Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • অক্টোবর ২৯, ২০২৩

তত্বাবধায়ক

শেখর সেনগুপ্ত
তত্বাবধায়ক

অলঙ্করণ: দেব সরকার

 
প্রতাপ পানিগ্রাহীর উৎসাহ অসচরাচর। উৎসাহের অভাবে বা হতাশায় যাঁরা মৃতপ্রায়, তাঁরাও উদ্দীপ্ত হতে পারেন ওর সংস্পর্শে এলে। মনে হয়, তাঁর হাতের তালুতে আঁকা রয়েছে বহু এলাকার ভূগোল, বিস্তর পরিচিত বা অর্ধপরিচিত মানুষজনও। আবাল্য তাঁর মাতৃভাষা যেন বাংলা, যদিও জন্মসূত্রে তিনি বাঙালি নন। বাল্য ও যৌবনের প্রথমাংশ অতিবাহিত হয়েছে বৃহত্তর কলকাতার অংশ রাজারহাটে। বাবা অঘোরনাথ পানিগ্রাহী ছিলেন নারায়ণপুরের পোস্টমাস্টার। এলাকার নানাকান্ডে ও অরাজনৈতিক সমাবেশে তাঁর গুরুত্ব ছিল অনস্বীকার্য। অবসরের আগে এখানে একটা ছোট বাড়িও করে ফেললেন। কালেভদ্রে ওড়িশার ঢেঙ্কালেন ছুটতেন দূরও নিকট সম্পর্কের স্বজনদের সঙ্গে দারুণভাবে মিলেমিশে নিজেকে সাবলীল, অবিচল ও সমৃদ্ধ রাখতে। প্রতাপের ছাত্রজীবন পুরোটাই কলকাতার। ইতিহাসে মাস্টারডিগ্রি। তারপর বিস্তর প্রতিযোগীর দৌড় থামিয়ে ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের প্রবেশনারি অফিসারের চেয়ার দখল করে প্রায় সারা দেশটাই ঘুরলেন দু’বছরের প্রবেশন-পিরিয়ডে। এ সব তো দেড় যুগ আগের কথা। বাবা কবেই দেশে ফিরে স্বজনদের মাঝে দেহ রেখেছেন। তারপর এক বর্ষণমুখর রাতে জননীও। বস্তুত প্রতাপের কোনও পারিবারিক ‘জীবন’ নেই। কেন নেই, তিনি কী প্রেম-নির্যাতনের শিকার, এ সমস্ত তথ্য সরববাহ করবার মতো কোনোও প্রত্যক্ষদর্শী আছেন বলে জানা নেই। নিরন্তর ব্যাঙ্কের কাজে মুনশিয়ানা দেখাবার পুরষ্কার পেতে তিনি এখন একজন পোক্ত, সমর্থ, পেশিবহুল দেহধারী ব্রাঞ্চ ইন্সেপেক্টর। আজ সমতলে তো কাল পাতালে – সবরকম ব্যাঙ্ক ব্রাঞ্চের কাজে ভুল-ক্রটি খুঁজে বের করা তাঁর কাছে নস্যি। ভুল সাধারণ হলে ফিক করে হেসে নিজেই শুধরে দিয়ে আসেন; আর ভুল যদি বৃহৎ হয়, সেই ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের ঝামেলা হয়ে উঠবে অতিকায় – কোনও মিচকেপনা নয়, সরাসরি লোকাল হেডঅফিসে লিখিত রিপোর্ট সাবমিট করে আসতেন, লাখো মে এক জবরদস্ত তত্ত্বাবধায়ক মিঃ প্রতাপ পানিগ্রাহী।
 
