- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- এপ্রিল ১৪, ২০২৪
ধারাবাহিক: ভোর ভয়ি । পর্ব ১
অলঙ্করণ: দেব সরকার
বায়োস্কোপের বাকসো। রঙের নকশা চটে খসে এখানে-ওখানে বেরিয়ে পড়েছে মৃত্যু-প্রস্তাব। বাকসোর গোল জানালার ঢাকনা কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। চোখের পর্দায় আসে শূন্য খেয়াঘাট, দূরে দূরে সবল ডানার চিল, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, আরও কত রক্ত চাই তব প্রীতি তরে, ধানের ক্ষেতে মশাল আগুন, লকআপের আর্তনাদে বাতাস কাঁপে, শিক্ষকদের চেয়ারে ভাঙনের শব্দ, রং ও রেখায় জাগে পুরাণপ্রতিমা, উন্নয়ন আর উৎসব শুষে খায় জলাভূমি, কুয়াশার ওপারে পলিথিনে মোড়া চাঁদ, জোড়া চোখ ঘটনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাঁতরায়, দূরে কোথাও আগুনবরণ আকাশে বাজে ‘ভোর ভয়ি’।
প্রথম পর্ব
মনে আছে, কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে জামাকাপড়ের দোকান৷ হ্যাঁ, সেই মার্কেট যা ‘বর্ণপরিচয়’ নামে পেল্লায় মল হতে গিয়ে কীভাবে যেন এক টুকরো মোহেনজোদড়ো হয়ে থমকে আছে৷ দোকানটির নাম ছিল ‘জয়গুরু বস্ত্রালয়’৷ হয়তো আজও আছে অন্য চেহারায়৷ সেদিন দু-ফুট কি আড়াই ফুট উঁচু বেদি মতন জায়গায় গদি পেতে বসেছিলেন বস্ত্রালয়ের মালিক৷ হাড্ডিপ্রধান শরীর, মাথায় বাবরি৷ তিনদিকে শো-কেসে জামা-প্যান্ট ছোটোদের বড়োদের, বুকে রঙিন সুতোর কাজ-করা সাদা পাঞ্জাবি ঝুলছে, ডানদিকে মেঝেয় কয়েক থাক লুঙি৷ দোকানের সামনে দু-টো বেঞ্চ৷ বাবাকে দেখে বস্ত্রালয়ের মালিক বলেন, আসেন, পালবাবু! কতদিন বাদে আইলেন৷ এই বেঞ্চিটায় বসেন৷ ওইটার পায়া লড়ে (নড়ে)৷ কয়টা পেরেক ঠুকতে হইব৷ সময় পাইনা৷ একহাতে সব৷ সংসার, দোকান৷ মাইয়ার সংসারও দেখতে হয়৷ জামাইবাবাজি হাজারিবাগে৷ ওইখানে কারখানায় কাম পাইছে৷ মাসে একবার আসে৷ বড়ো পোলারে কত কই দোকানে বইতে৷ অর নাকি মন বসে না৷ চাকরি করবে সে৷ বাদ দেন৷ আমাকে বললেন, তুমি আমার পাশে বসো, বাবু৷ কী নিবা?
জবাবে বাবাবলল, একটা ফুলপ্যান্ট দেন৷ কলেজে ভরতি হইছে৷ বস্ত্রালয়ের মালিক বলেন, বাহ্ বাহ্৷ কী রং দিমু? বাবা বলল, ময়লা হইলে য্যান্ বুঝা না যায়৷
বস্ত্রালয়ের মালিক উঠে দাঁড়ান৷ একটা শো-কেস খোলেন৷ বলেন, একখান জব্বর জিনিস দেই৷ দাম নিয়া কথা নাই৷ আগে জিনিস দেখেন৷ তিনটে প্যান্ট নামিয়ে তিনি বসেন৷ একবার খাড়াও তো, বাবু৷ মাপে এক্কেরে ঠিক৷ রোগা হইলে এইটা সুবিধা৷ মোটা কোমরে ফিটিংয়ে সমস্যা হয়৷ তইলে ডিপ বুলুটা দেই৷ অরবিন্দের কাপড়৷ একনম্বর জিনিস৷ ধারে-কাছে কেউ লাগে না৷ বন্ধুরা চাইয়া থাকব৷ শার্ট দেখামু?
