- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৫
ধারাবাহিক উপন্যাস। ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৪

১০
এতক্ষণে মনে পড়ল একটা অদৃশ্য শিকল, যাকে বলে ঝিঁজরি, আমার পায়ের বুড়ো আঙুলে বেঁধে অদৃশ্য লোকগুলোই আমাকে টেনে এনেছে সুবর্ণরেখা নদীর মশানির দহের জলতলে, জলের গভীরে ।
জলতল ছেড়ে তারপরে এই ডাঙায়, ডাঙা-ডুঙোড় ভূ-ভাগে । কতকটা চেনা, কতকটা অচেনা ভূখণ্ডে । পুরুষের যেমন পূর্বপুরুষ, তেমনি এ ভূ-ভাগও যেন আমাদের রামেশ্বর ডাঙা, পাড়িয়ার বিল, মহিষাসুর দঁক, গোঠটাঁড়ের মাঠেরই পূর্বপুরুষ ।
সামান্য হৃষ্টপুষ্ট, চৌদ্দ পুরুষকে পরপর দাঁড় করালেই তফাৎটা যেন স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে ওঠে । কাকগুলো যেন বড়বেশি কালো, পারাবতগুলোও ঈষৎ স্থূলকায়া, চড়ৈ-চটিও বেশ পুচ্ছওয়ালা ।
গো-শকটের এক্কায় থাকাকালীন পায়ের ঝিঁজরির উপস্থিতি ততটা টেরই পাইনি । এখন টান পড়ল । সে-ই অদৃশ্য হাত যেন আবার টানতে শুরু করেছে । টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই পোড়োবাড়িটার দিকে ।
মশানির দহের জলের ঝাঁজি বা শ্যাওলা এখনও যেন লটকে আছে পায়ে ! মা-কাকিমারা, দাদু-ঠাকুমারা নিছকই ভয় দেখানোর জন্য হয়তো বলেছিলেন, “যাস না, ওরে যাস না, মশানির দহের জলে অত ঝাঁপাঝাঁপি করিস না রে ! একবার যদি জলের ঝাঁজি পায়ে আটকায়, নিশুতি রাতে লোহার ঝিঁজরি হয়ে তোকে টেনে নিয়ে যাবে একেবারে জলের তলায় । “
আর তাই কিনা, হবি তো হ, সত্যি হয়ে গেল আমার বেলায় ! ঝিঁজরি বেঁধে কেউ না কেউ টানছে, স্পষ্ট টের পাচ্ছি । অথচ ধারেকাছে কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না ।
শূধুই পোড়ো বাড়িটা । নাকি ওদন্তপুরী-নালন্দার মতো ধ্বংসপ্রাপ্ত কোন মহাবিহার মহাগ্রন্থাগার মহাসঙ্ঘারাম?
বলা হয়, বখতিয়ার খিলজি নাকি সব ধ্বংস করে দিয়েছিলেন । আবার কেউ বলেন শশাঙ্ক । তবে য়ুয়ান্-চোয়াঙ বলেছিলেন, বৌদ্ধবৈরী শশাঙ্ক বোধিদ্রুম কর্তন করেছেন । নালন্দা ধ্বংস করেননি । কেননা তারপরেও নালন্দা অটুট ছিল ।
আসলে এর মূলে হয়তো সেই মহাযান ও হীনযানদের দ্বন্দ্ব । রাঢ় তথা আমাদের এতদ্ অঞ্চলে জৈন ও বৌদ্ধ আজীবক, শ্রমণরা ধর্ম প্রচারের হেতু একদা ঘুরে বেড়াতেন । তবে তাঁদের প্রচারিত ধর্মে এখানকার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার তেমন কিছু হেরফের ঘটেনি । বরং উল্টোটাই হয়েছে ।
