Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • এপ্রিল ২১, ২০২৪

সংবাদ মূলত কাব্যই

পাতাউর জামান
সংবাদ মূলত কাব্যই

 
খবরটা শোনার পর আমার আর কিছু ভালো লাগছিল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু যে করতে চাইছি না, এমনটা নয়। আসলে না-করতে করতে মনটা আমার এমন ভাবে পাঁকের মধ্যে গেড়ে গেছে আমি চাইলেও মন উঠে আসছে, কাদা ধুয়েও সাফ হচ্ছে না। 

 
আসলে কোনো কিছুই আমার পক্ষে যাচ্ছে না। না একটা চাকরি, না একটা সংসার, না আমার প্রেমিকা। হওয়ার মধ্যে শুধু কাড়ি-কাড়ি চাকরির ফর্ম জমা দেওয়া, পরীক্ষায় বসা, বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, রাতে বাবার খাওয়া হয়ে গেলে, নিশুথ রাতে ভাঁড়ার ঘরের নিঃশব্দ ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে যেভাবে ইঁদুর ঢোকে, আমিও ওভাবে ঘরে ঢুকি। খাবার টেবিলে ঢাকা দেওয়া থাকে ভাত আর একটা আলু দিয়ে হাফ ডিমের ঝোল। খেয়ে নিই। বাবার কিছু করার নেই। আমার মা  নেই বলে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যায়। আমি কাজের মাসির হাতের রান্না খাই। ওতে আমার কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়, কারণ আমি জি জেনারেশনের। তাছাড়া এ পাড়ায় আমিই একমাত্র পুরুষ, যে দুপুরে ফ্ল্যাটে থাকে। সুতারং কার ফ্ল্যাটে কে আসে, সে সব খবর আমার জানা। 
 
আমাকে অবশ্য পুরুষ বলতে আফরিনের আপত্তি আছে। টেকনোলজি নিয়ে পড়াশুনো করে, চাকরি না-পেয়ে বয়েস আটাশ হলেও আফরিন বলে, না, তুই এখনও পুরুষ হলি না, ছেলে মানুষই থেকে গেলি। আফরিন কেন ঝাজে কথা বলে, সেটা আমি আবশ্য বুঝি। না-বোঝার মতো বয়েস আমার পেরিয়ে গেছে অনেক দিন। যেমন করে ইউনিভার্সিটির প্রেম করার বয়েস পেরিয়ে গেছে, যেমন করে মলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করার অভ্যাস পাল্টে গেছে। 
 

লেকের ধারে স্টেডিয়ামের বিপরীত দিকে আমি আর পাথরের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমার অনেক কিছু বলার ছিল, অনেক প্রশ্ন ওনাকে করার ছিল, আমি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ শোকেসে সাজানো থাকে

 
আমিও সেবার অপেক্ষা করছিলাম লেকের ধারে, আফরিনের জন্য। সেদিন ছিল বাবরির রায়, কলকাতার রাস্তা ঘাট প্রায় জনশূন্য। জানি না মড়কে, মন্তরে, দাঙ্গায় কলকাতার রাস্তাঘাটগুলো এই রকম ফাঁকা ছিল কিনা ! শুধু লেকেরা ওভারব্রিজ দিয়ে কতগুলো প্রাইভেট কার ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আর কতকগুলো সরকারি বাস প্যাসেঞ্জার না-পেয়ে দিকভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করছিল। আমি তখনও লেকের ধারে স্টেডিয়ামের বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যেখানে আমি আর পাথরের মূর্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। অপেক্ষার নিয়মই হচ্ছে সময় সাপেক্ষ প্রতীক্ষা, আর সময় কাটার জন্য চারপাশ দেখা। আমার অনেক কিছু বলার ছিল, অনেক প্রশ্ন ওনাকে করার ছিল, যদিও আমি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ শোকেসে সাজানো থাকে। আমার দুপুরে কিছু না-করার ফলে, নেট ঘেটে, ওটিটি দেখে, ফুটবলের রিক্যাপে ক্লান্ত হয়ে ওনার বইগুলো পাড়তাম। ওল্টাতে পাল্টাতে যেটুকু পড়তাম, তাতে একদিন আমি লক্ষ করলাম যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ছাপানো রবীন্দ্ররচনাবলীর প্রায় সব কটা খণ্ডই আমি শেষ করে ফেলেছি। সুতারং আজকে বাবরি নিয়ে সুপ্রিমকোর্ট ফাইনাল রায় দেবে, কী হবে তখনো জানতাম না, এ বিষয়ে ওঁর মতামতটা জানতে ইচ্ছে করছিল। জানি ব্যাপারটা হাস্যকর। 
 
