Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪

ভোর ভয়ি। পর্ব ২২

মধুময় পাল
ভোর ভয়ি। পর্ব ২২


বায়োস্কোপের বাকসো। রঙের নকশা চটে খসে এখানে-ওখানে বেরিয়ে পড়েছে মৃত‍্যু-প্রস্তাব। বাকসোর গোল জানালার ঢাকনা কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। চোখের পর্দায় আসে শূন‍্য খেয়াঘাট, দূরে দূরে সবল ডানার চিল, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, আরও কত রক্ত চাই তব প্রীতি তরে, ধানের ক্ষেতে মশাল আগুন, লকআপের আর্তনাদে বাতাস কাঁপে, শিক্ষকদের চেয়ারে ভাঙনের শব্দ, রং ও রেখায় জাগে পুরাণপ্রতিমা, উন্নয়ন আর উৎসব শুষে খায় জলাভূমি, কুয়াশার ওপারে পলিথিনে মোড়া চাঁদ, জোড়া চোখ ঘটনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাঁতরায়, দূরে কোথাও আগুনবরণ আকাশে বাজে ‘ভোর ভয়ি’।

 

পর্ব ২২

 
ভরতি হব না হব না করে হয়ে গেলাম৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়তে৷ লেখাপড়া নিয়ে আগ্রহ যে ফিরে এসেছিল তেমন নয়, রাজনীতি থেকে হয়তো দূরে সরতে চাইছিলাম৷ তাছাড়া ক্রমেই একা বড়ো একা হয়ে পড়ছিলাম৷ কারও গ্রেফতার হবার খবর পাই, কেউ অজ্ঞাত জায়গায় চলে যায়৷
 
   এরকম একটা ভাবনা হয়তো কাজ করেছিল, ইউনিভার্সিটিতে নতুন বন্ধু পাওয়া যাবে৷ অন্যরকম কথাবার্তা হবে৷ তাতে আমার একা হয়ে যাওয়া খানিকটা ঘুচবে৷ লেখাপড়ায়ও একটু মন দেওয়া যেতে পারে৷ এবং সেটা, সত্যি সত্যি, সম্ভব হয়ে উঠছিল অরিজিৎ মিত্রকে বন্ধু পেয়ে৷ মেধাবী, অহংশূন্য, নম্রভাষী, সহৃদয়, বন্ধুবৎসল এক যুবক৷ অরিজিতের মতো বন্ধু জীবনে বেশি পাইনি৷ ওর গোলপার্কের বাড়ি আমার মনের আশ্রয় হয়ে উঠেছিল৷ দোতলার শান্ত একটা ঘরে দুজনে কথা বলা, আমিই বেশি বকতাম আর ও মুচকি হেসে চোখের ভাষায় জবাব দিত, পাঠ্যপ্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা, ভালো উত্তর তৈরির জন্য রেফারেন্স বই দেখা, ওর সংগ্রহে বই ছিল যথেষ্ট, এবং চলে আসার আগে মাংস আর মেটের ছোটো ছোটো টুকরোর হালকা ঝোল আর দু-পিস পাঁউরুটি, মাসিমা নিয়ে আসতেন, অরিজিতের স্বাস্থ্য মেনে প্রস্তুত, আমিও পেতাম, আয়েস করে খাওয়া৷ অরিজিৎ সম্পর্কে অনেক কথা বলবার আছে, যখন ও ‘নবান্ন’ পত্রিকার সম্পাদক সেইসময়ের স্মৃতি আমার চিরদিনের সম্পদ, সবই বলব, পরে কোনো লেখায়৷
 
