- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- এপ্রিল ২৮, ২০২৪
ভোর ভয়ি । পর্ব ৩
অসামান্য একটি গ্রন্থকে হত্যা করেছিল এক ছাপুড়ে

চিত্রকর্ম: চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য
বায়োস্কোপের বাকসো। রঙের নকশা চটে খসে এখানে-ওখানে বেরিয়ে পড়েছে মৃত্যু-প্রস্তাব। বাকসোর গোল জানালার ঢাকনা কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। চোখের পর্দায় আসে শূন্য খেয়াঘাট, দূরে দূরে সবল ডানার চিল, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, আরও কত রক্ত চাই তব প্রীতি তরে, ধানের ক্ষেতে মশাল আগুন, লকআপের আর্তনাদে বাতাস কাঁপে, শিক্ষকদের চেয়ারে ভাঙনের শব্দ, রং ও রেখায় জাগে পুরাণপ্রতিমা, উন্নয়ন আর উৎসব শুষে খায় জলাভূমি, কুয়াশার ওপারে পলিথিনে মোড়া চাঁদ, জোড়া চোখ ঘটনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাঁতরায়, দূরে কোথাও আগুনবরণ আকাশে বাজে ‘ভোর ভয়ি’।
♦ তৃতীয় পর্ব ♦
বলছিলাম ১৯৬৫-৬৬র কথা ৷ এই সময়কালে স্কুলে পড়েছি, স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিয়েছি ৷ সতীনাথ ভাদুড়ীর দুটো উপন্যাসের প্রসঙ্গ এসেছে শ্যামলস্যারের কথাসূত্রে ৷ এইখানে একটা লম্বা লাফ দিতেই হচ্ছে ৷ কমবেশি পঞ্চাশ বছর পরেকার একটা ট্রাজেডি, একটা বিশ্বাসঘাতকতা ও বর্বরতার ইতিহাস এইখানে বলতে হচ্ছে ৷ সতীনাথ ভাদুড়ীর লেখা নিয়ে আমার আবেগ আমার উচ্ছ্বাস কীভাবে এক আপাদমস্তক সুজনকে বিপদে ফেলেছিল এবং একটি দুর্জনসুলভ ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের মৃত্যু ঘটিয়েছিল, সে-ইতিবৃত্ত এখানেই বলা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হবে৷
সতীনাথ ভাদুড়ী পূর্ণিয়ার তরুণদের প্রিয় ‘সতুদা’ ৷ সেটা লেখক হবার কারণে তো বটেই, রাজনীতিও একটা কারণ ৷ বালকবয়স থেকে সুবল গঙ্গোপাধ্যায়ের হিরো সতুদা ৷ দেশ স্বাধীন হবার আগে সতীনাথ যখন জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক, সুবলবাবু তাঁর বাড়িতে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখেছেন রাজেন্দ্র প্রসাদ, জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য কৃপালনী প্রমুখ সর্বভারতীয় নেতারা বৈঠক করছেন ৷ বিহারের আঞ্চলিক নেতারা তো তাঁর শিষ্য ৷ সতীনাথের বাড়ির ব্যায়ামাগারে দেহচর্চা করেছেন সুবলবাবু ৷ শুনেছেন তাঁর মুখে ইউরোপ ভ্রমণের কথা ৷ দেখেছেন তাঁর বাগান করা ৷ সেই ‘সতুদা’ প্রয়াত হলেন ৩০ মার্চ ১৯৬৫ ৷ শুরু হল সুবল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘হিরো ওয়র্শিপ’৷ প্রায় সাত বছরের নিষ্ঠায় ও শ্রমে তিনি প্রকাশ করলেন ‘সতীনাথ স্মরণে’ ৷ তারিখ নভেম্বর ১৯৭২ ৷ ‘সম্পাদকের কথা’য় লিখলেন, ‘ভালোবাসা যেখানে, বেদনাও সেখানে ৷ গভীর