এ কারণে তাঁদের স্বীয় ধর্মে এসেছিল শৈথিল্য । মহাযান তো মহাযান, হীনযানদের মধ্যে তন্ত্রমন্ত্র যাদুবিদ্যা ডাকিনিবিদ্যা ঝাড়ফুঁক পিশাচসাধনা, হেন-তেন আরও অনেককিছু ঢুকে পড়েছিল । নাথ, যুগীদের আবির্ভাব ঘটল । সৃষ্টি হল মন্ত্রযানী বজ্রযানী কালচক্রযানীদের ।
বলা বাহুল্য, সুদূর ওড়িষা থেকে তাম্রলিপ্ত অবধি বিস্তৃত বৌদ্ধবিহার ও সঙ্ঘারামে কালচক্রযানীদেরই আধিক্য । কালচক্রযানী সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে মীননাথ, শবরীপাদ তো এতদ্ অঞ্চলেরই মানুষ । কেউ ছিলেন ধীবর, কেউ বা শবর ।
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র নাকি কাঁথি অঞ্চলে এহেন কাপালিকদেরই দর্শন পেয়েছিলেন । তাঁদেরই জনৈক কাপালিক পরোপকারী নবকুমারকে, যিনি কিনা পরের জন্য কাষ্ঠাদি আহরণে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তাঁকে বধার্থে অপহরণ করেছিলেন ।
কোন্ ছেলেবেলা থেকেই তো শুনে আসছি ‘অঁড়গা-ধরা’ অর্থাৎ ছেলেধরা তথা কাপালিকরা তন্ত্রসিদ্ধির জন্য নরবলি দেন । পুকুর-পুষ্করিণী খোঁড়া হয়েছে, জল আসছে না । চল্লিশ ফুট কুয়ো খোঁড়া হল, জল উঠছে না । মজবুত করে বাঁধ তৈরি হল, তবু পুনঃপুনঃ ভেঙে যাচ্ছে । তন্ত্রসাধক সিদ্ধাই বললেন, “ নরবলি চাই ! “
এইভাবে কত যে নরবলি দেওয়া হত ! মীননাথ, শবরীপাদের মতোই অনেক ধীবর, শবর, ডোম্বী, চণ্ডালী, রজকিনীরা সেযুগে সিদ্ধাই ছিলেন । তাঁরা তুক-গুণ ঝাড়-ফুঁক তন্ত্র-মন্ত্র জানতেন ।
কেন, ‘বেহুলা-লখীন্দর’ পালায় নেতা ধোপানী কী কম বড় সিদ্ধাই বা কাপালিক ছিলেন? এক থাপ্পড়ে নিজের ছেলেকে মেরে ফেলে ফের বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন । অধিকন্তু বেহুলাকে হদিস দিয়েছিলেন স্বর্গের ।
আমাদের ঘরের ধারেই পিতলকাঁঠি গ্রাম । সেখানকার বড়ামচণ্ডীর থানের সিদ্ধাই বা দেয়াশীরা লোধাশবর । শুধু কি পিতলকাঁঠি, গুপ্তমণি থানের সিদ্ধাইও তো লোধাশবর ! নরবলি না হোক, পিতলকাঁঠিতে বড়ামচণ্ডীর পুজোয় এখনও তো মহিষ বলি হয় । হয় না?
তবে কি এই পোড়ো বাড়িটা হীনযানী বজ্রযানী কালচক্রযানী সিদ্ধাই কী কাপালিকদের আখড়া বা আবাসস্থল? ডাকিনীবিদ্যা জাদুবিদ্যার চর্চা হয় এখানে? বলিদানের ‘অর্গলা’ বা হাড়িকাঠ আছে ?
আমার মা-কাকিমারা কেন, তামাম তল্লাটই তো জানে, মশানির দহে ‘অর্গলা ভূত’ আছে ! জলের তলায় অর্গলা ভূতের ‘অর্গলা’ অর্থাৎ হাড়িকাঠ আছে । ঝিঁজরি বেঁধে ধরে আনা মানুষকে হাড়িকাঠে ফেলে বলি দেওয়া হয় ।
মৃত নালন্দা ওদন্তপুরীর ধ্বংসস্তূপের মতো অত বৃহদাকার না হোক, তবু তো আচিরে-প্রাচীরে এটাও কম বৃহৎ নয় । তবে কি এখানকার আবাসিকরাই ‘অর্গলা ভূত’-এর হাড়িকাঠের বলিদার? বলিদানের উদ্দেশ্যেই কি অপহরণ করা হয়েছে আমাকে?
