- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- মার্চ ১৬, ২০২৫
ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে অথবা ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়। পর্ব ৯

২৫
কী পড়ছিল তারা? কোন পুস্তক? যে পুস্তকে লেখা আছে ‘কালা আদমী’-দের কথা ?
‘কালা আদমী’ তো আমাদেরই বলত ইংরেজরা । ব্ল্যাক । নেটিভ । মনে হয় পুস্তকটি কোনও ইংরেজ সাহেবসুবোর জলপথে ‘ভ্রমণ কাহিনী’-ই হবে ।
যখন উল্লেখ শুনি- সাগর, সাগরদ্বীপ, পানসী, দাঁড়িমাঝিদের কথা । আর বাংলা ভাষার পুস্তকে যতরকম ভেলা-ভেউরি, ডোঙাডুঙি,পাটিয়া, এমনকি ময়ূরপঙ্খী, হাঙ্গরমুখী, রণতরী, ভ্রমণতরীর ছবি দেখি – দাঁড়-হাতে পাল-হাতে তাদের চালকরা, দাঁড়ি-মাঝিরা মাথায় সব পাগড়ি বাঁধা, খালি গা – সবাই তো ‘কালা আদমী’ !
কেন ? আমাদের বড়োডাঙার শিমুলতলীর ঘাটে সুবর্ণরেখা নদীতে হংসী নাউড়িয়ার পানসির দাঁড়িমাঝিদেরও তো পোড়া আঙরার মতো ভুসভুসে কালো গায়ের রং । কালো না ?
কালো, কালো । ‘কালা আদমী’।
‘কালা আদমী’ – আর তো বলে ক্রীতদাসদের ! একসময় পৃথিবীর কোথায় না দাসপ্রথা বা দাসব্যবসা প্রচলিত ছিল ? দরদাম করেই কালো তথা প্রান্তিক মানুষদের ক্রয়বিক্রয় করা হত ।
ইতিহাস তো বলে- অতবড় গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্য-সভ্যতাটাই নাকি দাসনির্ভর। গবাদি পশুর মতোই অত্যাবশ্যক পণ্যসামগ্রী ছিল ক্রীতদাসরা।
অতদূর কেন ? এই তো একটু আগে বাশুলীচকের বুদ্ধেশ্বর লায়া আর বাড়চুনফলির লম্বোদর দলাইয়ের কথোপকথনের মধ্যেই তো উঠে আসছিল ‘নরের হাট’ তথা নরঘাটে মানুষ কেনাবেচার কথা ।
‘নরের হাট’-এ আমাদের মতো ‘কালা আদমীদের’ কিনে মাইয়া-মাইপো বাছ-বিচার না করে এক পানসিতে গাদাগাদি করে ঠেসে হাঁসমুরগির মতো চালান করে দিত গোয়া কী সিংহলে ওলন্দাজ-পর্তুগিজদের বাজারে।
তারপর তো তাদের উপর চলত অকথ্য অত্যাচার ! এহেন দাসরাও যে একসময় বিদ্রোহ করে উঠবে – তাতে আর কী আছে অবাক আশ্চর্য হওয়ার ?
রোমে ‘দাসবিদ্রোহ’-এর কথা আমরা তো নিচু ক্লাসের ইতিহাস বইয়েই পড়েছি –
‘প্রশ্ন : রোমে দাসদের অবস্থা কিরূপ ছিল ? স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে রোমান দাসদের বিদ্রোহের কাহিনী সংক্ষেপে বিবৃত কর ।
উত্তর : রোমের অধিবাসীদের একটা বড় অংশই ছিল ক্রীতদাস। তাদের নাগরিক অধিকারই ছিল না। তারা ছিল কেনা গোলাম । প্রভুদের একচেটিয়া সম্পত্তি। তাদেরই খেতখামারে চাষাবাদের কাজ করত। রাস্তাঘাট তৈরি থেকে যাবতীয় পরিশ্রমের কাজ তারাই করত। কাজ, খাবার আর শাস্তি – এই যেন তাদের বরাদ্দ ছিল ! শাস্তি মানে বেকসুর চাবকানো থেকে মানসিক পীড়ন আর হত্যা । ফলত ক্রীতদাসরা মাঝেমাঝেই বিদ্রোহ করত । দাস-বিদ্রোহের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য – ‘স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ’। থ্রেসীয় বন্দী স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে লক্ষাধিক দাস দুবছর কাল ধরে রোমকে নাস্তানাবুদ করে রোমের পতন প্রায় আসন্ন করেছিল –’
যাত্রাদলের নায়ক শান্তিগোপাল অভিনীত ‘স্পার্টাকাস’ যাত্রাপালাও তো দেখেছি ! ‘টমকাকার কুটির’-ও পড়েছি –
টম, হ্যারি, এলিজা, জর্জ হ্যারিস, ক্রো, হ্যাগার, জন,বেন, সাউল, অ্যালবার্ট, ফিনিয়াস, মাইকেল, রোজা – কতসব নিগ্রো ক্রীতদাসদের নাম !
তারা তো কালোই । সব ‘কালা আদমী’ ।
‘কালা আদমী’-দের পুস্তক পড়তে পড়তে একজোড়া চলে যাওয়ার অব্যবহিত পরে পরেই পুষ্করিণীর জলে হাতমুখ প্রক্ষালনের পরিচিত আওয়াজ উঠল।
কারা যেন ‘কুলকুচা – মুখে বদ্ধ ও আলোড়িত জলের শব্দ ‘কুল, কুলকুল’ এবং জলত্যাগের শব্দ ‘কুচ্’ -কুলকুচো’ করল। ( বি: দ্র: হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ )।
পরক্ষণেই যথা পূর্বং আমারই পাশ দিয়ে যেতে যেতে দুজনের একজন অপর একজনকে ‘আগো’ সম্বোধন করে জিজ্ঞাসা করল—
‘আগো শুনছ নি ?
অষ্ট হাঁটু ষোল চরণ,
মাছ ধরতে গেলা লাল্টুলাল।
শুকলা ভুঁইর জাল পাতি গি,
মাছ ধরলা চিরকাল ।।’ 〈 নারীকণ্ঠ 〉
উত্তরে পুরুষটি বলল –
- ‘হ, ছালিয়ার মা। শুনি থায়। সে তো গুট্যে ‘ধাঁধা’। যার উত্তর হেলা – মাকড়শা।’
- ‘না গো। ধাঁধা না। সত্যি সত্যিই আজ মুই নদীরু ‘সতীবাঁধা’ মাছ ধরলি দুপহরকু। চানাচুনা মাছ। অউ সঞ্ঝাবেলা রাঁধমু। খাইগি দেখহ।’
- ‘ভালা হিলা। চানাচুনা ‘সতীবাঁধা’ খাইগি আজ রাতকু মুই ‘উকা’-য় যামু । বড় বড় ডাঁটিয়াল মাছ ধরবা।’
নারী-পুরুষ। বোধকরি স্বামী-স্ত্রী। তবে এরাও কী এই পোড়োগৃহে তথা সংঘারামে থাকে ?
সংঘারামে কী ভিক্ষুনীরাও থাকে নাকি ? আগে আগে ছিল না, পরে পরে ‘চল’ ছিল সবকিছুরই। কেন ? অম্বপালী-বিশাখা-সুজাতারা ছিল না ?
