Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • আগস্ট ২৫, ২০২৪

ভোর ভয়ি। পর্ব ১৯ : এক ‘দিদিবাড়ি’তে থেকে পার্ট টু

মধুময় পাল
ভোর ভয়ি। পর্ব ১৯ : এক ‘দিদিবাড়ি’তে থেকে পার্ট টু


বায়োস্কোপের বাকসো। রঙের নকশা চটে খসে এখানে-ওখানে বেরিয়ে পড়েছে মৃত‍্যু-প্রস্তাব। বাকসোর গোল জানালার ঢাকনা কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। চোখের পর্দায় আসে শূন‍্য খেয়াঘাট, দূরে দূরে সবল ডানার চিল, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, আরও কত রক্ত চাই তব প্রীতি তরে, ধানের ক্ষেতে মশাল আগুন, লকআপের আর্তনাদে বাতাস কাঁপে, শিক্ষকদের চেয়ারে ভাঙনের শব্দ, রং ও রেখায় জাগে পুরাণপ্রতিমা, উন্নয়ন আর উৎসব শুষে খায় জলাভূমি, কুয়াশার ওপারে পলিথিনে মোড়া চাঁদ, জোড়া চোখ ঘটনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাঁতরায়, দূরে কোথাও আগুনবরণ আকাশে বাজে ‘ভোর ভয়ি’।

 

 

পর্ব ১৯

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়ছে৷ ‘ঐ রাস্তায় যাস নে বাছা৷/সাপ নয়; কিন্তু তার চেয়ে বেশী৷ তুই অন্ধ,/দেখতে পাস না/ঘুরছে পুলিশ’৷ পাড়ায় পাড়ায় পুলিশের খোচর-শাখা৷ থিকথিক করছে খোচর, এর মধ্যে একটা অংশ ‘বামপন্থী’৷
 
   বাড়িতে থাকা যাচ্ছে না৷ দিনের বেলা পাড়ায় ঢোকা যাচ্ছে না৷ ব্রিটিশ পুলিশের বঙ্গিয় জারজরা শ্বেতসন্ত্রাস জারি করেছে দক্ষিণ ও বামপন্থী বন্ধুদের অকৃপণ সহযোগিতায়৷ সিপিআইএমএল তখন গণসংগঠনের লাইন পরিত্যাগ করেছে৷ সুতরাং কী করবে আর কী করবে না বুঝে উঠতে না পেরে পার্টির বন্ধুরা ছিটকে গেছে কে কোথায়৷ কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই৷ কেশব সেন স্ট্রিট থেকে ‘দেশব্রতী’ আনা বন্ধ হয়ে গেছে আমার৷ প্রথম কথা, পত্রিকা আনতে হত নগদে৷ সেই টাকা দেবে কে? পত্রিকা নেবার সঙ্গে সঙ্গে সবাই দাম দিত না৷ বকেয়া পয়সা সংগ্রহ করা সমস্যা৷ মনে আছে, মানিকদা একবার টাকা দিয়েছিল৷ পরে বলেছে, আমাদের ইউনিট খুব দুর্বল, টাকা বড়ো সমস্যা৷ আমি একা টানব কীভাবে ? সিম্প্যাথাইজাররা পার্টির লাইন নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরে যাচ্ছে৷ দ্বিতীয় কথা, আমি কলেজে যাই ক্বচিৎ৷ কারণ, বন্ধুরা কেউ আসে না, কলেজটা অচেনা লাগে৷ কেউ গ্রামে গেছে কৃষকদের লড়াইযে অংশ নিতে৷ কারও খবর নেই৷ জেলে গেছে কেউ৷ যারা রাজনীতি থেকে দূরে, তারা বাড়িতে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ পার্ট টু সামনে৷   
 
   পার্ট টু আমারও৷ কিন্তু পড়ব কীভাবে, কোথায় ? রাতের শেলটার দু-তিনটে অবশিষ্ট আছে৷ সেগুলো শুধু রাত কাটানোর৷ এসময় বড়ো একটা উপকার করলেন দিপুদা এবং আমি পরীক্ষায় বসতে পারলাম৷ দিপুদা নকশালবাড়ি রাজনীতির সমর্থক৷ তবে মিটিং মিছিলে নেই৷ ব্যায়াম-করা পেশিবহুল শরীর৷ ডাকাবুকো যুবক৷ জনপ্রিয়৷ মানুষের প্রয়োজনে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া৷ সাহসী৷ পুলিশ খতমের ফেরারি যুবককে শেলটার দিয়েছিলেন নিজের বাড়িতে৷ বড়োরকমের ঝুঁকি, পিছ-পা হননি৷ সেই দিপুদাকে সমস্যা জানালাম৷ তিনি বেনেপুকুরে এক দরিদ্র পরিবারে আমার একমাস থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন৷ 
 