পরক্ষণেই মনে হল, ধুত্ ! এসব কী ভাবছি! আজকাল না হোক সেকালে, যাঁরা অত সুন্দর সুন্দর পদ লিখেছেন, বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে কত পদ মুখস্ত করেছি –
“ভব নই গহন
গম্ভীর বেগে বাঁহি
দু আন্তে চিথিল
মাঝে ন থাঁয়ি । । “
কিংবা, ওই যে –
“ উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসয়ি সবরীবালী –“
তাঁরাও আবার কাপালিক? তাঁরাও আবার বলিদার? এ হতে পারে না । বুকে-মনে জোর এনে ধীরে ধীরে এগোচ্ছি । যদিও ঝিঁজরির টান ততটা প্রবল ছিল না ।
না থাকারই কথা । কেননা, তাঁরা তো বুঝেই গিয়েছেন, পাখি আটকা পড়েছে খাঁচায় । পালানোর আর কোনও পথ নেই ।
আমাদের গ্রামের প্রতাপ রাণাও এমনটা করে । বনডাহির ধারে কুরথি কলাইয়ের খেতির আড়ালে ফাঁদ পেতে গুঁড়ুর বা গুড়গুড়ি পাখি ধরে । খাঁচার পাখিটা খাঁচার ভিতরে থেকে আপন খেয়ালে ডাকতেই থাকে, ডাকতেই থাকে –
-গু-ড়্-ড়্-ড়্-ড়্-ড়্-ড়্ –
বনের পাখিটাও এক পা দু পা করে আসতে থাকে – আসতে থাকে –
খাঁচার দরজা খোলা । খোলাই থাকে । খাঁচার দরজা স্প্রিংয়ে ভর করে মাটিতে পোঁতা । ঘরের পাখি যেমনকার তেমনই বন্দী থাকে খাঁচায় । ঘর-বাহির করে । এক পা-দু পা-তিন পা-চার পা –
অতঃপর বনের পাখি খাঁচার দরজায় পা রাখা মাত্রই দরজা উঠে যায় ঝপাং করে ! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বনের পাখি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে ।
প্রতাপ কিন্তু ধীরস্থির থাকে । বিচলিত হয় না এতটুকুও পাখি ধরার জন্য । তার পরিবর্তে সে কুরথি কলাইয়ের খেতির উপর বসে থেকে দাঁতে ঘাস কুটে । কী কুরথির দানা চিবোয় । কুরথি খেতিতে কাজ করা লোকেদের সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যায় । কারণ, সে তো জানেই পাখি আটকা পড়েছে খাঁচায় ।
আমারও পালাবার পথ নেই । পথ নেই, পথ নেই ।
অথচ একটা সাদামাটা আর পাঁচটা গঞ্জের মতোই গঞ্জ । গাছপালা আছে, পাখ-পাখালি আছে । ওই, ওই তো ঝাঁকের পারাবতগুলি উড়ে ঘুরে ফিরে আসছে আবার ! এই এই, পোড়ো বাড়িটার ছাদে বসল বসল করেও বসল না !
কোথাও কোনও কাঁটাতার নেই । প্রহরায় বন্দুক হাতে মুখোশধারী কোনও দুষ্কৃতী নেই । দৃশ্যত বন্ধনকারী ঝিঁজরিও নেই । তবু, তবু ।
ঝেড়ে ফেলার ভঙ্গিতে দু পা তুলে কাণ্ডজ্ঞানহীন তালজ্ঞানহীন প্রায় নৃত্যই শুরু করলাম । তা থৈ তা থৈ । তা তা থৈ তা তা থৈ –
এ নৃত্য কেউ দেখছে কী দেখছে না, জানি না । নৃত্য তো জানিও না ! ওই বড়জোর স্কুলে এ. সি. সি ক্যাডার হিসাবে “সা-ব-ধা-ন” “বি-শ্রা-ম” “ক-দ- ম তো-ড়” – ।
কিন্তু ভবী ভোলবার নয় । সেই অদৃশ্য ঝিঁজরির টান । টানছে তো টানছেই, নিশির ডাকের মতো । বলিপ্রদত্ত আমিও যেন এগিয়ে চলেছি । ভূতে ধরা আর কাকে বলে?
ওই, ওই । ওই তো হাট করে খুলে গেল ভগ্নস্তূপ, কী পোড়োবাড়ি, কী মৃত বৌদ্ধ সংঘারামের সিং-দরোজা ।
১১
গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা মাত্রই কে যেন মৃদুস্বরে বলে উঠল, “ পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?”
কে? কে বলল একথা? কন্ঠস্বর ভারি পরিচিত বোধ হচ্ছিল । তবে কি পরিত্যক্ত ভগ্নস্তূপ তথা পোড়োবাড়ি বা সংঘারাম জনমানবশূন্য নয়?
কই? চারদিকে খুব তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কাউকেই দেখতে পেলাম না? তবে কী কন্ঠস্বর কুহেলিকা ‘মায়ামাত্র’ ?
