শিবভোলার দেশ শিবখোলা
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
অলঙ্করণ: দেব সরকার
দীপ্ত কখনও ভাবেনি তার জীবন এই ভাবে শেষ হবে। তার সামনে তার চোখের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে স্বয়ং বিবত্যা। গল্প টা শুরু থেকে শুরু করা যাক।
দীপ্ত পেশায় লেখক। মুম্বাই এর বাসিন্দা। বনি তার বউ। বাবার রেখে যাওয়া বিরাট সম্পত্তির একলা মালকিন এই বনি। সানা নিহাল, জাম্ব আর সুমি সবাই খুব কাছের বন্ধু তাদের। সানা আর সুমি যমজ বোন, দুজনেই নাম করা মডেল। নিহাল ব্যবসায়ী এবং সানার বয়ফ্রেন্ডও। আর জাম্ব সিঙ্গার। মুম্বাইয়ের অতি ব্যস্ত জীবনে এই বন্ধুদের সারা সপ্তাহে একবার অন্তত দেখা করা চাই চাই। এদের সকলের ঘনিষ্ঠতার আর একটা কারন হল, এরা প্রত্যেকেই ট্রেকিং করতে ভালবাসে এবং দল বেঁধে বছরে অন্তত একবার ট্রেকিংয়ে যায়। সেরকমই একটা ট্রেকিংয়ের প্ল্যান নিয়ে একদিন সাপ্তাহিক আসরে উপস্থিত হল সুমি। ওদের এবারের ডেসটিনেশন হল কুলঙ্গ ফোর্ট বা কুলঙ্গ গড়। এই জায়গাটা ট্রেকারদের জন্য স্বপ্ন। এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল সবাই।
২১ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করলো ছয় জন মিলে। মুম্বাই থেকে বাই রোড তারা পৌঁছাল আম্বেভারিতে। এটি একটি বেস পয়েন্ট যেখান থেকে ট্রেকিং শুরু করতে হয়। এই কুলঙ্গ গড় বা দুর্গটি নাসিকের ইগাভপুরি অঞ্চলে, কালসুবাই সর্বতের পশ্চিম ঢালে অবস্থিত। আম্বেভারি থেকে যে রাস্তা দিয়ে তাদের উপরে ওঠার কথা সেটি ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেছে। সেখানেই আছে কালসুবা হরিশ্চন্দ্র গড় অভয়ারন্য। এই রকম একটা পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দুর্গম রাস্তায় ট্রেকিং করার উত্তেজনায় সবাই একবারে টগবগ করে ফুটছে। নিজেদের সুবিধার জন্যই তারা ভরু নামের একজন গাইড কে সঙ্গে নিল। দীপ্ত আর বনি সঙ্গে নিয়েছে চা আর শুকনো খাবার। জাম্ব আর নিহান নিয়েছে রান্না করার সরঞ্জাম। বেস ক্যাম্প থেকেই প্রতিবারের মত সানা আর সুমির ফোটো সেশন শুরু হয়ে গেল। তারা পাহাড়ে উঠতে শুরু করল সকাল দশটা নাগাদ। ভরু তাদের বারবার সাবধান করতে লাগলো, যাতে দল ছাড়া না হয় কেউ। কারন এখনও এই জঙ্গলে লেপার্ড বা কালো চিতা দেখতে পাওয়া যায়, যাকে মারাঠি ভাষায় বলা হয় বিবত্যা। জাম্ব আর নিহাল সারা রাস্তা সবাইকে ভয় দেখাতে লাগলো বিবত্যার নাম নিয়ে। মাঝে একবার সুমি আর সানা, জাম্ব আর নিহাল কে এই মারে কি সেই মারে অবস্থা করেছিল। এইসব দীপ্তর খুব চেনা ঘটনা। প্রত্যেকবার সুমি, সানার সাথে জাম্ব আর নিহালের ইয়ার্কি ফাজলামি প্রায় মারামারির পর্যায়ে পৌঁছায়। আর প্রত্যেকবার দীপ্তকে সেটা সামলাতে হয়। বনি ভীষণ শান্ত ও সরল মনের মেয়ে। দীপ্তর কম কথা বলা চুপচাপ স্বভাবটার জন্যই ওর প্রেমে পরেছিল বনি। এইভাবেই হইচই করতে করতে পাঁচ ঘণ্টা পাহাড় চড়ে তারা পৌঁছে গেল কুলঙ্গ ফোর্টের সামনে। সেখানে বিশাল একটা গুহার ভিতরে নিজেদের সরঞ্জাম রেখে, একগ্রস্থ চা পর্ব সেরে তারা চারপাশের দৃশ্যের ছবি তুলতে গেল। সেখান থেকে মদন গড় আর আলং দেখে সবাই মুগ্ধ। এই ফাঁকেই ভরু তাদের জন্য খাবার তৈরি করে রেখেছিল। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে ছেলেদের দল গেল আশেপাশে একটু ঘুরে আসতে। বনি, সানা আর সুমি কুলঙ্গ গড়ের ওয়াড়া অর্থাৎ সুবিশাল অট্টালিকা আর তার সামনের বিরাট সিংহ দরজার ধ্বংসাবশেষ দেখতে দেখতে সেলফি, আর গ্রুপি তুলতে লাগলো। সুমি হঠাৎ বলে উঠলো—বনি তোরা কোনও গন্ধ পাচ্ছিস ? বনি-কই না তো, কেমন গন্ধ ? সুমি- একটা সুন্দর আতরের গন্ধ। বনি আর সানা একসাথে বলল- না। তারপর সুমি বলল— দেখতো আমার পিঠ বেয়ে কিছু উঠছে মনে হচ্ছে। সানা, বনি দুজনেই কিছু দেখতে পেল না। এরপর তারা আর ঘোরাঘুরি না করে গুহায় ফিরে এলো। ততক্ষণে ছেলেরাও ফিরে এসেছে। দেখতে দেখতে সূর্য পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে গেল,অন্ধকার নামলো পাহাড়ের বুকে। জঙ্গল থেকে যোগাড় করা কাঠে আগুন জ্বালিয়ে সবাই তার চারিপাশে ঘিরে বসলো। ভরুও সেই দলে সামিল হল। নাচ, গান, হাসি মজা চলতে লাগলো এন্তার। হঠাৎ দীপ্ত বলল- আমি একটু হালকা হয়ে আসি বুঝলি। জাম্ব সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো- আরে ইয়ার গুড টাইমিং। আমাকেও যেতে হত, কিন্তু শালা বিবত্যার ভয়ে মনে হচ্ছিলো এখানেই করে দিই। সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। সানা বলল- কেনোরে, খুব তো আমাদের ভয় দেখাচ্ছিলিস দুপুরে, আর এখন নিজে ট্যাঁই ট্যাঁই ফিস। আবার সবাই হাসতে শুরু করলো। যায় হোক প্রায় কুড়ি মিনিট পর বনি খেয়াল করলো দীপ্ত আর জাম্ব এখনও ফিরে আসেনি। যেহেতু মোবাইলে টাওয়ার নেই তাই সে ফোনও করতে পারলো না। বনি বাকিদের হৈ হল্লা থামিয়ে বলল- অনেকক্ষণ হয়ে গেল দীপ্ত আর জাম্ব এলো না। সানা বলল, হ্যাঁ তাইতো। নিহাল বলল- দেখ বসে সিগারেট টানছে হয়ত। এমন সব কথার মাঝেই দীপ্ত ফিরে এলো। সে এসেই নির্বিকার ভাবে জিজ্ঞেস করলো- জাম্ব কই? ওকে দেখছি না? সুমি বলল- ওতো তোর সাথেই গিয়েছিল। দীপ্ত – হ্যাঁ, কিন্তু হালকা হওয়ার পর আমি ওখানে একটু বসে লেখার প্লট ভাববো বলায়, জাম্ব বিবত্যার ভয়ে এখানে চলে এসেছিল। বনি – কি বলছ? কিন্তু জাম্ব তো ফেরেনি। সবার মুখে ভয়ের ছায়া নেমে এলো। ভরু মেয়েদের গুহার ভিতরে থাকতে বলে, দীপ্ত আর নিহাল কে নিয়ে জাম্ব কে খুঁজতে গেল। যদিও হাই পাওয়ারের টর্চ, তবু আশেপাশে জাম্বকে কোথাও দেখা গেল না। রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের দিকে যেতে দীপ্ত আর নিহাল কে বারণ করলো ভরু। বেশ অনেকক্ষণ খুঁজে শেষে নিরাশ হয়ে গুহায় ফিরল ওরা তিন জন। বনি, সুমি আর সানা কান্নাকাটি