- ব | ই | চ | র্যা রোব-e-বর্ণ
- জুন ২৩, ২০২৪
দুই কবি এবং তাঁদের পৃথিবী

নিজেকে নিঃস্ব করার কথকতা
কবির কথকতায় উৎসারিত হয়— সত্তার শুদ্ধ উচ্চারণ, অনুভূতির গাঢ় বোধ ; উপলব্ধির সাত্ত্বিক প্রকাশ। কবি তিল তিল করে নিজেকে নিঃস্ব করে পালাগানের যাপনসুখ দিয়ে যান পাঠকের অন্তরে । প্রকৃত পাঠককেও সময়ের অবক্ষয় বুকে নিয়ে কবি চেতনায় সামিল হতে হয় স্বেচ্ছায় । আর তখন কবি ও পাঠক দু’পক্ষই বলতে পারেন – ‘তুমি ও তোমার প্রশ্ন উভয়েই রক্তকমলের মত/ওই বিদ্যুৎধর্মী মেঘ, ও যেন ভ্রমর / ডানায় সোনার ধান’। সারা জীবন ধরে এভাবেই ‘জীবন ও মৃত্যু’ — এই দুই অনুভবের বোধ ও বোধিতে ভর করে অবিরাম সৃষ্টির কথকতা নির্মাণ করেছেন কবি অমিতাভ গুপ্ত।
মার্কসীয় দর্শন প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। বামপন্থায় বিশ্বাসী হওয়া তখনই সম্ভব, যখন সাম্যময় মানবপ্রীতির প্রতি গভীর আনুগত্য থাকে। যেখানে সে আদর্শ বিনষ্ট হয়ে যায়, সেখানে মানবকল্যাণ সম্ভব হয় না। তখন সংবেদনশীল মানুষের মন বিষন্ন হয়। এদেশে এ বিষন্ন ক্লান্তি অনুভব করেছেন একাধিক কবি। যদিও অমিতাভ গুপ্ত জীবন ও যাপন দিয়ে মার্কসীয় দর্শন ও আদর্শ পালন করেছেন। তাই নিজের কাছে নিজে কখনও হেরে যাননি। একইসঙ্গে, “বাংলা সাহিত্যের ইউরোকেন্দ্রিক অবক্ষয়ী আধুনিকতার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ‘উত্তর আধুনিক চেতনা’ ভাবধারাটির অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। ভারতীয় সংস্কৃতির গভীরে তাঁর চেতনা নিহিত। সমকালীন ছিন্নমস্তা সময় তাঁকে ব্যথিত করলেও ‘সূর্য অনুসারী’ এই তাপসের অগ্নিপূত হৃদয় মানবতার সাধনায় ধ্যানমগ্ন”। অবশ্য কবির ‘সময়ের যন্ত্রণা’ ও ‘মানবতার আত্মময়তা’ অনুভব করতে হলে কবিতাগুলি একাধিকবার পড়তে হয়। বিশেষ করে চিত্রকল্পের ব্যবহারকে বুঝতে না পারলে কবিতার মর্মে পৌঁছানো মুশকিল।
অমিতাভ গুপ্তের ‘নির্বাচিত কবিতাপ্রয়াস’(১৯৬৫-২০১৯) এবং ‘আধেকমুক্ত রজনীগন্ধা’ বই দু’টির নাম আলাদা হলেও কবিতাগুলি প্রায় একই। প্রথমটির প্রথম প্রকাশ ২০১৫ তে। তৃতীয় সংস্করণে (জানুয়ারি ২০২০) “এ্কসহস্র একটি কবিতা (১৯৯৩)” এর ১৪ টি কবিতা সংযুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়। আবার, এপ্রিল ২০১৮ তে প্রকাশিত ‘আধেকমুক্ত রজনীগন্ধা’ কাব্যসংকলনে কাব্যগ্রন্থটি (“এ্কসহস্র একটি কবিতা ১৯৯৩”) প্রকাশিত হয়নি। ‘এই গ্রন্থের ভূমিকা হিসেবে একটি ক্ষুদ্র কবিতাপুঁথি (জননীভাষার কাছে) এবারই প্রথম পুনর্মুদ্রিত হল’। অতএব দু’টি সংকলনে প্রথমটিতে স্বতন্ত্র ১৮টি