সেদিন রায় বের হওয়ার পর লেকের ব্রিজের উপর হুডখোলা জিপের আনাগোনা বাড়ছিল। শুধু আফরিন আসেনি। আমার আর ঠাকুরকে প্রশ্নগুলো করা হয়নি। শেষবার যখন ফোন করেছিলাম ওকে, বলেছিল, আমাদের এখানে বড়োসড়ো একটা জুলুশ বের হয়েছে।   
 
আফরিনের কলেজের পার্ট-টাইম চাকরিটা পাকা হয়ে যেদিন স্যাক্ট হয়েছিল, সেদিন ও বলেছিল, চল বিয়ে করে নিই?
 
আমি বলেছিলাম, খাব কী? 
 
বলেছিল, কেন এই অর্ধেক ইনকামে চলবে না? তুই একটা কোম্পানিতে চাকরি জুটিয়ে নে, যতক্ষণ না সরকারি চাকরি হচ্ছে !
 
বলেছিলাম, তুই এই বুঝলি অঙ্ক পড়ে আর পড়িয়ে। নিজের জীবনের অঙ্কটাই বুঝলি না ! চলবে তো দুজনের ! এরপর তিনজন যখন হব, তখন?
 
আফরিন বলেছিল, সে চলে যাবে। তুই একটু বোঝ, আমার পক্ষে কতদিন আর এইভাবে থাকা সম্ভব। যতই কলেজে পড়াই না কেন, ভারতীয় নারী, চাপ আসবেই ! আব্বা আম্মা না-হয় মেনে নিল, পাড়ায় যে কী ঢি-ঢি হবে বুঝবি না তুই ! 
 
সেদিন আফরিনকে বোঝাতেই পারিনি, আসলে পাড়াতে ঢি-ঢি পড়ে যাওয়া কাকে বলে, কাকে বলে টিটকারির মধ্যে বেঁচে থাকা, সেটা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝি। আগুনের পাশে লোহা থাকলে লোহা যেমন বোঝে সে গরম হবেই। লোহার কিছু করার থাকে না, পরিস্থিতি ওকে আগুনের পাশে রেখেছে, ওর পক্ষে একা একা সরে যাওয়ার অসম্ভব।    
 
আমাকে আফরিন বারংবার বলছিল, তুই আমাকে নিয়ে চল। আমার আর এখানে ভালো লাগছে না। প্রত্যেক রোববার করে ছেলে দেখতে আসছে। সেজেগুজে ওদের সামনে বসে গল্প করতে আর ভালো লাগছে না।
 
বলতাম, আর কিছু দিন ম্যানেজ করে নে। এবার চাকরিটা হয়েই যাবে। অন্যান্য চাকরিরগুলোর বেলায় কোর্ট যখন রায় দিয়েছে, আমাদের জটটাও কেটে যাবে আশা রাখছি। 
 

আমি মেঘের সাথে ওর খুব একটা ফারাক দেখতে পাচ্ছিলাম না। মেঘ ক্রমশ ভারি হয় জলীয়বাষ্প নিয়ে, তারপর বয়ে বয়ে বেড়ায়। আর যেদিন সহ্য করতে না-পারে, সেদিন অঝোরে ঝরে পড়ে। সেই ঝরে পড়ার না থাকে দিন, না থাকে ক্ষণ

 
আফরিন আর কিছু বলেনি। আমি জানি ও আর কিছু বলবে না। কারণ গত তিন বছর ধরে ও আমাকে সময় দিয়ে আসছে। আমার একবার মনে হত, এখন বিয়ে করে নিলে সমস্যা কোথায়? ও একা যা রোজগার করে, আমাদের বেঝিঝক চলে যাবে। আমিও দু-দশ হাজারের কিছু একটা করে নিতেই পারি। আমি পুরুষ মানুষের ইগো বুঝতাম না, এমনটা নয়। ছেলে হয়ে বউয়ের টাকায় বসে বসে খাবে— বাপের এক্সটাম্যারিটাল অ্যাফিয়ার্স মেনে নিলেও এটা যে কেন মেনে নিতে পারতাম না – এ ছাইপাশ ভাবলে আমার কেমন যেন সব গুলিয়ে যেত। ঝড়ে ধুলোবালি, গাছপাতা, না-দেখা জলীয় কণা যেভাবে ঘুলমিল হয়ে যায়, ঠিক তেমন। 
 
