Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • জুন ২৩, ২০২৪

ভোর ভয়ি। পর্ব ১০: দুই বন্ধু, আমি শিক্ষক মানি

নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থানের পর প্রেসিডেন্সির লন যে আর প্রেসিডেন্সির একার থাকেনি, তার ভূমিকাপর্ব ছিল এই আন্দোলন...তারপর

মধুময় পাল
ভোর ভয়ি। পর্ব ১০: দুই বন্ধু, আমি শিক্ষক মানি

অলঙ্করণ: দেব সরকার

 
বায়োস্কোপের বাকসো। রঙের নকশা চটে খসে এখানে-ওখানে বেরিয়ে পড়েছে মৃত‍্যু-প্রস্তাব। বাকসোর গোল জানালার ঢাকনা কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। চোখের পর্দায় আসে শূন‍্য খেয়াঘাট, দূরে দূরে সবল ডানার চিল, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, আরও কত রক্ত চাই তব প্রীতি তরে, ধানের ক্ষেতে মশাল আগুন, লকআপের আর্তনাদে বাতাস কাঁপে, শিক্ষকদের চেয়ারে ভাঙনের শব্দ, রং ও রেখায় জাগে পুরাণপ্রতিমা, উন্নয়ন আর উৎসব শুষে খায় জলাভূমি, কুয়াশার ওপারে পলিথিনে মোড়া চাঁদ, জোড়া চোখ ঘটনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাঁতরায়, দূরে কোথাও আগুনবরণ আকাশে বাজে ‘ভোর ভয়ি’।

 

পর্ব দশ

রাজনীতির বজ্রনির্ঘোষে যাবার আগে কিছু অন্তরঙ্গ কথা বলে নেওয়া যাক৷ দুই বন্ধুর কথা, তাদের অন্যরকম পড়াশোনার কথা, সহজ করে সিরিয়াস ভাবনা বলবার আশ্চর্য গুণপনার কথা৷ এইসব স্মৃতি আমার পোড়ামাটির সম্পদ হয়ে আছে৷ সবটা যে সঞ্চয়ে আছে তেমন বলা যাবে না, যেটুকু আছে তার লাবণ্য এই বেলাশেষে চুঁইয়ে পড়ে৷ 
 
   প্রথমে কমলেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলি৷ বাটানগরে থাকত৷ ওর পিতৃদেব ছিলেন ওখানকার ডাকঘরের মাস্টারমশাই৷ পুরু ঝোলা গোঁফ, এলোমেলো বাড়বৃদ্ধি৷ গম্ভীর মানুষ৷ বারদুয়েক মুখোমুখি হয়েছি৷ টেবিল থেকে চোখ তুলে দেখেছেন, সময় নিয়ে, কড়া নজর, চোখ নামিয়ে নিয়েছেন, আমার নামও জানতে চাননি৷ কমলেন্দু হাসতে হাসতে বলেছে, বাবা ওরকমই৷ আমার দিকেই কখনও এমনভাবে তাকায় যেন আগে দেখেনি৷ বলেই হো হো হাসত কমলেন্দু৷ হাসির সঙ্গে মাথার ঝাঁকুনিতে পুরু চশমার ওপরে কপাল ঢেকে যেত চুলে৷ ফরসা মুখ লাল হয়ে যেত৷ এমন হাসকুটে বেশি দেখিনি৷ হাসিতে মনের ছবি ক-জনের পাওয়া যায়? 
 