ছিল, ছিল। তা বলে –‘ছালিয়ার মা, ছালিয়ার বাপ’- এরা তবে কারা ? ‘সতীবাঁধা’ ‘উকা’-য় মাছ ধরার কথা বলে ? লোকগুলোও যেন একরকম চেনা, তাদের মুখের ভাষাটাও চেনা-চেনা লাগে।
এরাও এই পোড়োগৃহে কী সংঘারামের অন্দরে থাকে ? নাকি ওই অদূরবর্তী গঞ্জে ? কী ভেবে তাদের পিছু পিছুই হাঁটতে লাগলাম।
তারা বেশ তো ‘সতীবাঁধা’ তারমানে চানাচুনো মাছ ধরার কথা, ‘উকা’-য় বড় বড় মাছ ধরতে রাত্রিবেলা নিষ্ক্রমণের কথাও বলছিল।
বর্ষাকালের নদী শুখা মরশুমে এসে ছিঁড়ে যায়। স-মাছ স-জলজ উদ্ভিদ, ঝাঁজি-শ্যাওলা নিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া ফালিগুলো নদীর মূলধারা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়, হতে থাকে।
সেসময় স্রোতটাও খুব বেশি থাকে না। ঝিরঝিরে, কাকচক্ষুর মতো স্বচ্ছ জল। জ্যোৎস্না রাতের চেয়ে অন্ধকার রাতই যেন ‘উকা’-র পক্ষে অনুকূল। তাবলে তেমন আঁধার রাত কী আর ? সেই যে সেই ‘আঁধারের রূপ’ – ‘বায়ুলেশহীন, নিষ্কম্প, নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ নিশীথিনী …সে যেন এক বিরাট্ কালীমূর্তি
অতঃপর ছেঁড়া ছেঁড়া জলাধারগুলি স্থানীয় মেছো মেছুনীদের নজরে ও অধিকারে আসে । তারা তারউপর তাদের শ্যেনদৃষ্টি ফেলে রাখে ।
মাঝেমধ্যেই অকুস্থলে হাজির হয়ে আয়নার মতো স্বচ্ছ জলে চাক বেঁধে ছোট ছোট মাছেদের খেলা দেখে।
মেছুনীরা সময় সময় হাতের তালি বাজায় আর মন দিয়ে দেখে – কেমন সর্ সর্ করে চানাচুনো মাছগুলো ঝাঁজি-শ্যাওলার ‘দঁক’-এ চকিতে লুকিয়ে পড়ে।
সময় সুযোগমতো তারা জলাধারগুলিকে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে বিভক্ত করে । যে যার সে তার। যাকে বলে ‘সতীবাঁধ’।
একদিন কিছুটা জল ছেঁচেও নেয়। তারপর তার সঙ্গে গুড়মন গাছের রস নিঙড়ে মিশিয়ে দেয়।
গুড়মন গাছ হল একপ্রকার মাদক গাছ। ছোট ছোট এক-দেড় হাত উঁচু, ঝাঁপুড় ঝুপুড় গাছ। ধনিয়া ফলের মতো তার ফল ।
চটকে মটকে রস নিঙড়ে জলে গুলে দিলেই হল ! ছোট ছোট জ্যান্ত জলে সঞ্চর- মান মাছগুলো আফিমখোরের মতো ত্বরিতে পেট উল্টে জলের উপর ভেসে উঠবে।
তখন ঝুলিজাল দিয়ে ছাঁকো রে, খলুইয়ে মুঠো মুঠো করে ভরো রে। ধরা মাছ নিয়ে হাটে-বাজারে যাও রে, কচু-মানকচুর পাতায় ‘খালি খালি’ করে ‘সতীবাঁধা মাছ’ বেচো রে !
ছালিয়ার মা হয়তো এভাবেই ‘সতীবাঁধা’ মাছ ধরে এনেছে। আজ রাত্রে তাহুত করে রেঁধে ছালিয়ার বাপকে খাওয়াবে। খেয়ে দেয়ে ছালিয়ার বাপ যাবে রাতভোর ‘উকো’-য় মাছ ধরতে।
‘উকা’ – সে আরেক প্রকার মাছ ধরার ‘কল’। ভরা নদীতে সে খুব জুতের হয় না, হয় মরা নদীতে অর্থাৎ শীত-হেমন্তের নদীতে।
সেসময় স্রোতটাও খুব বেশি থাকে না। ঝিরঝিরে, কাকচক্ষুর মতো স্বচ্ছ জল। জ্যোৎস্না রাতের চেয়ে অন্ধকার রাতই যেন ‘উকা’-র পক্ষে অনুকূল। তাবলে তেমন আঁধার রাত কী আর? সেই যে সেই ‘আঁধারের রূপ’ – ‘বায়ুলেশহীন, নিষ্কম্প, নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ নিশীথিনী …সে যেন এক বিরাট্ কালীমূর্তি ।’
না, না। যেমন তেমন আঁধার রাত হলেও হয়। বৃহদাকার ‘পাটিয়া’, ‘পানসি’ না হলেও চলে। দরকার শুধু একটা ডোঙাডুঙি আর হ্যাজাক লাইট । অন্যথায় হাই-ব্যাটারির টর্চ।
উঁহু, আরও একটা জিনিসের দরকার হয়। একটা ঝকঝকে ধারালো অস্ত্র, ঝকঝকে তরবারি । যা দিয়ে এক কোপে একটা আস্ত মাছের ধড়-মুণ্ড আলাদা করা যায়।
ওইরকমই আলো-অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে তালডোঙায় চড়ে হংসী নাউড়িয়ার সঙ্গে কতদিন গিয়েছি অঝোরঝর অন্ধকারে ‘উকা’-য় মাছ ধরতে সুবর্ণরেখায়।
মাথায় ‘ঘোঙ’ । উপরন্তু একটা ছেঁড়া ছাতাও থাকে তালডোঙায়। পরনে খেটো গামছা। কোনও মতে টেনেটুনে মালকোঁচার মতো খুঁটটা কোমরে গোঁজা।
খালি গা, ছেঁড়া-ফাটা ফতুয়াটা ভাঁজ করে কাঁধেই ফেলে রাখা। এই হল আমাদের গ্রামের শিমুলতলী ঘাটের বরাবরের হংসী নাউড়িয়া।
নাউড়িয়ার পো’-য়ের সঙ্গে নদীজলে ‘উকা’-য় চলেছি । চলেছি তো চলেছি, চুপচাপ ।
কেবলই ওঠা-পড়া জলের। ঢেউ-তরঙ্গ, ঊরাল ঘূর্ণির জলোচ্ছ্বাস। মাঝেমাঝে মাথার উপর দু-একটা রাতচরার চক্কর। তাদের ‘ট্র্যাঁ ট্র্যাঁ’ কলরব।
লগিতে ঠেস মেরে ডোঙা আটকে হংসী নাউড়িয়া হাত উঁচিয়ে ঘাড় লম্বা করে হঠাৎই বলে উঠল –
‘-টিপা-লাইটে জলদি করি ফুকাস ফ্যালো বেহেরার পুআ । মাছের চক লৌকায় যাবরনাস্তি ঠেল মারেটে ।’
অথচ তালডোঙায় ওঠাইস্তক হংসী নাউড়িয়ারই নিষেধ ছিল নদীতে টর্চ-লাইটের আলো না ফেলার ।
নাহলে এতক্ষণ ধরে কম ইচ্ছা তো হয়নি পাঁচ-সেল-ব্যাটারির টর্চের আলোয় ফোকাস ফেলে রাতের নদীর হাবভাব দেখার।
কেমন করে নদীবক্ষে স্থানে স্থানে নদীজল হঠাৎ হঠাৎ পাক খায়। ঘূর্ণি তোলে । যাকে বলে ‘ঊরাল ঘূর্ণি’ ।
ঘূর্ণিতে পড়ে মাছের চক ঘুরপাক খাচ্ছে। মাছ এসে যার পর নেই নৌকার গায়ে ঠুকরে দিচ্ছে। তাই এতক্ষণে নদীজলে টর্চের আলো ফেলতে বলছে হংসী।
আলো ফেললামও। আর দেখি কি –
শ’য়ে শ’য়ে মাছ ! শুধু মাথাটুকু উঁচিয়ে কব্ কব্ আওয়াজ দিচ্ছে। শরীরের গতিক আন্দাজ করা যাচ্ছে না । কী মাছ ওগুলো ?
পাঁচ-সেল টর্চের আলোয় মাছগুলো স্থিরচিত্র। নড়েও না চড়েও না। কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থম মেরে আছে ।
‘কড়ি দিয়ে কিনলাম,
দড়ি দিয়ে বাঁধলাম,
হাতে দিলাম মাকু,
ভ্যা কর তো বাপু ।’
এ যে কিছুই করে না । মাথা উঁচিয়ে শুধুই ভেসে থাকে । হাঁকাড় দিয়ে উঠল হংসী নাউড়িয়া –
— ‘করোটো কী বেহেরার পুআ ? কোপ মারো ! কোপ মারো !! মারি দু ফাঁক করি দও, ধড়-মুণ্ড আলাদা আলাদা ! উকায় মাছ মারতে আসি অত কাতর হিনে চলে ?’