কবিতা এবং দ্বিতীয়টিতে বাংলা ভাষার কাছে প্রগাঢ় ভালোবাসা নিয়ে ১৪টি কবিতা সংযোজন করেছেন। ‘আধেকমুক্ত রজনীগন্ধা’-র নিবেদন অংশে কবি চমৎকার লিখেছেন—“খসড়া থেকে পাণ্ডুলিপি, পাণ্ডুলিপি থেকে পত্র পত্রিকা, পত্রপত্রিকা থেকে পুঁথি, পুঁথি থেকে সংকলন – এই অভিসারে একাধিক কবিতাপ্রয়াসে বর্জন-পরিমার্জন ঘটেছে। কোনও কোনও শিরোনাম পরিবর্তন করা হয়েছে”। সার্থক সংকলন হয়ে ওঠার এই অভিসার গ্রন্থদুটিকে ভারমুক্ত করেছে। কবির চিন্তার সচল গভীরতা বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। অবশ্য দীর্ঘ সময়ের এই পথ পরিক্রমার মধ্যে চেতনার রঙ মাঝে মাঝে পরিবর্তন হলেও কবিতার রীতি প্রকৃতির খুব বেশি বাঁকবদল হয়নি। এই যেমন, ১৯৮৭ তে প্রকাশিত ‘খরা ও যমুনা’ কাব্যের ‘স্বেচ্ছা’ কবিতায় তরুণ কবিদের কাছে প্রত্যাশা অথবা কবির স্বপ্ন —
‘তরুণ কবিরা যেন তোমার সমস্ত মুখ জলে ধুয়ে দেয়/ তরুণ কবিরা যেন বালি খুঁড়ে জলাশয় টানে’/
জীবন অভিজ্ঞতা নিবিড় ও ব্যাপ্ত হয়ে সে স্বপ্ন উচ্চারিত হয় ২০১৭ এ লেখা ‘স্পর্শে বিষ নেই’ কাব্যের ‘ ওঁ’ কবিতায় –
কবি হয়ে এ বাংলায় জন্ম নিলে আমৃত্যু ভূমিষ্ঠ প্রণাম/ এবং ঈষৎ শবসাধনার প্রয়োজন, ক্ষিপ্রতম পাখির মতন/ যে আকাশ যেসব প্রতিমা দ্রুত অন্তর্নিহিত/ বাক্যের পূর্বাপরে,কবি, তুমি তার/ যজ্ঞ ও ঋত্বিক, তুমি অগ্নি, তুমি স্বাহা, তুমি সমিধ
চিত্রকল্পগুলির এই গভীরতা অনুভব করতে পারলে কবির চেতনাকে হয়তো কিছুটা ছোঁয়া যায়।
জীবন অনুভবের জন্য এবং জীবনের কথা অনুভব করানোর জন্য ইন্দ্রিয় সুখকর স্থূল শব্দের প্রয়োজন হয় না। শব্দের শুদ্ধতায় ভাবনার কথা শিল্পময় হয়ে ধীর লয়ে প্রকাশিত হতে পারে। অন্তত, অমিতাভ গুপ্তের এই কাব্য সংকলন দুটি পড়লে এরকম প্রতীতি হয়। তাঁর কবিতায় একবার স্বাদ পেলে বিস্বাদ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাঁর কবিতায় একটা নিঃশব্দ গতি আছে। নিঃশব্দ তো ঈশ্বরের ভাষা, কেবল উপলব্ধি করতে হয় শান্ত ধ্যানের ঐকান্তিকতায়। ভালো কবিতাপাঠের আস্বাদনে এই ধ্যানের প্রয়োজন হয়। অমিতাভ গুপ্তের কবিতায় ভোরের আলো যখন রাঙা হয় কিংবা জ্যোৎস্নার আলো বিলম্বিত লয়ে দূর দিগন্তচারী হতে থাকে, তখন প্রজ্ঞার আকুতি জাগিয়ে রাখে আমাদের।

• নির্বাচিত কবিতাপ্রয়াস, ১৯৬৫ থেকে ২০১৯। আপনপাঠ, কলকাতা । ₹ ২৭৫ • আধেকমুক্ত রজনীগন্ধা । খড়িমাটি প্রকাশন, চট্টগ্রাম । ২৫০ টাকা