   ওর ওপর রাগ করার একটা সঙ্গত কারণ তো ছিলই৷ যখন-তখন বই নিয়ে ওর মা্ত্রাছাড়া বকবকানিতে৷ কলেজের ছাদে অফ পিরিয়ডে দু-চারজন মিলে হয়তো লঘু কোনো বিষয়ে মজা করছি, হয়তো ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, হয়তো উত্তম-সুচিত্রা, হয়তো ভোটের ছড়া, কিংবা কলেজের পাশের বাড়ির ছাদে কোনো মেয়ে, তার শরীররেখা বা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা, কমলেন্দু এসে হাজির জগদীশ গুপ্ত নিয়ে৷ সদ্য পড়ার বিপুল উত্তেজনা সমেত৷ কাপড়ের কাঁধব্যাগ থেকে বের করল জগদীশ গুপ্তের বই৷ লেখা কাকে বলে দেখ৷ কীভাবে ভাবতে হয়, বুঝতে হয়, লিখতে হয়, জেনে নে৷ রমাপদ হয়তো সরে গেল আলগোছে৷ বিমল চলে গেল কোনো কাজে৷ বিষ্ণু ‘এক্ষুনি আসছি’ বলে কেটে পড়ল৷ গোবিন্দ এবং আমিও বিরক্ত৷ কমলেন্দু বেপরোয়া৷ বই খুলে কয়েক লাইন পড়ে শোনাল৷ আমরা শুনছি না বুঝেও সে আরও কয়েক লাইন পড়ল৷ সে যেন পণ করে আসে আমাদের বোঝাবেই ‘প্রকৃত সাহিত্য’ কী, ‘উন্নত সাহিত্য’ কী৷ সাড়া না পেয়ে সে হাসতে হাসতে বলত, সিরিয়াস সাহিত্য যদি এখনই না বুঝি সারাজীবন ঠকে যাব৷ বাজারের দর-দাম জেনে জিনিস কিনতে যেতে হয়৷ সরেস জিনিস চেনার চোখ তৈরি করতে হয়, বন্ধু৷ তোরা না শুনলেও আমাকে বলে যেতে হবে৷ এটা আমার দায়িত্ব৷ জানি, তোরা পছন্দ করছিস না, তবু আমাকে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে৷ বলে আবার হাসি৷ কপাল ঢেকে যায় চুলে৷ পুরু চশমার নীচে চোখ জ্বলজ্বল করে৷—এই হাসির জন্যই রাগ করা যেত না৷ নিজের নতুন পড়া ও জানা বন্ধুদের বলবার জন্য ওর অদম্য ইচ্ছেকে আঘাত করার কথা কখনও ভাবিনি আমরা, বেশ বিরক্ত হলেও৷

 
খাটের ওপর বইয়ের ছোটো ছোটো টিলার একপাশে হাঁটু মু্ড়ে বসে আছেন পোস্টমাস্টার ‘গুঁফো চাটুজ্জে’র ভাই ৷ বলেছিলেন, তোমাদের সিলেবাস বড়ো গরিব ৷ ভাবাতে পারে না, স্বপ্ন দেখাতে পারে না ৷ বড়ো কিছু ছুঁতে পারে না ৷ সাহিত্যের সঙ্গে জুড়ে আছে শিল্পকলা, ইতিহাস, দেশ, সমাজ ৷ সেসব বই নেই কেন? সিলেবাসের বাইরেই বিরাট পড়ার জগৎ, জানার জগৎ৷ সিলেবাস তোমাকে ডিগ্রি দেবে, বড়ো হতে দেবে না ৷ 

