Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • মে ৫, ২০২৪

ভোর ভয়ি। পর্ব ৪

মধুময় পাল
ভোর ভয়ি। পর্ব ৪

চিত্রকর্ম: দেব সরকার

বায়োস্কোপের বাকসো। রঙের নকশা চটে খসে এখানে-ওখানে বেরিয়ে পড়েছে মৃত‍্যু-প্রস্তাব। বাকসোর গোল জানালার ঢাকনা কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। চোখের পর্দায় আসে শূন‍্য খেয়াঘাট, দূরে দূরে সবল ডানার চিল, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, আরও কত রক্ত চাই তব প্রীতি তরে, ধানের ক্ষেতে মশাল আগুন, লকআপের আর্তনাদে বাতাস কাঁপে, শিক্ষকদের চেয়ারে ভাঙনের শব্দ, রং ও রেখায় জাগে পুরাণপ্রতিমা, উন্নয়ন আর উৎসব শুষে খায় জলাভূমি, কুয়াশার ওপারে পলিথিনে মোড়া চাঁদ, জোড়া চোখ ঘটনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাঁতরায়, দূরে কোথাও আগুনবরণ আকাশে বাজে ‘ভোর ভয়ি’।

 

চতুর্থ পর্ব

তোমাকে কেমন লাগছে বলব?

   জানি ও আমাকে নিয়ে মজা করে কিছু বলবে এবং আমাকে খুশি করে এমন কিছু বলবে না৷ বলো৷

   ফুলসাইজ ভ্যাবলা৷ পাপিয়া বলল৷ হাফপ্যান্টে হাফসাইজ ছিলে৷

   চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি৷ পাপিয়ার চোখ থেকে আমার চোখ নামিয়ে আনি মাটির দিকে৷ 

   রাগ করলে? কারও সামনে বলিনি৷ কথা রেখেছি৷

   নতুন কেনা ফুলপ্যান্ট আর ফুলশার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছি পাপিয়াদের বাড়ির ‘জাদুবাড়ি’ লেখা দরজায়৷ কলেজ থেকে ফিরছি৷ দোতলার বারান্দা থেকে পাপিয়া ডাকল৷ এলাম৷ ওদের দরজার বাইরে পাঁচিল ঘেঁষে আতাগাছ৷ আমার বালকবেলার চেনা৷ পাপিয়া বারান্দা থেকে নেমে দরজা খুলে বলল, ভেতরে এসো৷ এদিকে আসা ছেড়েই দিয়েছ৷ কতকাল ক্যারম খেলি না৷

   আমি বলি, কলেজে ভরতি হয়েছি৷ জেনারেল ক্লাস, অনার্সের ক্লাস, সেমিনার৷ বেলা এগারোটা থেকে৷ ফিরতে ফিরতে বিকেল৷ মাঝে মাঝে কলেজ স্ট্রিটে আমাদের প্রেসে যেতে হয়৷ এসব বলেছি হয়তো এটা বোঝাতে যে আমি আর আগের মতো ফালতু নই৷

   পাপিয়া হেসেছে৷ বলেছে, শুনেছি৷ কলেজে ভরতি হয়েছ৷ বাংলা নিয়ে পড়ছ৷ পিসিমা বলল৷ আমাকে বলোনি তুমি৷ 

   আমি কথা খুঁজেছি৷

   তোমাকে কেমন লাগছে বলব ? ফুলসাইজ ভ্যাবলা৷ হাফপ্যান্টে হাফসাইজ ছিলে৷ এখন ফুলসাইজ৷ 

   আতাগাছ বেশি উঁচু নয়৷ একটা ডাল আমার মাথা ছুঁয়ে আছে৷ উজ্জ্বল কালো দরজার ওপারে হলুদ শাড়ি পরে পাপিয়া৷ ছিপছিপে গড়নের ওপর ওর চোখ মুখ ছবির মতো৷ গল্পের বইয়ে, ক্যালেন্ডারে, সিনেমার হোর্ডিংয়ে ছেলেবেলা থেকে যা দেখেছে আমার চোখ, আমাদের চারপাশের রোজকার মুখগুলো থেকে আলাদা, সেইরকম ছবির মতো৷

   রাগ করলে? ভেতরে এসো৷ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে মা আমাকে বকবে৷ 