একেকটা মুহূর্ত আসে । আসেই, যখন বোধশক্তি সম্পূর্ণ রহিত হয়ে যায় । চারপাশে জুল্ জুল্ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তখন আর কিছু করার থাকে না । আমার এখনকার অবস্থা যেন তদ্রূপ, তথৈবচ ।
পরক্ষণেই মনে পড়ল, আরে এ তো বঙ্কিমচন্দ্র বিরচিত ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের নারীচরিত্র ‘কপালকুণ্ডলা’-র কন্ঠস্বর ! ভ্রম, অলীক স্বপ্নমাত্র ! তবু যাহোক নবকুমারের কপালকুণ্ডলা ছিল ।
ছিল, ছিল । “ মামনুসর “ বলে সেই যে তান্ত্রিক কাপালিক নবকুমারকে বধার্থে কুটিরমধ্যে আটকে রেখেছিলেন, কপালকুণ্ডলা না থাকলে কে তাঁকে খড়্গাঘাত থেকে বাঁচাতেন?
কপালকুণ্ডলার সঙ্গে নবকুমারের প্রেম-পরিণয়ও হয়েছিল । উপন্যাস তো এরকমই বলে ! আমার কোনও কপালকুণ্ডলা নেই, প্রেম-পরিণয় তো দূরঅস্ত্ ।
তবে এক-আধটুকু ভালবাসা-বাসি হয়েছিল বৈকি, যখন থ্রি-ফোরে পড়ি । কার যেন একটা এইরকমই হুবহু কবিতা পড়েছিলাম –
আমাদের ফ্রি প্রাইমারি মরি মরি কীরূপ ধরেছে হেরি
দেয়ালে এখনও লেখা – “নলিনী + কুসুমকুমারী”
এখানে ওখানে কালি হাতে মসি মুখে মসি
বাছা তুই পড়ে এলি – কুণ্ডুদের অলি-মলি
ছেঁড়া বই জীর্ণ রাফখাতা করবলী গাছের পাতা
ভাঙা উড্ পেনসিলের সীস্ – অঙ্কে একশোয় উনিশ
মহামতি লম্বোদর গিরি এখনও করেন ‘টিচারি’
লালমোহন সিং – শান্তবালাকে খায় ‘কিস্ ‘
বলে কীনা “ আমি শুক তুই শারী তোদের আজ কী তরকারি
আমাদের শুশনি পাতা “ – সারি সারি ছেঁড়া ছাতা
ছোট ছোট খোকা খুকু ভয়ে প্রাণ ধুকু ধুকু
তবু সাজিয়া গুজিয়া – জিলিপি বোঁদে নিদেন ‘গুজিয়া’
রোল কলের সময় এখনও বলতেই হয়
“জয়হিন্দ” “স্বাধীন ভারত” – রামচিমটি নতুবা নাকখত্
স্ট্যান্ড আপ অন দী বেঞ্চ নীলডাউন হাঁটুর তলায় খেঁচ্
পনেরই আগস্ট – নিমপাতা আমসার রঙিন কাগজ
“অ-য়ের পিছনে আঁকড়ি খুইয়েছিস সোনার মাকড়ি
ঘরে চল আজ তোর হবে “ – ধরেছে কদমকুঁড়ি সবে
আমাদের ফ্রি প্রাইমারি মরি মরি কীরূপ ধরেছে হেরি
দেয়ালে এখনও লেখা – “ ভোট + আদমসুমারি “
কিন্তু সে-কবিতায় “ নলিনী + কুসুমকুমারী “ কী আর ছিল? ছিল না, ছিল না । ছেলের নাম ও মেয়ের দাম – অন্য কিছু ছিল । আমি তার উপর বেলের আঠা লাগিয়ে পরিষ্কার কাগজ সেঁটে কালি দিয়ে মুক্তাক্ষরে লিখে রেখেছিলাম – “ নলিনী + কুসুমকুমারী “
কুসুমকুমারী বাগালদের মেয়ে । “ নলিনী + কুসুমকুমারী “ – এই ফর্মুলা অত কী আর বুঝত ! প্রেমট্রেম নয়, সে ভালবাসত ‘গুটি’ খেলতে । গুটি অর্থাৎ নুড়ি – সেই যে এ-হাতে সে-হাতে নুড়ি নিয়ে লোফালুফি খেলা – “এ-ক-ম দু-ক-ম টিলিঙ ঠয়া” –
তারপর তো তার বিয়ে হয়ে গেল বেশ ঘটা করে সেই কোন্ নাবালক বয়সে দূর দেশে ওড়িশা মুলুকে ! সে আর এখানে কোথায় যে পরিত্রাতার ভূমিকায় সহসা অবতীর্ণ হয়ে কর্ণকুহরে মৃদুস্বরে শোনাবে – “ পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ? “
হয়তো বা সে এখন তার রসুঁইশালে জুরুথুবু হয়ে বসে মাটির ‘ত্যালান’-এ কুরথির ডালে শুকনা লঙ্কার ফোড়ন দিয়ে মনে আনছে, মনে আনছে – “সোউ যে নলিন নামর গুট্যে ছুয়া থিলা, সে মোর বইঅর পাতায় পাতায় কাগজ সাঁটি কিছি লিখি থিলা – ই গো কিছি কি, গুট্যে হেঁয়ালি – “ নলিনী + কুসুমকুমারী “ –
হয়তো বাকি জীবনটা সে এই হেঁয়ালির ‘মানতি’ খুঁজে যাবে, সে কি আর এখানে এসে এই পোড়োবাড়ি থেকে বহির্গমনের বা পলায়নের পথ জানিয়ে দেবে?