ব্যথায় দস্যু রত্নাকরের মুখ থেকে মা নিষাদ বের হয়েছিল ৷ সাহিত্যের মূল বেদনা উপলব্ধি থেকে, কিন্তু তার সমাপ্তি আনন্দরসে ৷ বেদনা যদি কিছু থাকে তা আমার ৷ কিন্তু পাঠক যদি আনন্দরসের সামান্য আস্বাদও এই স্মরণগ্রন্থ থেকে লাভ করেন, তাহলে আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে মনে করব ৷’ এই স্মরণগ্রন্থে লেখেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, অন্নদাশঙ্কর রায়, বনফুল, ফণীশ্বরনাথ রেণু, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, বাণী রায়, গোপাল হালদার, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ভবানী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ৷
স্মরণগ্রন্থ বা স্মারকগ্রন্থ করার যে রেওয়াজ চালু আছে তার চেয়ে অনেকটাই অন্যরকম এই বই ৷ একান্ত নির্জনবাসী মিতভাষী ব্যক্তি সতীনাথকে জানবার বোঝবার এবং মননদীপ্ত ভিন্নধর্মী লেখক সতীনাথকে অনুধাবন করবার পক্ষে এ বই অপরিহার্য ৷ ‘সতুদা’কে যতটাসম্ভব বিস্তারে দেখার চেষ্টা ছিল সম্পাদনায় ৷
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘জোর করে পাঠক তৈরি করা যায় না ৷ আমার মতো লোকেরা বারবার লিখলেও সতীনাথ ভাদুড়ীর পাঠকের সংখ্যা বাড়বে না ৷ কিন্তু এইটুকু আশা করি, যাঁরা বাংলা সাহিত্যকে সত্যিকারের মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করতে চান, কিংবা যাঁরা নিজেরো কিছু লিখতে চান, তাঁদের কাছে এই লেখক অপরিহার্য
অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘অকৃত্রিম, অকপট, দরদী, প্রজ্ঞাদীপ্ত, বৈশিষ্ট্যবান লেখনী তাঁর৷ তাঁর কণ্ঠস্বর হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল দেখে ব্যথা বোধ করছি ৷ বিলম্বে এসে অসময়ে প্রয়াণ করে তিনি যা রেখে গেছেন তার মাধুরী ভোগ করছে তাঁর গুণমুগ্ধ দেশবাসী, বিদেশীরাও৷’ সতীনাথ ভাদুড়ীর ভাবশিষ্য ফণীশ্বরনাথ রেণু বলেছেন, ‘বাবা [রেণুজির বাবা] আরও অনেক কথা বলতেন ছোটোবাবুর [সতীনাথ ভাদুড়ী] সম্বন্ধে— ছেলে হয় তো ছোটোবাবুর মতন ৷ একটুও মেজাজ বা বিদ্যার ‘ঘমন্ড’ (দেমাক) নেই ৷ অযথা কোনো কথা বলেন না৷ ওকালতি পড়বার সময়েই ওঁর তৈরি করা ‘মিশিল’ পড়ে পূর্ণিয়ার ‘বার লাইব্রেরি’তে সিনিয়র উকিলরা ‘দাঁতের তলায় আঁগুলি’ দিতেন— এ তো আর-একটা ইন্দুবাবু [সতীনাথের বাবা ইন্দুভূষণ] তৈরি হয়ে গেছে ৷ আর হাতের লেখা? কী ইংরেজি কী বাংলা কী ‘কায়েথী’ (দশ-এগারো বছর আগে পর্যন্ত যে লিপি বিহারের কোর্টে চালু ছিল)— অক্ষরগুলো ঠিক ‘মোতীর দানা’র মতন৷ কোথাও ‘কাটকুট’ নয় ৷ সেদিন কোরবান মুহুরি বলছিল যে এমনি সুন্দর ‘হরুফ’ দেখেই উর্দু ভাষার কোনো শায়ের বলেছিলেন, লিখনেওয়ালে কী ওঁগলিয়াঁ চুম লুঁ…৷’ এই সংকলনে বিমল কর লিখেছেন, ‘কলেজ স্ট্রিটে যাবৎ বঙ্গীয় সাহিত্যিকদের