এই হল ‘উকা’ । ঘোরঘুট্টি অন্ধকারে আলো ফেলতে হবে জলে । আলোর তাড়সে মাছের দশা হবে ‘ ন যযৌ ন তস্তৌ’। তৎক্ষণাৎ তরবারির কোপে করে ফেল দু টুকরা ।
তারপর কাটা মাথা কাটা ধড় জলের উপর ভেসে উঠলে যত পারো ছাঁকো রে ! খলুইয়ে ভরো রে !!
‘সতীবাঁধা’ আর ‘উকা’-য় মাছ ধরার কথা শুনে আমার বদ্ধমূল ধারনা হল -এরা নির্ঘাত গাঁ-ঘরের, আমাদের গাঁ-ধারের লোক ।
মনে হতেই আমি তাদের পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলাম। দৌড়াচ্ছি। মৃদুমন্দ হাওয়া বইছিল।
হাওয়ার বেগ এক্ষণে আরোই বেড়ে গেল।
২৬
মৃদুমন্দ হাওয়া ঝড়ো হাওয়ায় পরিণত হল। দৌড়াচ্ছি সেই ঝড়ো হাওয়ার বিপরীতে। পায়ের নিচে বালি ছিটোচ্ছে, যেমনটা হয় খেড়ি-তরমুজের বিলে, কিংবা নদীবালিতে হাঁটতে গিয়ে।
বালি ঝিটানোর মস্ মস্ ভস্ ভস্ আওয়াজ। পরিষ্কার টের পাচ্ছি। চাঁদের আলো পড়ে বালি পর্যন্ত চিকচিক করছে। তাও দেখতে পাচ্ছি।
পোড়োবাড়িটা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার প্রাক্কালে কতক গোলা পায়রা ভদভদিয়ে উড়ে আকাশে উঠে মাথার উপর চক্কর কাটছিল। তাদের একটা কী দুটো বোধকরি এখনও উড়েঘুরে বেড়াচ্ছে।
ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ আসছে। উঁচুনিচু ঢেউ খেলানো প্রান্তরটার ভিতর হেঁটে যেতে গিয়ে সামনের গাঁ-গেরামের লোকদুটি মাঝেমাঝে হারিয়ে যাচ্ছে, ফের ভেসে উঠছে।
তাদের ধরতে হবে। ধরতেই হবে। আমি দৌড়োনোর গতি বাড়িয়ে দিলাম। যাকে বলে রিটপিটে দৌড়। দৌড়, দৌড় !
কিন্তু, হা হতোস্মি ! কোথায় কি !! আবারও সেই দুর্নিবার ঝিঁজরির টান। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ তর্জমা করে যে, “জিঞ্জলি, -ঞ্জির বি [ ফা জ ন্ জি র ; তু ‘ঝিঁঝির’ ] শিকল। “লোহার জিঞ্জলি গো। লৌহজিঞ্জির দিয়া ডিঙ্গা বান্ধ।”
টানতে টানতে ‘ইনভিজিবল্’ লৌহজিঞ্জির বা লোহার ঝিঁজরি কী জলঝিঁজরি আমাকে ফের নিয়ে চলল সেই পোড়োবাড়ি কী সংঘারামের দিকেই। বেগতিক বুঝে নিরুপায় আমি হেঁটে চলেছি।
হেঁটে চলেছি, হেঁটে চলেছি । এসময় কত কী মনে আসছে, সেই আমার মায়ের কথা গাঁয়ের কথা, সঙ্গে কার যেন একটা কবিতাও –
“ ম্রিয়মান রোদ্দুরের দিকে ”
রোদ পায়ে হেঁটে যায় সুখ, সারাদিনের মেয়েরা আর
অ আ ক খ
কিরকম রোদ ছেড়ে এসময় রোদের কিনারে যাচ্ছি
আজকাল রোদে গায়ে সোনার হরিণ লাফায়
কেউ কী শরৎকালের মাস দেয়ালে টাঙায়
না হয় হাওয়ায় সানাইদীঘির জলে জলবীজ ফাটে
দ্যাখো, দুপুরে দয়িতা-নারী খেতে দিয়েছিল
লালশাক
আজকাল কী ভীষণ তৃপ্তিহীন আমার বিকেল
যে যায় রাস্তার পিচে ম্রিয়মান রোদ্দুরের দিকে
স্বজনসান্নিধ্য তারা ঠিক পাবে
আমার ভীষণ ইচ্ছা করে যেন কথা কয়ে উঠি :
যে হও গাঁয়ের লোক, বলো, মা কেমন আছে
কবিতাটা জোরে জোরেই আউড়াচ্ছি । এরকমভাবে কত কবির কত কবিতাই তো আমার মনে আছে ! কবিতাটা আউড়াচ্ছি বটে, কিন্তু কে শুনছে ?
– কে ? কে ?
হয়তো কেউই না, আবার কেউ না কেউ শুনছে ঠিকই। ওই পোড়োগৃহে কী সংঘারামেই তো একটু আগে স্বচক্ষে দেখে এসেছি বাশুলীচকের বুদ্ধেশ্বর লায়া আর বাড়চুনফলির লম্বোদর দলাইকে।
ওই, ওই তো সেই বাড়িটা-পোড়োবাড়িটাকে দেখে এই কদিন যা মনে হচ্ছিল বুঝি বা একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত সংঘারাম, কেননা তার দেয়ালে দেয়ালে ‘স্টাকো’, কুলুঙ্গিতে কুলুঙ্গিতে মাথামুণ্ডহীন হাত-পা-ভাঙা ‘দ’ হয়ে যাওয়া ‘পুতুল’ ‘পুতুল’ মূর্তিসব, বোধকরি লোকেশ্বর, অবলোকিতেশ্বর, বোধিসত্ত্ব, বুদ্ধের।
এক্ষণে, এই ধবল জ্যোৎস্নায় বাইরে থেকে তাকে দেখে অকস্মাৎ মনে হল – সংঘারাম কেন হবে? গোটা বাড়িটাই একটা ডুবে যাওয়া, বালিপোত হওয়া, মাটি চাপা পড়া শতাধিক কুঠরিবিশিষ্ট এক অলৌকিক অর্ণবপোত।
বুঝিবা অপেক্ষায় আছে মহাতরঙ্গাভিলাষী কোনও না কোনও একটা সামুদ্রিক মহাজলোচ্ছ্বাসের, কোনও না কোনও একদিন সেই মহাজলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়ে সে ফের ভেসে উঠে অবশ্যই সমুদ্রগামী হবে।
আরে, এটাই আবার ওটা নয় তো ? ওই যে ওই, ‘ওক্কলবা’ তথা উৎকল দেশের ‘তপোসা’ আর ‘পালেকাথ’ নামের দুই সওদাগরের নানাবিধ বীজদানা ও হরেক মশলাভরতি জাহাজ? যাচ্ছিল ‘আদজেত্তা’ বন্দর থেকে ‘সুয়োমা’ বা সুহ্মদেশের উদ্দেশে ।
তারপর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ মহাসমুদ্রের প্রচণ্ড জোয়ার ও বায়ুপ্রহারে বিধ্বস্ত সওদাগরী সেই মালবাহী জাহাজটা কোনক্রমে বাঁচার তাগিদে ঢুকে পড়েছিল সুহ্মদেশের নদী অর্থাৎ আমাদের সুবর্ণরেখায়।
ঢুকেই অধিকতর আতান্তরে পড়ে আছড়ে ভেঙে পড়েছিল আমাদেরই গ্রামের অনতিদূরে থুরিয়াগ্রামের ‘মহিষাসুর দঁক’-এ।
ভেঙে পড়েছিল, ডুবে গিয়েছিল, বালিপোত হল। তারউপর মাটি চাপা পড়ল। সেই মাটি-বালি ভেদ করে নানাবিধ মশলা ও বীজদানা একদা অঙ্কুরিত হল। চারাগাছ মহীরুহও হল।
তবে সেসব গাছ শাল-সেগুন-কচড়া-মহুল-অর্জুন-পাকুড় কী আর, যতসব অচেনা-অজানা। বধুক-বিশুই-দঁড়পাট ঘরের জনমানুষরা, বউড়িঝিউড়িরা কেটে ফাঁকা করে দিলেও এখনও কিছু আছে।
আছে, আছে বৈকি।
দিবা-দ্বিপ্রহরে, ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে কী ফিঙ-ফোটা-জ্যোৎস্নায়, নিকষকালো অন্ধকার নিশীথেও নাকি নাম-না-জানা গাছেদের ফাঁকে দিন-ক্ষণ-তিথি-নক্ষত্র দেখে হঠাৎ হঠাৎ ঝলসে ওঠে সেই ডুবে যাওয়া ‘তপোসা’ আর ‘পালেকাথ’-এর সওদাগরী জাহাজের কানা ?