   রাগ হয়েছিল৷ অপমানের কাছাকাছি একটা বোধ রাগ ডেকে আনে৷ কিন্তু দরজা পেরিয়ে আমি বাড়িতে ঢুকেছিলাম৷ পাপিয়া দরজা বন্ধ করার সময় পারফিউমের সুন্দর গন্ধ পেলাম৷

♦•♦  ♦•♦  ♦•♦

   কমবেশি পঞ্চান্ন বছর আগেকার আতাগাছের স্মৃতির নীচে দাঁড়িয়ে এখন আমি৷ বাজি রেখে বলতে পারি, গাছটা আজ নেই৷ পাপিয়াদের আকাশি রঙের দোতলা বাড়িটাও নেই৷ ‘জাদুবাড়ি’ লেখা দরজাটা কোথায় কে জানে৷ উন্নয়নের নামে ঢালাই বস্তির যে হিড়িক লেগেছে পাড়ায় পাড়ায় তাতে কোনো নির্জনতাই থাকতে পারে না৷ ছিমছাম ঘরবাড়ির অস্তি্ত্ব থাকতে পারে না৷ একটিও অন্তরঙ্গ সংলাপ থাকতে পারে না৷ গাছ মাঠ পাখি পুকুরদের যে মহাসমাজ, যা আমাদের ধারণ করে লালন করে পালন করে উত্তীর্ণ করে, তার শেষ ঘটে গেছে, উন্নয়নের ফ্লেক্সের ঘোষণার সন্ত্রস্ত দিনকালে৷  

   পাপিয়া কোথাও আছে শুনেছি, তাই আসল নাম লুকিয়ে রাখলাম৷

   কোনোদিন ভোলা যাবে না, এক সকালে ‘হাওড়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ থেকে ঠোঙা-ভরা সিঙাড়া-কচুরি নিয়ে ঘরে ফিরছিলাম৷ তখন আমি সিক্স কি সেভেনে৷ দড়িবাঁধা ডুরে কাপড়ের হাফপ্যান্ট৷ হয়তো গা খালি ছিল৷ হয়তো সেদিন রবিবার ছিল৷ রোজকার হাতরুটি-আলুপেঁয়াজ ভাঁজা বা হাতরুটি-গুড়ের বদলে দোকানের মুখরোচক জলখাবার আনবার টাকা দিয়েছিল বাবা৷ ‘মাতৃ ভাণ্ডার’-এর কাছাকাছি হতেই একটা কাক ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার হাত থেকে ঠোঙা ছিনিয়ে উড়ে যায়৷ বেবাক-বোকা আমি থামের মতো দাঁড়িয়ে থাকি৷ কাকের ধারালো নখের খোঁচায় ছড়ে-যাওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে৷ ঠাকুমা জানলে বলত, আস্তা ব্যাক্কল৷ দাদু জানলে বলত, অলম্বুষ৷ (শব্দটার  অর্থ তখন অজানা৷ ভেবে নিতাম অপদার্থের কাছাকাছি কিছু হবে৷ পরে জেনেছি, মহাভারতে ঘটোৎকচ অলম্বুষের মাথা কেটেছিল৷ আমাকে সম্ভবত মস্তিষ্কহীন বোঝাতেই অলম্বুষ বলা হত৷) থামের মতো দাঁড়িয়ে-থাকা আমি হাসির শব্দ শুনতে পাই৷ ষাট দশকের গোড়ার দিকের কলকাতায় হাসির শব্দ তরঙ্গিত হবার পরিসর ছিল মাটিতে আকাশে৷ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, আতাগাছের ওপারে জাদুবাড়ির দোতলার বারান্দায় ফ্রক-পরা মেয়ে রেলিং ধরে হেসে কুটিকুটি৷ জাজুকরের মেয়ে৷ বন্ধুদের সঙ্গে আতা পাড়তে গিয়ে ওকে দেখেছি৷ ব্যাপটিস্ট মিশন গার্লস স্কুলে পড়ে৷ গাড়িতে যায় আসে৷ মায়ের সঙ্গে লেডিজ পার্কে বেড়াতে যায়৷ 

   লজ্জায় মাথা নিচু করে ওর হাসি থেকে জোরে পা চালিয়ে পালাই৷ তখন সাগরদের টিনের চালে কাকের দল সিঙাড়া-কচুরি নিয়ে ভোরভোজের চিৎকার আর ঝাপটা-ঝাপটিতে মেতেছে৷ 