তাঁর প্রতিবাদ ও প্রত্যাশার কথা কখনও উপদেশ বা বক্তৃতার মতো বলেন না। বলেন ‘কবি’র মতে। জীবনানন্দ দাশ যে প্রত্যয়ে বলতে পারেন — “মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময়চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো; কবিতা লিখবার পথে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই এ আমি বুঝেছি, গ্রহণ করেছি। এর থেকে বিচ্যুতির কোনো মানে নেই আমার কাছে। তবে সময়চেতনার নতুন মূল্য আবিষ্কৃত হতে পারে”। (কবিতার কথা, ৮ম সংস্করণ,সিগনেট প্রেস, পৃ ৪৩) কবি অমিতাভ গুপ্তের কবিতা সম্পর্কে একথা বলা যায়। এবং এও সত্য যে ‘সময়চেতনার নতুন মূল্য’ নির্মাণ করেছেন তিনি তাঁর কবিতায়। যখন লেখেন – “ মোরগের গলা মুচড়ে একটা টকটকে লাল সকাল বেরিয়ে এল” (অনেকে, আলো,১৯৭০) তখন একই সঙ্গে প্রত্যাশা, প্রতিবাদ, বিশেষ তত্ত্ব এবং সময়চেতনার প্রকাশ ঘটে। একই কাব্যের ‘যাই’ কবিতায় তিনি লিখেছেন — গলার কাছে একটা লাল টকটকে দাগ রয়ে গেছে, লোকে বলে/ তৃষ্ণা, আর / শরীরের চিহ্ন দেখে চেনা নাকি ভীষণ সহজ। এই “ টকটকে লাল’’ একেবারে ভিন্ন তাৎপর্যে উপস্থাপিত ।
অমিতাভ গুপ্তের কবিতার একটা বড় গুণ – তাঁর বৈদগ্ধ। তাঁর চিন্তার জগৎ দ্রুত দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বময়, কাল আতিক্রম করে পুরোনো ও পুরাণ কালে চলে যায়, পাঠককে আনন্দিত ও যুগপৎ বোধে নিয়ে যেতে পারে। এই যেমন—
শুধু এইটুকু জানি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাঝখানে/ ফাল্গুনীপূর্ণিমার/ একটি অথবা দুটি মাঠ পড়ে আছে/ কেউ কেউ বলে এই মাঠে মাঠে ভেসে যায়/ শব সাধনার শেষে কৃষানের শ্যামাঙ্গ শ্মশান
শুধু এইটুকু জানি আবার চৈত্রের শেষে/ মহুয়ার রক্তমুখ কুঁড়ি/ শ্রীমতীর আঁচলে ছড়িয়ে পড়ে সন্ধ্যাগোধূলির চন্দ্রাভায়
সময়, সমকাল ও জীবন পুরাণ প্রয়োগের বহুমাত্রিকতায় আশ্চর্য শিল্প রূপময় সম্পূর্ণ কবিতা হয়ে উঠেছে।
দু’টি সংকলনেরই প্রচ্ছদ খুবই পরিচ্ছন্ন। ‘আধেকমুক্ত রজনীগন্ধা’য় প্রচ্ছদ শিল্পী খালিদ আহসান জ্যামিতিক শৈলীতে জীবনের সঙ্গ-নিঃসঙ্গ কথকতাকে দুটি অবয়বের মুখোমুখি অথচ দুরত্বের তরঙ্গায়িত ভঙ্গিতে চমৎকার ধরেছেন। মিশে গেছে কবির অনুভবের সঙ্গে – ‘কতদিন আগে তুমি বলেছিলে দুঃখ দিয়ে যাবে/দুঃখের প্রতিটি বিষ বিকশিত হল…’ তবু অমিতাভ গুপ্ত দুঃখের ভার বুকে নিয়ে অবিরাম চলতে জানেন। আর চলতে চলতে বলেন—‘গভীর উদ্দেশ্যবোধ বুকে নিয়ে ফিরে যেতে পারি/ যেহেতু প্রতিটি বোধ থেকে আজ বোধাতীত/ উদ্দেশ্যবিহীন বেজে ওঠে।
জীবন ও স্বপ্নের আলো–আঁধারের সংলাপ