যেমনটা করেছিলেন কপালকুণ্ডলা –
“ কোথা যাইতেছ? যাইও না ।
ফিরিয়া যাও – পলায়ন কর । “
তদুপরি, কাপালিক যখন নবকুমারকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে সমুদ্রবালিতে ফেলে রেখে নরবলির জন্য পূজায় ব্যাপৃত হলেন, পূজাশেষে বলিদানের খড়্গের সন্ধানে দূরস্থানে গমন করলেন, তখন যেমন কপালকুণ্ডলা অভয় দিয়ে নব- কুমারকে শুনিয়েছিলেন –
“ চুপ ! কথা কহিও না –
খড়্গ আমারই কাছে – চুরি
করিয়া রাখিয়াছি -“
অধিকন্তু নবকুমারের হাত-পায়ের বাঁধন খড়্গ দিয়েই ছেদন করে তাঁকে মুক্তির পথ দেখিয়ে বলেছিলেন –
“ পলায়ন কর ; আমার পশ্চাতে
আইস, পথ দেখাইয়া দিতেছি -“
তেমনটা কি আর পারবে? পারবে কুসুমকুমারী? আমার এই পায়ের ঝিঁজরি কেটে আমাকে এই কারাগার থেকে, এই ‘অর্গলা’ থেকে মুক্তি দিতে?
সাধ্য কী কুসুমকুমারী তা পারে ! এক্ষণে কোথায় কুসুমকুমারী আর কোথায় বা আমি? হায় কুসুমকুমারী ! হায় “ নলিনী + কুসুমকুমারী “ !!
এখনও যে পায়ের ঝিঁজরি টেনেই যাচ্ছে! টেনেই যাচ্ছে, টেনেই যাচ্ছে। এ কি গৃহ? না, গুহা?
গৃহই । ওই তো – সারি সারি ‘ঝুরকা’ । যাকে বলে গবাক্ষ । গবাক্ষ-দণ্ডের ফাঁক-ফোকর দিয়ে মধ্যাহ্ন-সূর্যের রৌদ্র এসে পড়েছে ইতস্তত । আলো যেন বরফি কাটছে । চক্রা-বক্রা ।
আলো-ছায়া তো নয়, ‘আলো-ছাঁয়রা’ । আলো বাতাস । আহ্ ! এই তো জীবন ! গবাক্ষদণ্ডের ফাঁকফোকর দিয়ে মৃদুমন্দ হাওয়া আসছে ।
হাওয়াই তো । ঝুরকার পার্শ্বস্থিত দেয়ালগাত্রে ঊর্ণনাভ যে তন্তুজাল বয়ন ও বিস্তার করেছে – তা যেন ওই হাওয়াতেই দোদুল্যমান । দুল দুল দুলছে । দুলছে, কিন্তু ছিঁড়ে পড়ছে না ।
একটার পর একটা ঝুরকা । তারমানে, একেকটা ঝুরকাবিশিষ্ট কক্ষ বা প্রকোষ্ঠ । একদা কারা ছিলেন এইসমস্ত প্রকোষ্ঠে, এক্ষণে কারাই বা এখানে বাস করেন -কই, কাউকেই তো স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি না?উ
গিনতি শুরু করেছিলাম – রামে রাম, দুই-তিন-চার-পাঁচ-ছয়-সাত – আচমকা গুলিয়ে গেল । কোত্থেকে একঝাঁক চামচিকে না তার বাদুড় ঝটাপটি করে উড়ে এসে সবকিছুকেই ঘুলিয়ে দিয়ে ভদভদিয়ে বেরিয়ে গেল ।
মনে হল, কে যেন পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের খবরদারি করে তাড়িয়ে দিচ্ছে – “ হে-ই হু-স্ হু-স্ হু-স্ –“
– কে? কে? কে?
