Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • মে ১২, ২০২৪

ভোর ভয়ি। পর্ব ৫ : বইচুরি এবং এক বিকেলে ‘রাজকাহিনী’

মধুময় পাল
ভোর ভয়ি। পর্ব ৫ : বইচুরি এবং এক বিকেলে ‘রাজকাহিনী’

চিত্রকর্ম: পাবলো পিকাসো। শিরোনাম: পাঠক

 
বায়োস্কোপের বাকসো। রঙের নকশা চটে খসে এখানে-ওখানে বেরিয়ে পড়েছে মৃত‍্যু-প্রস্তাব। বাকসোর গোল জানালার ঢাকনা কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। চোখের পর্দায় আসে শূন‍্য খেয়াঘাট, দূরে দূরে সবল ডানার চিল, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, আরও কত রক্ত চাই তব প্রীতি তরে, ধানের ক্ষেতে মশাল আগুন, লকআপের আর্তনাদে বাতাস কাঁপে, শিক্ষকদের চেয়ারে ভাঙনের শব্দ, রং ও রেখায় জাগে পুরাণপ্রতিমা, উন্নয়ন আর উৎসব শুষে খায় জলাভূমি, কুয়াশার ওপারে পলিথিনে মোড়া চাঁদ, জোড়া চোখ ঘটনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাঁতরায়, দূরে কোথাও আগুনবরণ আকাশে বাজে ‘ভোর ভয়ি’।

 

পঞ্চম পর্ব

পাপিয়ার কথা আরও বলা লাগে৷ 
 
   এই ‘বলা লাগে’ কথনটা সুরুচিমাসির৷ আমার মায়ের মাসতুত দিদি৷ বীরভূমের মল্লারপুরে কোনো হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন৷ অবরে-সবরে কলকাতা আসতেন৷ কথা বলতেন নিচু গলায়, ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে এবং যার সঙ্গে কথা বলছেন তার চোখে চোখ রেখে৷ ছোটোখাটো, ছিপছিপে, গায়ের রং কালো, পরনে সাদা জমির ওপর হালকা ছাপা শাড়ি৷ মায়ের এই দিদিকে দেখে অনেককেই দেখেছি মাঝপথে চুপ করে যেতে৷ কেন? তারা এমন কিছু বলছিল যা বলা না লাগে৷ ছাপোষা সংসারে রুচির এমন মানবীরূপ বেশি দেখিনি৷ মাসিকে দেখতে চেয়েছিল পাপিয়া৷ দেখা হয়েছিল৷
 
   পাপিয়ার কথা আরও বলা লাগে এইজন্যে নয় যে, এখানে প্রেম ছিল, প্রেমের টানাপোড়েন ছিল, প্রেমের খেলাধুলো এক-আধটু থাকতে পারে, থাকতে পারে আমার বয়ঃসন্ধির উতল হাওয়া, বলা লাগে এইজন্যে যে, প্রেম ছিল না, তার অনেক বেশি প্রেমময় সম্পর্ক ছিল, যা আমাকে আলোর দরজা দেখিয়েছে৷
 

বই দেখানোর মধ্যে একটা আনন্দ আছে৷ বই দেখার মধ্যে কষ্ট আছে, টের পেলাম৷ আমার যে পাঠ্যবই-ই আসে না৷ এটা ওটা দেখতে দেখতে বাজে ইচ্ছা মাথা জুড়ে বসে৷ রোগামতো একটা বই নিয়ে পড়বার ভান করে সরে বসি৷ এক ফাঁকে কোমরে গুঁজে নিই৷ চুরি করি৷ আগে কখনও চুরি করিনি৷ করব ভেবেছি৷ সাহসে কুলোয়নি