করতে শুরু করলো। রাতে কারোর মুখেই খাবার উঠলো না। নিজের নিজের স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে শুয়ে পড়ে সবাই। রাত প্রায় বারোটা, সানার ঘুম ভাঙল একটা হালকা গোঙ্গানি শুনে। পাশে তাকিয়ে দেখল সুমি মাটির উপরে উবুড় হয়ে বসে গোঙ্গাচ্ছে। সানা তাড়াতাড়ি করে উঠে বসল। তারপর সুমির নাম ধরে ডাকতে লাগলো ভয়ে ভয়ে। সুমি কোনও সাড়া দিল না। কিন্তু তার গোঙ্গানির আওয়াজ বাড়তে থাকলো ধীরে ধীরে। সেই আওয়াজে ধড়ফড় করে উঠলো নিহাল, শুরু, বনি আর দীপ্ত। সবাই হতবাক, ব্যাপারটা কি বুঝতে শুরু এগিয়ে গেল সুমির দিকে। সুমির কাঁধে হাত রাখতেই উঠে দাঁড়িয়ে ভরুর দিকে ঘুরে তাকাল সুমি। ভরু ভয়ে চিৎকার করে পিছিয়ে আসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়েই গেল। সবার নজর গেল সুমির দিকে। সেকি বিকট মুখের অবস্থা ভার। চোখদুটো সম্পূর্ণ কালো হয়ে গেছে। মুখের চামড়া ছিঁড়ে ঝুলে পরেছে। সেখান থেকে গড়িয়ে পরছে বিন্দু বিন্দু রক্ত।
ঠোঁটগুলো বিশ্রী কালো, দুধারের দাঁত দুটো বেরিয়ে এসেছে বড়ো হয়ে। হাতের নখ গুলো এবড়ো থেবড়ো বড় বড়। সানা ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। বনি আতঙ্কে দীপ্তকে জড়িয়ে ধরল। সুমির বিচ্ছিরি স্বরে হাসতে হাসতে এগিয়ে যেতে লাগলো সানার দিকে। সানা সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকে, কিন্তু এই অবস্থায় সুমির সামনে যাওয়ার মত সাহস কারোর হল না। সুমি মারাঠি ভাষায় কি সব যেন বলতে থাকে চিৎকার করে। ভরু কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে হিন্দিতে জানতে চায় ওয়ারার ভিতরে তারা কিছু অদ্ভুত ফিল করেছিল কিনা ? বনি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে- সুমি একটা আতরের গন্ধ পেয়েছিল, আর ওর মনে হচ্ছিল ওর পিঠ বেয়ে কিছু উঠছে। ভরু বলল- ব্যাস, কাম তামাম। ইস্কে আন্দার কই আত্মা ঘুস গায়া হ্যায়। শুনে সবাই শিউরে উঠলো। সানার কাছে ভভক্ষণে পৌঁছে গেছে সুমি। একটা হাত দিয়ে টিপে ধরল সানার গলা। নিহাল আর দীপ্ত কোনোক্রমে ভয়কে জয় করে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুমির দিকে। সুমিকে টেনে হিঁচড়ে সরানো হয় সানার কাছ থেকে। কিন্তু এরপর মাটিতে লুটিয়ে পরে সানার নিষ্প্রাণ দেহটা। সুমি ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পরেছে দীপ্তর কোলে। বনি আর নিহাল ছুটে যায় সানার দেহটার কাছে। সানার দেহটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে নিহাল আর বনি। ভরু আর দীপ্ত অজ্ঞান সুমিকে কোলে তুলে সেখান থেকে সরিয়ে গুহার একধারে নিয়ে যায়। নিহাল কাঁদতে কাঁদতে বনিকে বলে- সানার ফস্মোফোবিয়া ছিল। সম্ভবত সেই কারনেই ও হার্টফেল করে। বনি অবাক হয়ে তাকায় নিহালের দিকে। নিহাল বলে- ওর এই ফোবিয়াটার ব্যাপারে ওর বাড়ির লোক আর আমি