দৈবাৎ জাহাজের কানা যে-ই দেখে ফেলে সে-ই নাকি উন্মাদ ও বিবাগী হয়ে যায়, তারমানে হয়ে যেতে বাধ্য হয় ! তাই আমরা, নদী-সেপারে বড়ইস্কুলে যাতায়াতকারী ‘টকামানুষরা’, এমনকি বড়রাও পারতপক্ষে জাহাজকানার জঙ্গলের দিকে চোখ তুলে তাকায় না ।
মনে হতেই শিহরিত হলাম। এই রে, কে জানে কখন আচম্বিতে ফের ঝলসে উঠবে না তো ডুবন্ত জাহাজের কানা ? আশঙ্কায় আশঙ্কায় দুচোখ তৎক্ষণাৎ বন্ধ করলাম।
আর খুলব না, খুলবই না। তার চেয়ে যেমন চলছে চলুক, অদৃশ্য জলঝিঁজরি না লৌহঝিঁজরি আমাকে যেমন টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যাক । গন্তব্য তো সেই একটাই – ‘ষড়ধিকং শতম্’ অর্থাৎ এক শো ছয়তম কক্ষ।
ওখানেই তো পরস্পর কথা বলতে দেখে এসেছিলাম বাশুলীচকের বুদ্ধেশ্বর লায়া আর বাড়চুনফলির লম্বোদর দলাইকে।
আর তার আশপাশেই তো একসঙ্গে ধ্বনিত হতে শুনে এসেছি— “চখ চখ তালধ্বনি করতালে”, করতালধ্বনি, আর “ধনিয়া গোপোঃ –
অন্ধকমকসা ন বিজ্জরে
কচ্ছে রূঢ়তিনে চরন্তি গাবো
বুটিটম্ পি সহেয়্যুম্ আগতম্
অথ চে পত্থয়সি পবস্ স দেব ।। ”
তারবেলা ?
তবু চোখ বুজেই হেঁটে চলেছি। উঁহু, একে কী হাঁটা বলে? টানা, টানা। টেনে নিয়ে চলেছে, টেনে নিয়ে চলেছে।
তাবলে ঘষটাতে ঘষটাতে নয়, আমিও তালে তালে পা ফেলে চলেছি। আর চোখ বুজেও দেখতে পাচ্ছি – দু চাট্টা ঘাসফড়িং টানাটানিতে, হয়তো বা অদৃশ্য ঝিঁজরির চাপে পড়ে চকিতে এদিক ওদিক চিড়িক চিড়িক করে ছিটকে উঠে গায়ে পড়ছে।
সন্ধ্যার পরে পরেই অথবা সূর্য ওঠার আগে আগেই এ জাতীয় ঘাসফড়িং, যাকে বলে ‘ডাইনি ফড়িং’, আমাদের গ্রামের অনাদি-দৈত্যারিদের পোষা শিকারী ‘কয়ের’ বা তিতিরপাখি খুব খায়।
দু-চারটা ‘ডাইনি ফড়িং’ গলাধঃকরণের অব্যবহিত পরেই অনাদি-দৈত্যারিরা তাদের শিকারী পোষ্যর দুঠোঁট ফাঁক করে একদলা থুতু গিলিয়ে দেয়। থুতু-গেলানোটা নাকি নেহাতই শিকারী ‘কয়ের’ বা তিতির পাখিটার রাগ-রিরংসা বাড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই।
অতঃপর রাগী পাখিটাকে খাঁচায় পুরে বনধারে রেখে দিলে খাঁচার ভিতর দু পা সামনে দু পা পিছনে অনবরত অগ্র-পশ্চাৎ করতে করতে পুচ্ছ কাঁপিয়ে পাখিটা ডাক ছাড়ে। সে ডাকে বনের পাখি সাড়া দেয় আর অবশ্যম্ভাবী ভাবেই খাঁচার ভিতর এসে পড়ে, আর আবদ্ধ হয়ে যায় চুপিসারে।
কে জানে, এই কদিনে তারা ক’টা পাখি শিকার করল। তবে এখানে এলে নিশ্চিত তারা মুঠো মুঠো নধরদেহী ‘ডাইনি ফড়িং’ হাঁটতে চলতেই পেয়ে যেত।
ফড়িংগুলো এখন যেন অতিমাত্রায় ছটফটানি শুরু করল। ডানপায়ের চাপে কিছু ফড়িং ছিটকে উঠে বাঁ কাঁধ পর্যন্ত এসে যাচ্ছিল। আবার বাঁ পায়ের চাপে যেসমস্ত ফড়িং ছিটকে উঠছিল, তারা আমার নাক-মুখও ছুঁয়ে দিচ্ছিল।
বলা বাহুল্য, আড়াআড়ি ছিটকে ওঠায় তাদের মধ্যে সময় সময় ধুন্ধুমার লড়াই বা ধাক্কাধাক্কি হচ্ছিল। সে-ধাক্কায় পরাস্ত হয়ে কিছু ফড়িং তো নিচেয় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিল।
একটাসময় ফড়িংয়ের উৎপাত আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে গেল, শুরু হল মথের উপদ্রব। গাদাগুচ্ছের মথ এদিক ওদিক থেকে উড়ে এসে চটাস ফটাস করে আমার গায়ের উপর সেঁটে বসে যাচ্ছিল ।
এমনটা দেখেছি বটে গাঁয়েঘরে রাতের বেলা ঘরের ভিতর হ্যাজাক কি হেরিকেন জ্বললে ‘পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়’ গুচ্ছ গুচ্ছ তসররঙা মথ এসে আলোর তাড়সে দেয়ালে সেঁটে যায়। আর সেসময়ই ল্যাজটা ঈষৎ নাড়াচাড়া করতে করতে লোলুপ টিকটিকি তারদিকে অগ্রসর হয়।
এখানে হ্যাজাক-হেরিকেনের আলো আর কোথায়, যেটুকু আছে বাহির প্রান্তরে তা তো জ্যোৎস্নাপুলকিত যামিনীর ! এহেন মোহমেদুর মনোরম জ্যোৎস্নায় মথপতঙ্গ তো মথপতঙ্গ, কে আর পুড়ে মরতে চায় ?
কাজেকাজেই অচিরেই মথপতঙ্গের ঝাঁকও অন্তর্হিত হল। ঝিঁজরির টানে ফের আমিও সেই পোড়োবাড়ি তথা সংঘারামের দ্বারস্থ হলাম। প্রথম প্রবেশের মতোই এই সন্ধ্যাউত্তীর্ণকালেও ঝাঁকে ঝাঁকে চর্মচটকা-বাদুড়া অর্থাৎ চামচিকা-বাদুড়ের ঝাঁক মাকুর ফিতার ন্যায়, তারমানে তাঁতে কাপড় বোনার জন্য পোড়নের সুতাভরা নলীর মতোই আমাকে ঘিরে বিরামহীন আবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল।
যেন বাদুড়-চামচিকারা প্রত্যুদগমন করে আমাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। এহেন অভ্যর্থনায় আমার তো আনন্দিত হওয়ারই কথা, কিন্তু অচিরাৎ আনন্দের পরিবর্তে বুকধড়ফড়ানি শুরু হল।
-কী হয় ? কী হয় ?