বাবা বলল, শার্ট আছে৷ পরে নিমু৷ বাবা কেন এমন বলল তখন বুঝিনি৷ শার্ট কেনারও কথা তো৷ চুপ করে থাকি৷ কিছু বলা বারণ৷ শো-কেস থেকে যে তিনটে প্যান্ট নামানো হল, তার মধ্যে আকাশিটা আমার পছন্দের ছিল৷ চুপ থেকেছি৷ বললে হয়তো শুনতে হত, বেশি বুঝ তুমি? নিজের রোজগারে পছন্দ ফলাইয়ো৷ আমি কী পরি? সস্তা খাদি৷ তোমার মায়ে কী পরে? সস্তা ছাপা শাড়ি৷ ফুটপাথের৷ বাবা বলল, দাম কত কইলেন য্যান্? বত্রিশ টাকা? অনেক বেশি৷ পঁচিশ করেন৷ এখন দশটাকা ধরেন৷ বাকিটা খাতায় লেইখা রাখেন৷
বস্ত্রালয়ের মালিক প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করেন৷ পাসিং শো৷ বলেন, অত লাভ নাই, পালবাবু৷ ম্যাচিস দিমু? কমপিটিশনের বাজার৷ লোকে সস্তা খুঁজতে অখন ধর্মতলায় যায়৷ আপনেগো আত্মীয়ে ময়দান মার্কেটে দোকান পাইছে? আগে ফুটপাথে বসত৷ তাগোরে জিগাইয়েন৷ সবই তো জানেন৷ লম্বা টানের ধোঁয়া উড়িয়ে বস্ত্রালয়ের মালিক বলেন, সুযোগ আমিও পাইছিলাম৷ বিধান রায়ে যখন দোকান দিতাছে, একজন কইছিল৷ রিফিউজি ডিপার্টমেন্টে তার জানাশুনা আছে নাকি৷ দুইশো টাকা মুখমিষ্টি চাইল৷ দিতে পারি নাই৷ কেউ ধার দেয় নাই৷ দেইখেন, ময়দানে ব্যাবসা খুব জমব৷
বারান্দা পেরোনোর সময় ছেলেমেয়েদের দেখি, ঝকঝকে চোখমুখ, সুন্দর সম্ভ্রান্ত পোশাকআশাক, তাদের হাঁটাচলা কথাবলা আমাদের পাড়ার থেকে একদম আলাদা৷ লম্বা পায়ে বেরিয়ে এসে ট্রামলাইনের ওপারে থেমে আরেকবার কলেজের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম, এখানে আমি শুধু বেমানান নই, ঠাট্টা-মশকরার পাত্র হব
সুতোয় বাঁধা ভাঁজ-করা লালখাতা বের করে বস্ত্রালয়ের মলিক বলেন, পুরানা ধার আছে৷ সতেরো টাকা৷ বেশিদিন ফালাইয়া রাখতে পারি না আর৷ বাজার ভালো না৷ তার উপর ভাইয়েরা কইতাছে ইন্ডিয়ায় চইলা আইব৷ যুদ্ধের পর পাকিস্তানে হিন্দুগো থাকনের উপায় নাই৷ (১৯৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধ) বস্ত্রালয়ের মালিক উঠে দাঁড়ান৷ শো-কেসে প্যান্ট দুটো রাখেন৷ বলেন, কিন্তু আইয়া করব কী ? খাইব কী ? আমাগো পাশের গ্রামের ছেলে অবিনাশ চইলা আসছে তিনমাস হইল৷ কোথাও কাম পায় নাই৷ তারে ডাবপট্টির পাশে ফুটপাথে পোলাপানগো ছিটের জামা-প্যান্ট দিয়া বসাইছি৷ আপনেগো প্রেস লাইনে যদি কোনো কাম হয় কইয়েন৷ ভাইয়ে বিদেশে পইড়া থাকলে কার না চিন্তা হয়৷ ছেলে-মেয়ে বড়ো হইতাছে৷ অ্যাশ-ট্রে থেকে আধখানা জ্বলন্ত সিগারেট তুলে টান দিয়ে বলেন, কী যে সময় আইল!
