- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জানুয়ারি ২৬, ২০২৫
ধারাবাহিক উপন্যাস। ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ২

পর্ব ২
• ৪ •
মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে – জলের তলায় নিরেট অন্ধকারের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। উঁহু হেঁটে যাচ্ছি কী আর, যেন কে বা কারা পায়ে ঝিঁজরি বেঁধে আমাকে টানতে টানতে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
আবার সময় সময় এরকমও বোধ হচ্ছে– না, হাঁটছি তো না। পায়ে লোহার ঝিঁজরি বেঁধে কেউ আমাকে টানতে টানতে নিয়েও যাচ্ছে না । আসলে বন্দী হয়ে আছি নিরেট এক অন্ধকারময় ঘরের মধ্যে।
কাকেও দেখতে পাচ্ছি না। কেউ আছে বলেও তো মনে হচ্ছে না । জল কোথায় ? সব তো চাগড়া চাগড়া স্তূপীকৃত অন্ধকার। আমার চারধারেই হেসে খেলে বেড়াচ্ছে দেদার !
তবে এ অন্ধকারের স্পর্শ ততটা ভয়ঙ্কর নয়। কেমন যেন মেদুর ও মোহময় । শরৎচন্দ্রের ‘নৈশ অভিযান’-এর ‘আঁধারের রূপ’ পড়েছি – “ কয়েক মুহূর্তেই ঘনান্ধকারে সম্মুখ এবং পশ্চাৎ লেপিয়া একাকার হইয়া গেল। রহিল শুধু দক্ষিণ ও বামে সমান্তরাল প্রসারিত বিপুল উদ্দাম জলস্রোত এবং তাহারই উপর তীব্র-গতিশীলতা এই ক্ষুদ্র তরণীটি এবং কিশোরবয়স্ক দুটি বালক।
প্রকৃতিদেবীর সেই অপরিমেয় গম্ভীর রূপ উপলব্ধি করিবার বয়স তাহাদের নহে, কিন্তু সেকথা আমি আজও ভুলিতে পারি নাই । বায়ুলেশহীন, নিষ্কম্প, নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ নিশীথিনীর সে যেন এক বিরাট্ কালীমূর্তি। নিবিড় কালো চুলে দ্যুলোক ও ভূলোক আচ্ছন্ন হইয়া গেছে, এবং সেই সূচিভেদ্য অন্ধকার বিদীর্ণ করিয়া করাল দংষ্ট্রা রেখার ন্যায় দিগন্ত বিস্তৃত এই তীব্র জলধারা হইতে কি একপ্রকারের অপরূপ স্তিমিত দ্যুতি নিষ্ঠুর চাপাহাসির মত বিচ্ছুরিত হইতেছে ।”
নাবালকোত্তীর্ণ প্রায় যুবক হয়ে-ওঠা আমার পক্ষেও হয়তো এই অন্ধকারের ‘অপরিমেয় গম্ভীর রূপ’ উপলব্ধি করা সহজ ছিল না । তবু, তবুও তো !
চাগড়া চাগড়া স্তূপাকার অন্ধকারের মধ্যেও কোথাও যেন ফাটাফুটো থেকে গিয়েছে । গহন-ঘন-অন্ধকার অরন্যানীর মধ্যেও যেমন ফাঁক-ফোকর ।
তার ভিতর দিয়ে, তার ভিতর দিয়ে মেদুর ও মোলায়েম অন্ধকারের আদর হল্কার মতো ভেসে আসছে । আমার হাত ধরে নাড়া দিচ্ছে, চুল নেড়ে দিচ্ছে, নাক টিপে দিচ্ছে, চিবুক ধরে এ-পাশ ও-পাশ করছে ।
নাকে-কানেও অন্ধকার যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে । এইবুঝি বেদম হেঁচে উঠব ! অকস্মাৎ কোথাও একটা কাক ডেকে উঠল । এমন তো হয়েই থাকে। হয়তো মধ্যরাত্রি অথবা ভোরের দিকে সামান্যই ঢল নেমেছে। মরা ক্ষয়াটে জ্যোৎস্না কিংবা ঝুঁজকো অন্ধকার।
কাকেরও ভ্রম হল, প্রাতঃকাল আসন্ন ভেবে সে হঠাৎ ডেকে উঠল। সে ডাকল ডাকল, ঘুমন্ত প্রতিবেশী কাকটাও যে ঘুম ভেঙে তার সঙ্গে সঙ্গত করল ! একবার নয়, দু-দুবার ডাকল।
তবে কী কুটুস পিঁপড়ের দল কাকেদের কামড় বসিয়েছে ? সময় সময় কাক কী শালিকের বাচ্চার লোভে সাপও তো ঢুকে পড়ে পাখিদের বাসায় !
পিঁপড়ে কী সাপের অতর্কিত আক্রমণে হোক, ভ্রমে-বিভ্রমে হোক, কাক রাত্রিবেলায় ডেকে উঠলেও উঠতে পারে । তাবলে মশানির দহের তলায় ঘোর অন্ধকার প্রদেশে কাক এল কোত্থেকে ?
তবে কী গোল গোল চোখ ঘুরিয়ে চামড়ায় চোখ ঢেকে ছাতিনাগাছে বসে থাকা অলম্ভুস দাঁড়কাকটা সারা দিনমান একবার ছাতিনাগাছ একবার জাহাজকানার জঙ্গল করে কাটিয়ে দিলেও রাত্রিতে সে নেমে আসে মশানির দহের তলদেশে ?
এসময়ই কাকটা আবারও একবার ডেকে উঠল। পাতিকাকের ডাক না দাঁড়কাকের গলা-জলজ অন্ধকারের ভিতর দিয়ে আসা ঠিক বুঝা গেল না । জলের ভিতর দিয়ে আসা ডাক তো কানে জলদগম্ভীরই শোনাল !
কাকের ডাক থেমে গেলে আবারও সেই অন্ধকারময় হাওয়ারই ফিসফিসানি। জলের তলায় এত হাওয়াই বা এল কী করে ?
অবশ্য জল তো হাওয়ারই সংমিশ্রণ। H2O= জল । জলে হাইড্রোজেন ( H2) অক্সিজেন ( O2 ) তো আছেই। কেননা বায়ু বা O2-এর সঙ্গে H2-এর যৌগিক সংমিশ্রণেই তো জল উৎপন্ন হয় । পৃথিবীর চারভাগের মধ্যে তিনভাগই তো জল !
জলই জীবন। জল নিয়েই কত হাজার হাজার কবিতা। রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ’ যেমন –
“ বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল’
পুরনো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে –
কোথা সে ছায়াসখী, কোথা সে জল। ”
পাতিকাক হোক দাঁড়কাক হোক, জলের ভিতর দিয়েই তাদের আনাগোনা । তবু, তবু তাদের ডানার পালকে জল লাগল না ছিটেফোঁটাও ?
আমার অবস্থাও তদ্রূপ। জলেরই ভিতর দিয়ে পায়ে ঝিঁজরি বেঁধে এরা আমাকে এতক্ষণ টানতে টানতে নিয়ে এল, এখনও টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আমার গায়ের গেঞ্জি পরনের পাতলুন যেমনকার তেমনই থাকল, শুকনো খড়খড়ে। কোথাও জলের দাগ লাগল না কিছুমাত্র ? এ যেন সেই –“ আমার যেমনি বেণী তেমনি রবে চুল ভিজাবো না –”
এবার ঘরের কথা, মা-কাকিমাদের কথা, পরীক্ষার কথা মনে পড়ে গেল হুদ্ হুদ্ করে। রাত পোহালেই আমাদের গ্রামের সঙ্গে চাঁদাবিলা গ্রামের একটা ফুটবল ম্যাচ আছে –
আমিই গোলে খেলব। আমার অবর্তমানে হয়তো গোটা ম্যাচটাই পণ্ড হবে। নতুবা পরিবর্ত গোলকিপার নিবারণ মাঠে নামবে। সে আমাদের দখিণসোলের সোঁতায় বুলান-হদহদিতে যত না মাছ ধরার ‘ঘুনি’ আটকে মাছ ধরতে পারে, তুলনায় গোলে দাঁড়িয়ে বল ধরতে ততটা দড় নয়।
পরের পর গোল খেয়ে আমরা অবধারিত ভাবেই হেরে যাব। গ্রামের পক্ষে সেটা খুব সম্মানের হবে না। ‘প্রেসটিজ্’-এর দফারফা হয়ে যাবে ! অথচ চাঁদাবিলার নামকরা স্ট্রাইকার বীরবল মাহাতো আমি গোলে দাঁড়ালে গোল দেওয়া তো দূরঅস্ত্, এতদিনে একটা বল নিয়ে গোলের চৌহদ্দিতেও ঢুকতে পারে নি !
মা-কাকিমারা বাবা-কাকারা এখনও জানতেই পারেনি। কী করেই বা জানবে ? তারা তো এখন ঘুমোচ্ছে ! আমি জানি, কাল সকালে সবার আগে উঠবে আমাদের মেজোকাকা। উঠেই ভোর ভোর চলে যাবে বিলে-বাতানে।
জমিজমার তদারকি করতে। আল কেটে জমির অতিরিক্ত জমা জল বের করে দিতে। কখন বা পাশের ঝর্ণা থেকে নালা কেটে জল নিয়ে আসবে বতর দিতে রুখাশুখা জমিতে। ঘরে ফিরতে তার বেলা হবে।
পরে পরেই উঠবে মা। উঠেই প্রথমে খোঁড়লের ঝাঁপ খুলে বের করে দেবে হাঁস আর মুরগিগুলোকে। “ চিঁ-চিঁ ” “ চ্ই-চই ” করতে করতে তারা বেরিয়ে যাবে। তারপরই ডাক পড়বে আমার – ‘ও রে ওঠ্ রে ! আর কত ঘুমোবি? বেলা ঢের হল বাবা !’