   ইতিমধ্যে বাবা-মা ভাই আর বোনকে নিয়ে ভদ্রেশ্বরে চলে গেছেন৷ বস্তিঘরের চাবির ডুপ্লিকেট অবশ্য আমার আছে, কারণ আমার জামা-পায়জামা, কিছু বই ও দরকারি কাগজপত্র ছিল ওই ঘরে৷ হঠাৎ কোনো দুপুরে ঘরে ঢুকে পরনের জামা-পায়জামা ধুযে মেলে ধোয়া সেট পরে আসতাম৷ ভাড়াটেদের কেউ জানত না আবার কবে কখন আসব৷ মেলে-দেওয়া জামা-পায়জামা শুকোলে তুলে রাখতেন মালতীদি৷ কিন্তু খাওয়া-দাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়ল৷ ইউনিভার্সিটিতে রাখালদার ক্যান্টিনে দুপুরের ডিম-ভাত সপ্তাহে তিন-চারদিন৷ ‘দাম পরে দেব’ বলে খেয়েছি দিনের পর দিন, পরে শোধ করেছি যৎসামান্য, ধার থেকে গেছে ঢের ! কোনোদিন সংস্কৃত কলেজে নারানদার ক্যান্টিনে আলুর চপ আর মুড়ি বা পরোটা-তরকারি৷ কোনো রাতে কারও বাড়িতে খাবার জুটত, কোনো রাতে না৷ দরগা রোড আর বামুনপাড়ায় দুটো টিউশনি পেয়েছিলাম, সেখানে মাস গেলে কিছু টাকা পাওয়া যেত এবং পড়াবার দিনে চা-বিস্কুট, কখনও ওমলেট জু্টে যেত৷ ওরা আমার রাজনীতির কথা জানত না৷ সেসব দিনের কথা ভাবলে আজ অবাক হই কীভাবে দিনগুলো কাটিয়েছি৷
 
   মা-বাবা ভদ্রেশ্বরে কেন গেলেন ? কারণ: এক. কলকাতা থেকে অনেকটা দূর৷ কমবেশি ৩৫ কিমি৷ রাজনীতি-করা ছেলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানো যাবে৷ দুই. সেখানে একটা কলোনিতে কয়েকঘর আত্মীয়স্বজন থাকেন৷ ঢাকায় যাঁরা একসঙ্গে খেলাধুলা করেছেন, দেশভাগের পর ছিটকে যান এখানে ওখানে, তাঁদের দু-চারজনের সান্নিধ্যে বাবা হয়তো সাহস ও পরামর্শ চাইছিলেন৷ পুলিশের হামলা যদি দল বেঁধে ঠেকানো যায়৷ তিন. ছেলের মতি ফেরাতে হয়তো তাঁরা সাহায্য করতে পারেন৷ চার. পুলিশের হুমকি ও তাণ্ডবে মা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে ওঠেন৷ তাঁকে হয়তো কিছুটা মানসিক শান্তি দেওয়া যাবে৷ পাঁচ. ছেলে যদি মায়ের টানে মরণের রাজনীতি ছেড়ে ঘরমুখো হয়৷ ১৯৭০ সালে যে টাকায় বাবা ভদ্রেশ্বরে জমি কিনেছিলেন, সেই টাকায় যাদবপুর নেতাজিনগর গড়িয়ায় আরও ভালো জমি কেনা যেত৷ 
 
   ভদ্রেশ্বরের কলোনিটি সেদিন বসবাসের পক্ষে বেশ অসুবিধাজনক ছিল৷ বিদ্যুৎ ছিল না৷ দেকানপাট দূরে দূরে৷ বাজার করতে যেতে হয় জিটি রোডে বা আসতে হয় স্টেশনে৷ দুটোই সমান দূরে৷ একখানা ঘর ও আধখানা রান্নাঘর, ঘেঁসের গাঁথনি, মাথায় অ্যাসবেস্টস, কুয়ো পায়খানা, বাতাবিলেবুর গাছ, বেলগাছ, আমগাছ, পেয়ারাগাছ, পৌনে পাঁচকাঠা জমির প্রায় অর্ধেকটা পুকুরের পেটে, উঠোনে দুপুরে ও রাতে সাপের চলাচল, জলের ব্যবস্থা রাস্তার কল ও ভিড়ের চেঁচামেচিতে৷ বাবা-মা যাবার আগে দু-চারদিন থেকেছি এই ঘরে৷ দুপুর হলেই মশারি খাটানো৷ সন্ধের পর হ্যারিকেন জ্বেলে পড়া বা বসে থাকা৷ রাতে ঝিঁঝির ডাকে কালে তালা লাগে৷ পাশের বাড়ি থেকে সুপারি কাটার শব্দ ভেসে আসে মাঝরাত পর্যন্ত৷ বাড়ির উলটোদিকে প্রতিবেশীর গোয়ালঘর৷ সারাদিন গোবরের গন্ধ ভাসে৷ আমাকে যদি কোনো গ্রামে পাঠানো হত, সেখানকার পরিস্থিতি এর চেয়ে কঠিন হতে পারত৷
 

ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকেই প্রুফ দেখি৷ বিশেষ করে সংস্কৃত প্রুফ৷ দেবনাগরী হরফ বাবা চিনতেন না৷ শ্যামলবরণ দত্ত অর্থাৎ শ্যামলস্যারের জন্য সংস্কৃত আমার প্রিয় বিষয় হয়েছিল৷ একটা ট্রেডল মেশিন, তিনটে কম্পোজিটর সিট আর একটা টেবিল, দুটো চেয়ার নিয়ে আমাদের ছোটোখাটো প্রেস৷ পরে একটু বড়ো হয়েছে৷ সে পরের কথা৷ লেগে গেলাম প্রেসের কাজে৷ নিজেকে জুড়ে দিলাম৷

 
   মালতীদির সঙ্গে হঠাৎ দেখা৷ হনহনিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন৷ দেখতে পেয়ে প্রায় ছুটে কাছে এসে বললেন, এদিকে আয়৷ বলে নিয়ে গেলেন পুলের নীচে৷ গলা নামিয়ে বললেন, বাড়ির দিকে এখন একদম আসবি না৷ হরিপদদার চায়ের দোকানে সাদা পোশাকে পুলিশ বসে৷ গেল পাঁচ-সাতদিন হল বসছে৷ হরিপদদা বলল তোকে সাবধান করে দিতে৷ শোন, তোর জামাকাপড় আমি গুছিয়ে রেখেছি৷ যদি বলিস কোথাও দিয়ে আসতে, আমি যাব৷ তোর ঘরে আসার দরকার নেই৷ মানিক তো জেলে৷ কবে ছাড়া পাবে ঠিক নেই৷ ওর বাবা থানা-কোর্ট দৌড়াদৌড়ি করছে৷ কী বিপদ! আমি মালতীদিকে বলেছিলাম, তুমি জামা-পায়জামাটা মদনদার দোকানে (লন্ড্রি) দিয়ে রেখো৷
 
   পাপিয়ার সঙ্গে হঠাৎ দেখা গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারে৷ কর্পোরেশন স্কুলের পাশ দিয়ে পশ্চিমমুখো এগিয়ে বড়ো রাস্তা এড়াতে কোয়ার্টারে ঢুকেছিলাম৷ ভেতর দিয়ে ডিহি শ্রীরামপুর রোডে পড়ব৷ তখন বিকেল৷ কোয়ার্টারের কোনো ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল পাপিয়া৷ আমাকে দেখেও দেখল না৷ উলটোদিকে হাঁটতে শুরু করল৷ আমি ডাকিনি৷ আগের পাপিয়া আর নেই৷ বড়ো হয়েছে৷ দেখতে আরও সুন্দর হয়েছে৷ হয়তো আমার রাজনীতির কথা শুনেছে৷ তাতে বিরক্ত হতেই পারে৷ পাপিয়ার কথা মাঝে মধ্যে মনে যে পড়েনি তা নয়৷ ইচ্ছে করেছে ওদের বাড়ি যেতে৷ কিন্তু কেন জানি মনে হত ও আমার সঙ্গে কথা বলবে না৷ ও হেঁটে গেল৷ আমি দ্রুতপায়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে সুরেশ সরকার রোড পার হয়ে বস্তির গলিতে ঢুকে পড়লাম৷ বুঝতে পারলাম শিশুবয়স থেকে চেনা এইসব পথ গলি ঘরবাড়ি দরজা জানালা গাছপালা, রামুমুচির দুলে দুলে রঘুপতির গান গাওয়া, গুন্ডিপানের মশলা বানাতে বানাতে নকুলের ওড়িয়া গান গাওয়া সব অচেনা হয়ে গেছে৷ 
 