অতিসম্প্রতি ব্যাঙ্ক তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছে বেঙ্গল সার্কেলের তিনটি ব্যাঙ্কের কাজ-কারবার খুঁটিয়ে দেখতে। প্রথমটি পশ্চিম বর্ধমান জেলার কোলবেল্ট এরিয়া লাউদহ ব্রাঞ্চ; দ্বিতীয়টি পূর্ব মেদিনীপুরের ইতিহাসখ্যাত নন্দীগ্রামের ব্রাঞ্চ এবং তৃতীয়টি সাগরদ্বীপের  রুদ্রনগরের ব্রাঞ্চ। কয়েক দফায় প্রথম দুটো ব্যাঙ্কের ইনেসপেকশন কমপ্লিট। খুঁটিনাটি সব পরীক্ষা করেছেন প্রতাপ। ‘হোক্স’ বলে কোনও ভুলকেই উড়িয়ে দেননি। নিজের আত্মবিশ্বাসী ও যুক্তিবাদী পরিচিতি অক্ষুণ্ণ। সাগরদ্বীপে পৌছতে হলে লঞ্চে চেপে সাগর ছুঁই ছুঁই নদীকে টপকাত হয়। ডায়মন্ডহারবারকে প্রদক্ষিণে রেখে গাড়ি ছুটছে। ব্যাঙ্কেরই গাড়ি ও বেতনভুক ড্রাইভার। আকাশে মেঘ নেই। তবে দাপট আছে বাতাসের। ড্রাইভারের চাঙ্গা গলা, ‘স্যার, এবার আপনি লঞ্চে উঠুন। ওপারে গিয়ে বাস পাবেন, স্যাটেলকারও পাবেন রুদ্রনগরে যাবার। কবে, কখন ফিরছেন, হেড অফিসে তো আপনি জানাবেনই। সেদিন এখানে এসে দেখবেন, আমিই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আপনার অপেক্ষায়।’
এরপর আর বকশিস না দিয়ে পারা যায়? প্রতাপের পঞ্চাশ টাকার একটি নোট গিয়ে ঢুকলো ড্রাইভারের পকেটে। উভয়ের অভিব্যক্তিতে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার আদান-প্রদান।
 

॥দুই॥

প্রতাপের কাঁধে বড় ঝুলন্ত ব্যাগ। ওটার ভেতবে গুচ্ছের কাগজপত্র, ব্যাঙ্কের ‘বুক অফ ইনস্ট্রাকশনস,’ একটা চৌকোনা কস্টিপাথর এবং ছোট্ট এক শিশি অ্যাসিড। লঞ্চে উঠেই প্রতাপ মোবাইলের দশটি বোতাম টিপে কানে যন্ত্রটাকে চেপে ধরেন, ‘হ্যালো, আপনি কাকদ্বীপ ব্রাঞ্চের হরেন গুছাইত?’
 
‘বলছি।’
‘আমি ইনেসপেক্টর ডি. পানগ্রাহী।’
 
‘ও, স্যার, আপনি। এখন কোথায় ?’
 
‘লঞ্চে।’
 
‘আমি রুদ্রনগর ব্রাঞ্চে এসে গিয়েছি। অপেক্ষা করছি আপনার জন্য।’
 
‘আশা করছি,’ ঘণ্টখানেকের মধ্যে পৌছে যাবো।’
 
ব্যাস, ফোন অফ। লঞ্চ তো একেবারে যাত্রীঠাসা। সকলেই কেমন যান্ত্রিক। একজন অত্যুৎসাহীরও পাত্তা নেই। প্রতাপের উন্মাদনা না থাক, নিশ্চিন্তি রয়েছে। কাকদ্বীপ ব্রাঞ্চের স্টাফ গুছাইত তাঁর কমেন্টস্ গুলিকে টাইপ করবেন, বহু বান্ডিল নোটও গুনবেন…। পূর্বপরিচিত। কাজের ছেলে। কাকদ্বীপ ব্রাঞ্চের চিফ ম্যানেজারকে পরে ধন্যবাদ জানতেই হবে গুছাইতকেই ডেপুট করবার জন্য।
 
ইনেসপেকশন কররার সুবাদে ভারতের নামা প্রান্তে প্রতাপের গমনাগমন। শহর, শহরতলি, পাহাড়, মরুভূমি, আবার বনাঞ্চলে মৌমাছির ঝাঁক অবধি। শয়ে শয়ে হাজারে হাজাকে নথিপত্র ঘেঁটে তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলা। কিন্তু জীবনে এই প্রথম লঞ্চে চেপে নদীর মোহনা অতিক্রম করছেন প্রতাপ। জল পরিস্রুত নয়, বেশ ঘোলাটে। যাত্রীর ভিড় এড়িয়ে ডেকে পৌঁছে কিছুটা ধাতস্থ হলেন প্রতাপ। কপালের ভাঁজটা অস্পষ্ট হয়ে আসছে। মাথাটা হেলে আছে কিছুটা পেছন দিকে। আজব না হলেও নদীতে ভাসমান থাকবার এই ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা তিনি নিশ্চয় অনেকদিন মনে রাখবেন। যাত্রীদের মধ্যে কে একজন আস্তে আস্তে এগিয়ে আসেন তাঁর দিকে। তারপর প্রায় মুখামুখি।
 
‘তু-ই, তু-ই, প্রতাপ না ?’
 