দোকানের টিনের ঝাঁপে কী যেন আছড়ে পড়েছিল৷ চমকে উঠেছিলাম৷
বস্ত্রালয়ের মালিক বলেন, পায়রা৷ নিজেগো মইধ্যে খটাখটি কইরা জড়াইয়া মরাইয়া পড়ে৷ ম্যালা পায়রা৷ বাজার ভরতি৷ ময়লা করে৷ কারোরে কওনের নাই৷ কওনের কেউ নাই৷ পুরানা বাজারের যত খোপখাপ চিপাচুপি আছে সব পায়রার বাসা৷ মাথা সামলাইয়া যাইয়েন, পালবাবু৷ ওইদিকের ঝাঁপের হুক খুইলা গেছে৷ দড়ি দিয়া বান্ধা৷ আর আপনে যা উঁচা (উঁচু)৷ তা বাবু, কোন কলেজে যাও? এইটা কি প্রথম ফুলপ্যান্ট? নতুন জন্ম৷ মনে রাখবা, সব সময় মনে রাখবা, জীবনে বড়ো কাজ করতে হইব৷ আমাগো দেশ গেছে, ভিটা গেছে৷ নিজের পায় খাড়া হইতে হইব৷
বাবা বলেছিল, আগেও বলেছে কথাটা, বলবার সময় একটা কষ্ট যেন বাজে গলায়, প্রেসিডেন্সিতে চান্স পাইছিল৷ ভরতি হয় নাই৷ কারণ, প্রেসিডেন্সিতে বড়োলোক ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়ে৷ অর পোশাক নাকি তাগো লগে মানায় না৷
কথাটা সত্যি৷ ভরতির মুখ থেকে পালিয়ে এসেছিলাম৷ আমার হায়ার সেকেন্ডারির মার্কসিট দেখে এক অধ্যাপক, করণিকও হতে পারেন, তাঁকে ‘স্যার’ বলেছিলাম, জানতে চেয়েছিলেন আমি কোন বিষয় নিয়ে অর্থাৎ কোন বিষয়ে অনার্স নিয়ে পড়তে চাই, আমার বাবা কী করেন, কবে ভরতি হব৷ উত্তর দিয়েছিলাম৷ ফেরার পথে বারান্দা পেরোনোর সময় ছোটো ছোটো দলে ছেলেমেয়েদের দেখি, ঝকঝকে চোখমুখ, সুন্দর সম্ভ্রান্ত পোশাকআশাক, তাদের হাঁটাচলা কথাবলা আমাদের পাড়ার থেকে একদম আলাদা৷ লম্বা পায়ে বেরিয়ে এসে ট্রামলাইনের ওপারে থেমে আরেকবার কলেজের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলাম, এখানে আমি শুধু বেমানান নই, ঠাট্টা-মশকরার পাত্র হব৷
‘জয়গুরু বস্ত্রালয়’ ছেড়ে কয়েক পা এগিয়ে বাবা বলল, চল, কিছু খাইয়া নেই৷ ‘বসন্ত কেবিন’-এ সেই প্রথম৷ দু-পিস করে মরিচটোস্ট দু-জনে, বাবা এককাপ চা৷ খেতে খেতে বাবা বলল, হরিসা হাটে যামু৷ তর শার্ট লাগে৷ ওইখানে সস্তা হয়৷ একটা দামে দুইখান৷
শ্যামবাজারের দিকে ট্রাম ছুটছে৷ খাকি পোশাকের ড্রাইভারের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখি, পেতলের ঝকঝকে হ্যান্ডেলের নীচে কালো রঙের চ্যাপ্টা লোহার ড্রামে উঁচু উঁচু লেখা Incorporated in London৷ মানে বুঝি না৷ যেমন বুঝিনি ‘অরবিন্দের কাপড়’৷
শ্যামলস্যার আপাদমস্তক দেখে বললেন, আরেব্বাস, এই ক-দিনেই এত বড়ো হয়ে গেলে? সেই ছেলেটা কই? হাফপ্যান্ট-পরা সেই ছেলেটা৷ হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি ভাঙত৷ পড়া না পেরে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকত৷ সুটকেস নিয়ে আমার সঙ্গে হাঁটত৷