কবিতার মধ্যে দিয়ে সে সব কথা বলা হয়, যে কথা স্পষ্ট করে বলা সম্ভব হয় নয় প্রাত্যহিক জীবনে। সামাজিক জীবনেও অবিরাম ভালো–মন্দ, সত্য–অসত্য, ন্যায়–অন্যায়, আঘাত–প্রত্যাঘাত, এমন পাশাপাশি চলে যে, সহজে আলাদা করা যায় না। তার উপর বিষয়গুলি এত আপেক্ষিক যে, সহজ–সত্যকে আলাদা করে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না সব সময়। এই কারণে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীকে কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়।
ছন্দ, অলংকার, চিত্রকল্প, ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করতে হয় সৃষ্টিকে। ধীরে ধীরে নির্মাণ হয়ে ওঠে কবিতা–গল্প–ছবি অথবা শিল্পের বিচিত্র বৈভব। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কবি বা স্রষ্টাকে সত্তার সেই শুদ্ধ উচ্চারণে পৌঁছাতে হলে সময় লাগে, সাধনার প্রয়োজন হয়। কেউ কেউ সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন আবার অনেকেই হয়তো পৌঁছাতে পারেন না প্রার্থিত লক্ষ্যে। কিন্তু যখন তিনি সৃষ্টি করেন সেই সৃষ্টির মুহূর্তে তাঁর সত্তা, তাঁর হৃদয় অনুভূতি জীবনের প্রতি, মানুষের প্রতি, পরিপূর্ণরূপে নিবেদিত হয়। প্রকাশিত হয় বা উচ্চারিত হয় কবিতার এক একটা মুহূর্ত।
কবির অনুভূতি কালের সীমায় বাঁধা থাকে না, চিরকালের সহজ মাটির রসে ভর করে পাতায়, ফুলে ও ফলে সে আনন্দ উৎসারিত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেবল পাল্টে যায় ভাষারীতি ও প্রকাশশৈলি। কবিতার সে রস আস্বাদন করেন পাঠক। অবশ্য সেক্ষেত্রে পাঠকের পাঠ–অনুভূতির উপর নির্ভর করে পাঠ–প্রতিক্রিয়া। একাধিক অভিমত থাকলেও, কবিকে বুঝতে পারলে তাঁর কবিতা উপলব্ধি করা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। এই যেমন রবীন্দ্র–অনুরাগী, মানবধর্মে বিশ্বাসী কবি সৈয়দ কওসর জামালের শান্ত–স্নিগ্ধ জীবন–যাপন তাঁর কবিতার আবহকে চিনিয়ে দেয়। তাঁর কবিতাগুলি পাঠ করলে ( আমার পক্ষে যতটা পড়া সম্ভব হয়েছে) একটি বিশেষ প্রবনতা (বিচিত্র ভাবের মধ্যে একটি) লক্ষ করা যায় – আত্মবিশ্লেষনের পথ ধরে আত্মশুদ্ধির তৃপ্তি। এই তৃপ্তি কবির সত্তাকে ক্লান্তি অতিক্রম করে আবার এগিয়ে চলার প্রেরণা দেয়। কবি যখন লেখেন – ‘আমার কবিতা কেমন তার উত্তরে বলব – আমি যেমন। একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়ে যায়। আসলে স্পষ্ট করে দেখলে আমিই তো সব – আমার প্রতিটি মুদ্রাদোষ, প্রতিটি নুয়ে থাকা পদক্ষেপ, প্রতিটি সুখ ও দুঃখ, ব্যর্থতা এরাই তো আমার কবিতায় ভর করে আছে । … আমার কবিতা জাগতিক অভিজ্ঞতার চেয়ে বেশি চেনে আমার কবিস্বভাবকে, ছিঁটেফোটা যদি কল্পনাবৃত্তি আমার মধ্যে থেকে থাকে, তাকে’। (কবির জগৎ কবিতার জগৎ ) কবির এই ভাবনাকে