এই ঘনঘোর অন্ধকার রাতে, যদিও কক্ষে কক্ষে দীপাধারে, কুলুঙ্গিতে কুলুঙ্গিতে কোন্ অদৃশ্য ও অলৌকিক হাতের ছোঁয়ায় ছোট বড় মশাল জ্বলছে, তার ঈষৎ আভায় বহির্বারান্দাও যৎসামান্য আলোকিত, উদ্ভাসিত ।
হেথা হোথা কলরব, কানাঘুষো দিব্যি শোনা যাচ্ছিল, ফিসফিসানি। মুহুর্মুহু আশঙ্কা হচ্ছিল – এইবুঝি ওইবুঝি মাথামুণ্ডহীন লোকগুলো হুড়দুড়িয়ে বেরিয়ে আসবে। লোকগুলো যে আছে তা তো আর মিথ্যা নয়।
তার তো জলজ্যান্ত উদাহরণ – বাশুলীচকের বুদ্ধেশ্বর লায়া আর বাড়চুন- ফলির লম্বোদর দলাই। আর তাদের নানাবিধ কথালাপ, আদার ব্যাপার থেকে জাহাজের কারবার।
আর কেরামতি কার্যকলাপ, হুট বলতে যখন তখন মাথার খুলিটা খুলে ফেলা, ফের প্রয়োজন পড়লে যথাস্থানে নাট-বল্টু ছাড়াই ইচ্ছামতো জুড়ে নেওয়া।
শুধু কী বুদ্ধেশ্বর, লম্বোদর। পুষ্করিণীর পাড়ে বসা জোড়ায় জোড়ায় তামাকু মাঞ্জনকারীরা। তদুপরি সেই ছালিয়ার মা ছালিয়ার বাপ। এছাড়াও পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে-বুঝে মনে তো হচ্ছে – লোকজন আছে আরও আরও, বিস্তর লোকজন !
ভাবতে না ভাবতেই কোথায় যেন হাসির হররা উঠল, খিলখিলিয়ে মেয়ে- মানুষদের হাসি। হাসতে হাসতে হল্লা করতে করতে তারা এগিয়ে আসছিল। এগিয়ে আসছিল বোধকরি আমার এদিকেই।
আমার পাশ দিয়ে আমাকে গ্রাহ্য না করেই পোড়োবাড়িটা ছেড়ে তারা চলেও যাচ্ছিল আর কোথাও। পরস্পর ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকিতে দু-চাট্টা নামও আমার কানে ভেসে আসছিল ।
‘আঙরি’ ‘বিমলি’ ‘ঝুপা’ ‘ঝুমরি’। আমাদের গ্রামের পাশের গ্রাম বড়ো- ডাঙার জ্ঞান দঁড়পাটের নিজের আর খুড়তুতো বোনের নামই তো যথাক্রমে ‘বিমলা’ আর ‘আঙুরবালা’। তাদেরই ডাকনাম তো ‘বিমলি’ আর ‘আঙরি’। তারা নদীধারের মাঠেঘাটে এই উঠতি বয়সেও ছেড়ী-ছাগল চরায়।
কিন্তু তারা এখানে কোত্থেকে আসবে ? নামদুটো তো স্পষ্টই শুনলাম। বড়ো- ডাঙা নয়, হয়তো বাড়চুনফলি কী বাশুলীচক বা অন্য কোনও গ্রামের লোক।
তবে যে ভাবছিলাম সংঘারাম ? উঁহু, সেখানে মহিলা ভিক্ষুনীদের জন্য তো আলাদা ব্যবস্থা, আলাদা সংঘারাম। যেমনটা পৃথক ‘গার্লস হোস্টেল’।
এই পোড়োগৃহ, পোড়োগৃহই, কোনও বৌদ্ধবিহার বা সংঘারাম-টংঘারাম হয়তো নয়ই । এখানে বৌদ্ধভিক্ষু বা ভিক্ষুনীরাও থাকে না। যতসব ভুল ধারণা।
ভুল, ভুলই।
‘আঙরি’ ‘বিমলি’ ‘ঝুপা’ ‘ঝুমরি’ নামে একে তাকে ডাকতে ডাকতে এই যে যারা একদঙ্গল পোড়োবাড়িটার বাইরে এইমাত্র গেল, তারা নির্ঘাত এখানেই থাকে, হয়তো কারোর স্ত্রী, কারোর বা ভগিনী, হাতে গুড়াখু মাঞ্জনের ডেলা নিয়ে পুরুষদের মতোই আপাতত পুষ্করিণীর পাড়ে জলের দিকে গেল, হয়তো শখের দাঁত মাজতে।
তারা এখানে করে কি ? নিশ্চয় গায়েগতরে খাটে, নচেৎ খাবে কি ? কিন্তু তাদের কাজের গতিকটা কি ? হালহলিকত ? বাশুলীচকের বুদ্ধেশ্বর লায়া নাহয় বাশুলীদেবীর পূজাআর্চি করে, পূজারি হয়েও তদুপরি শ্রেণীকক্ষে জাহাজ, ভড়, ভাউলিয়া নির্মাণের পাঠ দেয়, তাই তো শুনছিলাম –
“ ডিসপ্লেসমেন্ট SW
ফর্মূলা = ————————– mm
4× TPC
হোয়ার TPC ইজ্ দী টনস্ পার সেন্টিমিটার
ইম্যারসন্ অ্যাট দী ওয়াটারলাইন, অ্যাণ্ড
ডিসপ্লেসমেন্ট ইজ্ ইন্ টনস্। ”
বুদ্ধেশ্বর লায়া যেমন পুঁথিপত্র পাঠ, বাশুলীদেবীর পূজাআর্চি করে, তেমনি গড় গড় করে ইংরাজিতে ‘কনস্ট্রাকশন অব্ দী শিপ্’-এর ফর্মূলাও তো বলতে পারে।
তাজ্জব কি বাত !
এক্ষণে ঝিঁজরির টান যেন ঈষৎ দ্রুত বোধ হল। আর এসময়ই খিলান-অলিন্দের গলিঘুঁজিতে থাকা কিঞ্চিৎ স্থূলকায়া পারাবতগুলো তাদের গুরুগম্ভীর গলায় “বকম বকম” শুরু করল।
অকস্মাৎ প্রায় আমারই শরীর স্পর্শ করে, কতকটা যেন ঠেলে একধারে সরিয়ে দিয়ে আরও একঝাঁক যুবতী ও মধ্যবয়স্কা মহিলার দল দৌড়ুতে দৌড়ুতে বেরিয়ে গেল।
তারা এতটাই জোরে ও হল্লা করে কথা বলছিল আর হাসাহাসি করছিল যে তাদের কোনও কথাই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল না। তবে এতক্ষণে বুঝতে আর অসুবিধা হল না যে তারা বুদ্ধেশ্বর লায়া আর লম্বোদর দলাইয়ের মতো নিশ্চিত কোথাও কোনও কাজে নিযুক্ত ছিল।
এইমাত্র কাজের মেয়াদ শেষ হল, আর তারা ‘আঙরি’ ‘বিমলি’ ‘ঝুপা’ ‘ঝুমরি’-দের মতোই হুড়দুড়িয়ে বেরিয়ে এল। সন্ধ্যা উত্তীর্ণকালে হয়তো একটু হাঁফ ছেড়ে পুষ্করিণীর পাড়ে বসে দুদণ্ড স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, গুড়াখু মাজতে মাজতে একটু জিরিয়ে নেবে – ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি তাই এত।
তারা কুলি-কামিনরা। আড়কাঠিদের পাল্লায় পড়ে তাদের এতদূর আসা। ঠিকই ধরেছি ‘শ্রমিকদের কোয়ার্টার’ বা ‘খিলান ধাওড়া’, ‘হাজারীবাবু-লোডিংবাবু-তংখাবাবু’-দের ‘হাতা’ এই পোড়োবাড়িতে বা তার আশপাশে কোথাও না কোথাও আছে, আছেই।
কতক বাদুড়া ও চর্মচটকাও ডানা ফেতফেতিয়ে নির্গত হল। এত আকস্মিকভাবে ব্যাপারটা ঘটে গেল যে দুটো মাথামুণ্ডহীন যুবক কী কথা বলতে বলতে গেল, সেদিকে স্পষ্ট কর্ণপাত করা গেল না বা তাদের কথা সম্যক উপলব্ধও হল না
‘হাজারীবাবু’ – তারমানে শ্রমিকদের যার কাছে দৈনিক এবেলা ওবেলা হাজিরা দিতে হয়, ‘লোডিংবাবু’ – তারমানে যে বাবু ঝুড়ি বা ঠেকা-পাছিয়াতে মাল লোড করে দেয় আর ‘তংখাবাবু’ তো যে হপ্তায় হপ্তায় হপ্তার ‘তংখা’ বা টাকা তথা মজুরি দেয়।
‘আঙরি’ ‘বিমলি’, কি এই দলটার ভিতরে কাউকেই তো হুট বলতে খটাং করে মাথার খুলি খুলে কিছুক্ষণ পরে ফের যথাস্থানে খাপে খাপ বসিয়ে নিতে দেখলাম না ?