 
   নুঙ্গি স্টেশনে নেমে কমলেন্দুদের কোয়ার্টারে গিয়েছি৷ বাসেও যাওয়া যেত, মনুমেন্টের গায়ে বাসস্ট্যান্ড থেকে৷ প্রাইভেট বাস, নম্বর ছিল খুব সম্ভবত ৭৭, শিখ কন্ডাক্টার৷ কিন্তু তাতে খরচ বেশি৷ ওই কোয়ার্টারেই খোঁজ মেলে বইপাগল আমাদের বন্ধুর গুরুদেবের৷ খাটের ওপর বইয়ের ছোটো ছোটো টিলার একপাশে হাঁটু মু্ড়ে বসে আছেন বন্ধুর কাকা৷ পোস্টমাস্টার ‘গুঁফো চাটুজ্জে’র (বাবার এই লোকপ্রিয় নামটি জানিয়েছিল স্বয়ং কমলেন্দু) ভাই৷ পরিচয় করিয়ে দিতেই তিনি জানতে চাইলেন আমি কী পড়তে ভালেবাসি৷ হঠাৎই মাথায় এসে গিয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের ‘রাজকাহিনী’৷ তিনি বললেন, অবনীন্দ্রনাথ তোমাদের সিলেবাসে নেই৷ বললাম, না৷ আমার এক মাসি পড়তে বলেছেন৷ সেই থেকে পড়ি৷ ভালো লাগে৷ ছবি পাই অনেক৷ কমলেন্দুর কাকা বলেছিলেন, তোমাদের সিলেবাস বড়ো গরিব৷ ভাবাতে পারে না, স্বপ্ন দেখাতে পারে না৷ কিছু শেখায়৷ ওই পর্যন্ত৷ বড়ো কিছু ছুঁতে পারে না৷ সাহিত্যের সঙ্গে জুড়ে আছে শিল্পকলা, ইতিহাস, দেশ, সমাজ৷ সেসব বই নেই কেন? জানি না৷ কমলকে সব সময় বলি, সিলেবাসের বাইরেই বিরাট পড়ার জগৎ, জানার জগৎ৷ সিলেবাস তোমাকে ডিগ্রি দেবে, বড়ো হতে দেবে না৷ 
 
   তিনি কথাগুলো এভাবে নয়, নিশ্চয় তাঁর মতো করেই বলেছিলেন৷ কয়েকটা বই দেখিয়ে, কিছু লাইন শুনিয়ে, কোনো লেখক সম্পর্কে দু-চার কথা বলে৷ বুঝতে পারি কমলেন্দুর মাতামাতিটা কাকার কাছ থেকে পাওয়া৷ ও জগদীশ গুপ্ত পড়তে পেয়েছে অনার্সের সেকেন্ড ইয়ারে৷ আমি, সত্যি বলতে কী, অনেক পরে৷ গৌরমোহন মুখোপাধ্যায়ের ক্লাসে ভারতচন্দ্র পড়বার সময় কমলেন্দু যে অষ্টাদশ শতকের ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে জানতে চাইত, সেটা ওর কাকার কাছে পাওয়া৷ 
 
  কমলেন্দু এমএ পড়তে যায়নি৷ চাকরি পেয়েছিল ব্যাঙ্কে৷ কয়েক বছর বাদে ও এসেছিল আমাদের প্রেসে৷ তখনই জানি৷ অনেকটাই আগের মতন৷ কিন্তু সেদিন বইয়ের কথা বলেনি৷ ব্যাঙ্কের চাকরিতে যে খুশি নয়, সেটা বলেছে৷
 
   মনে পড়ে, এই বন্ধুই আমাকে পড়িয়েছে অসীম রায়৷ বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল ‘একালের কথা’, ‘গোপালদেব’, ‘দেশদ্রোহী’৷ বিএ পড়ার বয়সেই দোকানি-সাহিত্য থেকে সরে আসা শুরু কমলেন্দুর হাত ধরে৷ বলতেই হয়, আমার পাঠ-রুচি তৈরিতে তার ভূমিকা আছে৷ আজ যেভাবে এসব লেখা বুঝি, হয়তো সেভাবে বুঝিনি তখন৷ তবে টান অনুভব করেছি৷ প্রেসিডেন্সি রেলিংয়ে পঞ্চাননের স্টল থেকে কিনেছি মলাটহীন ‘একদা ট্রেনে’, ‘দ্বিতীয় জন্ম’৷ ১৯৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা ‘দেশদ্রোহী’র লাইনগুলো এখন আরও বড়ো সত্য হয়ে ওঠে: ‘আমার মামার কথা মনে আছে৷ মস্ত কমিউনিস্ট ছিল ফরিদপুরে৷ ছেলেবেলায় মামাবাড়ি গিয়েছি৷ দেখি একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি গায়ে দিনরাত পড়ে আছে মুসলমান নমশূদ্র চাষীর বাড়ি৷ দু-দলে দাঙ্গা লাগবার উপক্রম হলেই মামার ডাক পড়তো৷ সেই সড়কি আর লাঠির জঙ্গলের মাঝখানে যেই মামা এসে দাঁড়াতো, অমনি সব মিটে যেত৷ তারপর অনেক কংগ্রেস-কমিউনিস্ট দেখলাম৷ সে রকমটি দেখলাম না৷…মাথা খারাপ হয়নি মীরু৷ ঠিক বলছি৷ আমাকে একটা কথা বুঝিয়ে দাও৷ এত স্বাদেশিকতার বন্যা বইল উনবিংশ শতাব্দী থেকে৷ এত দেশ দেশ করে লোক ফাঁসিতে গেল৷ ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করলো৷ তারপর রান্নাঘরের মাঝখান দিয়ে দেয়াল উঠলো শোবার ঘর আর বৈঠকখানা আলাদা করে৷ দুই দেশের এতগুলো পার্টি ছিল, কই একটা শব্দও তো কেউ করেনি৷’ [মূল বই হাতের কাছে পেলাম না৷ ডায়েরির পাতা থেকে টুকে দেওয়া গেল৷]
 
