- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- মে ১৯, ২০২৪
ভোর ভয়ি। পর্ব ৬ : হিন্দি সিনেমার সাবঅল্টার্ন পাড়া
সকালের আগুনবরণ আলোর মাঝে নীল আকাশের শুকতারার অস্তপথ ধরে...তারপর

অলঙ্করন : দেব সরকার
বায়োস্কোপের বাকসো। রঙের নকশা চটে খসে এখানে-ওখানে বেরিয়ে পড়েছে মৃত্যু-প্রস্তাব। বাকসোর গোল জানালার ঢাকনা কবে যেন হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। চোখের পর্দায় আসে শূন্য খেয়াঘাট, দূরে দূরে সবল ডানার চিল, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, আরও কত রক্ত চাই তব প্রীতি তরে, ধানের ক্ষেতে মশাল আগুন, লকআপের আর্তনাদে বাতাস কাঁপে, শিক্ষকদের চেয়ারে ভাঙনের শব্দ, রং ও রেখায় জাগে পুরাণপ্রতিমা, উন্নয়ন আর উৎসব শুষে খায় জলাভূমি, কুয়াশার ওপারে পলিথিনে মোড়া চাঁদ, জোড়া চোখ ঘটনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাঁতরায়, দূরে কোথাও আগুনবরণ আকাশে বাজে ‘ভোর ভয়ি’।
♦ ষষ্ঠ পর্ব ♦
বলতে গেলে শুরুটা বেশ ভালোই ছিল ৷
‘শুরুটা’ মানে সূর্য সেন স্ট্রিটের (সাবেক মির্জাপুর স্ট্রিট) আদর্শ বিদ্যামন্দিরে ভরতি হওয়া এবং কম বেশি আড়াই-তিন কিমি হেঁটে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরবার সময়টা ৷ সাল ১৯৬২-৬৩ ৷ সিনেমা হলে না ঢুকে সিনেমা দেখা শুরু এই বয়সে ৷ পথের ধারে পরপর সিনেমা হল ৷ পূরবী, অরুণা, ছবিঘর, প্রাচী, মৌলালি থেকে বাঁদিকে ঘুরে খানিকটা এগোলে লোটাস, কলেজ স্ট্রিটের দিকে গেলে বীণা ৷ বিরাট হোর্ডিংয়ে নায়ক-নায়িকা, পার্শ্ব-চরিত্র এবং পটছবি ৷ টিকিট কাউন্টারের আশেপাশে দেওয়ালে বোর্ডে-আঁটা ‘আসিতেছে’ ও ‘চলিতেছে’ সিনেমার স্থিরচিত্রাবলি ৷ একই স্থিরচিত্র কতবার দেখেছি, তিনমাস-চারমাস ধরে৷ সব বাংলা সিনেমা ৷ বাংলা ছবির তখন আজকের মতো উদবাস্তু দশা নয়, রীতিমতো নিজেদের পাকা দালান ৷ বাংলা ছবি এখনকার মতো এবেলা ওবেলা খেপ খাটে না সেদিন, পাকা চাকরি ৷ কিছু সিনেমার নাম মনে পড়ে ৷ কাঁচের স্বর্গ, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, সপ্তপদী, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অতলজলের আহ্বান, অভিযান, দাদাঠাকুর, ভ্রান্তিবিলাস, পলাতক ৷ কাঞ্চনজঙ্ঘা আর অভিযান অবশ্য হলে দেখেছি হাসিকাকিমার সঙ্গে ৷ পলাতক জয়াপিসির সঙ্গে ৷ বাড়ি থেকে বেরতে ওঁদের বডিগার্ড লাগে ৷ যতই খুদে হই, পুরুষমানুষ তো ৷ বাকি সিনেমা সব হোর্ডিং আর স্থিরচিত্রের সমবায়ে কল্পনায় গড়ে ওঠা আমার সিনেমা ৷