অথচ স্পষ্টতই দেখেছি তাদের মধ্যে কেউই মাথামুণ্ডহীন ছিল না। তবে কী এখনও তাদের দ্বিজত্বপ্রাপ্তি বা গোত্রান্তরই হয়নি ?
তা কী করে হয় ? এতদিন ধরে তারা মাথামুণ্ডহীন বুদ্ধেশ্বর লায়া কি লম্বোদর দলাইয়ের তত্ত্বাবধানে কুলিকামিনের কাজকামই বা করছে কী করে ?
আর কিছুক্ষণ পরেই আমার জন্য নির্দিষ্ট ‘ষড়ধিকং শতম্’ অর্থাৎ এক শো ছয়তম কক্ষে পৌঁছে যাব। পৌঁছে যাব কি, অদৃশ্য ঝিঁজরি আমাকে অনিবার্যভাবেই সেখানে টেনে নিয়ে যাবে।
যাবেই।
হঠাৎ চোখে পড়ল দুজন লাল শালুর কাপড় পরিহিত মাথামুণ্ডহীন যুবক পরস্পর কথা বলতে বলতে একজন আমার ডানদিক দিয়ে আরেকজন আমার বামদিক দিয়ে প্রায় দৌড়ুতে দৌড়ুতে বেরিয়ে গেল।
তাদের সঙ্গে সঙ্গেই কতক বাদুড়া ও চর্মচটকাও ডানা ফেতফেতিয়ে নির্গত হল। এত আকস্মিকভাবে ব্যাপারটা ঘটে গেল যে দুটো মাথামুণ্ডহীন যুবক কী কথা বলতে বলতে গেল, সেদিকে স্পষ্ট কর্ণপাত করা গেল না বা তাদের কথা সম্যক উপলব্ধও হল না।
তারা কী আগাম ঝঞ্ঝা ও বর্ষার কথা বলছিল ? কেননা তাদের কথায় ‘পশ্চিম না উত্তর-পশ্চিমে বিদ্যুৎ ঝলকানি’ আর ‘সমুদ্রে না মরুভূমিতে ভয়ানক ঝড়ঝঞ্ঝা-তুফান’-এর কথাই তো খাপছাড়াভাবে শোনা যাচ্ছিল।
কেমন যেন ঘুলিয়ে উঠল মনটা, ঘোলাটে মন নিয়েই অগ্রসর হচ্ছিলাম। একে কী অগ্রগমন বলে ? অগ্রে গমনশীল, পুরোগামী ? উঁহু, তা কেন ? আমাকে তো জোর-পূর্বক অদৃশ্য কেউ একজন পায়ে ঝিঁজরি বেঁধে টেনে নিয়ে চলেছে।
‘ইনভিজিবল্ ম্যান’ অকস্মাৎ থেমে গেল। আমিও প্রায় ‘ষড়ধিকং শতম্’ অর্থাৎ এক শো ছয়তম কক্ষের চৌকাঠে হোঁচট খেতে খেতে দাঁড়িয়ে পড়েছি। “দ্বারে পোঁতা বৃক্ষ কলা”, দুদিকে দু-দুটো সদ্যপোঁতা কদলীগাছ । কলার তেউড় বা গেঁড় থেকে নির্গত তির্যক চারাগাছ ।
তলায় আবার পোড়ামাটির সরায় রাখা হলুদমাখানো কমুঠো শস্যদানা। – এসবই তো পূজাচার, পূজায় লাগে। কে রেখে গেল এসব ? নিশ্চয় ওই দুজন – ওই যে ওই লালশালুর পোশাক পরিহিত আমার ডাইনে-বাঁয়ে একটু আগে দৌড়ুতে দৌড়ুতে যারা গেল ?
তারমানে ব্যাপারটা আমার কাছে এখন জলের মতো পরিষ্কার যে, আমার গোত্রান্তরকরণ কি দ্বিজত্বপ্রাপ্তির সময়কাল প্রায় আসন্ন, সমাগতই বটে। আজ হোক, কাল হোক বলিদানের ‘অর্গলা’-য় খিলকাঠি আঁটা আমার ঘাড়ের উপর সিঁদুর মাখানো তাদের খড়্গাঘাত আসবেই আসবে।
মুহূর্তে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল বলিপ্রদত্ত ‘অর্গলা’-য় ঘাড় আটকানো ও আংটা-আটকানো পাঁঠা ছাগলটার গলার উপর খাঁড়াটা ঝপাং করে পড়ার আগ-মুহূর্তের দৃশ্যটা – কান ঝটপট করছে, চোখদুটো গুলির মতো বড় করে তুলেছে, কোনমতে ঘাড়টা টেনেটুনে ছাড়িয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, জিভ বেরিয়ে পড়েছে — দড়াম করে দরজায় সজোরে লাথি কষালাম। দরজাটা খুলে গেল হাট করে।
২৭
পরের দিন ভোর, ঘু-ঘু করে কোথাও ঘুঘুপাখি ডাকছে । ঘুঘু তো নয়, আমরা বলি ‘কপতি’। আমাদের গ্রামের ‘খুঁ’, ‘মদোতি’-রা বনধারে ধানকাটা ন্যাড়া জমিতে আঠাকাঠি পেতে খুব কপতি ধরে।
বনধারে ডাঙা জমিতে নুনিয়া, কার্তিকছোলা, জামাইনাড়ু ধানের খুব চাষ হয় আর তা বর্ষাতি ধানের আগেই পেকে যায়। ধান কাটা হয়ে গেলেও জমিতে ধানের টুঙ, দানাশস্য পড়ে থাকে। আর তাই খেতে ঘুঘু-কপতিরা দল বেঁধে আসে। তখন বনধার ঘু-ঘু ডাকে ঘু ঘু করে।
তড়াক করে ঘুম ভেঙ্গে উঠে ঘুঘুপাখির ডাক শুনেই মনে হয়েছিল বুঝি বা আমাদের বনধারেই ন্যাড়া ধানবিলে ধান, ধানের টুঙ খেতে এসে ঘুঘুরা তারস্বরে ডাকছে ।
অনতিবিলম্বে দরজা খুলে সেই বনধারে যাব ভেবে বাইরে বেরিয়ে দেখি কোথায় বনধার – এ তো সেই পোড়োমড়ো গৃহ কি সংঘারাম। ঘুঘুপাখির ঘু ঘু করে সুরেলা প্রলম্বিত ডাকই বা কোথায় ?