যেবার রাশিয়া উইক্রেনের আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেবারও আমাদের মধ্যে বিয়েটা নিয়ে খুব একটা ঝামেলা হয়নি। শুধু আফরিন সেদিন সকালে, রোববার ছিল মনে হয় সেদিন, ফোন করে বলেছিল, আজ আমি বেরিয়ে যাব বাড়ি থেকে। আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না। বিকেলে আমারা মধুসূদনমঞ্চের সিড়িতে দেখা করেছিলাম। আফরিন খুব কান্নাকাটি করছিল। আমি মেঘের সাথে ওর খুব একটা ফারাক দেখতে পাচ্ছিলাম না। মেঘ ক্রমশ ভারি হয় জলীয়বাষ্প নিয়ে, তারপর বয়ে বয়ে বেড়ায়। আর যেদিন সহ্য করতে না-পারে, সেদিন অঝোরে ঝরে পড়ে। সেই ঝরে পড়ার না থাকে দিন, না থাকে ক্ষণ। যতক্ষণ না পর্যন্ত আফরিন হাল্কা হচ্ছে কেঁদে কেঁদে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওর কান্না চলতে থাকে। আমার কিছু করার থাকে না। আমি এভারেস্টের মতো হীম-শীতল মৌনতার প্রতিক্ষাকে সম্বল করে আফরিনের হাত হাতে নিয়ে বসে থাকি। ওর স্পর্শে বুঝতে পারি, ওর সমস্ত ভাবনা । ও কী আমার সীমানাটা, আমার বাধ্য-বাধকতা বুঝতে পারছে না ! শেষঅব্দি স্টেশন থেকে কফি খাইয়ে ওকে ট্রেনে তুলে দিয়ে বলেছিলাম, চিন্তা করিস না, আমি সব ঠিক করে দেব।
 
আফরিন জানত আমার ঠিক করে দেওয়ার এবং করে নেওয়ার ক্ষমতা ঠিক কতখানি। আফরিন ফোনে বলেছিল,  না, ওরা আমাকে পছন্দ করে নিয়েছে। ছেলের আব্বা চাইছে আজকেই পাকা দেখা সেরে নিতে। ডেটও ভেবে ফেলেছে, এমাসে রোজার পর, ইদ বাদে। ঠিক এতটা কথা বলার পর আফরিন কল কেটে দিয়েছিল। আমি তখন ফোন ঘটতে ঘাটতে ইজরায়েল প্যালেস্টাইনের যুদ্ধের আপডেট নিচ্ছিলাম। আফরিন ছাড়া আমার অবস্থা চল্লিশ লক্ষ গৃহহারা প্যালেস্টাইনিদের মত। আগে খবর দেখতাম, রাগ হত, কিন্তু তখন অনুভব করেছিলাম ওদের কষ্ট এবং ভয় আর আমার আফরিনকে ছাড়ার কষ্ট এবং ভয় দুটোই সমান সমান।  
 
আমি টেক্স করেছিলাম, অনেক দিন ধরে আফরিনকে জানি, জানি এখন কোনো মতেই ও ফোন ধরবে না। তার থেকে টেক্স করাই ভালো। লিখেছিলাম এই কথাগুলো – যেন হঠকারিতায় কিছু করিস না। 
 
আফরিন প্রত্যুতরে লিখেছিল– তুই না পারলে বল, আমি তোর কাছে যাবো না। কিন্তু এ ঘরেও থাকব না। 
 
ওর জেদ জানি, ও একবার যেটা ভেবেছে, আর সে ভাবনা যদি জেদের পার্যায়ে পৌঁছে যায়, ও সেটা না-করে কিছুতেই ছাড়বে  না ! 
 