‘বেশ ভালোই’ মানে পরিচ্ছন্ন, রুচিশীল, চেনা চারপাশের অচেনা হয়ে-ওঠা সাদা-কালোর গভীর মায়াবী বিনোদন ৷ আমার মতো আধা বাঙালের ভাষা ও রুচি কিছুটা তৈরি করবার চেষ্টা করেছিল এই বিনোদন আর আমবাঙালির প্রাণের আলয় আকাশবাণী ৷
কিন্তু এই রুচিশীল এলাকা থেকে কীভাবে ছিটকে গেলাম, আজও তার ঠিকঠাক ব্যাখ্যা পাই না ৷ গিয়ে পড়লাম হিন্দি সিনেমার সাবঅল্টার্ন পাড়ায় ৷ মৌলালির কাছে এন্টালি টকিজ, পার্কসার্কাস-মল্লিকবাজারের পার্ক শো হাউস ও নূরমহল, ওয়েলেসলির ক্রাউন ও ম্যাজেস্টিক, ধর্মতলায় নিউ সিনেমা, নিউ অপেরা, জনতা, রিগাল, টাইগার, সোসাইটি এবং আরও কিছু, যাদের নাম আজ আর মনে পড়ে না, কিংবা যারা মুছে গেছে বহুদিন আগে ৷
টুটুদার হাত ধরে কি পার্ক শো এবং নূরমহলে? হতে পারে ৷ পার্ক সার্কাস মাঠের ফার্স্ট ডিভিসনে খেলত টুটুদা ৷ দরের গোলকিপার ৷ খেপ খেলতে যেত ম্যাচ-পিছু টাকা নিয়ে ৷ এইরকম খেপের শেষে পার্ক শো হাউসের উলটোদিকের ফুটপাথ পরোটা বা রুটি আর শিককাবাব একরকম ছিল বাঁধা ৷ হাতে নগদ, পেটে খিদে, দেরি কেন? অতটা দূরে যেতে হত এইজন্যে যে শিককাবাব গোরুর মাংসের ৷ পাড়ার কেউ দেখলে বাড়িতে বলে দেবে ৷ হিন্দু-মুসলমানের ভূত আমাদের ঘাড়ে কোনোকালে চাপেনি ৷ তবে বাড়ির ধর্মীয় বকাঝকা তো ছিলই ৷ আমি টুটুদার বিশ্বস্ত সঙ্গী ৷ যাকে এখন বলে, চামচা ৷ আমাকে বড়ো গোলকিপার বানিয়ে দেবে ৷ খাটতে হইব খুব ৷ শরীর হইব ইটের মতো ৷ ওজন হইব পাখির৷ ফাল দিয়া উড়বা ৷ মাঠে গলিতে গরমের দুপুরে প্র্যাকটিস করেছি ৷ ঘাড়ে গলায় বগলে ঘামাচি থিকথিক ৷ দর পাইনি কখনও৷ খেলার আগে একপিস চিউইং গাম, খেলার শেষে একটুকরো বরফ আর শুকনো বেলপাতার মতো তারিফ ৷ বড়ো জোর ছোটোমোটো টাওয়েল একখান ৷ এই টুটুদাই হয়তো শেখ মুখতারের সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায় পা্র্ক শো বা নূরমহলে ৷
রক্সি সিনেমা, ঠাণ্ডা ঘর, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, পর্দা থেকে বেরিয়ে আসে ইয়াহু, রঙিন ফুলের দেশ, সায়রা বানু সাদা মেঘ উড়িয়ে নাচে, বরফ ঝড়, হাড়হিম ঠাণ্ডা, তাঁবুর ভেতর কাঠের আগুন, এক পুরুষ ও এক নারী কাছাকাছি, ইস্টম্যানকালার, বাতাসে রঙের ঢেউ
ধর্মতলা চিনতাম ছেলেবেলা থেকে, সেই সাইকেল রিং ট্যাং টেংয়িয়ে তালতলা জানবাজার চৌরঙ্গি গড়ের মাঠ করবার দিনগুলি যখন ৷ তবে সিনেমাপাড়া অচেনা ছিল ৷ যতদূর মনে পড়ে নাটাদার সঙ্গে এ পাড়ায় আসা ৷ আমাদের তালতলা গলিতে, হরেন মুখার্জির বাড়ি যাবার কাঁচাপথের ধারে নাটাদার বস্তিঘর ৷ মোটোর মেকানিক ৷ গাড়িওলা বাড়ির ফরসা-ফরসা লোকজন লম্বা সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে নাটা মেকানিককে খুঁজতে আসে প্রায়ই ৷ নাটাদা চারফুটি