   বস্তি অঞ্চলে দুটি টালির ঘরে থাকে পরিবারটি৷ তিন বোন আর বাবা৷ ধরা যাক, তাঁদের নাম অরুণা, করুণা আর রঞ্জু৷ অরুণাদি পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফের কর্মী৷ করুণাদি স্কুলের বেশি পড়েননি৷ রঞ্জুদি ট্রেনি নার্স৷ এঁদের মা মারা গেছেন৷ বাবা আছেন, না থাকার মতো৷ ছোটো একটা স্টেশনারি দোকান চালান৷ তাতে কী আয় হয় কেউ জানে না৷ কারণ প্রৌঢ় ভদ্রলোকের পরকীয়া আছে৷ খাওয়া-দাওয়া মেয়েদের সংসারে, টাকা দেন পরকীয়াতে৷ এসব জেনেছি কয়েকদিন পর৷ করুণাদি বলেছিলেন এক দুপুরে৷ মা থাকতেই বাবার নাকি এই ভীমরতি৷
 

রাজনীতির বাইরে লোকমানুষের জীবন অনেক বিস্তৃত ও বিচিত্র৷ রাজনীতির সূক্ষ্ণ সংজ্ঞাও বোধহয় সে জীবন ছুঁতে পারে না৷ সে-জীবন আমার সামনে পৃষ্ঠা খোলা শুরু করেছিল হয়তো অনেক আগেই, বুঝতে পারিনি, বুঝলাম দিদিবাড়িতে৷ করুণাদির কেন বিয়ে হয় না, আর বিয়ে না হবার জন্য কেন তাঁকে ম্লানমুখ থাকতে হয় সারাক্ষণ, এর ব্যাখ্যা রাজনীতিতে আছে কি?

 
   সংসারের বোঝা টানতে হবে বলে অরুণাদি বিয়ে করেননি৷ রোগা-পাতলা ছোটোখাটো মানুষটি সব সময় হাসিখুশি৷ করুণাদির বিয়ে হয়নি কালো বলে৷ পাত্রপক্ষ আসে, মিষ্টি খেয়ে জানিয়ে যায়, পাত্রী বেশ কৃষ্ণবর্ণ৷ করুণাদি কথা বলেন কম, তাঁর মুখের ওপর মেঘ জমে আছে যেন৷ দুপুরে আমাকে খেতে দিতেন উনি৷ ওই সময় দু-চারটে কথা বলতেন৷ রাতের খাবার একসঙ্গে৷ সেসময় যত কথা অরুণাদির৷ রঞ্জুদি সবসময় যেন টেনশনে৷ নাইটডিউটি তো ছিলই৷ ডিউটির বাইরেও নাইট করতে হত৷ বাড়ি ফিরে স্নান করে কোনোরকমে দুটো খেয়েই ঘুম৷ ওঁদের দুটো ঘরের একটি ছিল রঞ্জুদির৷ সেখানে আমার জায়গা হয়েছিল৷ আরেকজন এসে থাকতেন মাঝে মাঝে৷ তিনি ওঁদের বাবা৷ বেশিরভাগ সময় সারাটা দিন ফাঁকা ঘর পেয়েছি আমি৷
 
   প্রৌঢ় ভদ্রলোক প্রথম দেখায় আমার ওপর বেশ চটেছিলেন৷ কে না কে ঘরে এসে ঢুকেছে৷ তিনি থাকেন না বলে যা কিছু চলবে এটা হতে পারে না৷ অরুণাদি দিপুদার নাম বললে সেই যে তিনি চুপসে গেলেন আর কখনও আমার সঙ্গে কথা বলেননি৷ আমার একটা দিদিবাড়ি হল৷ আমি পড়ছি কিনা, প্রস্তুতি কেমন হচ্ছে, রোজই খবর নিতেন অরুণাদি৷ রবিবার বা ছুটির দিন আমার পড়ার বই নিয়ে পাশের ঘরে পড়তেন৷ আমাকে কেউ যেন বিরক্ত না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতেন৷ আমার জীবনের প্রথম যথার্থ অভিভাবক৷ অরুণাদি, আপনি বলেছিলেন, তোদের ভালোলাগে এইজন্যে যে তোরা লোভের রাজনীতি, লাভের রাজনীতি করিস না৷ আবার কষ্ট হয় একথা ভেবে যে এই রাজনীতিতে শুধু ভয় অত্যাচার লাঞ্ছনা মৃত্যু৷ দিপুদাকে বলেছি, তুমি অন্য দল করলে কত বড়ো নেতা হতে পারতে৷ দিপুদা হাসে৷  
 
   রাজনীতির বাইরে লোকমানুষের জীবন অনেক বিস্তৃত ও বিচিত্র৷ রাজনীতির সূক্ষ্ণ সংজ্ঞাও বোধহয় সে জীবন ছুঁতে পারে না৷ সে-জীবন আমার সামনে পৃষ্ঠা খোলা শুরু করেছিল হয়তো অনেক আগেই, বুঝতে পারিনি, বুঝলাম দিদিবাড়িতে৷ করুণাদির কেন বিয়ে হয় না, আর বিয়ে না হবার জন্য কেন তাঁকে ম্লানমুখ থাকতে হয় সারাক্ষণ, এর ব্যাখ্যা রাজনীতিতে আছে কি? অফিস-ফেরত অরুণাদির মুখে শুনেছি ‘ঘাড় বোঝা হয়ে-থাকা’ বোনের প্রতি কটূক্তি, আর স্বভাবের নীরবতা ভেঙে করুণাদি মুখ ঝামটে উঠে কেঁদেছেন সশব্দে৷ ভয়ে থেকেছি, আমার ওপর যদি বেরিয়ে যাবার হুকুম জারি হয়৷ এখানে বলা দরকার, পরে জেনেছি, আমার খাবার খরচ বাবদ টাকা দিতেন দিপুদা৷ 
 