সহজ অর্থে গ্রহণ করলে তাঁর কবিতা বুঝতে অসুবিধা হবে। কবি যখন প্রাবন্ধিক হয়ে আত্মবিশ্লেষণ করেন, তখন তাঁর পক্ষে নিজেকে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে কবিতা লেখার সময় কবি যে চেতনার স্তরে অন্তর্লীন হয়ে যান, যে ভাবের মগ্নতায় ডুবে যান – প্রবন্ধ লেখার সময় সে বোধানুভূতিকে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। ‘আমি যেমন’ আমার কবিতা তেমনই – এর মধ্যে সত্য আছে , তবে ‘অধিকতর সত্য’ আরও গভীর ও ব্যাপ্ত। ব্যক্তিগত সুখ,দুঃখ, ব্যর্থতা,আনন্দ অতিক্রম করে যায় বলেই আমাদের মত পাঠকের তৃপ্তি জাগে। তাই প্রবন্ধ লেখার সময়, কবির পক্ষে সবসময় সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়না যে তাঁর সৃষ্টি, ‘স্বপ্ন, নির্মাণ ও পরিকল্পনা আসলে কতটা আত্মতাড়না আর কতটা অনুশীলন। কবির কবিতা চিরকালই, সমকালকে ছুঁয়ে ভাবীকালের অভিমুখে এগিয়ে চলে। আর যে কবিতা যতবেশি আগামীপাঠকদের রসাস্বাদনে আনন্দ দেয়, সে সৃষ্টি তত বেশি দিন বেঁচে থাকে। সে বিচার কালের কাছে ছেড়ে দিতে হয়। আমরা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে দেখার চেষ্টা করব সৈয়দ কওসর জামালের নির্বাচিত কবিতায় সময়, সমাজ ও জীবনের সুর শিল্পের সুচারু বুননে কতখানি সহজ জীবন রসসিক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর এই নির্বাচিত কবিতা সংকলনে ১০টি প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ থেকে ১৪৮ টি কবিতা এবং অগ্রন্থিত কাব্য ‘হাইওয়ে চতুর্দশপদী’র ১১টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি সাজানো হয়েছে একটু অন্যভাবে। সাধারণত, কালানুক্রমিক সাজানোর রীতি। এখানে ১০টি কাব্যের শেষ প্রকাশিত কাব্যটির কবিতা আগে, এরপর ৯ম কাব্যের কবিতা, ক্রমে ক্রমে প্রথম প্রকাশিত কাব্য ‘নষ্ট অরণ্যে ইউক্যালিপটাস’ এর কবিতা। কবিতার জগতে আত্মমগ্ন হতে হতে ক্রমশ কবিতাকে আশ্রয় করে একটা নিজস্ব ভাবনা ও নির্মাণের বিচরণ ক্ষেত্র তৈরি করে নিয়েছেন। কবির কথায় – “একটি পত্রিকা – ‘সময়’ সম্পাদক উৎপলকুমার গুপ্ত, শহর বহরমপুর, আমাকে প্ররোচিত করেছে কবিতার দিকে হাঁটতে। গল্প নয়, কবিতাই আমার আশ্রয় হতে পারে। এতদিন ধরে সেই ১৯৬৯ থেকে আজ অব্দি কবিতাই তো আমার আশ্রয় হয়ে আছে”। এই আলোচনাটি লেখার আগে কবির সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনুভব করেছি কবিতা–প্রাণ সহৃদয় মানুষটি কবিতার জগতে ডুবে আছেন। অবিরল স্বপ্ন দেখেন —
‘কতকাল জেগে আছে শব্দগুলো আকাশের নীচে / রোদজল ঝড়বৃষ্টি পেরিয়ে পেরিয়ে / তাঁদের এ বেঁচে থাকা আলোর সন্ধানে