‘আ- রে, আ- রে, তু-ই তো পলাশ !’
 
মুহূর্তগুলি সবেগে দু’জনকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যেতে থাকে পিছনের দিকে। আকাশপাতাল একাকার। কত রকমের টুকটাক ঘটনা স্মৃতিতে আজও টাটকা, যদিও মাঝে কেটে গিয়েছে নয়-নয় করে অন্তত দেড়টি দশক। কৈশোর ছেড়ে যৌবনের সেই যে প্রথম দেহের ইন্ধনে…। প্রতাপ এখন যতটা সাহেবসুবো, পলাশ হাওলাদার ধুতি-পাঞ্জাবিতে ততটাই বঙ্গবাবু। কথার পিঠে কথা গড়ায়। প্রতাপ তার বর্তমান পরিচয় দিয়ে জানায়, ‘আমি এই এথম লঞ্চযাত্রী হয়ে সাগরদ্বীপে যাছি।’
 
‘আমি তো নিত্যযাত্রী রে। তুঁই কোথায় যাবি?’
 
‘অফিসের কাজ।’
 
‘কোন অফিস ?’
 
‘রুদ্রনগরের ব্যাঙ্ক ব্রাঞ্চ।’
 
‘বুঝেছি। ইনেসপেশন। আমি তো ওই ব্যাঙ্কেরই কাস্টোমার। লোন নিয়েছি।’
 
‘লোন!’
 
‘গোল্ডলোন। রুদ্রনগরে আমার নিজের একটা জুয়েলারি শপ আছে। লোনের টাকাটা ওখানেই ইনভেস্ট করেছি। ব্যাঙ্কের খাজাঞ্চিবাবুকে আমার বন্ধু বলতে পারিস।’
 
‘এর অর্থ প্রেজেন্টলি য়ু আর আ রিচ ট্রেডার। হোয়াট অ্যাবাউট য়ুর ফ্যামিলি লাইফ ? যাক গে, সে তো মোটামুটি শুনেছি। একদিন গিয়ে ঢুঁ মেরে আসবো। আমি তো ব্যাঙ্কের উড়ন্ত পক্ষী। ফ্যামিলি হয় নি। হবেও না কোনও দিন।’
 
লঞ্চ থেকে নামবার পর টের পাওয়া গেলো, সূর্য এখানেও কতটা খারদীপ্ত। সামান্য নাড়াঘাটা করলেই ঘামের স্রোত নামবে কপাল থেকে পা। পলাশ অতঃপর প্রতাপের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অবধি তো যাবে। রকমারি যান অপেক্ষমান। পাঁচ-সাত জন যাত্রীকে তুলে ভ্যান রিকশ চালাতে যে তালিম এরা পেয়েছে বা পাচ্ছে প্রতিদিন, তাতে বাহাদুরি আছে বিলক্ষণ। সাত সকালে শুরু, শেষ হতে হতে প্রায় রাত দশটা। কিছু তো যাবে সাগর দ্বীপের অন্তিম প্রান্তে কপিলমুনির আশ্রম অবধি।
 