একবার দুবার তিনবার। সাড়া না পেয়ে দৌড়ে ঘরে ঢুকে আসবে মা । হাণ্ডুলমাণ্ডুল হয়ে খোঁজাখুঁজি করবে – “এত ভোরে না বলে কোথায় গেল ছেলেটা ? ”
একে তাকে ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি করে আমাদের ঘর তো আমাদের ঘর, গোটা বাখুল তো গোটা বাখুল -মায় গোটা গ্রামটাকেই মাত্ করে ছাড়বে না আমার মা ? গ্রামের সমস্ত মানুষকে উদব্যস্ত করে মারবে না ?
তারপর তো কান্না -কান্না -অঝোরঝর -অঝোরঝর –
– “ রাতে খেয়ে দেয়ে ভালো ছেলে আমার ভালোয় ভালোয় ঘুমোতে গেল আর সকাল হতে না হতেই জলজ্যান্ত ছেলেটা হাওয়া !”
অতঃপর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বাবা-কাকারাও কাঁদুলমাদুল মুখ করে যে পারবে যেদিকে খুঁজতে বেরুবে।
-“ তাই তো ! আজ চাঁদাবিলার সঙ্গে আমাদের গ্রামের জব্বর ফুটবল ম্যাচ আছে। ভোর ভোর উঠে প্রাকটিসে গেল না তো ছেলেটা গোঠটাঁড়ের মাঠে ! যা তো ‘পুরিয়া’ দৌড়ে একবারটি দেখে আয় ! ”
‘পুরিয়া’ অর্থাৎ পুরুষোত্তম কাকা দৌড়ুবে ফুটবল খেলার মাঠে। “ কোথায় ছেলেটা ? কোথায় ? গোঠটাঁড়ের মাঠে তো কতকগুলো গরু বসে বসে জাবর কাটছে ! ”
তাদের গায়ের ‘কেতুর’ খুঁটে খেতে কয়েকটা কাক উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । বাঞ্ছাদের মেয়েটা বগলে ঝুড়ি নিয়ে গোবরের নাদি কুড়োচ্ছে ।
– “কই, জিগ্যেস করায় সেও তো বলল না – বল নিয়ে লোফালুফি খেলতে ছেলেটাকে দেখেছে সে ?”
অকস্মাৎ কোথাও কারও হাত থেকে যেন ঝন্ ঝন্ করে গাদাগুচ্ছের বাসন পড়ল ! কাঁসা-পিতলের বাসন জলে পড়লে কি “ঝন্ ঝন্” আওয়াজ ওঠে ? কেউ কি ডাঙার উপর থেকে বাসনকোসনগুলো ছুঁড়ে ফেলল জলে ? নাকি, জলের ভিতরেই কাঁসা-পিতলের তৈজসগুলো হাত ফসকে জলেই পড়ে গেল
বাবা-কাকারা কেউ পুবে যাবে কেউ পশ্চিমে যাবে, এমনকি দক্ষিনের লাটায়-পাটায় খোঁজাখুঁজি করবে । উত্তরে মশানির দহের কথা হয়তো তাদের মাথাতেই আসবে না ।
কী করেই বা আসবে? তারা তো আর ঘুণাক্ষরেও জানতে পারবে না –‘তেনারা’ শ্যাওলার নাম করে পায়ে লোহার ঝিঁজরি পরিয়ে টানতে টানতে আমাকে মশানির দহে, একেবারে জলের তলায় নিয়ে এসেছে !
বাবা-কাকারা মা-কাকিমারা আমার বন্ধুবান্ধবদের -টুম্পা, চামটু, ফাটাদার, ক্ষুদিরাম, অমিয়-মহেনদের ঘরে ঘরে গিয়ে তল্লাসি করবে, জনে জনে ডেকে জিজ্ঞাসা করবে – গতকাল আমার সঙ্গে তাদের যখন শেষ দেখা, শেষ কথা হল, তখন ভোর ভোর বা গতরাতে আমি কোথাও চলে যাবার কথা তাদের বলেছি কি না –
সবদিক থেকে যখন একই উত্তর আসবে – “না, কোথাও দেখছি না” “কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না” “ কই কিচ্ছু তো বলে যায়নি “ ইত্যাদি ইত্যাদি –
তখন শোকে মুহ্যমান আমার মা তার পায়ের কাছে টিঁ টিঁ আওয়াজ এক-পা দু-পা করে এসে পড়া আমাদের ‘কটকটি কাটুল’টা অর্থাৎ সদ্য সদ্য ডিম পাড়তে শুরু করা মুরগিটা, যে কিনা এসময় “কট কট” শব্দ করে হামেশাই আওয়াজ দেয়, তাকেও মা অভিযোগ করে বসবে – “সময় নেই অসময় নেই “কট্ কট্” করে এত ডাকিস, আর তোদের খোঁড়লের পাশ দিয়ে আমার ছেলেটা ‘অগস্ত্য যাত্রা’ করল তুই মুখপুড়ি একবারও ডাকলি না ?”
সেই যেমনটা ‘নিমাইসন্ন্যাস’ যাত্রাপালায় আছে –
সন্তর্পণে ঘুমন্ত স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়ার শাড়ির গিঁট খুলে, ঘুমন্ত মা শচীরানিকে পাশ কাটিয়ে নিমাই সন্ন্যাসযাত্রা করল । কাকপক্ষীটিও টের পেল না।
অতঃপর ঘুম থেকে উঠে প্রাণের নিমাইকে দেখতে না পেয়ে শোকাতুরা শচীরানি পশুপাখিকেও অভিযোগপূর্বক দোষারোপ করে বিলাপ করছে –
’আমার নিমাই যাবার কালে ।
কোকিল কেন ডাকলি না রে ।।’
কোকিল ডাকল না, মুরগিও ডাকল না। মা-ও কিছু জানতে পারল না। অথচ আমাকে মাঝরাত্তিরে নিরুপায় হয়ে যেন নিশির পাল্লায় পড়ে আসতেই হল মশানির দহের জলে, রসাতলে !
কি-না, সেই কোন মধ্যাহ্ন-অপরাহ্ণের সন্ধিক্ষণে, চামড়ায় চোখ ঢেকে মটকা মেরে দাঁড়কাকটা ছাতিনাগাছে উড়ে এসে জুড়ে বসল। অজস্র তালচড়ুই হুরহার ফুরফার করে গাছটার চারধারে উড়ে-ঘুরে বেড়াল । তখনই শ্যাওলার মতো কী একটা আমার পায়ের দু আঙুলের ফাঁকে জড়িয়ে গেল ! জড়িয়ে থাকল। জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে থাকছে –
অকস্মাৎ কোথাও কারও হাত থেকে যেন ঝন্ ঝন্ করে গাদাগুচ্ছের বাসন পড়ল ! কাঁসা-পিতলের বাসন জলে পড়লে কি “ঝন্ ঝন্” আওয়াজ ওঠে ? কেউ কি ডাঙার উপর থেকে বাসনকোসনগুলো ছুঁড়ে ফেলল জলে ? নাকি, জলের ভিতরেই কাঁসা-পিতলের তৈজসগুলো হাত ফসকে জলেই পড়ে গেল ?
বাসনকোসনগুলো ডাঙা থেকে জলে ছুঁড়ুক আর নাহয় জল থেকে জলেই পড়ুক, একটা ঝনঝনানি আওয়াজ তো জলতরঙ্গের মতো তরঙ্গায়িত হতে হতে আমার কানেও এসে পৌঁছেছে। যেমনটা পৌঁছেছিল কাকের ডাক।
একটা কথা আমরা সবাই জানি। স্থির জলাশয়ে একটা ঢিল ছুঁড়লে ঢিলটি যেখানে জল স্পর্শ করে সেখানে একটি আলোড়ন বা তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। সে তরঙ্গ ওখানেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে এবং অবশেষে জলাশয়ের কিনারায় পৌঁছে যায়।
তেমনটাই শব্দ। শব্দও যেখানে সৃষ্টি হয় তার চারধারে শব্দতরঙ্গও ছড়িয়ে পড়ে। উৎস থেকে শ্রোতার দূরত্ব কম হলে শব্দের প্রাবল্যও বাড়ে। আবার শ্রোতার দুরত্ব বেশি হলে প্রাবল্য কমে।
তদুপরি মাধ্যম । মাধ্যমের ঘনত্ব ও স্থিতিস্থাপকতার উপরও শব্দতরঙ্গের গতিবেগ ও প্রাবল্য নির্ভর করে । কেননা তরঙ্গ বা কম্পন একটি আন্দোলন যা কোনও মাধ্যমের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়।
বাতাস বইলে যেমনটা ঘটে ধানের খেতে –
‘কাঁপন ধরে বাতাসেতে,
পাকা ধানের তরাস লাগে
শিউরে ওঠে ভরা খেতে ।’
এখানে মাধ্যম তো জল । মনে হয় আমিও শব্দ-উৎসের কাছাকাছিই আছি । না হলে স্পষ্ট, এত জোরে জোরে কাকের ডাক, বাসনকোসনের ঝনঝনানি শুনব কী করে ? তবে এখানে কি আর ‘নিউটন’ ‘আর্কিমিডিস’ ‘ল্যাভয়সিয়ের’-এর থিসিস ‘অ্যাভাগাড্রো’র হাইপোথিসিস খাটে ?