দেখা যায় ৷ কাউকে দেখেছি পাবলিশারের দোকানে বসে অট্টহাস্য করছেন, কাউকে দেখেছি কফি খাচ্ছেন, সন্দেশ খাচ্ছেন, কেউ বা গলাবন্ধ কোট গায়ে থলি হাতে পাবলিশারের সঙ্গে গলায় গলায় হয়ে পাবলিশারের গাড়িতে উঠছেন, কেউ মাসিক বরাদ্দের টাকা নিয়ে ভাউচার সই করছেন, কেউ নাকে নস্যি গুঁজে তাঁর প্রকাশককে একডজন পাঠকের চিঠি দেখাচ্ছেন নিজের সম্পর্কে ৷ এই ধরনের অসংখ্য দৃশ্য দেখে দেখে ভাবতাম, হয়তো কোনোদিন পূর্ণিয়াবাসী সেই সাহিত্যিকটিকেও দেখতে পাব এখানে ৷ কিন্তু না, তাঁকে দেখিনি, কোনোদিনও নয় ৷ অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁরা বলেছেন, আমরাও দেখিনি ৷ আমারই ভুল হয়েছিল প্রথমে, পরে বুঝেছিলাম, সংস্কৃতির পীঠস্থানে প্রণামী ফেলতে আসার লোক তিনি নন ৷ সতীনাথ অন্য জাতের সাহিত্যিক, কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় তাঁর দেখা পাওয়া যাবে না ৷’ প্রসঙ্গত মনে পড়ে, প্রকাশ ভবনের পরিচালক স্বপন মুখোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছিলাম, তিনি সতীনাথ ভাদুড়ীকে একবার দেখেছেন ৷ বেঙ্গল পাবলিশার্স ও প্রকাশ ভবন তখন এক ছিল, বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে সতীনাথের বই প্রকাশিত হত ৷ একদিন সতীনাথ হঠাৎই এলেন ৷ বইপাড়ায় ঘুরতে এসেছেন ৷ প্রকাশকের সঙ্গে একটু গল্প করে যাবেন ৷ কলকাতায় সচরাচর আসা হয় না ৷ খানিকক্ষণ গল্প হবার পর শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (স্বপনবাবুর পিতৃদেব, বেঙ্গল পাবলিশার্সের অন্যতম মালিক) বললেন, এলেন যখন, আপনার গ্রন্থস্বত্ব বাবদ প্রাপ্য কিছু টাকা আপনার হাতে দিয়ে দিই ৷ আমাদের ভালো লাগবে ৷ শচীন্দ্রবাবু এক কর্মচারীকে হিসেব দেখতে বললেন ৷ সতীনাথ বললেন, হিসেবটা হোক, আমি একটু ঘুরে আসি ৷ তিনি বেরিয়ে গেলেন ৷ আর আসেননি ৷
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘যোগ্য নতুন লেখককে সম্মানিত করার [সতীনাথের রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্তি]’ এমন দৃষ্টান্ত আর চোখে পড়েনি ৷…তাঁর রচনাবলি বেঁচে থাকবে কিনা সেই হচ্ছে কথা ৷ জোর করে পাঠক তৈরি করা যায় না ৷ আমার মতো লোকেরা বারবার লিখলেও সতীনাথ ভাদুড়ীর পাঠকের সংখ্যা বাড়বে না ৷ কিন্তু এইটুকু আশা করি, যাঁরা বাংলা সাহিত্যকে সত্যিকারের মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করতে চান, কিংবা যাঁরা নিজেরো কিছু লিখতে চান, তাঁদের কাছে এই লেখক অপরিহার্য ৷ ইনি হচ্ছেন জাত লেখক ৷’ পরে একটি সাক্ষাৎকারে পড়েছি যে, অরুণা প্রকাশনীর মালিক বিকাশ বাগচিকে ‘সতীনাথ গ্রন্থাবলী’ প্রকাশের পরামর্শ দিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ৷