এক টোটোচালক খাতির করে বসালেন দুজনকে। পলাশ চোখ টেপায় আর কোনও যাত্রীর ঠাই হলো না সেখানে। পরবর্তী মিনিট বারোর মধ্যে টোটো পৌঁছে দিলো ব্যাঙ্কের সামনে। কিছুতেই প্রতাপকে ভাড়া মেটাতে দিলেন না পলাশ হাওলাদার। চারিদিকে মফসল আবহ। ব্যাঙ্কের গেটকিপার পলাশকে সেলাম ঠুকলেও প্রতাপের প্রতি নিস্পৃহতা বিদ্যমান। পলাশ ঢুকে গেলেন ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে। আর প্রতাপ একমুহূর্তে চিনে নিলেন ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের চেম্বার। ব্যাঙ্কে এখানকার শাখাপ্রবন্ধক একজন চিফ ম্যানেজার। জাকিয়ে বসে কী সব আলোচনা সারছেন ব্রাঞ্চের সার্ভিস ম্যানেজার ও ফিল্ড অফিসারের সঙ্গে। এলিয়েন প্রতাপ নিজের পরিচয়পত্র দেখাতেই ব্রাঞ্চ ম্যানেজার উঠে দাঁড়িয়ে সবিনয়ে প্রতাপের দুই হাত চেপে ধরেন। অন্য দুই আফিসারও বিনয়ে বিগলিত। আপ্যায়নের প্রাথমিক সূচনা গরম কফিও জোড়া বিস্কুট দিয়ে। শাখাপ্রবন্ধক স্বয়ং গোটা ব্রাঞ্চ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। প্রাসাদোপম অট্টালিকার গোটা একতলা জুড়ে ব্যাঙ্ক। প্লাইউড ও কাচে ঘেরা কাউন্টারের সংখ্যা বিস্তর। মেশিন চললেও তাপ নিয়ন্ত্রণে নেই। গরমের ঠেলায় অধিকাংশ লোক যেন ট্রমার মধ্য দিয়ে চলেছে। সতত ব্যস্ততার মধ্যেও তিলে তিলে ধৈর্যর অণুশীলন। ক্যাশ অফিসারকে প্রৌঢ় না বলে বৃদ্ধই বলা চলে। বাণ্ডিল কয়েক বিগ ডিনোমিশেনের নোট আগলে বসে আছেন। যে যুবতী কাউন্টারে বসে পেমেন্ট সামলাচ্ছেন, তিনি রূপসী এবং কাজের চার থাকা সত্ত্বেও কাস্টোমারের সঙ্গে ব্যবহার তাঁর সন্তোষজনক। এই ব্রাঞ্চের প্রাথমিক রিপোর্ট কেমন হবে, মনে মনে তার লে-আউট এঁকে নেন প্রতাপ পানিগ্রাহী। চট করে তিনি কাউকে দোষেণ না। তাই তাঁর রিপোর্টের উপস্থাপনা অন্য ইনেসপেক্টরদের থেকে একটু আলাদা। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ফিরে গিয়েছেন তাঁর চেম্বারে। প্রতাপের সহায়করূপে ডেপুটেড ক্লার্ক – কাম – ক্যাশিয়ার হরেন গুছাইত লেগে পড়েছেন নোট গোনার কাজে, যথাসময়ে  প্রতাপের বয়ান টাইপও করবেন। পলাশের সঙ্গে ক্যাশ অফিসারে বন্ধুত্ব যে সুদৃঢ়, সেটাও অনুমান করা যাচ্ছে। পলাশের গুরুত্বও বাড়ছে পরতে পরতে, যেহেতু ইনেসপেক্টর সাহেব যে তাঁর বাল্যবন্ধু। প্রতাপের  মুখের দিকে চেয়ে পলাশের প্রশ্ন, ‘থাকবি কোথায়? বড় ব্রাঞ্চ। সব উল্টেপাল্টে দেখতে, লেখাজোকা করতে বেশ কয়েকদিন তো লাগবেই।’ প্রতাপের সহাস্য জবাব, ‘ও নিয়ে ভাবি না। তুই তো এক রকম এখানকারই লোক।’
 
পলাশ উৎসাহ দেখান, ‘অধমের এখানে যেমন একটা সোনা-রূপোর দোকান রয়েছে, তেমনি একটা ছোট পাকা বাড়িও রয়েছে। যতদিন ইচ্ছে থেকে যাবি।’
 
প্রতাপ হাসিমুখে মাথা নাড়েন, ‘আমার গুড লাক।’
 