১২
কই? কেউ তো নেই ।
ঝুরকার বাহিরে দৃশ্যমান – ওই, ওই তো – জল ছিল্ ছিল্ পুষ্করিণী । চারধারে তার কেয়া বনঝাড় । এমন, এমনতরো পুকুর-পুষ্করিণী তো আমাদের তল্লাটে হামেশাই দেখা যায় ! উদাহরণ স্বরূপ –
চিনিবাসের গাড়িয়া । চিনিবাস তো নয়, ভালো নাম শ্রীনিবাস । বড়োডাঙা গ্রামের দঁড়পাট মহাজনদের ‘গড়িয়া’ । সেই বলে না – “গড়িয়া আড়িরে শ্বেত মান্দার “ । অর্থাৎ পুকুরপাড়ে শ্বেত মান্দারগাছ –
রামেশ্বর ডাঙার ‘কুঁড়পুকুর’ বা কুণ্ডুপুকুর । কুঁড়পুকূরের পাড়ে গাজনের সময় ‘বারুণী’-র মেলা বসে । শশা কাঁকুড় তরমুজ শাঁকআলু ঢেলে বিক্রি হয় । শাঁকআলু তো নয়, কেশর আলু । বোলতার পেটের মতো নাকে নোলক পরা চাষীদের মেয়ে সারারাত ধরে কেশর বেচে ক্লান্ত হয়ে একসময় কেশর আলুর গাদাতেই ঘুমে ঢলে পড়ে ।
যেমনটা, “ সেথা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে । “ চৈত্র- সংক্রান্তির শেষ রাতে যখন চেলা-চামুণ্ডা-পাণ্ডা পরিবৃত হয়ে প্রধান পুরোহিত ‘গয়লা-ভার-কাঁধে’ সুবর্ণরেখার জলে তার সামান্য পিতলের ঘটিদুটি ভরাতে যান, বা ঘটিদুটি জলে ভরতি করে ভার-কাঁধে অতিশয় ভারে ন্যুব্জ হয়ে থাপুস থুপুস করে হেঁটে আসেন, তখনও তার ঘুম ভাঙে না ।
ঘুম ভাঙে না । ঘুম ভাঙে না ।
জলে শির্ শিরানি ওঠে । নদীজলে কী পুষ্করিণীর জলে । কাক-চিল খুব কাছ দিয়ে উড়ে গেলে একরকম, শিকারি জেলের ছায়া পড়লে একরকম, নদীর কাতাধারে, কি পুষ্করিণীর পাড়ে ঝুর ঝুর বালি ঝরে পড়লে একরকম ।
চরতে বেরিয়ে ঝাঁক-বাঁধা-মাছ জলে বিলি কেটে কেটে এগোচ্ছে, অনুকূলে নয় প্রতিকূলে, এগোচ্ছে তো এগোচ্ছে । হঠাৎ কেমন চাক ভেঙে ছিন্ ছাতুর ! ভয়ার্ত জলচরগুলো মুহূর্তেই হাওয়া !
আর তাতেই জলে শিরশিরানি ওঠে । জলের শিরা-উপশিরা দেখা যায় । কুঞ্চন অকুঞ্চনে জলসিঁড়ি তৈরি হয় । এমনটা হামেশাই ঘটে ।
কাক-চিল জালুয়া-মালুয়া বালি ঝরঝরানি থাকলেও হয়, না থাকলেও হয় । ওই, ওই তো গবাক্ষের বাহিরে পুষ্করিণীর জলে বাও নেই, বাতাস নেই আচমকা জল-শিরশিরানি, জলসিঁড়ি তৈরি হল ।
গবাক্ষের পর গবাক্ষ । পেরিয়ে যাচ্ছি একের পর এক । ঝপাং করে কেউ যেন ঝাঁপ দিল পুষ্করিণীর জলে ! চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ রাখলাম গবাক্ষে ।
-কই, কেউ তো নেই !