আমি ঘুরিয়ে আফরিনকে ফোন করেছিলাম। ও ধরেও ছিল। আমি বলেছিলাম, এরকম করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
 
ও বলেছিল, তোকে কিছু ভাবতে হবে না। বাড়ি থেকে বের হয়ে তোর কাছে যাব না, বন্ধুর পিজিতে উঠব। 
 
আমি বলেছিলাম, বাড়ি থেকে বের হোস না। আমি যাচ্ছি, তোর আব্বার সাথে কথা বলব।
 
এমনিতে আফরিনের আব্বা মা আর ওর এক ছোট ভাই ইবন, আমাকে চেনে, এদের নিয়ে ওর পরিবার। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমরা বন্ধুরা বেশ কয়েকবার ওদের বাড়িতে গেছি। সেবার ইদেও নেমতন্ন ছিল, ইদে সবাই যায় বলে আমি যেতাম না। অন্য বন্ধুরা গেছিল। ওর আব্বা যখন কোভিডে অসুস্থ হয়ে মেডিকেলে ভর্তি ছিল, কম ছোটাছুটি করিনি। যেদিন ডিসচার্জ হয়েছিল, আমি আর আফরিন ধরাধরি করে ওর আব্বাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আফরিনের মা খুব ভালো, রাতে বেশ যত্ন করে আমাকে খাইয়ে ছিল। আমার মা থাকলে হয়তো এমন আদর-যত্ন করে খাওয়াত। আমার মায়ের কথা শুনে আফরিনের মায়ের চোখে জল এসে গেছিল। বলেছিল, বাবা দীপু, তোমার যখন মনে চাইবে, তখন আমাদের বাড়িতে চলে আসবে। বালিগঞ্জ থেকে ফটক খুব বেশি দূরে নয়। তুমি যা করেছো তা এই বাজারে, কে করে বলতো বাবা।
 
আমি একটু লজ্জায় পড়ে গেছিলাম। নাইনটিজের সিনেমার গল্পের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তারপর বেশ কয়েকবার আমি ওদের বাড়িতে গেছি কারণে অকারণে। সুতারং আজও আমার ওদের বাড়ি যাওয়াতে খুব একটা যে বাধা আছে, তা নয়। 
 
আমি আফরিনকে ফের কল করলাম। ও ধরেনি। একটা টেক্স করলাম, তুই একা একা বের হবি না। আমি আসছি। কথা বলব তোর  এবং পরিবারের অন্যদের সঙ্গে । জানি আমার কথা না-মানার চান্স নিরানব্বই ভাগ। একভাগের আশা আমি ছাড়তে চাই না। তুই প্লিজ বের হস না।
 
পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখি টেক্সটাতে দুটো সবুজ রাইট চিহ্ন পড়ে গেছে। 
 
আমি আরেকবার কল করেছিলাম। ও ধরল না। খুব দ্রুত আমি নিজেকে তৈরি করে নিয়েছিলাম, ট্রেনের দেওয়া সময় অনুসারে আমাকে সাড়ে পাঁচটার ট্রেন ধরতে হবে। ফটক স্টেশনে নেমে আরো হেঁটে দশ মিনিট মিলেয়ে, মিনিট চল্লিশেক লাগবে। 
 
ট্রেনে খুব একটা ভীড় ছিল না। যদিও এই সময় ভীড়ই থাকে। তারপর মনে হল আজ রোববার, তার উপর রোজাও চলছে। জানালার ধারে একটা সিট পেয়ে গেছিলাম অনায়াসে। বাড়ি থেকে বেরোনো, স্টেশন অব্দি আসা, ট্রেনের টিকিট কাটা – এ সব কিছুরমধ্যে আমার একটা ঘোর লাগছিল, সঙ্গে ভয়ও। 
 
ট্রেনটা ঠিক সময় মতো নাচতে নাচতে হাজির হয়েছিল। 
 
জীবনকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে আমি আফরিনের প্রতি আমার যে ডেডিকেশন, সেটাকে কম করে ফেলেছি ? – এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত ! সব বিষয়ে যে একেবারে নিশ্চিত হতে পারতাম, তা নয়। আমরা উচিৎ কী ছিল ? না, আফরিন যখন প্রথমেই ফোন করে চলে আসার কথা বলেছিল, কোনো রকম দ্বিধা মনে না-রেখে আমার হ্যাঁ বলা। সেটাতে আমি প্রথমবারই ঢাহা ফেল। ওকে আসতে বারণ করলাম, উপরন্তু কয়েকটা শর্তও চাপিয়ে দিলাম। এটা যে আফরিনের খারাপ লাগবে আমার ভেবে দেখা উচিৎ ছিল! 
 