ক্যাশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে প্রতাপ বললেন, ‘আপনার ডিপার্টমেন্টে আমার কাজ দুটো। প্রথম কাজ, গুছাইতকে দিয়ে বড় অঙ্কের নোটবাল্ডিল গুলির কিছু অংশকে গোনানো; আর আমি নিজে পরখ করবো গোল্ডলোনের অর্নামেন্টগুলির পিউরিটি এবং তাদের ডকুমেন্টস।এরপর অন্য কাজ।’ পলাশের অনভিপ্রেত মন্তব্য, ‘অর্নামেন্টের পিউরিটি নিয়ে এখানে মাথা ঘামাবার কিচ্ছু নেই। আমার দোকানের স্যাকরাকে দিয়ে সমস্ত অর্নামেন্ট বন্ধক রাখবার আগে ভেরিফাই করিয়ে থাকেন খাজাঞ্চিবাবু। সামান্য চার্জ দিতে হয়। যিনি রাখছেন, তিনিই সেটা দিয়ে থাকেন।’
 
পলাশের দিকে চেয়ে প্রতাপ চোখ ছোট করেন, ‘ব্যাঙ্ক বিজনেসের সঙ্গে ভালোই জড়িয়েছিস নিজেকে। ভালো। তবে কিছু পরীক্ষা তো আমি করবই। না হলে বিষয়টা খুব স্থূল হয়ে যাবে যে।’
 
পলাশ চলে যাবার আগে প্রতাপকে বললেন, ‘তুই কাজ কর। ব্যাঙ্কেরই কোনও স্টাফ সঙ্গত সময়ে তোকে নিয়ে যাবে আমার এখানকার বাড়িতে।’
 
একটু যেন গম্ভীর মুখে ধুতি উড়িয়ে স্যান্ডেলে শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলেন ব্যাঙ্ক থেকে পরেশ হাওলাদার। প্রতাপ ব্যাঙ্কের অফিসারকে দিয়েই ভল্টের কপাট খোলালেন। ভেতরে তিনটি আলমারিঠাসা নোটের বাণ্ডিল। আর একটি আলমারির দুটি তাকে গোল্ডলোন অ্যাকাউন্টের নাম্বারিং স্লিপসাঁটা কতগুনি গহনা রাখা কাপড়ের ব্যাগ। সবগুলিকে পরীক্ষা করবার কথা জানালেও অতি সচেতন প্রতাপের পক্ষে ‘তা’ অমূলক হতে বাধ্য। কিছু ব্যাগের পরীক্ষা হবে, কিছু ডকুমেন্টের যাবতীয় ডেটাকে খুঁটিয়ে দেখা হবে। পরে তথ্যাদি আপাতত স্থান পাবে বা চালান যাবে নির্দিষ্ট কর্তাদের কাছে ফেসবুক, টুইটার, ইনষ্টাগ্রাম ইত্যাদি মিডিয়ার মাধ্যমে। ব্যাঙ্কের তত্ত্বাবধায়করূপে প্রতাপ পানিগ্রাহীর ইমেজ উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে।
 
ক্যাশ অফিসারকে প্রশ্ন করেন প্রতাপ, ‘গোল্ডলোনের সংখ্যা কত?’
 
‘নাইনটি থ্রি টিল ডেট।’
 
‘তিন মাসে তিরানরইটি গোল্ডমোন! বিগ পারফরমেন্স!’
 
ক্যাশ অফিসারের বিনীত হাসি বিস্তারিত হয়। প্রতাপ ডকুমেন্টস্ নিয়ে ভাবিত কম। সময় লাগবে প্রতিটি গহনার ওজন ও সোনার মান নির্ণয়ে। গোটা দশেক ব্যাগে পরীক্ষা চালিয়ে প্রতাপ প্রমাণ পেলেন। ওজন একেবারে নিখুঁত। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়— প্রতিটি ব্যাগে রয়েছে এক বা একাধিক মিনে করা বালা। প্রতাপ তাঁর ব্যাগ থেকে বের করলেন তাঁর নিজস্ব টাচস্টোন বা কস্টিপাথরটিকে। বেরিয়ে এলো অ্যাসিডের সেই ছোট শিশিটাও। ভল্টের মধ্যেই আনানো হল চেয়ার টেবিল। হরেন গুছাইতের দুই চোখ চকচকে, ‘স্যার নিজেই গোল্ডের পিউরিটি টেস্ট করবেন।’
 
‘এ কাজটা আমি সব ব্রাঞ্চে নিজের হাতেই করে থাকি।’
 