   দিনকয়েক বাদে বিকেলের দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়েটি আমাকে ডেকেছিল৷ বলেছিল, তোমার জন্য মা-র কাছে বকুনি খেয়েছি৷ আমার কী দোষ ছিল? তোমার হাত থেকে কাকটা ছোঁ মেরে ঠোঙা নিয়ে গেল৷ তুমি ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকলে৷ আমার হাসি পেল৷ হাসলাম৷ হাসি চাপতে পারলাম না৷ মা বলে, হাসা উচিত হয়নি৷ এতে অপমান করা হয়৷ আমি কোথায় অপমান করলাম? আমি তো কাকের চালাকি আর তেমার মুখ দেখে হেসে ফেলেছি মাত্র৷ মা বলেছে তোমাকে আমাদের বাড়িতে আসতে৷ যদি আসো খুব মজা হবে৷ ক্যারম খেলব৷ একা একা খেলা যায়? মা তো খেলতেই পারে না৷ স্ট্রাইকার ধরতেই জানে না৷ বাবার সঙ্গে খেলা জমে৷ কিন্তু বাবা থাকেই না৷ আমার নাম পাপিয়া রায়৷ মা ডাকে, বুলবুলি৷

পশ্চিমদিকে বন্ধ ঘরের মাথায় ক্রুশবিদ্ধ যিশু৷ আমরা ক্যারম খেলি৷ ঘুঁটির শব্দ ঘরময় ছোটাছুটি করে৷ দোতলা থেকে ভেসে আসে পাপিয়ার মায়ের খালি গলায় গান৷ পাপিয়াদের সঙ্গে বাজারে যাই, ডাক্তারখানায় যাই, ওদের ইলেকট্রিক বিল জমা দিই, কলের মিস্ত্রি ডেকে আনি৷ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত ওইবাড়িতে আমার যাওয়া প্রায় নিয়মিত ছিল

   বস্তিঘরের খাড়াচুলো কালা বাঙাল কোনোদিন জাদুবাড়িতে ঢুকতে পাবে ভাবতে পারেনি৷ জাদুবাড়ি নিয়ে তার একটা কৌতূহল ছিল বটে, আতাগাছে উঠে উঁকি মেরে দেখতে চেয়েছে বাড়ির ভেতর, দেখেছে লাল সিঁড়ি কয়েক ধাপ, সবুজ জানালার পাল্লা, ব্যস ওইটুকু৷ উকিলবাড়ি্র মেয়ে শিলা তার সঙ্গে ডেকে-ডেকে কথা বলে জানালায় দাঁড়িয়ে, এটা-সেটা কিনে এনে দিতে বলে, কোনোদিন বাড়িতে ডাকেনি৷ রবিনের দিদি দেখতে পেলেই পড়ার কথা বলে, সে যে লেখাপড়ায় খুব ভালো সেকথা গুছিয়ে বলে, কখনও ঘরে ডাকেনি৷ ভাগ্যিস কাকটা সেদিন তার হাতে ছোঁ মেরেছিল৷ ততটা ভ্যাবলা না হলেও সে সেদিন সত্যি ভ্যাবলাকান্ত বনেছিল৷ পাপিয়া বলল, এই ঘরে বোসো৷ মা-কে বলছি৷ ওই যে ক্যারমবোর্ড৷ ঘুঁটি সাজাও৷ আমি আসছি৷