অথচ পুষ্করিণীতে পরিষ্কার আলোড়ন উঠেছে । জল আলোড়িত হতে হতে জলাশয়ের কিনারায় পৌঁছে যাচ্ছে ।
আর আমরা তো জানিই, “ একটি স্থির জলাশয়ে যদি ঢিল ফেলা যায় তবে ঢিল যেখানে জলস্পর্শ করে সেখানে একটি আলোড়নের সৃষ্টি হয়, কিন্তু আলোড়ন ওই জায়গাতে আবদ্ধ থাকে না, ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে এবং কালক্রমে
সমস্ত জলাশয়েই আলোড়ন বিস্তৃত হয়ে যায় । “
পদার্থবিজ্ঞানে একেই তো বলে ‘তরঙ্গ । জলসিঁড়ি ধানসিঁড়িও তো এভাবেই রচিত হয় । “ আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে –“
ধানসিঁড়ি নদী না হোক, ধানখেত । ধানের খেতেও হাওয়া দোলা দিলে এমনিতরো তরঙ্গের অভিঘাত তৈরি হয় । পাকা ধানের শীষগুলো কেমন দোল তুলে ধাপে ধাপে ধানসিঁড়ি রচনা করে । অথচ ধানগাছগুলো কোথাও একেবারে চলে যায় না । স্থির অবস্থানকে মধ্যে রেখে শুধু উপর-নিচ পর্যায় গতিতে দুলতে থাকে ।
দুলতে থাকে, দুলতে থাকে ।
আর এভাবেই কখন যে কী করে ভাবের ঘোরে তৈরি হয়ে যায় ধানসিঁড়ি জলসিঁড়ি !
কতবার যে হাতেনাতে প্রমাণ করেছি – কোনও তরঙ্গবাহী সুতোর x বিন্দুতে ‘নতি’, ওইবিন্দুতে কণার গতিবেগ ও তরঙ্গবেগের অনুপাতের সমান । অঙ্ক করেছি – ‘ পজিটিভ x-অভিমুখে গতিশীল একটি সরল দোলগতির তরঙ্গের বিস্তার ৫ সিএম, গতিবেগ ৪০সিএম/এস এবং কম্পাঙ্ক ৬০ ; মূলবিন্দু থেকে ৪০ সিএম দূরবর্তী একটি কণার টি=২এস সময়ে সরণ, গতিবেগ এবং ত্বরণ নির্ণয় কর ।’
সে যাহোক, জলাশয়ে এতবড় তরঙ্গ তোলা বস্তুটি তরঙ্গ তুলেই কোথায় বা অদৃশ্য হল ! তবে সে কী ডুব-সাঁতারে আছে? ডুব-সাঁতার, চিৎ-সাঁতার, ব্রেস্ট স্ট্রোক, ফ্রি স্টাইল, বাটার ফ্লাই, ব্যাক স্ট্রোক –
ডুব-সাঁতার – এই ডুব মারলো তো, ঘড়ির সেকেণ্ডের কাঁটা ঘুরেই চলেছে ঘুরেই চলেছে, ঘুরেই চলেছে, জলের তলায় নাক টিপে দম আটকে আর কতক্ষণ বা থাকা যায় – ওই, ওই ভুস্ করে খইচালার মতো ভেসে উঠল কালো মাথা!
আমিও উৎকন্ঠায় অধীর আগ্রহে তরঙ্গায়িত জলাশয়ের জলবিজকুড়ির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি, তাকিয়ে আছি –
সাঁতারু যেদিকে যায় তার যাত্রা বরাবর জলের উপরিতলে গুঁড়ি গুঁড়ি বুদ্বুদের কণা, জলবিজকুড়ি ভেসে ওঠে । তেমন কিছু কি ভেসে উঠছে?
-কই, না তো !
অবশ্য চোখ খুলে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখার উপায়ন্তর কি আর আছে? মশানির দহের ‘অর্গলা ভূত’- এর অদৃশ্য পায়ের ঝিঁজরি তো অনবরত টেনে নিচ্ছে আমাকে ।
লোকে বলে, “ পায়ের তলায় সর্ষে “ । তারমানে ভ্রমণের চাকা ঘুরছে তো ঘুরছেই । সর্ষেদানার আকার-অবয়ব যে গোলাকার ! সমতল মাটিতে পড়লে সে আর থামতে জানে না, গড়াতে থাকে, গড়াতেই থাকে । তার উপর পা পড়লে যার পা সেও তো গড়াবেই –
আমার অবস্থাও, বলা বাহুল্যই, তদ্রূপ । পায়ের তলায় সর্ষে না থাক, লোহার ‘জিঞ্জলি’ । তাও আবার দৃশ্য নয়, অদৃশ্য । অদৃশ্য ঝিঁজরির টানেই কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে –
পরিত্যক্ত পোড়ো বৌদ্ধ সংঘারামই ধরব । সেই কোন্ থ্রি-ফোর থেকেই তো পড়ে আসছি ইতিহাসে – ‘ গৌতমবুদ্ধ কে ছিলেন? গৌতমবুদ্ধের প্রচারিত ধর্মের নাম কী? নালন্দা ও তক্ষশীলা কী জন্য বিখ্যাত? ‘
শুধু কি তক্ষশীলা নালন্দা? কর্ণসুবর্ণ রঙ্গভিত্তি সংঘারাম, তাম্রলিপ্ত সংঘারাম, জগদ্দল বিহার, পুন্ড্রবর্ধন বিহার, বরাহ বিহার, বিক্রমপুরী বিহার, শীলবর্ষ বিহার, সোমপুরী বিহার, ত্রৈকূটক বিহার, দেবীকোট বিহার, আরও যে কত !