— প্রতাপের কণ্ঠস্বরে গাঢ় প্রত্যয়।
 
ক্যাশ অফিসার কেঁপে কেঁপে উঠছেন। বেরিয়ে যেতে পারছেন না ভল্ট থেকে। হরেন গুছাইত নিজের হাতে ভল্টের কপাট বন্ধ করে পাহারা দিচ্ছেন যেন।
 
পানিগ্রাহী একটার পর একটা বালা বের করে টাচস্টোনে ঘষেন। স্বর্ণাভ রেখা ফুট ওঠে কালো পাথরে। সেই রঙের ওপর এক- দু ফোঁটা অ্যাসিড ফেলেন প্রতাপ। ধোয়া ওড়ে। সোনালি আভা নিশ্চিহ্ন। প্রতাপের পর্যবেক্ষণী প্রয়াস সফল। দাঁতে দাঁত ঘষে তাঁর মন্তব্য, ‘নট গোল্ড অ্যাট অল।’ সেই মন্তব্যের ধাক্কায় ক্যাশঅফিসার দেয়ালে হেলে পড়েন যেন। গুছাইত তাঁকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেন।
 
চমকের তখনও অনেকটাই বাকি। প্রতাপের নির্দেশ মোতাবেক ম্যাসেঞ্জার নিয়ে এলো এক বালতি টলটলে জল। সেই জলকে ব্যবহার করা হলো প্রতিটি বালার মধ্যকার মোমের ওজনকে জানতে। প্রতাপ গুছাইকে শোনালেন, ‘Bank এর Book of Instructions লেখা আছে, প্রতিটি বালার water weight করা দরকার As wax and water have The Same specific gravity. কিন্তু আমরা এখানে দেখছি, বালার মধ্যে মোম বা গালা নেই। এর Base metal তামা অথবা লোহা! কী সাংঘাতিক চোরামি!
 
গুছাইত এগিয়ে এসে পানিগ্রাহী স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন। ক্যাশ অফিসার দুহাতে মুখ ঢেকে বিচিত্র আওয়াজ তোলেন। হাইব্রিড আতঙ্ক ও হতাশায় খুব দ্রুত অশীতিপর হয়ে উঠছেন যেন তিনি।
 
এরপর মানসিক স্থিরতাকে দৃঢ়তর করে প্রতাপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন তিরানব্বইটি গোল্ডলোন ডকুমেন্টসকেই। প্রত্যেক লোনিকে ব্যাঙ্কের কাছে ইন্ট্রডিউস করেছেন একজনই। পলাশ হাওলাদার! এ হেন উদ্যমী পরিচয়দাতা কী কোটিতেও দুটি মেলে এই বাণিজ্যিক দুনিয়ায়?
 
‘এ কী হয়েছে ! এত বড় জালিয়াতি।’
 
— জবরদস্ত তত্ত্ববধায়ক প্রতাপ পানিগ্রাহী বিকটস্বরে আর্তনাদ করে ওঠেন। তারপর উঠে এসে গোল্ডলোনের আলমারিকে সিল করে দিলেন। ভল্টের কপাট বন্ধ করে চাবি রেখে দিলেন পকেটে। পর্দা সরিয়ে সোজা ঢুকে পড়লেন ব্রাঞ্চম্যানেজারের চেম্বারে। তাঁর কণ্ঠস্বর অনেকেই শুনতে পেলেন, ‘আমি বিকেল চারটের মধ্যেই ফিরে আসছি ব্যাঙ্কের ভিজিলেন্স ডিপার্টমেন্টের লোককে নিয়ে। সঙ্গে পুলিশও থাকতে পারে !’
 
শাখাপ্রবন্ধক কিছুক্ষণ পাথর হয়ে থাকবার পর যখন মুখ খুলনেন, ততক্ষণে গুছাইতকে নিয়ে ব্যাঙ্কের বাইরে চলে এসেছেন প্রতাপ পানিগ্রাহী।
 
লঞ্চ যখন মোহনার মধ্যপথে প্রতাপের মোবাইল বেজে ওঠে।
 
‘হ্যালো…’
 
‘আমি পলাশ রে। তোর ছোটবেলাকার বন্ধু…।’
 
মোবাইলের সুইচ অফ করে দিলেন বড় কঠিন স্বভাবের তত্ত্বাবধায়ক।
 

♦–♦–♦

 


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!