও অনেক খুশি জবেদ, তার মা, বোন। মায়ের একটি শাড়ি কিনতে চায়, বোনের একটি জামা কিনতে চায়। মা বলে, এখনই না। তার চেয়ে আগে যাই কিছু হোক শরিফ মুন্সির টাকাটা কিছু কিছু শোধ কর।
 
আচ্ছা। সব থেকে আগে যেটা করব, সেটা হল তোমাকে আর কারো বাড়িতে কাপড় কাঁচতে যেতে হবে না।
মা হাসে। জবেদ আলি আর ময়নাও হাসে।
 
চাকুরির কথা শুনে শরিফ মুন্সি বাসায় আসে। পান খেতে খেতে বলে, আমিই তোমাকে বুদ্ধি দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত কাজে লাগলো। তো এবার আমার টাকাটা শোধ কর দেখি।
 
আপনার এত টাকা তো একেবারে শোধ করতে পারব না। প্রতি মাসে মাসে কিছু কিছু করে শোধ করে দেব।
সে কি? এতদিন কিছু বলিনি। এখন ছেলের চাকুরি হল। আর কদ্দিন ঝুলাবা?
 
আর মাত্র কটা মাস সময় দেন মুন্সি ভাই। কিছু টাকা এগিয়ে দেয় জবেদের মা। মুন্সি গজর গজর করতে করতে চলে যায়।
 
পরের মাসে ময়না ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করে। ঘুমোতে পারে না। ডাক্তার দেখাব দেখাব করে দেখানোই হয়নি। মাস শেষ হতেও আরো কদিন দেরি। জবেদের মা ছুটে যায় শরিফ মুন্সির কাছে। টাকা চায়। শরিফ মুন্সি আশ্চর্য হয়ে তাকায়। এ তুমি কী বলছো? কেবল কিছু টাকা শোধ করলা। আবার তার চেয়ে বেশি তুমি ধার নিবা ? এ কেমন কথা ?
 
আমার মেয়ে ময়নার ভীষণ কষ্ট ভাই। একটু যদি সাহায্য না করেন, তাইলে আর কার কাছে যাব?
কেন এখন জবেদের অফিস থেকে নাও। আর তুমি তোমরা কার কাছে যাবা আমি কীভাবে বলবো বল ? এ গাঁয়ের তো আমি একাই বড় লোক না।
 
আপনাকে তো আপনার ভাই খুব বিশ্বাস করত। কত আসতেন আপনি।
 
এ কথাগুলো বলে বলে কিছু হবে না। তুমি চলে যাও জবেদের মা। কোনো কাজ হবে না।
 
জবেদের মা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসে। সাথে নিয়ে আসে কিছু অন্ধকার ।
 
জবেদ নুরুর কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে এসে ময়নার চিকিৎসা করায়। তবে টাকা নিতে যাওয়ার সময় কিছু কথাও শোনায়। কী চাকরি, শুরু করলি তুই ? সামান্য চিকিৎসা করার টাকা থাকে না। তার চেয়ে আমি যে ব্যবসার কথা বললাম, সেটাতেই তো ভালো হত। তোর মা যে এত বড় বড় কথা বলে তো কিছুই তো করতে পারে না। এত দেমাগ কীসের তোদের? তোকে তো বড়লোকই করতে চেয়েছিলাম। নাকি?
 
জবেদ উত্তর দেয় না। নুরু পকেট থেকে কয়েকটা টাকা বের করে দেয়। জবেদ সেগুলো পকেটে ঢোকায়। বোনের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার কিছু টেস্ট, কিছু ওষুধপত্র দেয়। টেস্ট করা হয় না। ওষুধ কিনে নিয়ে আসে জবেদ। খাওয়ায় ময়নাকে। ময়না অনেকটা সুস্থ বোধ করে। সকলেই খুশি । ময়না দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে যায় না। জবেদের মা বলল, জবেদ তুই অফিস যাওয়ার পথে ময়নাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাবি। অনেক দিন ধরে স্কুলে যাওয়া হয় না ওর।
 

নুরু এদিক ওদিক কয়েকবার তাকিয়ে বলে, তা কী হয়রে? এ পথে যখন একবার নেমেছিস আর কি ফিরে যাওয়া যায়? যাদের মাল গেল, তারা কি আমাদের ছেড়ে দেবে? খুঁজে খুঁজে ওরা ঠিকই আদায় করে নেবে