শ্যামবাজার পেরিয়ে, টালা ব্রিজ পেরিয়ে বিটি রোড ধরে হু হু৷ এ শহর কী দারুণ বাসযোগ্য ছিল সেদিন৷ গ্রীষ্মভোরে ছিল ঠাণ্ডাহাত৷ শ্যামলস্যারের কাছে পড়েছি সংস্কৃত ও ইংরেজি৷ তাঁর বাড়িতেই প্রথম দেখি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা৷ দেখেছি ঘরজোড়া বই৷পরে ভেবেছি, মাস্টারমশাইদের কত বেতন ছিল তখন? বড়ো জোর আড়াইশো কি তিনশো৷ এত বই কেনার পয়সা কীভাবে পেতেন? টুইশনি করতেন না৷ আর ‘বাঙাল’ স্কুলে এনসাইক্লোপিডিয়া লাগে কবে? শ্যামলস্যার ছিলেন প্রকৃত জ্ঞানান্বেষী
ভরতি হয়েছি বঙ্গবাসী কলেজে৷ আমার স্কুল আদর্শ বিদ্যামন্দির বেশি দূরে নয়৷ শেয়ালদা অঞ্চলের মধ্যে৷ বৈঠকখানা ধরে পাঁচ-সাত মিনিটের পথ৷ পরীক্ষা দেবার পর মার্কশিট আনতে যাবার দিন দেখা হয়েছিল৷ সংস্কৃতে প্রত্যাশিত মার্কস হয়নি বলে দুঃখ পেয়েছিলেন৷শ্যামলবরণ দত্ত৷ সংস্কৃতের শিক্ষক৷ পূর্ববঙ্গের মানুষ৷ সম্ভবত ঢাকা জেলার৷ ছিপছিপে গড়ন৷ একমাথা ঢেউচুল৷ টানা চোখ৷ পরনে ধুতি-জামা৷ কথা বলেন মিষ্টি করে৷ ভাঙা ভাঙাবাঙাল টানের জন্যে হয়তো বেশি মিষ্টি লাগে৷ এত দরদি শিক্ষক আমি বেশি পাইনি৷ লেখাপড়ায় আমার দুর্মেধা আর দুরবস্থা দেখে বলেছিলেন, বাসায় চলে আয় সকালে৷ পারবি তো? ঘণ্টা দুই পড়া হবে৷ তারপর দু-জনে একসঙ্গে দু-মুঠো খেয়ে স্কুলে চলে আসব৷
বরানগরে গোপাললাল ঠাকুর রোডে তাঁর বাসায় গিয়েছি বহুদিন৷ ভোরের বাসে৷ লিন্টন স্ট্রিট থেকে ১০ নম্বর-এ কলেজ স্ট্রিট মোড়, সেখান থেকে ৩৪বি বাসে, টবিন রোড থেকে দুটো স্টপেজ৷ শ্যামবাজার পেরিয়ে, টালা ব্রিজ পেরিয়ে বিটি রোড ধরে হু হু৷ এ শহর কী দারুণ বাসযোগ্য ছিল সেদিন৷ গ্রীষ্মভোরে ছিল ঠাণ্ডাহাত৷ শ্যামলস্যারের কাছে পড়েছি সংস্কৃত ও ইংরেজি৷ তাঁর বাড়িতেই প্রথম দেখি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা৷ দেখেছি ঘরজোড়া বই৷ গুছিয়ে রাখার ব্যবস্থা নেই৷ পরে ভেবেছি, মাস্টারমশাইদের কত বেতন ছিল তখন? বড়ো জোর আড়াইশো কি তিনশো৷ এত বই কেনার পয়সা কীভাবে পেতেন? টুইশনি করতেন না৷ আর ‘বাঙাল’ স্কুলে এনসাইক্লোপিডিয়া লাগে কবে? শ্যামলস্যার ছিলেন প্রকৃত জ্ঞানান্বেষী৷
টিচার্স রুমে আরও অনেকেই ছিলেন সেদিন৷ আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম শ্যামলস্যারের সামনে৷ তিনি দেখলেন৷ প্রণাম করলাম৷ বললেন, সব মাস্টারমশাইকে প্রণাম করো৷ বললেন, বাংলায় অনার্স নিয়েছ৷ বেশ করেছ৷ কিন্তু আমাদের সরকার যে বাংলার কথা ভাবে না৷ কাজের সুযোগ কম৷ যাই হোক, ওসব ভেবে লাভ নেই৷ মন দিয়ে পড়ো৷ আমার আশা ছিল তুমি সংস্কৃতে লেটার পাবে৷ তারপর গলা নামিয়ে বলেছিলেন, বাবা জুতো কিনে দিতে পারেনি এখনও, তাইতো?
ক্ষয়ে-যাওয়া হাওয়াই চটি পায়ে সেই কাঠের সিঁড়ি বেয়ে, দোতলা থেকে সোজা নেমে-আসা, ক্লাস সেভেন ক্লাস এইট ইতিহাস অর্থনীতি রাষ্ট্রনীতি ব্লটিং পেপার এনসিসি ছুটির ঘণ্টা, আমি উঠতেই বা নামতেই থাকি৷
ক্রমশ…
❤ Support Us