   দ্বিতীয় জন গোবিন্দ দাশ৷ কবিতা লিখত সায়ন্তন দাশ নামে৷ ওর কবিতা ছাপা হয়েছে খুব কম৷ একেবারে নিকটজন ছাড়া কাউকে বলত না৷ অনেকবার চাইবার পর হয়তো কোনো পত্রিকাকে কবিতা ছাপতে দিত৷ ভীষণ লাজুক, আর গুটিয়ে-থাকা মানুষ৷ কমলেন্দু কথা বলতে ভালেবাসে৷ গোবিন্দ শুনতে৷ কোথাও ভিন্নমত হলে জানায় চোখের ভাষায়৷ ঘনপক্ষ্ণ ওর টানা টানা চোখ দুটো নিবিড় সংকেতের পাণ্ডুলিপি যেন৷ গোবিন্দ থাকত এন্টালি বাজারের গায়ে দোতলা, তিনতলাও হতে পারে, ভাড়াবাড়িতে৷ দুই দাদা-বউদি, মা-বাবাকে নিয়ে ওদের থাকার জায়গা অসংকুলান ছিল বাইরের কারও পক্ষে৷ আমরা কথা বলতাম ওদের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা৷ এন্টালি বাজার থেকে আমাদের বস্তিবাড়ি ধীরপায়ে দশমিনিটের পথ৷ বস্তিঘরেও কাউকে বসাবার জায়গা নেই৷ এখানে আমাদের কথা হত বস্তির উলটোদিকে অশ্বত্থের নীচে৷ এখানে বলা দরকার, একটা কল আর বিয়াল্লিশজন মানুষের বস্তিবাড়িতে জলের আকাল ছিল রোজকার৷ পুরসভার কল থেকে বালতি করে জলে নিয়ে বড়ো একটা ড্রাম ভরা আমার নিত্যকর্তব্য৷ আমাদের কথা বলার মধ্যে বালতি ভরা হত, ক্রমে ড্রাম ভরা হত৷ ওই শতজলধ্বনির মধ্যে গোবিন্দ শুনিয়েছে জীবনানন্দ, সুধীন দত্ত, অলোকরঞ্জনও৷ আমার জল ভরা আর গোবিন্দর কবিতা পড়া জুড়ে নির্জন প্রান্তর ছিল, আজ মনে হয়৷ সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ফ্রেজিয়োলজি তখনও আমাকে সেভাবে গ্রাস করেনি৷ তবু হার্ড রিয়ালিটির গদ্যে বিশ্বাসী আমি কখনও কি কবিবন্ধুটিকে আঘাত করিনি ? হয়তো করেছি৷ চোখের ভাষায় ফিরিয়ে দিয়েছে, ভুল আমাকে৷
 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৯

ভোর ভয়ি। পর্ব ৯: নীল আকাশের নীচে প্রেসিডেন্সি


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!