   এভাবে কখন যে কেটে গেল একবছর৷ ছন্নছাড়া জীবন৷ অরিজিৎ একদিন জিজ্ঞেস করল, পড়িস কখন? পরীক্ষা দিতে হবে তো?
 
   পড়াশোনা থেকে একেবারে ছিটকে গেছি৷ শুধু ইউনিভার্সিটি যাওয়াটাই আছে৷ ক্লাস করি না নিয়মিত৷ নতুন বন্ধু কামালউদ্দিনের এলিয়ট রো-র বাড়িতে পড়ার একটা ব্যবস্থা হয়েছিল৷ ও একা একটা ঘরে থাকে৷ কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারি বাবুর দোষ আছে৷ রসিক মানুষ৷ এসময় কাজের চেষ্টা করেছি৷ যে কোনো কাজ৷ ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদের কাজ পেয়েছিলাম৷ কিন্তু সেখানে মজুরি এত কম এবং কাজ এত অনিশ্চিত যে নির্ভর করা যায় না একেবারেই৷ 
 
   অগত্যা সিদ্ধান্ত নিলাম বাবার প্রেসে কাজ করব৷ ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এক বিকেলে চলে গেলাম৷ বাবা প্রেসে ছিলেন৷ দুই কি আড়াই মাস পরে দেখলেন৷ বললেন, কই আইছস ? বললাম, এইখানে৷ প্রেসে৷—কাজ করুম৷ জিজ্ঞেস করলেন, পার্টি ? আমার জবাব নেই৷ থাকস কই ? খাস কী? এসব প্রশ্নেরও জবাব নেই৷ ভদ্রেশ্বর যাবি ? বলি, এখন না৷ মায়েরে দেখতে ইচ্ছা করে না ? বলি, যামু৷ পুলিশের তাড়া খাইয়া এইখানে ঢুকলি ? বলি, না৷ কাজ করুম৷
 
   প্রেসের কাজ আমি অল্পস্বল্প জানতাম আগেই৷ ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকেই প্রুফ দেখি৷ বিশেষ করে সংস্কৃত প্রুফ৷ দেবনাগরী হরফ বাবা চিনতেন না৷ শ্যামলবরণ দত্ত অর্থাৎ শ্যামলস্যারের জন্য সংস্কৃত আমার প্রিয় বিষয় হয়েছিল৷ একটা ট্রেডল মেশিন, তিনটে কম্পোজিটর সিট আর একটা টেবিল, দুটো চেয়ার নিয়ে আমাদের ছোটোখাটো প্রেস৷ পরে একটু বড়ো হয়েছে৷ সে পরের কথা৷ লেগে গেলাম প্রেসের কাজে৷ নিজেকে জুড়ে দিলাম৷ বাবা দিনের বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরে থাকেন৷ কাজের খোঁজে৷ আমি সকাল থেকে কিছু কম্পোজ করে ক্লাসে যাই৷ বিকেলে ফিরে আসি৷ রাতে প্রেসেই থাকি৷ পড়ি৷ অরিজিতের কাছ থেকে বই আনি৷ দুপুরের খাওয়া রাখালদার ক্যান্টিনে৷ রাতে কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের হোটেলে৷ দিনগুলো যেন শান্ত হল৷ স্নান পেল, ঘুম পেল, ছন্দ পেল৷ প্রেসে পুলিশের উৎপাত হয়নি৷
 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ২১

ভোর ভয়ি। পর্ব ২১ : খোঁচড় বৃত্তান্ত, পুলিশের খপ্পরে মানিকদা


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!