ছিল, অনুমান, মেপে দেখা হয়নি ৷ ঘাড়ে গর্দানে হাতে পায়ে পেশি ৷ পেশির বান্ডিলের ওপর বসানো মাথা, বাবরি চুল, চোখ দুটো কথায় কথায় প্যাঁচ খায়, কথা বলে হিন্দি সিনেমার ডায়ালগ বসিয়ে ৷ আজকের পোলিটিকাল ও আ-পোলিটিকাল সেলেব্রিটিরা বোধহয় নাটাদার কাছে এই স্টাইল শিখেছে ৷ এন্টালি মার্কেটের দক্ষিণে যে ফুলবাগান বস্তি, তার মুখে কর্পোরেশনের গোডাউন, তার পেছনে কালু খাঁর গ্যারেজ, সেখানে হেডমিস্ত্রি ছিল নাটাদা ৷ আমাকে কাজ শেখাবে বলে নিয়ে যায় ৷ বলেছিল, মোটরের কাজ শিখলে মোটা রোজগার ৷ বড়োলোকদের খাতির ৷ বড়োলোকের মেয়েদের বউদের মিষ্টি মিষ্টি কথা, আইল্লুস, গায়ের কী সেন্ট ! বিবরণে কাঁচা শব্দ ঢুকে পড়ত চাপা লালার টানে ৷ ওর মুখে শোনা টুকরো টুকরো ছবি ছিল আমার সেই বালকবেলার নারীশরীরের বর্ণপরিচয় ৷ কালু খাঁর গ্যারেজে গাড়ি ধুইয়েছি, কেরোসিন তেলে ডুবিয়ে ঘষে ঘষে বিয়ারিং সাফ করেছি, লোহাকাগজ দিয়ে বডি ঘষেছি, দফায় দফায় চা এনেছি ক্যানে-এ ঝুলিয়ে, বিকেলে মুড়ি-তেলেভাজা এনেছি ঠোঙায় ঠোঙায় ৷ কালু খাঁ বলত, উয়ো কুছু কাম কা নহি, ফালতু, উসকা পিছে ওয়াটার পাইপ ঘুসা দে ৷ মানে জলকলের কাজে ঢুকিয়ে দে ৷ এই নাটাদা আমাকে একদিন ঢুকিয়ে দিল ‘জংলি’ ছবিতে ৷ রক্সি সিনেমা, ঠাণ্ডা ঘর, চাহে কোই মুঝে জংলি কহে, পর্দা থেকে বেরিয়ে আসে ইয়াহু, রঙিন ফুলের দেশ, সায়রা বানু সাদা মেঘ উড়িয়ে নাচে, বরফ ঝড়, হাড়হিম ঠাণ্ডা, তাঁবুর ভেতর কাঠের আগুন, এক পুরুষ ও এক নারী কাছাকাছি, ইস্টম্যানকালার, বাতাসে রঙের ঢেউ ৷
আমার আকাশ ভরে গেল রাজকাপুর, দিলীপকুমার, দেবানন্দ, ভারতভূষণ, জয় মুখার্জি, বৈজয়ন্তীমালা, সাধনা, আশা পারেখ, সায়রা বানু, দারা সিং, কে এন সিং, জীবন, প্রাণ এবং আরও কত তারায় তারায় ৷
হিন্দি সিনেমার এই সাবঅল্টার্ন পাড়ায় আমার দিনগুলো ভরে গেল গঙ্গা-যমুনা, বিশ সাল বাদ, দিল এক মন্দির, তেরে ঘর কে সামনে, সঙ্গম, কাশ্মীর কি কলি, লিডার, গাইড ইত্যাদির নাচাগানা ঢলাঢলি মারপিটের বালখিল্যে ৷ (রক্সি বা প্যারাডাইস অবশ্য সাবঅল্টার্ন ছিল না সাজসজ্জায় ৷) আমার আকাশ ভরে গেল রাজকাপুর, দিলীপকুমার, দেবানন্দ, ভারতভূষণ, জয় মুখার্জি, বৈজয়ন্তীমালা, সাধনা, আশা পারেখ, সায়রা বানু, দারা সিং, কে এন সিং, জীবন, প্রাণ এবং আরও কত তারায় তারায় ৷