 
   কাকের সেই ছোঁ-মারার মতো আরেকটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার কথা বলি৷ পাপিয়াদের ‘জাদুবাড়ি’ থেকে এবং আমাদের বস্তিঘর থেকে বালকবয়সের পায়ে মিনিটচারেকের পথ জয়াপিসির বাড়ি৷ পাপিয়ার আপন পিসি৷ ওই যেখানে ডা. সুরেশ সরকার রোড আর গোবরা রোড মিলে চারমাথা হয়েছে, তার কয়েক পা উত্তরে৷ একটা গলির ভেতর দোতলায়৷ পাপিয়ার দাদু মহীতোষ রায় রাজ্য সরকারের শিক্ষাবিভাগের দায়িত্বপূর্ণ পদে ছিলেন৷ এখন কলেজ স্ট্রিটের এক প্রকাশকের লেখক৷ ছোটোদের জন্য গল্প-ছড়াও লেখেন৷ জেনেছি পাপিয়ার মা-র কাছে৷ আমার শ্বশুরমশায় লেখাপড়া নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন৷ তোমরা যাবে৷ গল্প শুনবে৷ কী সুন্দর গল্প বলেন, রেডিয়োর চেয়েও ভালো৷ 
 
   মহীতোষ রায়ের বই কখনও পড়েছি বলে মনে পড়ে না৷ তবে এটা ঘটনা, ওঁর গল্প বলার জাদুতে মুগ্ধ থেকেছি ছেলেবেলার আমি৷ ছবির পর ছবির মধ্য দিয়ে গল্প এগোয়৷ আলো ফুটে ওঠে, অন্ধকার নামে, বন তোলপাড় করে বৃষ্টি আসে৷ যদিও সে সবই রূপকথা, আমি সেই কথার দেশের একজন হয়ে যেতাম৷ ঠাকুরমার ঝুলি শুনেছি দিদিমার কাছে৷ ‘রামের সুমতি’, ‘নিষ্কৃতি’ও৷ সেসব যেন আমাদের এপাড়ার ওপাড়ার গল্প৷ পাপিয়ার দাদুর গল্পের জগতটা চেনা-চেনা লাগলেও অচেনা থেকে যায়৷ তাতে মজা বেশি৷ গাছ নদী পাখি যদি কথা বলে, কী ভালোই না লা্গে৷ আমার দেখা প্রথম লেখক মহীতোষ রায়৷ দেখেছি, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে পড়ার টেবিলে৷ টেবিলের সামনের দেয়ালে বঙ্কিমচন্দ্র৷ যাঁকে দেখেছি দিদিমার বইয়ের শেলফে একাধিক মলাটে, যাঁর ‘কপালকুণ্ডলা’ শুনেছি দিদিমার মুখে, কুপি-জ্বলা রাতে, নিভোনো উনুন আর জল-ভরা বালতির মাঝখানে বসে৷
 
   মহীতোষ রায়ের গল্পছবির আঁতুড় ঘর চিনি একটু বড়ো হয়ে৷ সেটা অবনঠাকুরের দেশ৷ এত ছবি, এত রং, এত বর্ণনা বাংলার পাঠক নিতে পারেনি বলেই কি হারিয়ে গেলেন মহীতোষ রায়? 
 