ছাড়া কেউ জানতো না। এরপর দীপ্ত ফিরে এসে বনি আর নিহালকে জানায় সুমি এখন অজ্ঞান রযেছে, তবে তার চেহারাটা ওদের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ভরু ওকে পাহারা দিচ্ছে, কোনও গণ্ডগোল বুঝলেই সে ডাক দেবে। সবাই তখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে। প্রথমে জাম্ব, তারপর সানা। কে জানে এরপর কার পালা? সবাই এত নিস্তব্ধ যে প্রত্যেকে নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে। আচমকা নিস্তব্ধতা ভাঙল সুমির গলার আওয়াজে। সে দূর থেকে সানার মৃতদেহ দেখে ছুটে এলো সেখানে। সে এত কাঁদছে যে তাকে সামলানো মুশকিল হচ্ছে। বনি আর দীপ্ত তাকে থামানোর ভীষণ চেষ্টা করছে। ঠিক সেই সময় নিহাল সানা… ঐতো সানা… সানা… সানা বলে উন্মাদের মত গুহা থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল সেই দিকে। কোথায় সানা, তার মৃতদেহ তো এখানে পরে, তাহলে কাকে দেখে ছুটে গেল নিহাল? তাহলে কি এবার নিহালের পালা ?
হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে কিছু আলোড়ন দেখা দিল। তারপরেই পাখিদের পরিত্রাহি ডাক । ঠিক সেই সময় ভরু বাঁ হাতটা উপরে তুলে সবাইকে ইশারায় থামতে বলল। তার চোখ স্থির হয়ে গেছে জঙ্গলের একদিকে তাকিয়ে। সুমি, নিহাল আর বনি তার পিছনে পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে গেছে
বাইরে আকাশ লাল হয়ে গেছে, সূর্য উঠলো বলে। ভরু সবাই কে বলল রেডি হয়ে নিতে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নীচে পৌঁছাতে হবে। বনি বলল- দীপ্ত, তুমি আমাদের ব্যাগ গুলো গুছিয়ে নাও। সুমি তুই তোর আর সানার জিনিস গুলো গুছিয়ে নে। আমি সানার কাছেই থাকি। ভরু আমার কাছে থাক প্লিজ। দীপ্ত আর সুমি গুহার ভিতরের দিকে যেখানে ব্যাগপত্র ছিল সেখানে চলে গেল। গোছগাছ করে বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। বনি বলল – সুমি, সানার বডিটা কি করবি? সুমি কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল— সঙ্গে নিয়ে যাব। সানাকে এখানে এই ভাবে ফেলে যাব কি করে? সবাই তাতেই রাজি হল। গুহা থেকে বেরিয়ে চারিদিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে বনি বলল- আসার সময় কত আনন্দ করেছিলাম সবাই। কখনও ভাবিনি ফেরার সময় এইভাবে ফিরতে হবে। ভরু সানার দেহটা পিঠে বেঁধে বাকিদের সঙ্গে নিয়ে নীচে নামতে শুরু করলো। বেশ কিছুটা নামার পর ভরু থমকে দাঁড়ালো। পাথরের একধারে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল দীপ্ত আর সুমিও। সবার চোখ বনির দিকে। বনি কিছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকাল দীপ্তর দিকে। দীপ্ত তার কোমর থেকে একটা বড় ভোজালি বার করে একভাবে তাকিয়ে রইল বনির দিকে। সুমি হাসতে হাসতে বলল- দীপ্ত ডার্লিং, আর দেরি কেন? এবার তোমার বউকেও খালাস করে গল্প শেষ করো। বনি