 
ময়নাও ভীষণ খুশি। অনেকদিন পর স্কুলে যাবে সে। সেই যে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিল। তারপরে বাবা মারা যাবার পর আর কখনো ওমুখো হয়নি। কী করে হবে ? এতসব ঝামেলার মধ্যে মায়ের অন্য বাড়িতে কাজ। ধার-বাকিতেই চলেছে সংসার। পরীক্ষাও দিতে পারেনি। এখন যে স্কুলে কোন শ্রেণিতে রাখবে সেটিও বুঝতে পারছে না। প্রায় একবছর । মার্চ মাস হলে প্রায় একবছর হবে স্কুলে যায়নি ময়না। বইও পায়নি। সে যাই হোক স্কুলে গেলেই না হয় বুঝা যাবে। জবেদ স্কুলের সামনে এসে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল, স্কুলের গেট বন্ধ হয়ে আছে। আশে পাশে কয়েকটি কুকুর আর গরু ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা লোক ঘাস কাটছে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলো জবেদ, স্কুল বন্ধ নাকি ?
 
কেন তুমি জানো না? মহামারির কারণে তো সবই বন্ধ। স্কুলও বন্ধ।
 
জবেদ মহামারির নামটি আগেও শুনেছিল, এই অসুখ হলে নাকি আশেপাশের সবারই হয়ে যাচ্ছে। তাই মাস্ক পরতে হবে। আর সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। এইটুকুই শুনেছিল। স্কুল বন্ধের খবর তো শোনেনি। সবাই তো বলছিল ওগুলো বিদেশের বড়লোকদের ব্যাপার-স্যাপার। এখন দেখছি গাঁয়ে-গঞ্জেও চলে এসেছে।
 
নুরু বলেছিল, ওগুলো কে মানেরে? রাখ তোর মহামারি। ওগুলো সব ঢাকা রাজশাহীর ব্যাপার-স্যাপার। এখানে কে ওগুলো করে?
 
অগত্যা ময়নাকে নিয়ে আবার বাড়িতে রেখে অফিসে গেলো জবেদ। অফিসে গিয়েই শুনলো খবরটি। বিশ্ব জুড়ে মহামারি দেখা দিয়েছে, অনেকের চাকুরি চলে গেছে। জবেদেরও আর প্রয়োজন নেই অফিসে। অফিসের স্যার নাকে মুখে মাস্ক লাগিয়ে তাঁর ফর্সা হাত প্লাস্টিকের কাগজে জড়িয়ে কিছু খাবার আর কিছু টাকা দিয়ে জবেদকে বললো, করোনা কদ্দিন থাকবে না থাকবে আমরা জানি না। তোমাকেও আমরা আর রাখতে পারলাম না। অফিসের নির্দেশ। এই খাবারটুকু আর এই কয়টা টাকা নিয়ে যাও। অফিস থেকে আর কত সাহায্য করা যায়?
 
অফিস থেকে বাসায় ফিরে জবেদ খাবারগুলো রাখল। মায়ের কাছে টাকাগুলো দিল। আর বলল, মা দোয়া কর। তারপর ছুটে গেল নুরুর কাছে। আমি এসেছিরে নুরু। বল তোর সাথে আমি ব্যবসা করতে চাই। যা বলবি, তারই ব্যবসা করব । তুই আমার আসল দোস্ত।
 
মা যে তাকে বাধা দেয়নি তা নয়। অভাবের তাড়না আর ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় মা তাকে কী বলবে কী বলবে না— ততক্ষণে জবেদ গলিপথ পেরিয়ে মিন্টু মিয়ার দোকান পার হয়ে গেছে। মা ভীষণ ক্লান্ত আর বুক ব্যথায় কথা বলতে পারছিলো না। ময়নাকে ডাকে। ময়নাও আবার অসুস্থ হয়েছে। কে কাকে সাহায্য করে? কিন্তু জবেদের মধ্যে কেমন একধরনের নিষ্ঠুরত একগুঁয়েমি জেদ পেয়ে বসেছিল সেদিন।
 