   পরীক্ষার ভালো প্রস্তুতি নেবার সময় ও সুযোগ ছিল না—তখন৷ হাতের কাছে ছিল টেক্সট বইগুলো আর কিছু রেফারেন্স৷ অল্পস্বল্প নোট জোগাড় করা গিয়েছিল রমাপদ আর কমলেন্দুর কাছ থেকে৷ রমাপদর বাড়ি শাসনে, কমলেন্দুর বাটানগরে৷ যাতায়াত করা যখন বিপজ্জনক, অতটা দূর যাই কোন ভরসায় ? একবার পুলিশের হাতে পড়লে পরীক্ষা বরবাদ, সঙ্গে বিস্তর ঝামেলা৷ সুযোগ ও সময় যখন ছিল, তখন কেন ভাবিনি? অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্যের কথা বারবার মনে পড়ে, জীবন থেকে ছিটকে যাবি৷ গরিব ঘরের ছেলে দেখবি চারদিক শুনশান ফাঁকা হয়ে গেছে৷ বাড়ির বড়োদের ছোটোদের বিরক্ত বিষণ্ণ মুখ তোকে ঘিরে৷ অপরাধী মনে হবে নিজেকে৷ যাই হোক, পরীক্ষায় বসলাম৷ আশঙ্কা ছিল সেখানেও৷ পুলিশি হানার, হলের ভেতরে না হোক, বেরিয়ে আসার পথে গেটে৷
 
   চলনসই একটা গদ্য আয়ত্ত করা গিয়েছিল৷ পাপিয়ার সঙ্গে অবনঠাকুর পড়া থেকে, কমলেন্দুর কথাবার্তা থেকে, স্কুলবেলার শেষের দিকের পাঠাভ্যাস থেকে৷ কিন্তু তা দিয়ে অনার্সের পরীক্ষা উতরানো কঠিন৷ টেক্সট পড়েছি মন দিয়ে৷ তার ফলে উত্তর কী হবে বুঝতে অসুবিধে হয়নি৷ কিন্তু লিখতে হবে তো৷ গুছিয়ে বলতে হবে, উদ্ধৃতি দিতে হবে, ব্যাখ্যা করতে হবে, কোনো প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের বয়ানের ভিন্নতা থাকলে সেটা জানাতে হবে, কোথাও তুলনামূলক বিচারের সুযোগ থাকলে সেটা করতে হবে৷ আমি যে সেভাবে পড়িইনি৷ তার ওপর ভাষা৷ সাহিত্যের পরীক্ষার ভাষা সাদামাটা হলে মামুলি হয়ে যায় না কি উত্তর? 
 
   চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, কমলেন্দু হাইবেঞ্চের ওপর ঝুঁকে পড়েছে৷ থুতনি আর উত্তরপত্র খুব কাছাকাছি৷ পুরু কাচের চশমা নেমে আসছে নাকের ওপর৷ কপালে উড়ে–আসা চুল সরিয়ে দিচ্ছে বারবার তার আঙুল৷ মাথার ভেতর উত্তর তৈরি, সেটা যত ভালোভাবে সম্ভব নামাতে হবে৷ কোনো দিকে তাকাবার অবকাশ নেই৷ রমাপদ বরাবর চতুষ্পাঠীর ছাত্রের মতো৷ সাদা পাঞ্জাবি, ধুতি, ছোটো করে ছাঁটা চুল, আজও তাই, টানটান বসে লিখে যাচ্ছে৷ তাড়াহুড়ো নেই৷ চমৎকার ছাঁদের হস্তাক্ষর৷ আমি এসব দেখি, আর নিজের দুরবস্থার কথা ভাবি৷ মনে আছে, আমার উ্ত্তরগুলো হয়েছিল ছোটো ছোটো৷ দেড়-দু পাতা৷ বেশি লেখার উপাদান ছিল না৷ অন্যেরা যখন ঊর্ধ্বশ্বাসে লিখে যাচ্ছে, নতুন নতুন পাতা নিচ্ছে, খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে এসেছি আমি৷ কমলেন্দুদের সঙ্গে দেখা করতে চাইনি৷
 
   নিজের অপদার্থতার কথা বেশি বলতে নেই৷ অনার্স টিঁকে গিয়েছিল টায়েটোয়ের কিছুটা ওপরে৷ কমলেন্দু, রমাপদদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে পাইনি৷

 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১৮

ভোর ভয়ি। পর্ব ১৮ : দেশভিখারি দাদু আর দিদিমা


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!