বিস্ফোরিত চোখে তাকাল দীপ্তর দিকে। দীপ্ত বলল- সুমি ডার্লিং, এত ভাড়ার কি আছে? আগে পুরো গল্পটা ওকে মরার আগে শুনিয়ে দিই। তারপর ওকে মেরে ওর সব সম্পত্তি আমি হাতিয়ে নেব। বনি কাঁদতে কাঁদতে বলল- এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা কেন করলে দীপ্ত ? দীপ্ত বলল- মানুষের কিছু আদিম প্রবৃত্তি আছে, যেগুলো মাঝে মাঝেই মানুষকে মনুষ্যত্বের মুখোশ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করে। আমি তোমাকে শুধুমাত্র তোমার সম্পত্তির কারণে বিয়ে করেছিলাম। আর তারপর সুমিকে দেখে ওর প্রেমে পরে যাই। ওর সাথে মেশার পরেই বুঝতে পারি যে ও আমার মতই লোভী। সানাকে ও কোনোদিনই সহ্য করতে পারেনা। সানার কারণে সুমি মডেলিং জগতেও আধিপত্য বিস্তার করতে পারছিল না। এর মধ্যে আমার লেখক হিসাবেও নাম কমতে শুরু করে। আর তখনি আমরা দুজন মিলে এই ট্রেকিংয়ের প্ল্যান করি। এখানে আসার মূল উদ্দেশ্যই ছিল তোমাকে আর সানা কে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলা। কিন্তু গল্প সাজাতে প্রথমেই জাম্বকে মারতে হল। সুমি জানতো সানার ফস্পোফোবিয়া আছে। ভাই ওয়ারা থেকেই সুমি নাটক শুরু করে। তারপর মাঝরাতে সঙ্গে আনা মেকআপ দিয়ে ভুত সেজে সানার চ্যাপ্টার ক্লোজ। বলেই শয়তানের মত হেসে ওঠে দীপ্ত। এরপর সুমি শুরু করলো- ট্রেকিং শুরুর আগেই আমরা টাকা দিয়ে ভরুকে কিনে নিয়েছিলাম।
নিহালকে মারার দায়িত্ব ভরুর উপরেই ছিল। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হল না। ব্যাটা নিজেই সানার দুঃখে পাগল হয়ে কোথায় বেরিয়ে গেল। এতক্ষণে হয়ত লেপার্ডের পেটেও চলে গেছে। বাকি রইলি তুই। দীপ্ত এবার তো গল্প বলা শেষ। ওকেও এবার তাহলে শেষ করে দাও। সুমির কথা শেষ হওয়ার আগেই দীপ্ত ভোজালি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো বনির দিকে। আচমকা জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো নিহাল। এসেই এক ঘুসিতে ছিটকে ফেলল দীপ্তকে । তারপর নিজের জিম করা চেহারার সদব্যবহার করে তাকে একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলল। এই ভাবে নিহালের প্রত্যাবর্তন দীপ্ত বা সুমি কেউই আশা করেনি। কিন্তু বনির মুখ দেখে মনে হল যেন এই আকস্মিক ব্যাপারটা ভার আগেই জানা ছিল। সুমি ভরুকে চিৎকার করে বলে উঠলো- দেখ কেয়া রাহা হ্যায় কমবক্ত, কুছ কর। বলি হাসতে হাসতে উত্তর দিল— তোরা যা টাকা দিয়ে ওকে কিনেছিলি, আমি তার ডবল টাকা দিয়ে ওকে কিনেনি। এবার তাহলে আমার গল্পটা একটু শোন তোরা। সানা মারা যাওয়ার পর শুরু আর দীর্ঘ যখন তোকে গুহার অন্যদিকে তুলে নিয়ে যায়, আমিও কি ভেবে কিছু পরেই সেখানে গিয়েছিলাম। আর তখনি তোদের সব আলোচনা শুনে আমি তোদের প্ল্যান জানতে পেরে যাই। খুব আঘাত পেলেও নিজের মনকে শান্ত করে ফিরে আসি নিহালের কাছে। ওকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলি। আর