আমি জানি, আফরিনের মা বাবা ও রকম নয়। এখন যা পরিস্থিতি চলছে, তাতে আশেপাশের কেউ না এ প্রশ্ন করে বসে ! শেষমেশ কিছু ভাবনা না-পেয়ে মনকে প্রবোধ দিয়েছিলাম, সত্যের কোনো রঙ নেই, ভয়ও নেই। যা আছে কপালে, ছেড়া কাঁথা বগলে, সত্যিটাই বলব। বলব যে, আফরিনই ডেকেছে

 
ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে আমাকে ফেলে যাওয়া গতিময় দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে কয়েকটা পরিকল্পনা করে নিয়েছিলাম। আফরিনদের বাড়িতে কেন এলাম তার জন্য কয়েকটা অজুহাত খাড়া করেছিলাম। একটা হতে পারে, কমন অজুহাত, এমনি এ দিকে একটা কাজে এসেছিলাম, তাই ভাবলাম ঘুরে যাই। আমার এই যুক্তির প্রতি আমি নিজেই ভরসা পাইনি। ধরা খেয়ে যাব ওর বাবা-মার কাছে। প্রথমটাকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় আর একটা যুক্তি সাজিয়েছিলাম। রোজা চলছে, তাই ইফতার করতে আসা । এটা একটা ঠিকঠাক কৈফিয়ত বলে আমার মনে হয়েছিল। পরক্ষণে এটাও মাথায় এসেছিল, যদি বলে হিন্দু ছেলে হয়ে ইফতারি নিয়ে এত আদিক্ষেতা কেন ? আমি জানি, আফরিনের মা বাবা ও রকম নয়। এখন যা পরিস্থিতি চলছে, তাতে আশেপাশের কেউ না এ প্রশ্ন করে বসে ! শেষমেশ কিছু ভাবনা না-পেয়ে মনকে প্রবোধ দিয়েছিলাম, সত্যের কোনো রঙ নেই, ভয়ও নেই। যা আছে কপালে, ছেড়া কাঁথা বগলে, সত্যিটাই বলব। বলব যে, আফরিনই ডেকেছে।  
 
মাঝেরহাট ছাড়িয়ে যখন বেসব্রিজের দিকে ট্রেনটা ছুটছিল, এমন সময় একটা জিজ্ঞাসা আমার চেতনাকে এবং আমাকে বাস্তবে নামিয়ে ট্রেনের মধ্যে ফিরিয়ে আনে। আমি দেখেছিলাম, সামনে যেমন সাধারণ গড়পরতা মানুষ বসে থাকে, তেমনই তিনজন বসে আছে। এরমধ্যে যার ডাকে আমি বাস্তবে ফিরে এসেছিলাম, সেই মানুষটি বছর ষাটেকের বেশি হবে। ঘোলাটে সাদা ময়লা পাঞ্জাবি পরেছিল, সঙ্গে চেক কাটা নীল সাদা লুঙ্গি। মাথার টুপিটাও পাঞ্জাবির কাপড়ের। আলাদা করে টুপি কেনার বিলাসিতা নেই। হয়তোবা কয়েক ছটাক কাপড় বেঁচে গেছিল, সেটা দিয়েই বানিয়েছে। পায়ের দিকে লক্ষ করে দেখেছিলাম, চপ্পল। চপ্পলে ফিতে নেই, পাটের দড়ি দিয়ে ফিতে করা। আবার একটা ‘বাবু’ ডাক এবং ‘আজ কটায় ইফতার’ – এই প্রশ্নটা কানে এসেছিল। আমি একটু ইতস্থত না-করেই বলেছিলাম, দাঁড়ান দেখছি। 
 
মোবাইলে গুগুল করে দেখে বলেছিলাম, আজ পাঁচটা তিপান্নয়।
 
লোকটা আবার প্রশ্ন করেছিল, এখন কটা বাজে?
 