যাহোক জলে তো জলে, ডাঙায়ও হঠাৎ হঠাৎ হাত থেকে বাসনকোসন পড়ে যায় । তারপর ঝন্ ঝন্ করে বিকট আওয়াজ হয়।
সুনসান মধ্যাহ্ন। বাইরে খাঁ খাঁ রৌদ্র । দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে রান্নাঘর গুছিয়ে রেখে গৃহস্থ নির্ধুমসে ঘুমিয়ে পড়েছে । উঠোনে মাচানতলে ছায়ায় কুণ্ডলী পাকিয়ে কুকুরটা- বিড়ালটাও বিশ্রামরত।
আচমকা রান্নাঘরের তাক থেকে একটার পর একটা বাসনকোসন মাটিতে গড়িয়ে পড়ে ঝন্ ঝন্ করে বাজতে লাগল ! গৃহস্থ তো গৃহস্থ, মায় কুকুরটা-বিড়ালটাও চমকে জেগে উঠে এদিক সেদিক দৌড়তে লাগল।
দরজা খুলে গৃহস্থ দেখল -কোথায় কী ? কেউ নেই, মেঝেতে বাসন পড়ে শুধুশুধুই গড়াগড়ি খাচ্ছে !
এ তো গেল গৃহস্থের কথা, গ্রামের মধ্যে। গ্রাম থেকে অনেকটা দূরে ফাঁকা মাঠে কবেকার পোড়োবাড়ি একটা ! লোকজন ঘর ফেলে চলে গেছে অন্যত্র। তার ধারেকাছে থাকে বলতে মোটের উপর একটা খেজুরগাছ আর একটা বিরুদবৃক্ষ।
ধূ ধূ হাওয়া এসে লাট খেতে খেতে হঠাৎ হঠাৎ ঢিস্ ঢিস্ করে ধুলো ওড়ায়, বিরুদ বৃক্ষের ডাল ভেঙে দেয় মট্ মট্ করে !
অধিকন্তু সুনসান মধ্যাহ্নে কী মধ্যরাতে আলো জ্বলতে দেখা যায়। ঝন্ ঝন্ করে গড়িয়ে পড়তে থাকে থালাবাসন, হাতাখুন্তি, ডেকচি-হাঁড়া।
এদিক দিয়ে মশানির দহ আরেক কাঠি সরেস। থালাবাসন হাতাখুন্তি ডেকচি-হাঁড়া এদেরও পর্যাপ্ত পরিমানে আছে বটে। সময় সময় জলের ভিতর জলদগম্ভীর ঝন্ ঝন্ আওয়াজ করে হাত থেকে পড়েও যায়।
এই যেমন এখন।
তবে এইসব তৈজস বাসনসামগ্রী আমাদের গ্রামের তথা আশপাশের গ্রামের, এমনকি সমগ্র তল্লাটের গরীবগুর্বো মানুষজনের ভারি উপকারে আসে !
ধরা যাক, দেখেশুনেই মেয়ের বিবাহ স্থির হয়েছে কুঁকড়াকুপি গ্রামের পাশের গ্রাম মহাপালে। নদীধারের গ্রাম, আখ-অড়হর-মুগ-ছোলার চাষসহ মোটামুটি সম্পন্ন পরিবার।
কিন্তু মেয়ের হবু শ্বশুর লোকটি এক নম্বর চশমখোর। পণ নয়, যৌতুক হয়তো চেয়ে বসেছে সোনাদানাসহ বস্তাদুয়েক কাঁসা-পিতলের বাসনকোসন আর হাঁড়া-কড়া বারকোশ।
মেয়ের বাপের তেমন আর সংগতি কোথায় ? ওই তো কটা গরু, ছেড়ি-ছাগল হাঁস- মুরগি, জঙ্গলের ধারে ডাঙা-ডুঙোড় কাঠাকতক জমি !
সোনাদানা ভরিকতক যাও বা জোগাড় হল, বাসনকোসন তো ঢু ঢু ! শূন্য শূন্য। অগত্যা ধূপ-ধুনো-সিঁদুর আর গোটাকতক গোটা সুপারি উৎসর্গ করে সকাল-সন্ধ্যা মশানির দহের ধারে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকবে না মেয়ের বাপ ?
হাতে হাতেই ফল। একদিন ভরসন্ধ্যায়, ওই যখন চামড়ায় চোখ ঢেকে ছাতিনাগাছে মটকা মেরে বসেছিল অলম্ভুস দাঁড়কাকটা, তখনই কীনা মশানির দহের জলে ভুস করে ভেসে উঠল একের পর এক যত সব থালাবাসন হাঁড়া-কড়া-বারকোশ !
মেয়ের বাপের আনন্দ আর ধরে না। বিয়েটা ভালোয় ভালোয় উতরে গেল। শুধু কি যৌতুকের দ্রব্যাদি? চাওয়ার মতো চাইতে পারলে বিয়েসাদি, উপনয়ন ও অন্নপ্রাশনে ব্যবহার্য ডেকোরেটারের বাসনকোসন হাঁড়াকড়া হাতাখুন্তিও পাওয়া যায়।
তবে তা ফেরত দিতে হয় নির্দিষ্ট সময়েই, গুণে গুণে। গুণতিতে একটা তৈজসও যদি কম পড়ে, তখন মশানির দহ তাকে ছাড়বে না! হয়তো আমারই মতো পায়ে শ্যাওলা ওরফে লোহার ঝিঁজরি বেঁধে জলের তলায় টেনে আনবেই আনবে।
অতএব নিরেটকালো জলআঁধারে একটু আগে হাত ফসকে বাসনকোসন পড়ে যাবার যে জলদগম্ভীর ঝনঝনানি শুনেছিলাম, তা যে থালাবাসনেরই আওয়াজ, তা তো দেখছি মিথ্যে নয় । বরঞ্চ সেটা হওয়াই তো স্বাভাবিক।
তা বলে রব –“হাম্বা” –“হাম্বা”
একবার নয়, দু-দুবার শোনা গেল । জলের ভিতরে গরুর ডাক -কোত্থেকে এল ? এখানে শ্রীশ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ পুনরপি তর্জমা করে যে –
“ হাম্বা, -ম্মা বি ” [ সং হম্বা, -ম্ভ ] গাভীর ডাক ।
“ গরু মধ্যে মধ্যে হাম্বা হাম্বা করিতেছে ” [ আলালের
ঘরে দুলাল ] । “ বৎসহারা যেন গাই, হাম্বা রবে
ফিরে যাই ” [ দুর্গাপঞ্চরাত্রি ] । “ হাম্বা রবে ধেনু ধাইল
শুনি ” [ বঙ্গসাহিত্য পরিচয় ] ”
• ৫ •
পরীক্ষায় প্রমাণিত যে, জল, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সংযোগেই সৃষ্টি হয়। জলের মধ্যে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের অনুপাতের পরিমানও ২ : ১।
তবু নদীর জলে বা সমুদ্রের জলে দীর্ঘক্ষণ ডুবে থাকতে হলে অক্সিজেন সিলিন্ডারের প্রয়োজন হয়। কেননা, নদীর জলে বা সমুদ্রের জলে হাইড্রোজেন-অক্সিজেন ছাড়াও তো আরও অনেককিছুই থাকে । যেমন— সোডিয়াম পটাসিয়াম ক্যালসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম আয়রন, ইত্যাদি ধাতুর সালফেট, ক্লোরাইড, কার্বনেট, বাই-কার্বনেটও থাকে।
আমাদের মশানির দহের জলে এতসব একসঙ্গে না থাকলেও কোনও কোনওটা, কিছু কিছু তো আছেই । তাছাড়া এখানকার জলতল বা পাতালের বাসিন্দারা এমন সব তুক-গুণ জানে, সময় সময় নিজেদের প্রয়োজনে জলের সঙ্গে এমন সব ‘অনুপান’ মিশিয়ে দেয় যে, এখানে তাবড় বিজ্ঞানও ফেল মেরে যায়।
তাই কাক তো কাক, গরু তো গরু, আস্ত মানুষও সল্ সল্ করে জলের তলায় ঢুকে পড়ে – আহা ! আহা ! স্ব-ইচ্ছায় কি আর ! পায়ে ঝিঁজরি বেঁধে ‘কারা’ যেন হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যায় ।
“ এভাবে এইভাবে নয়, যেন যেতে হবে
কোথাও, কোথাও যাবার ঠিক ছিল, যার জন্য
অন্যতম ট্রেনের অপেক্ষায় পোশাক পাল্টে আছি
সংকেত এলেই স্টেশন আড়াল করে যাব
এ যেন, জল ঘেঁটে জলের ভিতরে চলে যাওয়া ”
মনে হচ্ছে আশপাশে কোথাও গরুর গোঠ আছে। গরু চরছে, চুরনি গরুর গলায় কাঠের ‘ঠরকা’ বাজছে –“ ঠ-র-ক ! ঠ-র-ক !!”