তারপর আমরা একটা প্ল্যান করি। সেই প্ল্যান মাফিক নিহাল সানাকে দেখতে পাওয়ার ভান করে পাগল সেজে উধাও হয়ে যায়। তারপর ব্যাগ গোছানোর নাম করে তোদেরকে সরিয়ে দিয়ে ভরুকে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে কিনে নিই। আমি জানতাম সানার দেহ তোরা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইবি, যাতে কেউ সন্দেহ না করে। আর তোরা যে এইখানে আমাকে মারার প্ল্যান করেছিলিস সেটা জেনেই আমি নিহাল কে সময় বুঝে এখানে এসে লুকিয়ে থাকতে বলি। এরপর মাটিতে পরে থাকা বেদম মার খাওয়া দীপ্তর দিকে তাকিয়ে বনি বলে— তুমি ঠিক বলেছিলে দীপ্ত মানুষের কিছু আদিম প্রবৃত্তি আছে। তোমাদের যেমন লোভ আছে তেমনি আমার আছে প্রতিশোধ স্পৃহা। এই বাদানুবাদের মধ্যেই হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে কিছু আলোড়ন দেখা দিল। তারপরেই পাখিদের পরিত্রাহি ডাকে কান প্রায় ঝালাপালা। ঠিক সেই সময় ভরু বাঁ হাতটা উপরে তুলে সবাইকে ইশারায় থামতে বলল। তার চোখ স্থির হয়ে গেছে জঙ্গলের একদিকে তাকিয়ে। সুমি, নিহাল আর বনি তার পিছনে পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে গেছে। দীপ্তর মাটি থেকে ওঠার ক্ষমতা হলনা। আর তারপরেই সেই গম্ভীর হুঙ্কার। ভরু চিৎকার করে বলল— সব লোগ পেড় পর চড়িয়ে। ভরনা বিবত্যাকে শিকার বান যাওগে। নিহাল, বনি লাফিয়ে গাছে উঠে পড়লো। ভরুর দায়িত্ব ছিল সানার দেহটা সুরক্ষিত অবস্থায় বেস ক্যাম্পে পৌঁছে দেওয়া। তাই সে ওই মৃতদেহ সমেত গাছে উঠে পড়লো। সুমি দীপ্তকে ওঠানোর দুবার বৃথা চেষ্টা করে নিজের প্রাণ বাঁচাতে গাছে উঠে গেল। দীপ্ত মাটিতে পরে কাতরাচ্ছে। তার চোখের দিকে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে স্বয়ং বিবত্যা। তারপরেই এক লাফে সে দীপ্তর ঘাড়ের উপরে পড়ল। এক থাবায় ফাটিয়ে দিল বিশ্বাসঘাতক দীপ্তর মাখা। তারপর তার দেহটা মুখে করে টানতে টানতে জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে চলে গেল। সবাই আস্তে আস্তে নেমে এলো গাছ থেকে। সুমি যেন কাঠের পুতুল, ওর মুখ থেকে কোনও আওয়াজ বের হল না। তারপর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো- বিবত্যা আমাকে মারতে পারবে না। দীপ্তকেও মারতে পারবে না দেখিস। আমরা ঠিক বেঁচে যাব। তারপর একছুটে হারিয়ে গেল গভীর জঙ্গলে। নিহাল আর বনি ভরুর সাহায্যে সানার দেহটা নিয়ে বেসক্যাম্পে পৌঁছে একগাদা টাকা ধরিয়ে দিল ভরুর হাতে। তারপর একটা মৃতদেহ আর দুটো ভাঙ্গা মন নিয়ে ফিরে এলো মুম্বাইয়ে নিজেদের শেষ ট্রেকিং থেকে।
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।
সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।
মিরিক নামটি এসেছে লেপচা ভাষার “মির-ইওক” শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুনে পুড়ে যাওয়া জায়গা।
15:34