আমি বলেছিলাম, সাত মিনিট বাকি আছে। 
 
লোকটা আর কোনো কথা বলেনি। মনে মনে ভেবেছিলাম, লোকটা ওজু করবে না ! এই চলন্ত ট্রেনে ওজুই বা করবে কী করে। দেখি লোকটার হাতে কাপড়ের দোকানের যে জীর্ণ প্লাটিকের ব্যাগছিল, সেটা থেকে একটা গোল অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন বক্স বের করেছিল। আমার কাছে টিফিন বলে মনে হলেও, আমি নিজের মনকে এটা বলে বোঝাচ্ছিলাম যে, ওটা কোনো মতেই লোকটার টিফিনবাক্স নয়, ওটা কোনো কিছু রাখার পাত্র। গরিব মানুষে আর কী, ওরা কি বড়োলোকদের মতো একটা জিনিসের জন্য একটাই পাত্র ব্যবহার করে ! 
 
পাত্রটা খুলতেই দেখি, টিফিন ভর্তি জল। জলটা একটু লালচে। পরে যখন লোকটা নিজের অনামিকা সোজা করে বাকি আঙ্গুলগুলো মুঠো বেঁধে, জলটা ঘোলাচ্ছিল, তখন দেখেছিলাম টিফিন বাক্সে চাল আর ছোলা ভেজানো। চালগুলো ভিজে কেমন সাদা সাদা ও ফোলা ফোলা। লোকটা আমার তাকানো দেখছিল, যখন আমি লোকটার চোখে চোখ রেখেছিলাম। আমার চোখে লজ্জা ও গ্লানি থাকলেও লোকটার মধ্যে ওদুটোর কোনোটাই ছিল না। বরং পালটা জিজ্ঞেস করেছিল, বাবু ইফতারির সময় হলে বলবেন। আমি ঘড়ি দেখে বলেছিলাম, আর তিন মিনিট বাকি। সন্তোষপুর স্টেশন ছাড়তে ছাড়তে আমাদের কানে আজানের শব্দ এসেছিল। লোকটা খুব তৃপ্তি ও ভক্তিভরে সেই চাল ও ছোলা ভেজা জলে চুমুক দিয়ে এক খাবলা ভেজানো চাল ও ছোলা মুখে ফেলে চোখ বুঁজে যে শান্তিতে চিবাচ্ছিল, তা দেখে আমি অবাক হয়ে গেছিলাম। চমকেও গেছিলাম। এত সুখ পেল কী করে ! আফরিনের পাঠানো ইফতারের ছবিতে দেখতাম – পাঁচ ছয় রকমের ফল, দু-তিন রকমের শরবত, চার পাঁচ রকমের ভাজাভুজি। লোকটার তো কিছুইও নেই। একবার মনে হয়েছিল, চাচাটাকে বলি, আমাকে তোমার ওই পেয়ালা ইফতার বাটি থেকে এক চুমুক দেবে?
 

নীল প্লাস্টিকে মোড়া ছোটো ছোটো দেহ সার দিয়ে সাজানো। ঠিক তার বিপরীত কোনে ট্রাকের পেছন খোলা দিক থেকে দুটো লোক প্লাস্টিকে মোড়া শরীর নামানোর জন্য ধরে আছে। ড্রেনের মধ্যে টুপি পরা, ষাটের বেশি বয়েসি চারটে মানুষ হাত উঁচু করে আছে, সেই নীল প্লাস্টিকের ব্যাগটা ক্যাচ করার জন্য। ফোন থেকে মুখ তুলে সামনে বসা চাচার দিকে তাকাই। …সেই কপালে ভাজ, সেই মাথায় টুপি, সেই স্থির কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি