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কেমন একধরনের ভাবালুতা এসে গিয়েছিলো জবেদের। ধীরে ধীরে হাত পেকেছে। কিছুটা আয় ইনকামও এসেছে, এ পথে যেমন আয় আছে তেমন অনেককে দিতেও হয়। পুলিশ-বিজিবির কেউ কেউ প্রায় খবর নেয়। কেউ কেউ আবার মায়া করে। কেউ জিজ্ঞেস করে, আজ কেমন হল, দে হাজার খানেক দিয়ে যা।  আজকের মতো আর কষ্ট হয়নি কখনো। আজ বাড়ি থেকে আসার সময় মা বলে দিয়েছিলো ময়নাকে আবারো ডাক্তার দেখানো লাগবে রে। পেট ব্যথায় সারারাত ঘুমোতে পারেনি। তার মায়ের শরীরও ভালো ছিল না। আজ তার একেবারে আসতে ইচ্ছে হয়নি। আজকের কাজটা বেশ রিস্ক। নুরু খুব করে বলে দিয়েছিল, আজ সফল তো জীবন সফল। ওপার থেকে একজন দিয়ে গেছে, এখন পৌছে দিতে হবে উজিরপুর জলবাজার। সামনেই জলবাজার। এখানে আজ বিজিবিগুলো টহল বাড়িয়ে দিয়েছে।
 
এই জবেদ, এই জবেদ ওরা কারা দেখেছিস?
 
অন্ধকারে তেমন দেখা যায় না। সূর্য ডুবেছে বেশ আগে। নদীর বালিতে পা এগুনো যাচ্ছে না। দু একটা পেয়ারা, বরই কলাগাছ নজরে এসেছিল। পেয়ারাগুলোয় পলিথিন বাঁধা। যত্নে যত্নে বড় হচ্ছে এগুলো। নুরু দু-একবার বলেছে পেয়ারা দুএকটা আনলে হয় না? খিধায় তো পা চলছেনারে জবেদ। ভাই আমার, একটু সাহায্য কর। নুরু জানে জবেদকে এ লাইনে আনা গেলেও চুরি করে খাওয়ার অভ্যাস তার নেই। আর এ কারণেই নুরুরও খুব ভালো লাগে জবেদকে। আমবাগানের কাছে বেশ অন্ধকার। বালির আবছা আলোয় সাইকেল নিয়ে দুটো মানুষ যদি হাটে,  নিশ্চিত চেনা যায়।
 
নুরুর কথায় চমকে ফিরে তাকায় জবেদ। পাঁচ কি ছয়জন বিজিবির লোক দাঁড়িয়ে উজিরপুরের মোড়ের ধারে। দোকানের বিদ্যুতের আলোয় তাদের নড়াচড়া বেশ দূর থেকেও বুঝা যাচ্ছে। সেখান দিয়ে তাদের যেতে হবে জলবাজার। দোকানের পাশে বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে জবেদ আর নুরু সাইকেল দুটিকে লুকিয়ে রাখে। আর তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে। এর আগেও সে মোড়ের দোকানে কয়েকবার বিজিবিদের দেখা গিয়েছিল, কিছুক্ষণ চা টা খেয়ে তারা অন্যদিকে টহলে চলে যায়। আজ কেন যে সরছে না। কোনো নতুন খবর পেয়েছে নাকি?
 
এদিকে পেটে খিদে নিয়ে খুব বেশি অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। এ যাত্রায় সব মাল গুলো খালাস করতে পারলে বেশ কিছু টাকা পেয়ে যাবে। আর ধরা পড়লে মাল তো যাবেই, সাথে জেল জরিমানা আরো কত !
 
তুই সাইকেল দুটোকে দেখ, আমি একটু পেটে পানি দিয়ে আসি। নইলে আর কতক্ষণ যে এখানে অপেক্ষা করতে হবে জান তো চলছে না। জবেদ সায় দেয়। তাইতো। তুই যা তাহলে। নুরু যাওয়ার পর জবেদ একা একা কেমন অসহায় মনে হয় নিজেকে। এমন জীবন হবে ভেবেছিলো কখনো?
 