চরতে চরতে কোনও কোনও গরু হঠাৎ হঠাৎ দলছুট হয়ে জঙ্গলের গভীরে চলে যায় এদিকে সেদিকে। হয়তো কোনও উন্নততর ঘাস কিংবা পাতার লোভে ও সন্ধানে। অথবা, পাছে মুখ দিয়ে দেয় ‘চুরনি’-টা অন্যের খেতি-খামারে-ধানবিলে-
তাই তাকে ‘চুরনি’ সাব্যস্ত ও ‘চিহ্নত’ করে তার গলায় ঘন্টি বাঁধতে হয় । কুড়চি কী ডকাকাঠের ‘ঠরকা’ বানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে দিতে হয়। চরৈবেতি। যেখানেই যাক না — “ঠ-র-ক্ ” “ ঠ-র-ক” আওয়াজ তার পিছু ছাড়বে না !
“খুঁজে খুঁজে নারি যে পায় তাহারি” -খুঁজে পেতে আর কোনও অসুবিধাই হয় না । সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রণীত ‘পালামৌ’-এ এমন ‘কাষ্ঠঘন্টা’-র কথা পড়েছি বটে । ওই যে—… “ বন দিয়া যাইতে যাইতে এক স্থানে হঠাৎ কাষ্ঠ-ঘন্টার বিস্ময়কর শব্দ কর্ণগোচর হইল ; কাষ্ঠঘন্টা পূর্ব্বে মেদিনীপুর অঞ্চলে দেখিয়াছিলাম। গৃহপালিত পশু বনে পথ হারাইলে শব্দানুসরণ করিয়া তাহাদের অনুসন্ধান করিতে হয় ; এইজন্য গলঘন্টার উৎপত্তি । কাষ্ঠঘন্টার শব্দ শুনিলে প্রাণের ভিতর কেমন করে । পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে সে শব্দ আরও যেন অবসন্ন করে…”
প্রথমে “হাম্বা” “হাম্বা”, তারপরে “ঠ-র-ক” “ঠ-র-ক”-ই তো শুনলাম ! সে আওয়াজ তো এখনও শুনছি -ওই তো ওই –“ঠ-র-ক” “ ঠ-র-ক” – আর কেমন অবসন্ন বোধ করছি !
একসঙ্গে অনেকগুলো পাখি ডেকে উঠল কোথাও ! “ কিচ্ কিচ্” “ কিচির মিচির !” অনেক পাখির ডানা ফেটানোর আওয়াজ ! “ হুর্ হার্” “ফুর্ ফার্” !
চড়ুই-টড়ুই হবে হয়তো । চটি-বনিরা, তালচড়ুইরা তো সকাল-সন্ধ্যা তালগাছের চারধারে, ঝোপঝাড় ঘিরে ধরে অনবরত ডানা ফেটিয়ে কীসব আওয়াজ করে! কত কী কথা বলে !
কথা বলে কী ? না, কিচ্ কিচ্ কিচির মিচির করে গান করে ? নাকি পূর্বাহ্নে সায়াহ্নে মন্ত্র উচ্চারণ করে তারা বৃক্ষবন্দনা, জপতপ বা আহ্নিক সারে ?
যাই করুক না কেন, সে তো পূর্বাহ্নে-অপরাহ্ণে, দিনের বেলায় । তা বলে এহেন ঘোর নিশীথে ? তদুপরি জলের তলায় ? পাতালে ?
হ্যাঁ, শীতের মরশুমে আমাদের সুবর্ণরেখা নদীকিনারে সকাল-সন্ধ্যা পরিযায়ী পাখিদের মেলা বসে যায় বটে। কোন্ সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসে খড়হাঁস বালিহাঁস বিগড়িহাঁস !
তাদের সঙ্গে জুটে যায় আমাদের দেশি সরাল, শামুকখোল, জলপিপি – জল-পিপি তো এক পা দু পা করে একেবারে জলের ভিতর ঢুকে আসে ! জলকাক বা পানকৌড়ি মাঝনদীতে ঘন ঘন মাথা ডুবিয়ে মাথা উঁচিয়ে সাঁতারও কাটে।
তবে তারা কী আর আমার মতো কখনও জলের তলায় অতলে এই অন্ধকারময় মহাপ্রদেশে এসে অশরীরিদের কব্জায় পড়ে বন্দী হয়েছে ? ‘কারিকুরি’ বা পরিযায়ী পাখিরা, মুক্ত বিহঙ্গ তারা –“যথা ইচ্ছা তথা যা” “যাও পাখি বলো তারে” ইত্যাদি ইত্যাদি।
কবিতায় সেই আছে না ? –
“ যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে
সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্-দিগন্ত অবগুন্ঠনে ঢাকা,
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।”
আসলে কী, ভয়ই পাচ্ছি ? পাখির ডাক তো পাখির ডাক, এহো বাহ্য, কানে ভুলভাল শুনছি কী ? পাখির ডাক নয়, পাখির ডাক নয়, জলঝিঁঝির ডাক ? “ রিঁ-ই-রিঁ ” “ রিঁ-ই-রিঁ ” ? জলে একজাতের ঝিঁঝিপোকাও থাকে নাকি ? যারা অনবরত নিজেদের পেট টিপে-রিঁ-ই-রিঁ করে ডাকতে থাকে ?
না, না । তা কেন ? এই তো এখন আর পাখির ডাক নয়, পাখির ডাক নয় । শুনছি তো একটানা ঘন্টাধ্বনি ! যে সে ঘন্টা নয়, এমনকি আমাদের রোহিণী চৌধুরানী রুক্মিণী-দেবী হাইস্কুলের আর্দালি পিওন কার্তিক মাইতির হাতের ঘন্টাধ্বনিও নয়। এ যে পাগলা-ঘন্টির মতো বেজে চলেছে, বেজেই চলেছে !
পর্যটক মার্কো পোলো নাকি সেবার বাংলায় এসে হাতির মতো বড় আর লম্বা লম্বা ষাঁড় দেখেছিলেন ! ‘আইন-ই-আকবরি’-তেও আছে -সেকালে শরিফাবাদে খুব সুন্দর সুন্দর সাদা ষাঁড়ের জন্ম দেওয়া হত। একেকটার আকারও ছিল বিরাট বিরাট। একটা ষাঁড় নাকি একসঙ্গে ১৫জন মানুষকে অবলীলায় টেনে নিয়ে যেতে পারত। সেকালের শরিফাবাদ তো একালের বর্ধমান
মনে তো হয়- কোনও মঠ বা মন্দিরে ঘন্টাধ্বনি সহকারে কোনও দেবারতি হচ্ছে। জলের তলায়ও দেবদেবীর পূজাপাঠ ? জলের তলায় কাকেশ্বর কুচকুচ্, চড়ৈ-চটি, “ হাম্বা ” রবে গরু ডাকতে পারে, “ঝন্ ঝন” করে থালাবাসন পড়ে যাবার আওয়াজ উঠতে পারে, সেখানে ঘন্টা বাজিয়ে কোনও মঠ-মন্দিরে কোনও দেবদেবীর আরাধনা হবে – তাতে আর আশ্চর্য কী !
জলের দেবী তো গঙ্গা। পড়েছি বৈকি – “দেবি সুরেশ্বরি ভগবতি গঙ্গে, ত্রিভুবনতারিণি তরল-তরঙ্গে । শঙ্কর মৌলিনিবাসিনি বিমলে, মম মতিরাস্তাং তব পদকমলে ।। “ তাছাড়া, আমাদের গ্রামের ব্রাহ্মণ পুরোহিত শ্রীঅমূল্যচরণ মিশ্র কী শ্রাদ্ধে, কী ঘাট-ক্রিয়াদিতে, কী পূজার ঘটোত্তোলনে এই সুবর্ণরেখা নদীকিনারে বসেও তো জলশোধনের নিমিত্ত এহেন মন্ত্র উচ্চারণ করেন—
“ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি ।
নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেহস্মিন সন্নিধিংকুরু ।। ”
হাতে জল নিয়ে জল ছিটাতে ছিটাতে বলেন— “ওঁ মধুবাতা ঋতায়তে মধুক্ষরন্তি সিন্ধবঃ” ইত্যাদি ইত্যাদি । হয়তো এক্ষণে গঙ্গারতিই হচ্ছে । জলের তলায় তারই ঘন্টাধ্বনি।
পরক্ষণেই মনে হল, ধুত্ ! এদের আবার গঙ্গারতি ! শ্রীশ্রীহরিচরণ বন্দ্যো-র ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ চৈতন্যভাগবতের ‘ভূতের কীর্ত্তন’ তর্জমা করতে গিয়ে লেখে যে, “ কাজি বোলে ‘জান, ভাই ! কি গীত বাজন। কিবা কারো বিভা, কিবা ভূতের কীর্ত্তন’ ।”
হ্যাঁ, ঘন্টাধ্বনি সহকারে বোধকরি ভূতেদেরই কীর্তনই হচ্ছে।
যেন একসঙ্গে অনেকের গলার আওয়াজও তো পাচ্ছি ! সে-আওয়াজ যত মৃদুই বা ফিসফিসানি হোক। কী বলে তারা কীর্তন করছে? নামগান করছে কী ? “ হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে” “হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ” ?
না, না । তাও কী হয় ? সেই বলে না –“ ভূতের মুখে রামনাম !” আমাদের গ্রামের তামাম লোকই তো জানে, জানেও মানেও যে, রামের নাম করলে ভূত তো ভূত, ভূতের বাপও পালিয়ে যায় !