ঢং ঢং করে কাঁসর ঘন্টা বাজছে, তৎসহ বাদ্য-বাজনা। এমনটা শুনেছি বটে শ্রীশ্রী৺শীতলাপূজা উপলক্ষে আমাদের গ্রামে সকাল সকাল ঘটোত্তোলনে কীর্তনীয়ার দল যখন নদীঘাটে যায়।
মুহূর্তেই মনে পড়ল আজ আমার বোধকরি গোত্রান্তরকরণ কি দ্বিজত্বপ্রাপ্তিকরণ। এসব ঘটে গেলেই আমি মাথামুণ্ডহীন লোকেদের মতো খটাং খটাং করে মাথার খুলি খুলে হেলমেটের মতোই ফের পরতে পারব।
বেণীমাধব শীলের সচিত্র ফুল পঞ্জিকায় যেমনটা দেখি – স্নানযোগ, অব্যূঢ়ান্ন, দ্বিরাগমন, সাধভক্ষণ, উপনয়ন, শান্তিস্বস্ত্যয়নের দিনক্ষণ, নির্ঘণ্ট, ইত্যাদি বিধিব্যবস্থা।
তেমনটাই আজ বুঝি আমার গোত্রান্তরকরণের অবধারিত দিনক্ষণ ধার্য হয়েছে । কাল পর্যন্ত দুয়ারে কদলী বৃক্ষ পোঁতা দেখেছি আর আজ দেখছি সারা পোড়োগৃহে দড়িতে ঝোলানো ‘আমসার’, অর্থাৎ আমপাতাগুলি দড়িতে বোঁটা গাঁথা হয়ে দুলছে, দোদুল্যমান।
গোবর লেপে, শুদ্ধ করে তার উপর হেমঘট বসিয়ে, ধান-আমডাল-সপুষ্প-সচন্দন দিয়ে বেদীমঞ্চ সাজিয়ে, ঢাক-ঘাঘর-নূপুর-শঙ্খ-মাদল বাজিয়ে নির্ঘাত বাশুলীদেবীর পূজা হবে।
তাই কাঁসরঘন্টা, ঢাক-ঢোল বাজাতে বাজাতে এখন নদীতে ঘট আনতে চলেছে বাশুলীচকের বুদ্ধেশ্বর লায়া আর বাড়চুনফলির লম্বোদর দলাইরা। জল- তলে দু-একদিন আগেও এমনতরো ঘন্টাধ্বনি কর্ণকুহরে এসেছিল।
বলিদানের দিনগুলোয় আমরা, গ্রামের ‘ন্যাঙটা ভুটুং সাধের কুটুম’-রা কতই না আনন্দ ফুর্তিতে থাকি । শীতলাথান জল দিয়ে ধুয়ে মুছে পবিত্র গোবর লেপে ঝকঝকে তকতকে ও শুদ্ধ করা হচ্ছে, ঢাক ঢোল ঘাঘর ঘন্টা বাজিয়ে কীর্তনীয়ার দল ইতোমধ্যেই গিয়েছে নদী থেকে ঘট তুলতে
কে জানে হয়তো সে-সময়টায় বলিদানপূর্বক কারোর না কারোর গোত্রান্তরকরণ হয়েছিল।
আজ যে গোত্রান্তর আমার – সে-বিষয়েও আমার কোনও সন্দেহ নেই, কেননা এই ‘ষড়ধিকং শতম্’ কক্ষদ্বারে কদলীবৃক্ষ পোঁতা থেকেই তো সারি সারি ‘আমসার’, হয়তো সে চলে গিয়েছে বাশুলীদেবীর মন্দির হয়ে যে গ্রামে এই পোড়োগৃহ সেই গ্রামের প্রবেশদ্বার পর্যন্ত।
শ্রীশ্রী৺শীতলাপূজায় আমি এই সময়টায়, যখন ঘটোত্তোলনকারী কীর্তনীয়ার দল নদীঘাটে যায় ঘট তুলতে, তখন লাল-নীল-সবুজ-হলুদ আর বিশেষত দেশলাই বাক্সের রংয়ের কাগজ নিয়ে কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে কাগজফুলের মালা গাঁথি আর সে-মালা মন্দির থেকে গ্রামের মাথা পর্যন্ত টাঙিয়ে দিই ।
শুধু কী আমসার, হয়তো বুদ্ধেশ্বর লায়া আর লম্বোদর দলাইরাও সংগ্রহ করেছে কাগজফুলের জন্য নানা রংয়ের রাংতা আর চিকচিকি কাগজ।
আমার হাত নিসপিস করছে, তাদের ডেকে বলি – কাগজগুলো আমাকে দাও, আর কাঁচি দাও। দাও না হে, ফুলেরমালা বানিয়ে দিই। আমি কতরকম ফুল বানাতে জানি, ফুল, কোঁকড়ানো ফুলের পাপড়ি।
গট মট করে ‘আমসার’-এর লাইন বরাবর এগোচ্ছি, এগিয়ে দেখিই না কোথায় কতদূরে আছে শ্রীশ্রী৺বাশুলীদেবীর মন্দির, অদৃশ্য লোকজন আমার পিছনে কলকাঠিই বা নাড়ছে কোত্থেকে ?
দশ-বিশ গজও আমাকে যেতে দিল না, অদৃশ্য জল-ঝিঁজরি টেনে-হিঁচড়ে ফের পশ্চাতে নিয়ে এল, হয়তো ঘর ছেড়ে, ‘ষড়ধিকং শতম্’ কক্ষ ত্যাগ করে এখন-এখনই বাইরে বহির্ভ্রমনে কোথাও যাওয়া নিষেধ আছে।
আজ না আমার গোত্রান্তর, আজ না আমার বলিদান ?
অথচ বলিদানের দিনগুলোয় আমরা, গ্রামের ‘ন্যাঙটা ভুটুং সাধের কুটুম’-রা কতই না আনন্দ ফুর্তিতে থাকি । শীতলাথান জল দিয়ে ধুয়ে মুছে পবিত্র গোবর লেপে ঝকঝকে তকতকে ও শুদ্ধ করা হচ্ছে, ঢাক ঢোল ঘাঘর ঘন্টা বাজিয়ে কীর্তনীয়ার দল ইতোমধ্যেই গিয়েছে নদী থেকে ঘট তুলতে।
আমরা জনাকতক কাঁচি হাতে খেজুরপাতার নতুন পাটিয়াতে বসে গেছি রঙিন চিকচিকি কাগজ কেটে ফুলের মালা গাঁথতে। গাঁথছি আর মেপে দেখছি কতটা লম্বা হল, আরও কতটা লম্বা করতে হবে !!
বলিদার ‘কালিকাকা’ বলিদানের ‘অর্গলা’-টা যার পর নেই সাফা করেছে, খড়্গটাতেও শান দিয়েছে । তারউপর সূর্যের আলো পড়লে চকিতে ঝলসে উঠছে ।
একে একে ‘বলি’-ও আসছে । ‘মানসিক’ – অর্থাৎ মানত করা পাঁঠা ছাগ, মোরগ, হলুদ পালকওয়ালা ছোট ছোট মুরগির বাচ্চা, চিঁয়া।
‘বলি’ আনছে ঘরের বড়রা, সঙ্গে আসছে ছোটরাও । তাদেরই তো আনন্দ ফুর্তি বেশি । কেউ কেউ জাপটে ধরে আছে মানত করা পশুটাকে, মোরগটাকে, ‘চিঁয়া’গুলোকে ।
বলিদান তো হবে শীতলামায়ের পূজাশেষে । ততক্ষণ আদর যত্ন করে পাতাপতর, দানাশস্য খাওয়াচ্ছে বলিপ্রদত্ত পশুপাখিগুলোকে । বলিদানের আগে আবারও একবার খাওয়ানো হবে, শেষ খাওয়া।
নৈবেদ্য সমূহ । আতপচাল, পাকারম্ভা, মেথি আর মিষ্টান্ন । শেষ খাওয়াও তারা খাবে গোগ্রাসে । তারপরই তো তাদের ধড়-মুণ্ডু আলাদা হবে বলিদার কালিকাকার খড়্গের এককোপে !!
পুনরায় আমাকে ‘ষড়ধিকং শতম্’ অর্থাৎ এক শো ছয়তম প্রকোষ্ঠেই টেনে- হিঁচড়ে নিয়ে এল ‘ইনভিজিবল্’ জলঝিঁজরি । সকাল থেকেই আমাকে খেতে দেয়নি, নাকি যে বলিপ্রদত্ত তার আবার খাওয়া কী ? তার তো নির্জলা উপবাস।
নির্জলা উপবাস নয়, তবু তো ক্ষুধাতৃষ্ণায় বড় কাতর বলিপ্রদত্ত নবকুমার- কে কাপালিক বলেছিল, “ফলমূল যাহা আছে, আত্মসাৎ করিতে পার। পর্ণপাত্র রচনা করিয়া, কলসজল পান করিও। ব্যাঘচর্ম আছে, অভিরুচি হইলে শয়ন করিও। ”
আর ক্ষুধার্ত নবকুমার ফলমূল আহার করে ঈষত্তিক্ত জল পান করে ব্যাঘ্র-চর্মে শয়ন করে ঘুমিয়েও পড়েছিল । মনে হতেই বন্ধ দরজায় ফের দুদ্দাড় করে লাথি কষালাম একের পর এক।
কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা ? কেউই তো সাড়া দিল না, কেউই তো ধারে- কাছেও এল না ? অগত্যা ব্যাঘ্রচর্মহীন অপরিচ্ছন্ন বিছানায় আমি আমার মতো ক্ষুধায়-রাগে-দুঃখে ঘুমিয়ে পড়লাম।
না না, ঘুঘুপাখির ঘু ঘু ডাকে নয়, এবার কিয়ৎকালীন ঘুমের চটকাটা ভেঙে গেল ঢাক-ঢোল-ঘাঘর-ঘন্টাধ্বনির পুনরাগমনে না কারোর না কারোর পুনঃপুনঃ দরজায় ধাক্কাধাক্কিতে ?