   আশ্চর্য শান্ত বাড়ি৷ বিরাট হলঘর৷ একতলার একটি ঘর ছাড়া সব বন্ধ৷ পশ্চিমের জানালা দিয়ে আসা আলোর পাশে ছড়ানো ছায়া৷ হলঘরের বাঁদিকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়৷ সেখানে বাতাসে পর্দা ওড়ে৷ তার শব্দ নেমে আসে৷ সিঁড়ির পাশে কয়েকটা কালো ট্রাঙ্ক৷ তাদের গায়ে লেখা KING MAGICIAN K K৷ একটা ট্রাঙ্কের গায়ে DANGER এবং ক্রস-করা হাড় ও মুন্ডুর ছবি৷ পশ্চিমদিকে বন্ধ ঘরের মাথায় ক্রুশবিদ্ধ যিশু৷ আমরা ক্যারম খেলি৷ ঘুঁটির শব্দ ঘরময় ছোটাছুটি করে৷ দোতলা থেকে ভেসে আসে পাপিয়ার মায়ের খালি গলায় গান৷ পাপিয়াদের সঙ্গে বাজারে যাই, ডাক্তারখানায় যাই, ওদের ইলেকট্রিক বিল জমা দিই, কলের মিস্ত্রি ডেকে আনি৷ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত ওইবাড়িতে আমার যাওয়া প্রায় নিয়মিত ছিল৷ এখানে বলতে হয়, দুটো ব্যাপার রহস্যময় থেকে গেছে৷ এক. পাপিয়ার বাবা অর্থাৎ ম্যাজিশিয়ান কে কে রায়কে আমি কখনও দেখিনি৷ দুই. হলঘরে পায়ের শব্দ শুনতে পেতাম, আবছা, ফিসফিস কানে আসত, ছায়ার ভেতর ছায়া নড়াচড়া করত, কখনও কাউকে দেখিনি৷ পাপিয়া বলেছে, ডোন্ট বি কুরিয়াস৷ বাবার দুটো পুষ্যি আছে৷

কমবেশি পঁয়তাল্লিশ বছর পর, লেখা হবে একটি গল্প, নাম ‘দোলাদের জাদুবাড়ি’৷ পাপিয়া এখানে দোলা, ছেলেটি তিমির৷ যা দেখেছি সেটাই লেখা হতে থাকবে৷ কিন্তু অভাবিত কয়েকটা জিনিস এসে যাবে৷ দোলার মা নারীর অধিকারে তিমিরকে চাইবে৷ দোলার সঙ্গে খেলতে খেলতে তিমির যখন স্পর্শসুখে ডুবে যাবে, আবিষ্কার করবে সেটা দোলার মা-র সোহাগ-সংলাপ৷ দোলার মা ভয় পাবে মাথা-ছেঁড়া কোনো আদুরে পাখির রক্তাক্ত দৃশ্যে৷ কুড়ি বছরের পুরোনা মোটা খাতা দিয়ে থেঁতলে মারবে৷ দেয়ালে লাগবে রক্তের ছিটে

   পার্টিবাজির দৌরাত্ম্যে পাড়াছাড়া হবার কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমি পাপিয়াদের বাড়ি যাব এবং এরপর আর কোনোদিন যাব না, দেখা হবে না৷

  এবং ২০১৫ সালে, কমবেশি পঁয়তাল্লিশ বছর পর, লেখা হবে একটি গল্প, নাম ‘দোলাদের জাদুবাড়ি’৷ পাপিয়া এখানে দোলা, ছেলেটি তিমির৷ এত বছর পরেও, গল্পে কুড়ি কুড়ি বছরের পর, সব কিছুই প্রায় একইরকম৷ বয়সের ভারী বা শিথিল ছাপ নেই কারও কণ্ঠস্বরেও৷ শান্ত রহস্যময় বাড়ি, দোলার বাবা আসে না, কারা যেন আসে দেখা যায় না৷ যা দেখেছি সেটাই লেখা হতে থাকবে৷ কিন্তু অভাবিত কয়েকটা জিনিস এসে যাবে৷ দোলার মা নারীর অধিকারে তিমিরকে চাইবে৷ দোলার সঙ্গে খেলতে খেলতে তিমির যখন স্পর্শসুখে ডুবে যাবে, আবিষ্কার করবে সেটা দোলার মা-র সোহাগ-সংলাপ৷ দোলার মা ভয় পাবে মাথা-ছেঁড়া কোনো আদুরে পাখির রক্তাক্ত দৃশ্যে৷ তিমির খুন করবে একটা বাদুড়কে৷ কুড়ি বছরের পুরোনা মোটা খাতা দিয়ে থেঁতলে মারবে৷ দেয়ালে লাগবে রক্তের ছিটে৷

   গল্পে ভায়োলেন্স এসেছে৷ সে কি আমার বাউন্ডুলে বয়ঃসন্ধির উচাটন? কোনো বাঁকের আঁধারে নারীশরীর দেখার তন্ত্র? ব্যক্তিগত আমার অপমানরাশিকে বিদ্ধ করার অন্তরগত হিংসা? জানি না৷ ছোটোবেলার গল্প বুড়োবেলায় লেখার মজাই আলাদা৷  —

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…

আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৩

 


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!