“ রাম রাম ! – পাপকথা শ্রবণে, ঘৃণায়, ভূতের ভয়ে উচ্চারণীয় রামনাম।” – তাই যদি সত্য হবে, তবে আমি কেন রামনামের শরণ নিচ্ছি না ? আসলে, প্রকৃত প্রস্তাবে, আমার গলা দিয়ে কোনও কথাই ত বেরোচ্ছে না, রামনামের শরণ নেব কী করে ?
তবু, তবু আরেকবার গলা ফুলিয়ে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে ডাক দিলাম, “রাম ! রাম ” !! কোথায় কী, গলা দিয়ে বিন্দুমাত্র স্বরাগমই তো স্ফূরিত হল না !
অথচ জলের ভিতর ডুব দিয়ে মুখের কাছে দুহাতের চেটো জড়ো করে কত, কতবার আওয়াজ দিয়েছি, “কু-ব ! কু-ব !!” তার প্রতিধ্বনিও শুনতে পেয়েছি, “কু-উ-ব ! কু-উ-ব !!” যেন “কুবোপাখি কুব্ কুব্ ডাক দেয় লুকায়ে কোথাও –”
ঘন্টাধ্বনি তো এখনও বেজে চলেছে ! রাত কত হল ? — কে জানে ! রাত যখন ভোর হবে, চারধারে আলো ফুটবে, রাতচরারা ফিরে এসে সন্তর্পণে এ-ডাল সে-ডাল করবে, ঝোপঝাড়ের চারধারে তালগাছটাকে ঘিরে ধরে অজস্র তালচড়ুই, চটি-বনি প্রাতঃকাল আসন্ন ভেবে হুর্ হার্ ফুর্ ফার্ উড়েঘুরে বেড়াবে। তা বলে মশানির দহের জলে, জলতলেও কী অনুরূপ রাত্রি শেষের দৃশ্যাবলি অনুষ্ঠিত হতে দেখা যাবে ?
কে বলবে ? – সেসমস্ত তো মশানির দহের ‘তাহারা’-ই জানে ! জলে কখন কী জড়িবুটি, অনুপান মেশাবে বা ‘মূল্য ধরে দেবে’ যার প্রভাবে রাত দিন হয়ে যাবে, দিন রাত হবে, নয়-কে ছয় করবে, ছয়- কে নয়।
মনে মনে এত কিছু ভাবছি বটে । কই, কাউকেই তো স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি না ? অথচ মাঝেমধ্যেই হ্যাঁচকা টান দিয়ে কে বা কারা আমাকে পায়ে ঝিঁজরি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে !
টানছে তো টানছেই ! “আর কতদূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী ? বলো কোন্ পারে ভিড়িবে তোমার সোনারতরী ?” সোনার কী আর, লোহার। লোহার ঝিঁজরি না জল-ঝিঁজরি ? তাও তো হাঁতড়ে হাতমুঠোয় নাগাল পাচ্ছি না ! কীসব কলকব্জা দিয়ে তৈরি !
মাঝে মাঝে ঝিমুনি আসছিল। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব । কিন্তু অদৃশ্য হ্যাঁচকা টানে ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছিল । ঘুম কি আর -ওই ঘুম-ঘুম ভাব।
তবে কি ভয় পাচ্ছি না ? না না, ভয়ডর তো ষোলোআনাই আছে । তবু একটা জেদ, চাপা উত্তেজনা – দেখি, দেখিই না শেষপর্যন্ত কী হয়! কথাতেই তো আছে –“ পড়েছি যবনের হাতে খানা খেতে হবে সাথে । ”
মনে হল, হঠাৎ ঝড় উঠেছে, ঝড়ে নদীর জল তোলপাড় হচ্ছে । জলতল প্রকম্পিত করে গর্জন। গর্জনটা যেন এদিকেই ক্রমশ এগিয়ে আসছে । এগিয়ে আসছে, এগিয়ে আসছে !
সমুদ্রে ‘টর্নেডো’ বা সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কথা তো ভূগোলে পড়েছি। এর উৎপত্তির সঠিক কারণ জানা না গেলেও অনেক বিজ্ঞানীদের মতে বজ্রবিদ্যুৎ সহ বিশালাকার ঝড়ই এর উৎপত্তির মূল।
ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে উত্থিত ফানেল আকৃতির বজ্রবিদ্যুৎ সহ মেঘ ও ঝড়ই টর্নেডোর কারণ। এর গতিবেগ ঘন্টায় প্রায় পাঁচ শো কিলোমিটার। গতিপথে যা পায় সব- কিছুকে ধ্বংস ও তার তোল্ মাটি ঘোল্ করে ছাড়ে !
তা বলে নদীগর্ভেও কী ‘টর্নেডো’ হয়? হয় হয় । এমন হয় যে নদীকে জলসহ উৎ-পাটিত করে অন্য কোনও খাতে আছড়ে ফেলে দেয় । পরিবর্তে সেখানে হয়তো আস্ত কোনও জনপদ বা নগরকে বসিয়ে দেয় ।
এমনি কোনও সামুদ্রিক ঝড় অথবা নদীঝড়েই তো একদা ডুবে গিয়েছিল ‘ওক্কলবা’ তথা উৎকলের সওদাগর ‘তপোসা’ ও ‘পালেকাথ’-এর ‘আদজেত্তা’ বা তাম্রলিপ্ত বন্দরগামী অর্ণবপোত !
টর্পেডো, টাইফুন, টর্নেডো কি সাইক্লোন আজ সুবর্ণরেখা নদীবক্ষে তথা মশানির দহে যুগপৎ আছড়ে পড়ুক, জলস্তম্ভ উঠুক, জলঝড়। তোল্ মাটি ঘোল্ হোক । নদীতল উপরে উঠুক, জলের উপরিতল নিচে নামুক।
তবেই তো আমার লোহার-ঝিঁজরি-বাঁধা বন্দীদশা এবারের মতো ঘুচে যাবে ! এক- বার যদি উপরে উঠতে পারি- আর আমাকে পায় কে ! হারান-পরাণ-মন্মথ-পরিতোষদের মুগচনা ছোলামটরের খেতের উপর দিয়ে কুদি মেরে এমন দৌড় দৌড়ুব !
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুপ্তধন’-এ যেমনটা আছে —
“ সন্ন্যাসী ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, মৃত্যুঞ্জয়, কী চাও । সে বলিয়া উঠিল, ‘আমি আর কিছুই
চাই না -এই সুড়ঙ্গ হইতে, অন্ধকার হইতে, গোলক- ধাঁধা হইতে, এই সোনার গারদ হইতে, বাহির
হইতে চাই । আমি আলোক চাই, আকাশ চাই, মুক্তিচাই । সন্ন্যাসী কহিলেন, এই সোনার ভাণ্ডারের চেয়ে
মূল্যবান রত্নভাণ্ডার এখানে আছে । একবার যাইবে না? মৃত্যুঞ্জয় কহিল, ‘না, যাইব না ।
সন্ন্যাসী কহিলেন, একবার দেখিয়া আসিবার কৌতূহলও নাই ?
মৃত্যুঞ্জয় কহিল, ‘না, আমি দেখিতেও চাই না । আমাকে যদি কৌপীন পরিয়া ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতে
হয় তবু আমি এখানে একমুহূর্তও কাটাইতে ইচ্ছা করি না। ”
হাঁড়া হাঁড়া গর্জন তেল ‘অনুপান’ হিসাবে জলে মিশিয়েও হয়তো কাজের কাজ কিসসু হল না। ঝড় উঠলই। প্রলয়ঙ্করী ঝড়। সে-ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সবকিছুই। মড় মড় করে কতক হাড়গোড় ভাঙল আর আমি মূর্ছিত হলাম।
যাত্রাপালা বা নাটকের ‘ পতন ’ ও ‘ মূর্ছা ’ নয়, সত্যি সত্যিই আমি জ্ঞান হারালাম । তবে সে কতক্ষণ বলতে পারি না । জ্ঞান যখন ফিরল তখন শুনি পাখি ডাকছে। “ পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল–”
তবে এসব কী পাখি ? চারিভিতে তালীবন আছে বটে, তার চারধারে হুর্ হার্ ফুর্ ফার্ করে তালচটা-চড়ৈ উড়েঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা এত নধরগতর হৃষ্টপুষ্ট হল কী করে ?