   সেই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার কথা বলি৷ মহীতোষদাদুর বাড়িতে পুজোর বই আসে৷ সেবারও এসেছে৷ অনেক বই৷ দেব সাহিত্য কুটিরের ‘অরুণাচল’, ‘অরুণোদয়’, ‘পূর্বাচল’ এরকম নামের পূজাবার্ষিকী এখানেই প্রথম দেখি৷ জয়াপিসি বই ঢেলে দিয়েছেন আমাদের সামনে৷ কত বই! ‘জলসা’, ‘সিনেমা জগৎ’ও ছিল গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে৷ বই দেখানোর মধ্যে একটা আনন্দ আছে৷ বই দেখার মধ্যে কষ্ট আছে, টের পেলাম৷ আমার যে পাঠ্যবই-ই আসে না৷ এটা ওটা দেখতে দেখতে বাজে ইচ্ছা মাথা জুড়ে বসে৷ রোগামতো একটা বই নিয়ে পড়বার ভান করে সরে বসি৷ এক ফাঁকে কোমরে গুঁজে নিই৷ চুরি করি৷ আগে কখনও চুরি করিনি৷ করব ভেবেছি৷ সাহসে কুলোয়নি৷ জয়াপিসি পাশের ঘর থেকে এসে শতরঞ্চিতে ছড়ানো বইয়ের পাশে বসে৷ বলে, এখানে যে বইটা ছিল, এইমাত্র দেখছিলাম, কোথায়? মাসিক বসুমতীর পাশে ছিল৷ পাপিয়া ওইদিকটা দেখ তো৷ আমি ঘামছি৷ মহীতোষদাদু বলেন, আছে, আছে৷ কোথায় যাবে ঘর থেকে৷ বাইরের কেউ তো আসেনি৷ জয়াপিসির মুখ দারোগার মুখ মনে হয়৷ আমি ঘামি৷ পাপিয়া বলে, অত ব্যস্ত হয়ো না, ছোটোপিসি৷ আমি খুঁজে দেখি৷—জয়াপিসি আমার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন হাত বাড়িয়ে আমার পেট চেপে ধরবে৷ যেন জামার নীচে বইটা দেখতে পাচ্ছে৷ আমি নড়েচড়ে বসে খোঁজার ভান করি৷ হঠাৎই জয়াপিসি রান্নাঘরে যায়৷ সঙ্গে সঙ্গে পাপিয়া আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, বইটা দাও৷ আমি বের করে দিই৷ ঘামে ভিজে গেছে মলাট৷ জয়াপিসি ফের ঘরে ঢুকলে পাপিয়া বলে, শতরঞ্চির নীচে ঢুকে গিয়েছিল৷ তুমি এমন হইচই বাধালে যেন আমরা চুরি করেছি৷ জয়াপিসি হাতে বই নিয়ে বলে, না না৷ আসলে কোথায় গেল, তাই৷ আমার সবটাতেই বাড়াবাড়ি৷ এমা, মলাট ভিজে গেছে৷ বোধহয় মেঝেয় জল ছিল৷ পাপিয়া বলে —বইটা এখন আমি নেব৷ পড়ে দিয়ে যাব৷ বাড়ি ফেরার পথে পাপিয়া বলেছিল, ভ্যাবলাকান্ত৷ আর ঘামছ না তো? 
 

চিত্রকর্ম: দেব সরকার

   বইটা ছিল ‘সেকালের গল্প’৷ মলাটে কুঁড়েঘরের দাওয়ায় বসে আছে চুলগোঁফদাড়ির ঋষি৷ পুরাণের গল্পকথা৷ বিষয়ের টানে নয়, চুরি করতে গিয়েছিলাম আমার কেন নেই বলে৷ যদি ধরা পড়ে যেতাম, সেটাই হতে যাচ্ছিল, কী বকাঝকাই না জুটত কপালে৷ জয়াপিসি কমপ্লেন করত দিদির কাছে৷ সিদ্ধান্ত হত, আমি চোর, একে বাঙাল তায় বস্তির মাল, হাতসাফাইয়ে ওস্তাদ৷ সুতরাং পাপিয়ার সঙ্গে ওর মেলামেশা এবং দুই  বাড়িতেই ঢোকা বন্ধ৷ 
 

সুরুচিমাসির সঙ্গে অল্পক্ষণের মধ্যে গল্পে জমে গেল পাপিয়ার৷ কী ভ্যাবলাকান্ত, আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না, মাসি৷ হাঁদারামেরও বেশি৷ বই সরিয়ে দেখি ঘামছে৷ জয়াপিসির যা চোখ, পুলিসও ফেল মারবে, ধরা পড়ে যেতই৷ আমাকে বললেই হত৷ চুরি করে ঘামে ভিজে যায়৷ হা হা৷ চার্চে নিয়ে যাই৷ এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে৷ বলি, বেঞ্চে বোসো৷ বসে না৷ যেন ফাদার ওকে ধরে খ্রিস্টান বানিয়ে দেবে

 
   বইচুরির বহু ঘটনা বয়স্ক হতে হতে জেনেছি৷ বলতে খারাপ লাগলেও এটা বাস্তব, বইচুরিতে নামী শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের হাত বেশ পাকা৷ বিখ্যাত গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য বই বাইরে চলে যায়, আর ফেরে না৷ বইরক্ষার দায়িত্বে-থাকা আধিকারিক বই ঝেড়ে দেয়৷ ধরা পড়েও পড়ে না৷ আমি যদি ধরা পড়ে যেতাম এবং পাপিয়ার সঙ্গ হারাতাম, আজ যে সামান্য পড়বার ও লেখবার চেষ্টা করি, কাউকে পড়াবার চেষ্টা করি, সে সুযোগ হয়তো আসত না আমার জীবনযাপনে৷ 
 