সুবল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সতীনাথ স্মরণে’ বিহারের তৎকালীন রাজ্যপাল দেবকান্ত বরুয়ার অর্থসাহায্য পেয়েছিল ৷ সম্পাদক লেখা সংগ্রহ ও মুদ্রণ ইত্যাদি্ ব্যয়ের অনেকটাই বহন করেন নিজে ৷ প্রকাশক হিসেবে নাম ছিল ভারতী ভবন, পাটনা ১-এর ৷ গ্রন্থস্বত্ব সম্পাদকের ৷ ১৯৭২-এ প্রকাশের পর বইটি আর ছাপা হয়নি ৷ ধরে নেওয়া যায়, তিরিশ বছরের বেশি বইটি ছাপা নেই ৷ সংকলনের কিছু লেখা সতীনাথ ভাদুড়ী বিশেষ সংখ্যায় মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয় ৷ কিন্তু মূল বইটি পাওয়া যায় না ৷ আমরা এই সংকলনের পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ বের করার উদ্যোগ নিই ২০১২ সালে ৷ ইতিমধ্যে সুবলবাবু প্রয়াত ৷ তাঁর স্ত্রী, দুই পুত্রও ৷ তাঁর ভাই শেখরবাবুকে পাওয়া গেল বহু খুঁজে ৷ তিনি পুণের বাসিন্দা ৷ কথা বললাম ৷ তিনি জানালেন, বইটা দাদা নিজের খরচে বের করেছেন ৷ আপনারা যদি আবার প্রকাশ করতে চান, করুন ৷ আমরা তাঁর লিখিত অনুমতি চাই ৷ উনি দিতে সম্মত হন ৷ ‘সতীনাথ স্মরণে’র পরিবর্ধিত সংস্করণ বের হয় জানুয়ারি ২০১৩-য় ৷ প্রকাশ ভবন থেকে ৷ আনন্দবাজার পত্রিকা প্রশংসা করে ৷ ঠিক এরপরই হাজির হয় সেই ভারতী ভবন, পাটনা ১ ৷ তারা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের একটি ঠিকানায় দেখা করতে বলে ৷ তাদের দাবি, বইটি তাদের এবং তারা আবার প্রকাশ করবে ৷
আমাদের প্রশ্ন ছিল: ১. বইটির প্রকাশস্বত্ব নিয়ে চুক্তি আছে কি ? ২. বইয়ের স্বত্ববাবদ প্রাপ্য সম্পাদক বা তাঁর ওয়ারিশনকে কখনও দেওয়া হয়েছে কি? ৩. অবিক্রিত বইয়ের মজুত আছে কি? ৪. তিরিশ বছরের বেশি বইটি ছাপা নেই কেন? ৫. বইটি বিক্রির সাম্প্রতিক কোনো মেমো আছে কি? ইত্যাদি ৷
ওরা কোনো কিছু দেখাতে পারেনি এবং জবাবও দিতে পারেনি ৷ শুধু একটাই কথা, বইটা আমাদের ৷ আমরা একথাও বলি, ঠিক আছে, আমাদের ছাপা বইটা আপনারা বেচুন, টাইটেল পালটে ৷ লিখে দিচ্ছি ৷ পয়সা দিতে হবে না ৷ বহুদিন বইটা পাওয়া যায় না ৷ এটা ছিল বইটিকে বাঁচাতে আমাদের শেষ চেষ্টা ৷ সুবলবাবুর ভাই শেখরবাবু আমাদের লিখে দেননি এবং তাঁকে সমস্যা জানালে তিনি আর ফোন ধরেননি ৷ কেন জানি ভাগলবা হয়ে যান ৷ প্রকাশ ভবনের মালিক আদ্যন্ত সুভদ্র স্বপন মুখোপাধ্যায় উকিলি ঝামেলায় যেতে চাননি ৷ বলেন, যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে ৷ আর সমস্যা চাই না ৷ কোর্ট-কাছারি আমার পোষাবে না ৷ ওরা বলল সারেন্ডার করতে ৷ স্বপনবাবু ৩৫০ পৃষ্ঠার ‘সতীনাথ স্মরণে’-র সব ফর্মা পাঠালেন ভারতী-তে ৷ ওরা নাকি কাটিং মেশিনে ‘ডেস্ট্রয়’ করেছে ‘সতীনাথ’-কে ৷
এই ছাপুড়ের ছুরির নীচে ছিন্নভিন্ন হন সতীনাথ ভাদুড়ী ৷ বঙ্গীয় সাহিত্যিক ও প্রকাশকদের অনেককেই বলেছিলাম তখন ৷ কেউ কিছু করেননি ৷
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ২
❤ Support Us