কবির স্বপ্ন এই, নাম মুছে যাক, কালো অক্ষরেরা যেন প্রাণে আলো জ্বালায়। কবিতার কথা ও ভাব ‘স্বপ্ন আর স্বপ্নহীনতার বিস্ময়ের বোধ যেন মেঘ ও রৌদ্রের খেলা’ হয়ে মুগ্ধ করে কবিতার পাঠকদের।
কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন – “সময় ও পৃথিবী অভিজ্ঞতার আধার। কবিও সঞ্চয়ী। কিন্তু তার আনীত অভিজ্ঞতা কতখানি সার্বিক, কতখানি তাঁর নিজের এবং নিজের অভিজ্ঞতাকে কতদূর অপরের করে তুলতে যায় – সকলকে না হোক, অনেককেই পরিদীকক্ষিত করতে পারা যায় নিজের মূল্যজ্ঞানের চেতনায় – এ দায়িত্ব কবির”। ( কবিতার কথা, মাত্রাচেতনা, পৃ–৩১) কবি সৈয়দ কওসর জামাল দীর্ঘকাল ধরে নিজের অভিজ্ঞতাকে অনেকের মধ্যে একাত্ম করতে পেরেছেন। তাঁর কবিতায় সমাজের যূথচারী মানুষের সুখ–দুঃখ, প্রেম–বিরহ, আনন্দ–বিষাদ একটা নিজস্ব ও পরিমিত শিল্পরীতিতে প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণ জীবনের প্রতি সুগভীর প্রীতিতে সহজ বাক্যবন্ধে তিনি যেমন লেখেন – ‘সাগর ওগো, সাগর জলরাশি/ফিরিয়ে দাও জেলেপাড়ার হাসি’। আবার সমুদ্র ঢেউ ও সময়ের ঢেউয়ে কাঁকড়া ও মানুষের জীবনের ওঠাপড়া একাকার হয়ে যায় এইসব পঙতিতে –
‘ একটু দূরে ঢেউ ভেঙে পড়ছে বালিতটে / পুনরায় আসে ফিরে যায় জলস্রোত হয়ে, / লাল কাঁকড়াগুলো যেই দাঁড়াবার চেষ্টা করে/ হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যায়, আবার দাঁড়াতে চায় / মানুষের মতো / তাদের স্বপ্নের ওই হাঁটাপথ গোধূলির আলো মেখে / উদ্ভাসিত হল / পুনরায় ভাঙ্গে ঘর ঢেউ এসে স্বপ্ন ভেঙে দেয় / গভীর সমুদ্র থেকে, ভূ–পৃষ্ঠের অন্য পার থেকে / একই কথা বয়ে আনে ঢেউ
কবি যেন জীবনের ভাঙ্গা গড়ার স্পষ্ট লেখালেখ্য এঁকে দেন কবিতার এই লাইনগুলোর মধ্যে। জীবন অভিজ্ঞতার ছোট ছোট ঘটনা সমষ্টিগত জীবনের সঙ্গে এভাবে একাকার হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথে গভীর অনুরাগী কবি বিশ্বাস করতেন প্রতিদিনের সংসারের ‘আমি’ কেবল চেষ্টা করতে পারে মাত্র, অন্তরলোকে নিত্য যে বড় আমির বাস সেই লিখিয়ে নেন কবিকে দিয়েই। তাই তিনি লিখতে পারেন—
লেখা অসম্পূর্ণ রেখে গেলে / অশরীরী কোনও হাত তুলে নেয় লেখার কলম / পাতার বাকিটা ভরে যায়… / লেখা আর আমার থাকে না।
বহুবছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাহিত্য’ গ্রন্থে একথাই লিখেছিলেন – ‘মানুষের হৃদয়ও সাহিত্যে আপনাকে সৃজন করিবার, ব্যক্ত করিবার চেষ্টা করিতেছে। এই চেষ্টার অন্ত নাই, ইহা বিচিত্র। কবিগণ মানব হৃদয়ের এই চিরন্তন চেষ্টার উপলক্ষমাত্র। … ভগবানের আনন্দসৃষ্টি আপনার মধ্য হইতে আপনি উৎসারিত; মানবহৃদয়ের আনন্দসৃষ্টি তাহারই প্রতিধ্বনি। বহিঃসৃষ্টি যেমন তাহার ভালোমন্দ তাহার অসম্পূর্ণতা লইয়া চিরদিন ব্যক্ত হইবার চেষ্টা করিতেছে, এই বাণীও তেমনি দেশে দেশে ভাষায় ভাষায়, আমাদের অন্তর হইতে বাহির হইবার জন্য নিয়ত চেষ্টা করিতেছে’।(সাহিত্যের তাৎপর্য) কবি সৈয়দ জামালের কবিতায় বরাবর মানুষের হৃদয়ের কথা উচ্চারিত হয়েছে।
প্রকৃতির সঙ্গে কবি একাত্ম হতে চেয়েছেন বারবার। শুদ্ধ প্রকৃতির কথা তাঁর কবিতায় যেমন এসেছে, তেমনি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষকে একাকার করে দেখেছেন বহুক্ষেত্রে। তাই অনায়াসে বলতে পারেন—‘তেমনভাবে কাছে দাঁড়ালে গাছও নাকি মানুষের মত কথা কয়/ কেউ কেউ শুনেছে চাপা কন্ঠে তার স্থবির থাকার দুঃখবেদনা’। আসলে মানুষের সঙ্গে গাছের তো তেমন কোনো পার্থক্য নেই, অবিরাম আহত হতে হতে বেঁচে থাকে। প্রতিনিয়ত গাছের ডালপালা কেটে দেয়া হয়, ছিঁড়ে নেয়া হয় ফুল–ফল। তবুও সে নীরবে কেবলই দিয়ে যায়। আমাদের সমাজে সংবেদনশীল, মানবদরদী মানুষ, তাঁরাও এই গাছেরই মত অবিরাম দিয়ে যান। তবুও সমাজ থেকে আঘাতের পর আঘাত আসে। আহত হতে হতে এক সময় মনে হয়—
একজীবন যেন আমি বসিয়েছি শবব্যবচ্ছেদে/ প্রতিটি রক্তের ফোঁটা চেয়েছে অমৃতস্বাদ/ প্রতিটি হাড়ের টুকরো সুবর্ণকঙ্কণ হয়ে বাজতে চেয়েছিল/ ও আগুন, শেষ অব্দি সব ছাই করে দিয়ে গেলে ?
অবশ্য জীবনে দুঃখ তো আছেই, মৃত্যুও আছে। তবু প্রেম আছে, আনন্দ আছে। মুহূর্তের সেই আনন্দ, প্রেম, আত্মনিবেদন, ভালোবাসা ও প্রীতি বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে। তাই কবি বলতে পারেন— এক একটা দীর্ঘ দিন প্রেমপত্রের পাতা হয়ে জাগিয়ে রেখেছে।
আসলে ঝড় তো ছিল প্রেমে–পড়া মেয়েটির মতো / আর রাত প্রেমিক যুবাটি।

• নির্বাচিত কবিতা। আলোপৃথিবী, কলকাতা । ₹ ৪৫০
তবু ঝড় একদিন থেমে যায়। জীবনের দীর্ঘ পথ অতিক্রান্ত হয় ধীর লয়ে। এগিয়ে যেতে যেতে আমরা একদিন উচ্চারণ করি – ‘বৃদ্ধ নাবিকের মত ধীর নৌকো বেয়ে আমি ক্রমশ এগোই’। এই এগিয়ে চলার মন্ত্রই কবির পাথেয়। কবি তো থামতে জানেন না; কবি কেবলই চলেন, আর চলতে চলতে বলেন – “আমাকে ভয় দেখিও না বিষাদ, অনেক স্রোত পেরিয়ে এসেছি…” তারপর মাটি থেকে আকাশ, আকাশ থেকে সুদূর মহাকাশে যেখানে অশ্রু মেঘ হয়ে মিলিয়ে যায় দূরে… বহু দূরে… মহাজাগতিক লোক।
♦•⋅—♦•⋅♦•⋅—♦•⋅♦•⋅—♦•⋅
লেখক পরিচিতি: মনোরঞ্জন সরদার বঙ্গবাসী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। পথ পত্রিকার সম্পাদক
❤ Support Us