শীলভদ্র, অতীশ দীপঙ্কর, আচার্য অদ্বয়বজ্র, উধিলিপা, ভিক্ষুনী মেখলা, বন-রত্ন, অবধূতাচার্য কুমারচন্দ্র, লীলাবজ্র, বিভূতিচন্দ্র, দানশীল, শুভাকর গুপ্ত, মোক্ষাকর গুপ্ত, ধর্মাকর, সিদ্ধাচার্য নাড়পাদ, তন্ত্রাচার্য তৈলপাদ, বোধিবর্মা, আচার্য প্রজ্ঞাবর্মা, ফা-হিয়েন, য়ুয়ান্-চোয়াঙ, ইৎসিঙ ।
কত যে বড় বড় পণ্ডিত, আচার্য, সিদ্ধাচার্যরা এইসমস্ত বৌদ্ধবিহার- মহা- বিহারে বসবাস করে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কত যে সংস্কৃত গ্রন্থের তিব্বতী অনুবাদ, তান্ত্রিক টীকা-গ্রন্থ, সারসংগ্রহ রচনা করেছেন !
ফা-হিয়েন, য়ুয়ান্-চোয়াঙ, ইৎসিঙ, মহাস্থবির তাম্রলিপ্তবাসী কালিকের মতো কত যে ভিক্ষু আর থেরীরা এইসমস্ত সংঘামগুলোয় কাঠ কি সেজের আলোয় অধ্যয়ন করতেন !
কক্ষে কক্ষে পায়রা-পারাবতের মতো “বকম” “বকম” কলরব উঠত । দশটা-বাইশটা শুধু নয়, কোথাও কোথাও পঞ্চাশ-ষাট, এমনকি শতাধিক সংঘারামের রমরমা ! পাঁচ শো-ছ শো শুধু নয়, হাজার হাজার আজীবক-শ্রমণ-ভিক্ষু ও থেরীদের উপস্থিতি ।
আজ বাঙালি কবির কবিতায় সেসমস্তই ‘সকরুণ স্মৃতি’ –
“ হিমালয় নামমাত্র,
আমাদের সমুদ্র কোথায়?
টিম টিম করে শুধু খেলো দুটি বন্দরের বাতি ।
সমুদ্রের দুঃসাহসী জাহাজ ভেড়ে না সেথা;
-তাম্রলিপ্ত সকরুণ স্মৃতি ।
দিগন্ত-বিস্তৃত স্বপ্ন আছে বটে সমতল সবুজ ক্ষেতের
কত উগ্র নদী সেই স্বপনেতে গেল মজে হেজে;
একা পদ্মা মরে মাথা কুটে ।
উত্তরে উত্তুঙ্গ গিরি
দক্ষিণেতে দুরন্ত সাগর
যে দারুণ দেবতার বর
মাঠভরা ধান দিয়ে শুধু
গান দিয়ে নিরাপদ খেয়া-তরণীর
পরিতৃপ্ত জীবনের ধন্যবাদ দিয়ে
তারে কভু তুষ্ট করা যায় !
ছবির মতন গ্রাম
স্বপনের মতন শহর
যত পারো গড়ো,
অর্চনার চূড়া তুলে ধরো
তারাদের পানে;
তবু জেনো আরো এক মৃত্যুদীপ্ত মানে
ছিলো এই ভূখণ্ডের,
-ছিলো সেই সাগরের পাহাড়ের দেবতার মনে ।
সেই অর্থ লাঞ্ছিত যে, তাই,
আমাদের সীমা হল
দক্ষিণে সুন্দরবন
উত্তরে টেরাই ! ”
♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦
ক্রমশ..
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৩
ধারাবাহিক উপন্যাস। ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৩
❤ Support Us