তালগাছগুলোই বা এত দীর্ঘ আর ঘন পাতাসন্নিবিষ্ট কবে হল ? আমাদের গ্রামের মুচিরামদের বসতবাটির পশ্চাতে যে তিন-তিনটি সিড়িঙ্গে তালগাছ আছে, মরাহাজা,তাদের তো কভু এত লালিত্যময় দেখি না ।
তবু শ্রাবণ-ভাদ্রে তাল যখন পাকে, মুচিরামের পিসি পদ্মবুড়ির তখন কী আহ্লাদ । কী আনন্দ ! “ আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে !” ঘন ঘন তালতলায় যায়, তাল পায়, তাল কুড়ায় আর উপর্যুপরি ছড়া কাটে –“ উপরনু পড়ল দুম্ । দুম্ বলে মোর পোঁদ শুঙ্ ।।”
তাছাড়া আমাদের গ্রামের মাথায় আর তালগাছ কোথায়?আছে তো বড়জোর একটা কুসুমগাছ, কুসুমতলা । একটা মহুয়া বা মুহুলগাছ, মহুলতলা । কটা লাল ভেরেণ্ডা, বাঘনখী আর বিরি-বাইগনের ঝাড় ।
কাঁকুরে-এঁটেলমাটির সমুন্নত ছোটখাটো পাহাড় বৈ আর কিছু না আমাদের গাঁমুড়ো, গ্রামের মাথা । পা টিপে টিপে সাবধানে ওঠানামা করতে হয় । আসতে যেতে চড়াই-উৎরাই-এর পথ । তারমধ্যেই অরণ্যদেবের খুলিগুহার মতো আমাদের গ্রামের মৃৎশিল্পী কুম্ভকারদের ‘মাটিখানা’ । হাঁড়ি-কলসি কুঁদা-কুঁজো গড়বার মাটির কারখানা ।
এখানে, এই ভূখণ্ডে তেমনটা দেখি না । চেনাজানার মধ্যে তালগাছ আছে বটে । পাকুড়, বাঁশ, ইক্ষু, ভুট্টাগাছও দেখছি এদিক-ওদিক । তিলগাছ, তুলোগাছ, নারকেল গাছও আছে । বাকি সব উদ্ভিজ্জ্য কেমন নতুন নতুন, আর বৃহদাকার ।
প্রথমটায় ভেবেছিলাম ঝড়ঝঞ্ঝা জলঘূর্ণীর মারণ-উচাটনের ধাক্কায় মশানির দহের উপরে উঠে আমাদের শ্মশানেই আছড়ে পড়েছি, ঘোর কেটে গেলেই গ্রামের দিকে কুদি মেরে দৌড়ুব – দৌড় দৌড়-
হা হতোস্মি ! আমাদের গ্রাম কোথায় ? – “ঐ যে গাঁ’টি যাচ্ছে দেখা আইরি খেতের আড়ে, প্রান্তটি যার আঁধার করা সবুজ কেয়াঝাড়ে । …”
না না, এ তো অন্য কোনোখানে। অন্য কোনও গঞ্জে কী অন্য কোনও নগরে এসে পড়েছি ! গঞ্জের পুরোভাগে বাঁশের ঝাড়, পাকুড়গাছ, পাটকাঠির বেড়া ও খড়ের ছাউনি দেওয়া পানের বরোজ অবশ্য আছে।
তদুপরি অদূরে গোচরভূমি -ওই তো ওই, সে-মাঠে গরুছাগলও চরে বেড়াচ্ছে। তবে তাদের আকার আয়তনও অন্যরকম। অন্যরকম, অন্যরকম। একেকটা বৃহদাকার গাছপালা যেমন, ছাগলগরুগুলোও তেমন। বেশ বড় বড়।
পর্যটক মার্কো পোলো নাকি সেবার বাংলায় এসে হাতির মতো বড় আর লম্বা লম্বা ষাঁড় দেখেছিলেন ! ‘আইন-ই-আকবরি’-তেও আছে -সেকালে শরিফাবাদে খুব সুন্দর সুন্দর সাদা ষাঁড়ের জন্ম দেওয়া হত। একেকটার আকারও ছিল বিরাট বিরাট। একটা ষাঁড় নাকি একসঙ্গে ১৫জন মানুষকে অবলীলায় টেনে নিয়ে যেতে পারত। সেকালের শরিফাবাদ তো একালের বর্ধমান !
প্রাগৈতিহাসিক যুগে গরুছাগলের চেহারা-চরিত্র ছিল তো হাতির মতোই। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সন নাগাদ গরু-ছাগল-ভেড়া আকারে ছোট হতে শুরু করল। আর মার্কো পোলো- র যুগ ১২৮৮-১২৯৩ খ্রিস্টাব্দ তো এই সেদিন !
যাহোক এই গঞ্জটি আকারে-প্রকারে সুবিশাল হলেও কেমন যেন পোড়ো পোড়ো। হরিদ্রা আভা ধরেছে। ইতস্তত কতক পতিত বাস্তুভিটা, উইয়ের ঢিবির মতো উঁচু নিচু। দেখে তো মনে হয় ধ্বংসস্তূপ।
তাসত্ত্বেও, কী আশ্চর্য ! কাছেপিঠের চাষাবাদের জমিতে ধান ফলেছে। শুধু কি ধান, আখ-ইক্ষু-নানাবিধ সর্ষপ-তাল-খেজুর-নারিকেল-পান-সুপারি। ঘরগুলোও খড়, নল-খাগড়া, পাতার ছাউনি দেওয়া দো-চালা চৌ-চালা কি আট-চালা। কাঁচা-পোড়া ইটের ব্যবহারও আছে দেখছি ।
কিন্তু, এহো বাহ্য ! কী ঘরে কী মাঠে, গোচারণেও এপর্যন্ত একটাও লোক দেখি না। আমাকে, যে বা যারা পায়ে ঝিঁজরি পরিয়ে মশানির দহের জলে ছলে-বলে-কৌশলে টেনে এনেছিল, তারাই বা গেল কোথায় ? ঝড়ের ঝাপটে তারা কি হাড়-গোড়-ভাঙা ‘দ’ হয়ে পড়ে আছে কোথাও ?
এদিকে-সেদিকে নড়েচড়ে বসলাম। এক-পা দু-পা হাঁটাহাঁটির চেষ্টাও করলাম। অন্যো- ন্যোপায়। না না, পালিয়ে যাবার কোনও উপায়ই দেখি না। পায়ের ঝিঁজরি যেমনকার তেমন অটুটই আছে।
বোধকরি, এখান থেকে সমুদ্র খুব দূরে নয়। জোয়ারবাহী নদীও হয়তো ধারেকাছেই। হাওয়ায় উড়ে আসছে, ভেসে আসছে ঢেউ-গর্জনের শোঁ শোঁ আওয়াজ। নদীর কল্ খল্। জলের গুঁড়ো।
মাথার উপর উড়েঘুরে বেড়াচ্ছে কাক-চিল-সমুদ্রপাখি। জমির খাঁড়িতে বাবলা-বাবুলের গাছে ঘুরপাক খাচ্ছে চড়ৈ-চটা -ওই তো নলখাগড়ার দঁকে নড়নচড়ন নট একটা ‘মাছরাঁকা’ ! মাছরাঙা তো নয়, মাছের ‘রাঁকা’। ‘রাঁকা’ তারমানে লোভী।
জোয়ারবাহী নদীধারের জমির নোনাপ্রকৃতি। ‘নুনিয়া’-ভাব কাটাতে চাষীদের তাই জমির আলবরাবর বাবলা-বাবূল-সুবাবুলের চাষ। তাছাড়াও জমিতে তারা গর্ত বা মাদা করে রাখে, জোয়ারের জমা জল শুকিয়ে যাতে নুন করতে পারে।
সেহেতু মাঠেঘাটে অষ্টপ্রহর লোক থাকারই তো কথা। তবু যে চারধার জনমানবহীন সুনসানই দেখি ! দরিয়াদারি নদীধারের মাছমারা ‘জালুয়া’-রাই বা গেল কোথায় ? তাদের তো রাত থাকতে ‘বেড়া-বেহুঁদি-সাবাড়-সারানি’ কি খেপলা জাল নিয়ে নদীতে মাছধরার ‘ভেউরি-জালিবোট’ কি বাছাড়ি নৌকোয় যেতে হয় !
আর তাদের ঘরের বউড়িঝিউড়ি এণ্ডাগণ্ডা গেঁড়িগুগলিরাও তো ঘর থেকে নদীঘাট পর্যন্ত ভোর হতে না হতেই হাট বসিয়ে দেয়। এরকম ছবি আমাদের বড়োডাঙা গ্রামের বধুক-বিশুইদের পরিবারেও কি কম দেখেছি !
রাস্তায় ঘাটে লোকজন না থাকুক, হাওয়া-বাতাসে কেমন যেন “আঁধারঘরে গাঁদার- গুঁদুর” হিসহিসানি ফিসফিসানির আওয়াজ তো আছে! আছে, আছে।
আবার কোথাও কোনও মঠে বা মন্দিরে লাগাতার ঘন্টাধ্বনি হতে লাগল, যেমনটা কাল রাতেও শোনা যাচ্ছিল।
এমনসময়ই একটা জবরদস্ত গরুর গাড়ি এসে আমার সামনে দাঁড়াল । কাঠের খাঁচা- ওয়ালা গাড়ি, মাত্র একটাই বলদ। হাতির মতো বড় না হলেও বেশ বড়সড়ই । এমনটা কোথায় যেন দেখেছি? কোথায় যেন ?
হুবহু একরকম । একইরকম। পিঠের তথা ‘শিব’-এর বা কুঁজের ওদিকটা ভুসভুসে কালো। পা, পেট সাদা। বাঁকানো সিং,বড়সড় গলকম্বল। হ্যাঁ, এটা যেন মহেঞ্জাদড়োর ছাপ্পা- মারা সেই ‘ষাঁড়’।
এক্ষণে, এই চালকবিহীন কেবলমাত্র ষাঁড়পরিবাহিত এক্কা শকটটিই কি আমাকে বলির নিমিত্ত পূজাস্থানে, সেই ‘অর্গলা ভূতের হাড়িকাঠ’-এ পৌঁছে দেবে ?