কেউ জানতে চাইতে পারেন, টিকিটের পয়সা জুটত কোথায় ? উত্তর: নানাভাবে ৷ কালু খাঁর গ্যারেজ থেকে পেতাম ৷ নাটাদার সঙ্গে প্রাই্ভেট কাজে অ্যাসিস্টান্ট হয়ে খেটে ৷ রক্সির উলটোদিকে ফলের রসের দোকানের ছিবড়ের টিন কাঁধে বয়ে মার্কেট স্কোয়ারের (এখন চ্যাপলিন স্কোয়ার) ভ্যাটে ফেলে দিয়ে আসতাম ৷ টিনপিছু দশ পয়সা ৷ সস্তার ছোকরা ৷ টিকিটের দাম ছিল কোথাও ১৯ পয়সা, কোথাও ৩৫, সর্বোচ্চ ৬৫ পয়সা ৷ ছিবড়ে-ফেলা ছোকরা সিনেমার শেষে হিরো, ধর্মতলা স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে আপনমনে গায়, ‘বারবার দেখো হাজারবার দেখো, ইয়ে দেখনে কা চিজ হ্যায় হমারা দিলরুবা, দালে হো ৷’
আমার শিক্ষাজীবনের পাঠশালা ছিল গোবরা গোরস্থান ৷ (সেদিনের লেপ্রোসি হাসপাতাল, এখনকার মেন্টাল হাসপাতালের পাশে ৷) ঢালাও সবুজ, ঝুঁকে-পড়া গাছেদের ছায়ার নীচে টলটলে পুকুর, জামগাছ জামরুল গাছ, একটা মহুয়া গাছ ছোটো এবং অনেক বাঁধানো কবরের নির্জনতা জানে বস্তির এক বাঙাল বালক এইখানে প্রাণের জমিদারি পত্তন করেছিল, সে আবোলতাবোল বকত সারা দুপুর গাছেদের সঙ্গে ৷ স্কুল-বই-মাস্টার থেকে পালাতে টেয়েছিল সে ৷ সেই পালাতে চাওয়া থেকেই ‘ছোটোলোক’দের সিনেমাপাড়ায় ৷
কেন সে পালাতে চেয়েছিল ? মথুরানাথ-জগদীশ বিদ্যাপীঠে ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে ওঠার প্রগ্রেস রিপোর্ট তাকে দেওয়া হয়নি ৷ এমনকি জানানো হয়নি সে পাস করেছে কিনা৷ কারণ ছ-মাসের টুইশন ফি বাকি৷ সে ক্লাস সেভেনে ভরতি হল বেনেপুকুর বিদ্যাপীঠে ৷ পাঠ্য বই নেই বলে শিক্ষকদের বকুনি খেয়েছে ৷ সেখানে ফাইনাল পরীক্ষায় তাকে বসতে দেওয়া হয়নি টুইশন ফি বাকি বলে ৷ অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া হয়নি ৷ টাকা জোগাড় করতে কসবায় রামশঙ্কর দাদুর কাছে, নাগের বাজারে হরিশঙ্কর দাদুর কাছে তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে মা ৷ ভিক্ষে চাইতে৷ ভিক্ষে মেলেনি ৷ হয়তো এইসব ঘটনা বালককে লেখাপড়ায় বিমুখ করেছিল ৷ সব ছেলে বই পায়, পড়তে পায়৷ সে পায় না ৷
যাই হোক, মন্দ ছিল না সেইসব পাঠশালা৷ মনে পড়ে, পার্ক শো হাউসে এক মাস্তান ছিল ৷ গন্নাকাটা গোঙা ৷ চাবুক চালিয়ে সে লাইন ম্যানেজ করত ৷ নিজের লোক ঢোকাত ৷ নিয়ম মেনে লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকে টিকিট পেত না চাবুকে ছিটকে গিয়ে ৷ একদিন গোঙার চাবুক ধরে টান মেরে ওকে হিঁচড়ে নিয়ে আসি ট্রামলাইনে ৷ ঘুসি লাথি মারি ৷ গোঙার দলবল চড়াও হতে চেয়েছিল ৷ তখন আমার হাতে চাবুক ৷ কেউ কেউ হাততালি দিয়েছিল ৷ গোঙা ধুলো ঝেড়ে উঠে হাত বাড়িয়ে বলে, দোস্ত, গলতি হো গয়া ৷ সিনেমাটিক সিচুয়েশন ৷ টিকিট ব্ল্যাকার গোঙা ‘জীবিকা’ ছাড়েনি, এরপর আমাকে মাগনায় শিককাবাব খাইয়েছে বেশ কয়েকবার ৷ ছোটোলোকের পাঠশালায় মাগনার খাবারও থাকে ।
♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৫
❤ Support Us