 
চাচা ইফতারি শেষ কর জীর্ণ সেই প্লাসটিকের ব্যাগে টিফিনবাক্সটা ঢুকিয়ে কারোর দিকে না তাকিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে চোখ বুঁজিয়ে পেটের কাছে হাতে উপর হাত রেখে বসে আছে। ভঙ্গিটা অনেকটা নামাজ পড়ার মতো। আফরিনদের বাড়িতে গেলে ওর কাছ থেকে ব্যাপারটা জেনে নেব। আমার হাতে ফোন ধরা ছিল। চাচা যদি দেখে আমি তার দিকে ঢ্যাব ঢ্যাব করে চেয়ে আছি, অসস্থিতে পড়তে পারে। আমি ফোনটা খুলে বসি। দেখি আফরিন কিছু উত্তর দিল কি না। এখনো ব্লু রাইট চিহ্নই আছে। আমি ওয়াটস্যাপ স্কিপ করে যাই। নিউজের কয়েকটা নোটিফিকেশন এসেছে। একটাতে ক্লিক করতেই  দেখি চোখের সামনে একটা লম্বা ড্রেনের মতো কাটা বড়ো কবর। তাতে নীল প্লাস্টিকে মোড়া ছোটো ছোটো দেহ সার দিয়ে সাজানো। ছবির এক কোণে একটা লোক স্ট্যান্ডে ভিডিও ক্যামেরা বসিয়ে রেকর্ড করেছে। ঠিক তার বিপরীত কোনে ট্রাকের পেছন খোলা দিক থেকে দুটো লোক ওই রকম নীল  প্লাস্টিকে মোড়া শরীর নামানোর জন্য ধরে আছে। ড্রেনের মধ্যে টুপি পরা, ষাটের বেশি বয়েসি চারটে মানুষ হাত উঁচু করে আছে, সেই নীল প্লাস্টিকের ব্যাগটা ক্যাচ করার জন্য। ফোন থেকে মুখ তুলে সামনে বসা চাচার দিকে তাকাই। কতকটা একই বলে মনে হচ্ছে। সেই কপালে ভাজ, সেই মাথায় টুপি, সেই স্থির কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ছবির নীচে ক্যাপশন, গতকাল একটি আবাসনে ইজরাইলের ছোঁড়া বোমার ভালোবাসায় প্যালেস্টাইনের তিরিশটি লাশের উপহার। 
 
আমি ঠিক ব্যাঙ্গটা নিতে পারিনি। হত্যাটা হত্যাই এবং মৃত্যুটা মৃত্যু। সারিবদ্ধ লাশ নিয়ে এমন রসিকতা, আমি রাগে ঘৃণায় চোখের দৃষ্টিটা জানালা থেকে বাইরের অন্ধকারের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলাম। কিছু দেখা যাচ্ছে না। এই বেশ শান্তি !
 
একবার ভাবলাম আমার আর কী ! যা হবার তাই হবে। কিন্তু সব সময় যা হবার তাই হবে বলে ছেড়ে দিলে অন্য কেউ আমারটা নিয়ে যাবে না তো? আমার স্বপ্ন, আমার আশা, আমার ভালোবাসা, আমার বাঁচা মরার দায় অন্য কেউ নিয়ে আমাকে বেঁধে ফেলবে না তো? 
 
আমি আফরিনকে আরেকবার ফোন করেছিলাম। ও ধরেনি। 
 
মনে মনে আমি আমার পূর্বেকার সাজানো সব যুক্তিগুলো ঝোড়ো হাওয়ার সামনে মুঠো ভর্তি ধুলে ছেড়ে দিলে যেভাবে উড়িয়ে নিয়ে যায়, তেমন করে ছেড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। না, আফরিন ডাকেনি। আমি সত্যিটাই বলব। আমি নিজে যেচে এসেছি। আমি আফরিনকে ভালোবাসি। এতদিন আমি ওর দায়িত্ব নিতে চাইনি। মানুষের তিন নম্বর হাত দেখিয়ে আমি এড়িয়ে গেছি। আর না।
 
আরেকবার ওকে কল করেছিলাম। ও ধরেনি। আমি ওয়াটস্যাপ খুলি। সেই আগেরই দৃশ্য। আমি আফরিন টাইপ করে সত্যিটা লিখতে যাবো, আঙুলের চাপে শুধু আফরিন নামটা সেন্ড হয়ে গেছিল। সঙ্গে সঙ্গে দেখেছিলাম, দুটো সাদা ঠিক চিহ্ন ব্লু হয়ে গিয়েছে। পেজের উপরে দেখছিলাম, আফরিন ইজ টাইপিং – এই লেখাটা ফুটে উঠেছিল। আমার কাছে এক মুহূর্ত তখন মনে হচ্ছিল কোটি কোটি বছরের প্রতীক্ষা।
 

♦–♦♦–♦♦–♦

লেখকের আরো গল্প পড়ুন⇒

আমরা চার বন্ধু, আমরা আমাদের শরীরটাকে হারিয়ে ফেলেছি


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!