- ব | ই | চ | র্যা রোব-e-বর্ণ
- জুন ৪, ২০২৩
ভিন্নস্বরের দুই কবি

‘ভাঙা নূপুরেরা পড়ে আছে’
এ কারণেই তুঘলকাবাদে কোনও নৃত্য নেই গান নেই, কারণ শহরটি ধ্বস্ত, জাতিদাঙ্গায় আহত। তুঘলকাবাদ কি সত্যিই আমাদের স্মৃতিতে কোনও বুদবুদ তোলে? এ দেশে জাতিদাঙ্গা, ধর্মের জন্য দাঙ্গা নতুন কিছু নয় কিন্তু তুখলকাবাদ স্পর্শকাতর কবিমনে নানা অনুভূতির তরঙ্গ তোলে। এই তরঙ্গ দেশের ইতিহাসকেও ছুঁয়ে যায়। অমিতাভ গুপ্ত, বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য কবি, তুঘলকাবাদের মাটিতে লক্ষ করেন ইতিহাসের জীবাশ্ম, যেখানে সভ্যতার মিলন ঘটেছিল, আজ সেখানে “উল্কার মর্মর/ ধর্ম-অধর্ম ধর্ম-অধর্ম” সংঘর্ষে লিপ্ত। “পঁচাত্তর বছর পরও হিরোশিমা দিবসের সপ্রতিভ ভস্ম খুঁজে/ পেয়েছিল তুঘলকাবাদ”। গোলাপকাঁটার মতো শহর, “নিশীথের রাত যার পায়ে সুঘ্রানের মতো ঝরে পড়ে”, সেখানে আজ মানুষের হাতে গড়া দাবানল লক্ষ করেন কবি। কী সুন্দর মেটাফরের সাহায্য নিয়ে তিনি লেখেন—
একদিন দেবতার পথ আঁকা হয়েছিল ওই ছায়াপথে
একদিন তুঘলকাবাদের দিকে আকাশগঙ্গায় ভেসে এসেছে দেবদূত
একদিন জানাগেল তুঘলকাবাদের মতো অর্বুদ কোটি
জ্যোতির্বিন্দু দিয়ে গড়া এই নীহারিকা
একদিন ন্যাশনাল হাইওয়ের উপরে থেঁতলে গেল একগুচ্ছ ফড়িং
ভুলেযাওয়া বাকরীতির মতন শহরের পাশে গ্রামের নিঃস্তব্ধতা শানিত তিরের মতো ছুটে যাচ্ছে চারিদিকে। এরপর পাঠকেরও স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
অমিতাভ গুপ্ত / তুঘলকাবাদ/সূর্যপট প্রকাশনা
অপচ্ছায়া
না, অপচ্ছায়া লেখেননি কবি একরাম আলি, তিনি লিখেছেন ‘অপচ্ছায়’। অর্থ একই—ছায়াময় আকার, প্রেতমূর্তি। “কার অপচ্ছায় রাতের পাশে দাঁড়িয়ে?/ ভারী পর্দার ওপারে শুধু নিশ্বাসের শব্দ– ক্ষুধার্ত”, কবি অনুভব করেন। সবসময় এই যে এক অপচ্ছায়া আমাদের অনুসরণ করে, সে কি সময়ের কীট, ফুটো ফুটো করে দেয় আমাদের স্বপ্ন—“সেই স্বপ্নের কাছাকাছি যতবার গেছি/ কেঁপে উঠেছে আমাদেরই অন্তরাত্মা”। একটা সময়ে যখন পিছন ফিরে দেখি, সময়ের কীটদগ্ধ মুখ আমাদের নজরে পড়ে— প্রার্থনাকক্ষে তারা গাইছিল আনন্দগীত/ আর, পুরোহিতের ভূত সর্বক্ষণ ছিল পাহারায়”। এমন অন্তরঙ্গ কণ্ঠেই কথা বলেন একরাম। এক একটি স্তবকের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় নিস্তব্ধতা। এই স্তব্ধতা উপলব্ধির, জীবনকে ফিরে দেখার। স্তব্ধতাই জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। ১৩ নম্বর কবিতায় একরাম যখন বলেন—“পশম বিছানো ছিল, ছায়ারা অনড়/ খুনের পর স্ফীত স্তন-দুটো ঘুমে জড়ানো/ বাতাস বইছে নতুন রহস্যের ঊপর”, তখন সময়ের স্তব্ধতাই নয়, অপচ্ছায়ার নির্মমতাও লক্ষ করি আমরা। কিন্তু কখনই উচ্চকিত হন না কবি, আসলে উচ্চকিত না হওয়া কবির ধর্ম। এমন মৃদু উচ্চারণও ধারালো ও দ্বিমুখী হয়ে উঠতে পারে। স্বপ্ন দেখেন না কবি, বিশ্বাসের মুঠিও ক্রমে শিথিল হয়ে আসে। এ সময় কী অনায়াসে আমরা অপরকে দুঃখ দিতে পারি। যখন কবি বলেন—“দুঃখ একটা শব্দ/ শব্দ জিনিসটা অন্যকে দেওয়া যায়/ আমি তোমাকে দুঃখ দিলাম”। কিছু তো দিতে পারি না কাউকে, এমনকি, প্রিয়জনকেও, তখন দুঃখই দিই—“কষ্ট হলেও, পেয়েছিলামও তো কিছু!” এই উচ্চারণ শ্লেষ হয়ে পাঠকের বুকে বেঁধে। একরাম আলির মতো কবিই পারেন এমন কাব্যভাষা ব্যবহার করতে। তাঁকে ধন্যবাদ।
একরামের কবিতার শরীর আর আত্মা নিয়ে ভাবতে হবে, ভাবতে হবে তাঁর গদ্য ভাষার নির্মাণ ও বিস্তার নিয়েও। তাঁর লেখালেখির বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই । কবিতা দিয়ে শুরু। কালক্রমে গল্প উপন্যাস আর বহুমাত্রিক প্রবন্ধেও একরামের দুত্যিময় বিচরণ জাগিয়ে তোলে যে প্রগাঢ় বিশ্বাস-তা হচ্ছে এই যে, আমাদের ভাবনা চিন্তার সবটা হারায়নি, হারাবে না, একরাম আলির মতো গদ্য পদ্যের সহজ সঙ্গীরা নতুন নতুন পথ তৈরি করে নিরন্তর শিল্প শর্ত বাতলে দিচ্ছেন। বসে নেই। নিঃসময়ের বন্ধুরা জাগ্রত।
একরাম আলি/ অপচ্ছায়/ আক্ষরিক প্রকাশনী
❤ Support Us