“ -সবিস্ময়ে দেখিলা অদূরে,
ভীষণ-দর্শন মূর্তি । ”
• ৬ •
গো-শকটে আরোহণ মাত্রই শরীরে ও মনে বোধকরি নতুনভাবের সঞ্চার হল। অন্তত জলতল বা পাতালপ্রবাস থেকে উত্থিত হওয়ার পরে পরেই অনুরূপ ভাবই তো স্বাভাবিক। হালকা-পুলকা বোধই হচ্ছিল।
অথচ, গো-শকটে আরোহণ ও ভ্রমণের পূর্ব-অভিজ্ঞতা ততটা সুখের নয় মোটেও। আড়ায় গাড়ায় পড়ে গো-শকটের চাকা পুনঃপুনঃ ঘূর্ণন ও ঘর্ষণে এমন ‘রগড়ে’ যায় যে ভ্রমণ-অন্তে সারা শরীরে, হাড়ে ও মজ্জায় ভয়ানক পীড়ার উদ্রেক করে।
কতই তো গো-শকটে চড়েছি ! কার্তিক-অগ্রহায়ণে ধানকাটার মরশুমে ধানের খেত থেকে ধানের ‘বিঁড়া’ খামারে আনয়নের প্রাক্কালে, বন থেকে কাষ্ঠাদি আহরণের সময়ে, আরও নানাবিধ কৃতকর্মে।
চড়াই-উৎরাইয়ের পথে চলমান বোঝাই গাড়ির ভারসাম্য বজায় রাখতে, অর্থাৎ ‘উলার’ বা ‘ডাবু’ ধরতে কি না একজন কাউকে না কাউকে, সে ছোট হোক বড় হোক, গাড়িতে থাকতেই হয় !
গাড়ি যখন খাদ থেকে উচ্চাবচে উঠছে, অথবা উচ্চাবচ থেকে খাদে অবতরণ করছে, তখন স্বাভাবিক কারণেই শকটের ভারসাম্য ঠিক থাকে না। উচ্চাবচে ওঠার প্রাক্কালে শকটের সম্মুখভাগ বলদের গলার দড়িদড়াসহ উপরে উঠতে চায়, উঠতেই চায়, যাকে বলে ‘উলার’। তখন দরকার হয় শকটের মাথায় অর্থাৎ অগ্রভাগে কারোর না কারোর চড়ে বসার।
আবার, অবতরণ সময়ে শকটের পশ্চাদভাগ অনুরূপভাবে উপরের দিকে উঠতে চায়, উঠতেই চায়, যাকে বলে ‘ডাবু’। ভারসাম্য বজায় রাখতে তখন কাউকে না কাউকে চড়ে বসতেই হয় শকটের পশ্চাতে।
তা, এ তো গেল গো-শকটের শর্টকাট এক-দু ক্রোশের ভ্রমণকাহিনী । ততটা কষ্টের নয় বটে। একদা আমাদের যেতে হয়েছিল ক্রোশের পর ক্রোশ, তা প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ ক্রোশ দূরের বেলিয়াবেড়া রাজবাড়ির ‘রাসটাঁড়’-এ।
সেখানে রাসপূর্ণিমা তিথিতে রাসযাত্রা উপলক্ষে মেলা বসেছিল রাসটাঁড়ে। মেলায় যেমন এসেছিল ‘ভাণুমতীর খেল্’ তেমনি তাঁবু গেড়ে ডায়নামো ফিট করে দেখানো হচ্ছিল ‘টকিজ্’।
সেবার মাকে টকি দেখাতে গো-শকটেই পাড়ি দিয়েছিলাম বেলিয়াবেড়া রাজবাড়ির রাস- টাঁড়ে। টকিজের নাম ছিল ‘বেহুলা-লখিন্দর’।
আমাদের গাড়ি সুবর্ণরেখা নদীর হাঁটুজল অতিক্রম করে গড়ধরা-কাঠুয়াপাল হয়ে রগড়া গ্রামে পৌঁছাল। নদীজলে গাড়ি ডুবে যাওয়া ত দূরঅস্ত্, শুধুই বলদজোড়ার উদরমাত্র কিঞ্চিৎ ডুবেছিল।
গো-শকটের গাড়োয়ান ছিল আমাদেরই ঘরের সংবৎসর ভাত-কাপড়ের ‘ভাতুয়া’ মুর্মু সনাতন। সে ছিল গাড়োয়ানের গাড়োয়ান, রাজা গাড়োয়ান। বলদজোড়ার সঙ্গে তার ছিল ভারি ভাব। সে “হিঁ-ই ব-হঁ” বলে এক অদ্ভুত ভাষায় তাদের সঙ্গে সারা রাস্তায় আলাপ জুড়ত। আর তারাও তার কথা শুনত।
গাড়ি চলত দুলকি চালে। একবার এদিকে গড়ায় তো একবার সেদিকে। গাড়ির ছইয়ের টুঙিতে একটা হেরিকেন বাঁধা ছিল, রাতের অন্ধকারে আলোর জন্য। গাড়ির ঝাঁকুনিতে সেটা দুলত ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো ।
বেলিয়াবেড়া প্রহরাজ রাজবাড়ির রাসটাঁড়ে। ততক্ষণে রাস- টাঁড় জুড়ে চতুর্দিকে হৈ হৈ রৈ রৈ ! কলের গান বাজছে, প্যাঁ পোঁ আওয়াজ করে বাজছে ব্যাঙ-বাজনা । এখনও টকিজ্ শুরুই হয়নি, হব হব । নাকি যন্ত্রচালিত টকিজের ডায়নামো-টাই বিগড়ে গেছে
অযথা শরীরে যাতে পীড়ার উদ্রেক না হয়, তারজন্য গো-শকটের অভ্যন্তরে বেশ পুরু করে শুষ্ক-ধান্য-তৃণ অর্থাৎ খড়ের বিছানা পাতা ছিল । সে-খড় দিয়ে বলদজোড়ার যেমন করে আহারের সংস্থান হচ্ছিল, তেমনি আমাদেরও আরামের ব্যবস্থাপনা ছিল।
খড়ের বিছানায় শুয়ে বসে মা আর আমি ক্রমাগত, ক্রমান্বয়ে দেখে যাচ্ছিলাম – সুবর্ণরেখা নদীতীরবর্তী ‘পালচাষী জনমানুষ’-দের হাতে করা রাস্তার দুধারের ইক্ষু-অড়হরের খেত, বিরি-বাদাম, মুগ-চনার খেত।
কেউ কেউ খেতের বিরিকলাই ইত্যবসরে তুলে এনে খলায়-খামারে ডাঁই করে রেখেছে। আর কেউ কেউ, বিশেষ করে বধূরা, স্তূপীকৃত দানাশস্যের গাদা ভেঙে গুচ্ছ গুচ্ছ নিয়ে মাটিতে আছড়ে পাছড়ে দানা ছড়াচ্ছে। তাদের গায়ে মাথায় ভুর্ ভুর্ করছে বিরিকলাইয়ের ভুষি !
রাঙা-ভাঙা রৌদ্র এসে পড়েছে খলাখামারে। চল্লা, ডুমুর, অর্জুন, পাকুড়ের ডালে, মগ- ডালে ঝিল্ ঝিল্ করছে পীত বর্ণের আলো । তাই দেখে মা উদব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, “সনাতন, বাবু রে ! বেলা যে পড়ে এল ! বেলাবেলি রাসটাঁড়ে পৌঁছাতে হবে যে ! গাড়ি টুকচার হুঁকরে চালা !”
সনাতন মুর্মু তৎক্ষণাৎ তার বলদজোড়ার ল্যাজ মুচড়ে “হু-ট্ হুট্ ! অ বে হিঁ-ই-ই ন ব- হ !!” কী যেন বলে তাদের আদেশ করল। হাজারহোক গো-শকট তো । তবু গাড়ি হুঁকরে ছুটে চলল। আমরা একে একে পশ্চাতে ফেলে এলাম মহাপাল, পেটবিন্ধি, কুচলাদাঁড়ি, কুঁকড়াকুপি, যুগীডিহা গ্রামাদি সব।
অবশেষে পৌঁছানো গেল বেলিয়াবেড়া প্রহরাজ রাজবাড়ির রাসটাঁড়ে। ততক্ষণে রাস- টাঁড় জুড়ে চতুর্দিকে হৈ হৈ রৈ রৈ ! কলের গান বাজছে, প্যাঁ পোঁ আওয়াজ করে বাজছে ব্যাঙ-বাজনা। এখনও টকিজ্ শুরুই হয়নি, হব হব । নাকি যন্ত্রচালিত টকিজের ডায়নামো- টাই বিগড়ে গেছে ! তবে আশার কথা, মেরামতির কাজ চলছে । এই ঠিক হল বলে !
টিকিট কাটার ঝুরকা থেকে হরিদ্রাবর্ণের দুটো টিকিট কেটে আমরা মায়ে-পোয়ে টকি- ঘরের পর্দার একেবারে সামনাসামনি অর্থাৎ পুরোভাগে মাটিতে আসন গেড়ে বসে থাকলাম । যাতে করে টকির টুকিটাকি সবকিছুই চোখের সামনে স্পষ্ট দেখা যায় । সামনে বসলে স্পষ্ট আর দূরে পিছনে বসলে অস্পষ্ট দেখা যাবে — গ্রাম্যলোকেদের, অর্থাৎ আমার মা-কাকিমাদের ধ্যানধারণা এইরকমই।
বেলিয়াবেড়া প্রহরাজ রাজবাড়ি। কী থেকে কী !! কালাপাহাড়ের কলিঙ্গ আক্রমণের কালে জনৈক নিমাইচাঁদ প্রাণভয়ে ভীত হয়ে পালিয়ে এসেছিল উৎকল থেকে মল্লভূমে। দুস্থ নিমাইচাঁদ ঘুরতে ঘুরতে একদিন মল্লভূমের রাজা সংসার মল্লদেবের কাছে এসে হাজির !