এই কে রে তুই এখানে অন্ধকারে চোর না ডাকাত? হঠাৎ এমন শব্দে চমকে উঠে জবেদ। এরা আবার কারা, পুলিশ বিজিবি তো নয়। জবেদ শক্ত থাকার চেষ্টা করে। আমি জবেদ। উত্তর দেয় আমি সাহাপাড়ার জবেদ। সাহাপাড়ার জবেদ টবেদ তো এখানে কী করিস তুই? মাল এনেছিস ? দেখি তোর মাল। বলেই লোকটি সাইকেলের কাছে আসে। আর মোবাইলে কাদের যেন ডাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে পাঁচছয়জন এসে সাইকেল থেকে মালগুলো নিয়ে মাথায় চড়ায়, আর বলে কী আছে বল?
 
জবেদ বলে না ভাই এগুলো অর্ডারই মাল এগুলো তো দেওয়া যাবে না।
 
দেওয়া যাবে না তো তুই সাহাপাড়ার ছোঁড়া এখানে কেন? যাহ শালা যাহ। আমরা ঠিকই জানি কার কাছে কী আছে। জবেদ নুরুকে খোঁজে এদিক ওদিক। কী করবে এখন সে ? সাইকেল থেকে মাল নামাতে বাধা দেয় জবেদ,  এতগুলোর শক্তির কাছে ক্ষুধা পেটে একার পক্ষে টাল সামলাতে পারে না। ওরা কোথায় হারিয়ে যায়। আর পড়ে থাকে জবেদ একা।
 
নুরুর ডাকে জবেদের হুস ফেরে। চোখ যায় সাইকেলের দিকে। খালি সাইকেল পড়ে আছে। নুরু বুঝতে পারে। বলে, আমি থাকলে… ইসস, কেন গেলাম রে। আর তুই আর কিছুক্ষণ ওদের ধরে রাখতে পারলি না ? জবেদ কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়।
 
নুরু বলে, এ পথটা এমনইরে। চল ফিরে যাই। জান তো বেঁচেছে। জবেদ কান্নাকণ্ঠে বলে, এই পথে আর নয়।
 
নুরু এদিক ওদিক কয়েকবার তাকিয়ে বলে, তা কী হয়রে? এ পথে যখন একবার নেমেছিস আর কি ফিরে যাওয়া যায়? যাদের মাল গেল, তারা কি আমাদের ছেড়ে দেবে? খুঁজে খুঁজে ওরা ঠিকই আদায় করে নেবে। মাঝখান থেকে আমাদের টাকাটা ওরা দিল না। বুঝলি। আবার আমাদের কাছ থেকেই জরিমানা চাইতে পারে।
 
জবেদ ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে বলে, ময়না পেট ব্যাথায় সারারাত ঘুমোতে পারেনি। মাকেও অসুস্থ রেখে এসেছিলাম। কিছু টাকা হলে চিকিৎসাটা করিয়ে নিতাম রাজশাহী গিয়ে। এখন তো আর হল না।
 
বাড়ি চল। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। সবাই ভালো থাকবে, শুধু শুধু আমাদের কষ্টটাই মাটি হল রে আজ। নুরু সান্ত্বনা দেয়।
 
বাড়ি ফিরতেই দেখে ময়নাকে ধরাধরি করে বিছানা থেকে ভ্যানের উপরে তুলছে কয়েকজন। চমকে সামনে এগিয়ে যায় জবেদ। ময়নার কী হয়েছে? অন্ধকার থেকে একজন বলে, কেন তুই জানিস না। যাওয়ার আগেই তো ময়না তোকে বলল, আজ না যেতে, শুনলি না। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে, চল। জবেদ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভ্যান চলতে থাকে দ্রুত । জবেদের কোলে মাথা রেখে ময়নার কণ্ঠ অসাঢ় হয়ে ওঠে। ভাই, আমার এমন ব্যথা কেন হয়, আমি বাঁচবো তো। ভাই? জবেদ কিছু বলে না। ক্লান্ত চিটচিটে ময়লা হাত দিয়ে বোনের হাতটি ধরে। কেমন হিমশীতল, অসাঢ়, অচঞ্চল। জবেদ দেখে তার প্রিয় ছোট বোনটির মুখ একদিকে ঢলে পড়েছে। মুখে কোনো অনুযোগ নেই, নেই কোনো প্রশ্ন।
 

♦–♦♦–♦♦–♦

গল্পকার রাজশাহী কলেজের অধ্যাপক


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!