   বেনেপুকুর বিদ্যাপীঠের কাছে সহকর্মীর বাড়িতে এলেন সুরুচিমাসি৷ গ্রীষ্মছুটির কয়েকটা দিন কাটাবেন৷ পাপিয়াকে বললাম, যাবে? ওর মা বললেন, যাও৷ সন্ধের আগে ফিরে এসো৷ সুরুচিমাসির সঙ্গে অল্পক্ষণের মধ্যে গল্পে জমে গেল পাপিয়ার৷ কী ভ্যাবলাকান্ত, আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না, মাসি৷ হাঁদারামেরও বেশি৷ বই সরিয়ে দেখি ঘামছে৷ জয়াপিসির যা চোখ, পুলিসও ফেল মারবে, ধরা পড়ে যেতই৷ আমাকে বললেই হত৷ চুরি করে ঘামে ভিজে যায়৷ হা হা৷ চার্চে নিয়ে যাই৷ এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে৷ বলি, বেঞ্চে বোসো৷ বসে না৷ যেন ফাদার ওকে ধরে খ্রিস্টান বানিয়ে দেবে৷ বন্ধুরা হাসাহাসি করে৷ বড়োদিনের মজা মাটি করে দেয়৷ সন্ধে গড়াতেই বলে, বাড়ি যাব৷ ঘুম পাচ্ছে৷ আচ্ছা মাসি, ভূতের বাড়িতে কেউ থাকতে পারে? ও বলে, আমাদের বাড়িতে ভূত আছে৷ বাবার পোষা ভূত৷ জাদুখেলা দেখাতে নাকি লাগে৷ হা হা৷ কলকল করে যায় পাপিয়া৷ সুরুচিমাসি হাসেন৷ কথা বলবার সুযোগই পান না৷ পাপিয়া তখন ক্লাস নাইন৷ সুরুচিমাসি বলেছিলেন, মেয়েটা ভালো৷ কথা বলে কম৷ যা বলে সেটা ওর কথা বলতে না পারার কষ্টের শব্দ৷ যা বলতে চায়, বলতে পারে না৷ আমি সুরুচিমাসির মন্তব্য শুনে হাঁ৷
 
   মাসখানেক পর, এক বাদলবিকেলে পাপিয়া বলল, একটা বই এনেছি৷ মাসি পড়তে বলেছেন৷ আমরা পড়ব৷ দিনদুই পর, বর্ষার দুপুর পশ্চিমের আধখোলা দরজা দিয়ে হলঘরে আলো আসে, মসৃণ লাল মেঝে, দেওয়ালে যিশুখ্রিস্ট, আলোছায়ার মধ্যে হেঁটে যান পাপিয়ার মা, সিঁড়ির গায়ে কালো কালো ট্রাঙ্ক, দোতলায় পর্দা ওড়ে আঁচলের মতো, আমরা পড়ি ‘তখন রাত কেটে সবে সকাল হচ্ছে, দূর থেকে কমলমীর অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সেই সময় পৃথ্বীরাজ ঘোড়া থেকে ঘুরে পড়লেন— রাস্তার ধুলোয়৷ কমলমীর— যেখানে তাঁর তারারানী একা রয়েছেন, সেইদিকে চেয়ে তাঁর প্রাণ হঠাৎ বেরিয়ে গেল— দূরে— দূরে— কতদূরে সকালের আগুনবরণ আলোর মাঝে নীল আকাশের শুকতারার অস্তপথ ধরে৷ আর ঠিক সেই সময় সঙ্গের অদৃষ্ট শ্রীনগরের নহবতখানায় বসে আশা-রাগিণীর সুর বাজিয়ে দিলে— ভোর ভয়ি, ভোর ভয়ি৷’
 
   অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ সংগ্রামসিংহ৷ রাজকাহিনী৷ বিকেলপশ্চিমের দরজার ওপারে ভোরের মতো আলো৷
 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৪

ভোর ভয়ি। পর্ব ৪


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!