সংসার মল্ল দয়াপরবশ হয়ে একদিন তাকে ডেকে এনে খেতে দিলেন। নিমাইচাঁদ রৌদ্রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খেতে লাগল। রাজা বললেন, ‘আরে আরে করছ কী ? রৌদ্রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে না খেয়ে, কোথাও অন্তত ছাতা মাথায় নিজের জায়গায় বসে বসে খাও!’ বলেই তাকে একটা ছাতা দিলেন।
নিমাইচাঁদ তখন কাতর ভাবে বলল, ‘এই ছাতাটা যে কোথাও, কোনও জায়গায় পুঁতে রাখব, সে নিজস্ব জায়গাটুকুও তো আমার নেই ।’ তার কথা বুঝতে পেরে রাজা অতঃপর নিজ গৃহেই তার খাওয়ার বন্দোবস্ত করলেন। খাওয়া শেষে তাকে একটা ঘোড়া দিয়ে বললেন, ‘এই ঘোড়ায় চেপে এক প্রহরের মধ্যে তুমি যতটা ভূখণ্ড ঘুরে আসতে পারবে, ততটা ভূখণ্ডই তোমার নিজের অধিকারে থাকবে।’
একপ্রহরের রাজা। এই তার রাজবাড়ি আর রাসটাঁড়। এত কথা মায়ের মুখ থেকেই শোনা । তবে রাজারাজড়াদের সেই সময়টাও তো আর নেই।
যাহোক, বিলম্ব হলেও ‘টকিজ্’ শুরু হল। পালার নাম ‘বেহুলা লখীন্দর’। আহা ! কী সুন্দর ! কী সুন্দর !! ছবি তো নয়, যেন সবকিছুই জীবন্ত !
ওই, ওই ছিল আমার ও মায়ের প্রথম দেখা ‘টকি’।
প্রথম প্রথম টকি তো ভালোই লাগছিল। দুচোখ ভরে দেখছিলাম সবকিছুই। মাঝেমাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলাম মাকেও। তার চোখও যে আঠার মতো সেঁটে আছে ছবির পর্দায় !
হঠাৎ আরম্ভ হল উৎপাত ! উৎপাত বলে উৎপাত, মহোৎপাত !! কোথা থেকে যে পর্দায় এত সাপ এসে আছড়ে পড়ল ! “ দূরে চল বেহুলা তুমি না কর উৎপাত । ” -সাপ ! সাপ !! কিলবিল করে ‘দন্তবিষো’ বিষধর সাপগুলো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল !
আচমকা মা উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার জুড়ে দিল, “বাবু রে ! অ্যাই ! অ্যাই !! ওই ! ওই !! ওই তো আসছে হলহলিয়ে ! এই তো একটা ওদিকে গেল! ওই তো একটা এদিকে এল—
“ বাবু রে ! চ, পালাই ! চ, চ !! আর একমুহূর্তও এখানে নয়, এখানে নয় ! কখন এসে হিস্ হিস্ করে দংশে দেবে দণ্ডবিষো !” বলতে বলতে মা তো হাত-পা ছুঁড়তে লাগল।
যতই বলি, “ও কিছু নয় মা। সত্যিকারের সাপ কী আর ? সবই তো ছবির সাপ। নকল, নকল।” মায়ের মোটেও বিশ্বাস হল না। সমানে ভয়ার্ত ও ভয়ানক চিৎকার করে যাচ্ছিল। করেই যাচ্ছিল। তাই দেখে হলভর্তি লোকজন আমাদের উপর যার পর নেই বিরক্ত হচ্ছিল।
‘বেহুলা লখীন্দর’ টকি সবে শুরু হয়েছিল । সাঙ্গ হওয়া তো দূরঅস্ত্, গোড়ার দিকেই আমরা হল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠল, “ যাক বাবা ! বাঁচা গেল !”
পরিবর্তে আমরা ‘ভোজরাজা ও ভাণুমতীর খেলা’ দেখলাম । সেও তো নানাবিধের গ্যাঁড়াকল! ‘ডিম্বের নৃত্য’ ‘বাক্সমধ্যে একটী নর্ত্তক্য প্রবেশ করাইয়া দিয়া তৎপরিবর্ত্তে কয়েকটী রাজহংস বাহিরকরণ’ ‘মস্তকছেদন’ –
এক ঘন্টার মধ্যে তুলসীবৃক্ষ উৎপাদন’ ‘মৃত মৎস্যকে পুনর্জীবিত করিবার উপায়’ ‘ডিম্ব হইতে জীবিত পক্ষী বাহির করা’ ‘দর্শকদের পকেট হইতে ডিম্ব বাহির করা’ –
‘ শূন্যে শুইয়া থাকিবার কৌশল’ ‘দর্শকদের সামনে তাস উড়াইবার কৌশল’ ‘টাকার নৃত্য’ ‘দর্শকদের সামনে এক গ্লাস জল উড়াইয়া দিবার কৌশল ’ –
‘ভোজরাজা ও ভাণুমতীর খেলা’– ঘরের দরজায় একজন লোক জোকার সেজে হ্যান্ড- বিল বিলি করছিল। তাতে এ সমস্তই লেখা ছিল।
মা তবু বলল, “আচ্ছা, দেখা যাক । ” আমরা এখানে গৈরিক বর্ণের টিকিট কেটে ‘ভোজরাজা ও ভাণুমতীর খেলা’– ঘরে প্রবেশ করলাম ।
কিন্তু শুরু হতে না হতেই সে এক বিপত্তি। ‘মস্তকছেদন’। ঘোরতর আপত্তি জানিয়ে মা উঠে দাঁড়াল । বলল, “বাবু রে ! ঘর চ ! এসব কাটাছেঁড়া আর দেখতে পারছি না !”
মাকে ফের বুঝালাম, “এসব কি আর সত্যি মা ! সবই তো ভোজবাজি, হাতের কারসাজি । না হলে হরতনের বিবিকে নিমেষমধ্যে রুহিতনের বিবি করে কীভাবে? মা বুঝল না ।
এপর্যন্ত তাও না হয় মানা গেল। কিন্তু গো-শকটের নিকটবর্তী হয়ে সনাতন মুর্মুকে তলব করে মা যখন নির্দেশ দিল, “সনা মনা, বাবু রে ! গাড়ির সব খড় এক্ষুনি ফেলে দে ! এতগুলো সাপের ভিতর দু-একটা তো এখানেও আসতে পারে ? পারে না ?
ভাতুয়া সনাতন তক্ষুনি তার আদরের বলদজোড়ার জন্য আঁটি কতক খড় আলাদা করে রেখে দিয়ে বাকি সমস্ত খড়ই ‘গিরিহানী’-র আদেশ মোতাবেক রাসটাঁড়েই ফেলে দিল।
তারপর থেকে খড়বিহীন বিছানায় শুয়ে বসে গো-শকটে প্রায় সারারাত্রি ধরে কম করেও চল্লিশ-পঞ্চাশ ক্রোশ চড়াই-উৎরাইয়ের পথ পেরিয়ে আসা -সে কি কম কষ্টকর? ছইয়ের টুঙিতে ঝুলন্ত হেরিকেনটা গল গল ধোঁয়া উগরে জ্বলছিল ত জ্বলছিল, দুলছিল ত দুলছিল।
খড়হীন খালি গাড়িতে এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি খাচ্ছিল মা । অতবড় দুঃসহ রাতে দু- চোখের পাতা নিমেষের জন্যও এক করতে পারেনি মা । আমিও কখনো সনাতনের সঙ্গে ক-দণ্ড বকর বকর, মায়ের সঙ্গে মাঝেমাঝে এটা ওটা গল্প করে নিদ্রাহীন ও কষ্টকর একটা রাত কোনও ক্রমে কাটিয়ে যাচ্ছি –
গো-শকটের ছইয়ের ভিতরে কখনও কখনও একরাশ তারাসহ ‘মেঘপাতাল’ অর্থাৎ একফালি আকাশ ঢুকে আসছিল । তাই দেখে মা আমাকে তারা চেনাচ্ছিল -উত্তরা, মঘা, ফাল্গুনী, ভরণী, কৃত্তিকা –
কোনটা ধ্রুবতারা, কোনটা কালপুরুষা, কোনটা দধিভারিয়া, কোনটা সাতভায়া, কোন দুটো তারাই বা রাবণের সিং-দুয়ারের তারা, কোনটা ‘ইপিল’ বা ভোর-পোহাতি তারা–
পরের দিন প্রভাতে গো-শকট যখন গ্রামে, আমাদের গৃহে উপনীত হল, তখন গাড়ি থেকে অবতরণের ইচ্ছাটাই মরে গিয়েছিল আমার । শরীরময় পীড়া দিচ্ছিল। ওদিকে মায়ের তো ধূম জ্বর। গাড়ি থেকে নেমেই শয্যাশায়ী।
♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦
ক্রমশ..
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১
নতুন ধারাবাহিক উপন্যাস : ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়
❤ Support Us