ঘটোত্তোলন পর্ব সমাধা করে হয়তো বাশুলীচকের বুদ্ধেশ্বর লায়া আর বাড়চুনফলির লম্বোদর দলাইরা ঢাক-ঢোল-ঘাঘর-ঘন্টাধ্বনি সহকারে প্রায় পৌঁছে গিয়েছে মন্দিরে, ফলতঃ বাদ্যোদ্যম শোনা যাচ্ছে দ্রুত ও উচ্চৈঃস্বরে।
তদুপরি ও তৎক্ষণাৎ কেউ না কেউ ‘ষড়ধিকং শতম্’ অর্থাৎ এক শো ছয়তম দ্বারকক্ষেও উপর্যুপরি করাঘাত করে চলেছে।
স্বভাবতই ঘুমটা ভেঙে গেল চট করে। এক্ষণে ভাবছি – দরজাটা খুলব কি খুলব না ? খুলেই দিলাম। আর দেখি কি, দুয়ারে দণ্ডায়মান আলুথালু বেশে দুই রমণী !!
না না, এদের দর্শনমাত্রই নবকুমারের মতো আমার মনে হল না বটে, “এ কি দেবী – মানুষী – না কাপালিকের মায়ামাত্র !” তারা দুজনেই যদিও, হলুদ-গাবানো শাড়ি পরেছে, গালে কপালে হলুদ মেখেছে, অধিকন্তু দুজনের হাতেই হলুদের ‘মাখা’ ভরতি বাটি ।
তারা হাসিমুখে আমার গালে কপালে, এমনকি চুলেও হলুদ মাখিয়ে দিল, তদুপরি হলুদ ‘মণ্ড’-এর বাটি হাতে গছিয়ে দিয়ে বলল, “যাও হলুদ মাখি করি পাশের গাড়িয়ানু গাধোই আইস !”
বলেই তারা হাসতে হাসতে এর-তার গায়ে ঢলে পড়তে পড়তে অতি দ্রুত গতিতে কে জানে কোথায় প্রস্থান করল। অতঃপর হলুদ ‘মাখা’-র বাটি হাতে আমি যার পর নেই অস্থিরতায় ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলাম।
কেননা হলুদ মাখামাখি ও স্নানাদির পরে পরেই তো বলিদান ! গ্রামের ‘গরাম’ পূজায় কি শীতলাপূজায় তো দেখেছি – বলিপ্রদত্ত পশুপাখিগুলোর গায়েও তো বলির আগে হলুদ ‘মাখা’ ও মেথি ‘মাখা’ মাখিয়ে স্নান না করাক মুঠোয় ভরে গায়ে জল ছিটিয়ে দেয় !!
এমনকি বিবাহে, চূড়াকরণে, কি উপনয়নেও এই ‘গাত্রহরিদ্রা’ বা গায়ে হলুদ মাখামাখি তো আছেই।
বিয়েতে অধিবাস, গায়ে হলুদ তো জানা কথা। উপনয়ন অনুষ্ঠানে বয়স সাত তেরো সতেরো কি আঠার একুশ চব্বিশে যজ্ঞোপবীত বা চলতি কথায় ‘পৈতে’ ধারণ করানো হয়।
উপবীত বা পৈতে প্রকৃতপক্ষে তিন-তিনটে পবিত্র সুতো যা নাকি দেবী সরস্বতী, গায়ত্রী আর সাবিত্রীর প্রতীক। প্রত্যহ গায়ত্রী মন্ত্রও জপ করতে দেওয়া হয়। এতেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের দ্বিজত্বপ্রাপ্তি ঘটে যায়।
ঘট আনয়ন, গণেশ, নারায়ণাদি দেবতার পূজা, অধিবাস ইত্যাদির পরে চূড়াকরণ, অর্থাৎ ক্ষৌরকার ডেকে মুণ্ডণ, মাথায় শিখিচূড়া ধারণ। অতঃপর গাত্রহরিদ্রা ও স্নান।
একসময় ভারত ও ইথিওপিয়ার মধ্যে সমুদ্র পথে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। বিশেষ করে কাপড়-বস্ত্রাদির। ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে একবার ইথিওপিয়ার সম্রাট ‘লেবনা দেঙ্গেল’ এসেছিলেন রাজসভায় এক অভিনব সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে
পরিশেষে মায়ের কাছে “ভিক্ষাং দেহি” বলে বালকের বা যুবকের ভিক্ষা- গ্রহণ, পৈতেধারণ ও ব্রহ্মচারী হওন। কিন্তু সেই তো আগে ভাগেই ‘গাত্রহরিদ্রা’ বা গায়েহলুদ –
আমিও পুষ্করিণীর পাড়ে, স্বেচ্ছায় কী আর সেই ‘ইনভিজিবল্’ জল না লৌহঝিঁজরির টানে উপস্থিত হয়ে, যার পর নেই রগড়ে রগড়ে হরিদ্রা ‘মাখা’ বুলিয়ে বুলিয়ে এজন্মের মতো গাত্রমাঞ্জন করে চলেছি, করেই চলেছি।
বেলা প্রায় আড় হতে চলল, স্নান বা গা-ধোওয়া তো দূরঅস্ত্ আমি এখনও জলেই নামিনি। অকস্মাৎ ঢাক-ঢোল ঘাঘর-ঘন্টাধ্বনির আওয়াজ উচ্চকিত হল, তৎসহ কিছু মানুষের উত্থিত কলরব কোলাহল।
এবার ঝিঁজরির টানও প্রবল থেকে প্রবলতর হল, অবশ্যই সে-টান জলের দিকে, জল না তার লৌহঝিঁজরি আমাকে নিয়ে এবার জলে নামল। তারপর তো ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতার, ফ্রি স্টাইল, ব্রেস্ট স্ট্রোক, ব্যাক স্ট্রোক –
পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে সেই – “ঝাপাসি ঝুরেঠ্যা”। জল পেয়ে ফের আমি মশানির দহের ‘জলক্রীড়া’-য় যেন মেতে উঠলাম । ডুবছি, ডুবছি – ডুব থেকে উঠেই হাত থাবড়াচ্ছি জলে, হাত থাবড়াচ্ছি – ছি-র ছা-র করে জল ছিটকে উঠে ছড়িয়ে পড়ছে চারধারে –
“ থির জলে ছুঁড়ে দিলে হাত, ওগো হাত, আর কেন বসে থাকো
উঠে এসো ছড়ানো রয়েছে হাত সুশীতল জলে, ধরো হাত
ছিঁড়ে ফেলি থির জল, ওগো জল, আর কেন শুয়ে থাকো
ভেঙে পড়ো হাতের মুদ্রায়, ওগো হাত, ছুঁড়ে দাও জলে –”
কোথায় ‘অর্গলা’, বা অর্গল ? কোথায় বলিদান ? কোথায় ‘জলঝিঁজরি’ ? মারো গুলি ! মারো গুলি !! আমি পুষ্করিণীর এপার সেপার পারাপারের চেষ্টা করছিলাম । ছিঁড়ে খুঁড়ে ‘ইনভিজিবল্ জলঝিঁজরি’-ও যেন এতক্ষণ আমাকেই সঙ্গত করছিল।
এক-আধমিনিটও গেল না, প্রবল পরাক্রান্ত জলঝিঁজরি না লৌহঝিঁজরি এক হ্যাঁচকায় আমাকে ফের ডাঙায় তুলল। অতএব ‘চলো মন নিজ নিকেতনে’— ‘ষড়ধিকং শতম্’ গৃহকক্ষে।
সেখানে পৌঁছেই দেখি বিছানায় আমার জন্য রাখা আনকোরা নতুন, একজোড়া ধুতি-চাদর, যা কীনা কষানো বা ছোপানো, রক্তরঙা। ‘কাষায়’ কী ? বৌদ্ধ ভিক্ষু ভিক্ষুনীরাই পরেন ?
উঁহু, তা কেন। এ পোশাক ভারতীয় বনাশ্রমের, মঠের সাধুসন্ন্যাসীরাও পরেন। কোথায় যেন পড়েছি –একসময় ভারত ও ইথিওপিয়ার মধ্যে সমুদ্র পথে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। বিশেষ করে কাপড়-বস্ত্রাদির। ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে একবার ইথিওপিয়ার সম্রাট ‘লেবনা দেঙ্গেল’ এসেছিলেন রাজসভায় এক অভিনব সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে।
পর্যটকের বিবরণ থেকে জানা যাচ্ছে, সঙ্গে সেদিন একই সিল্কের শাড়ি পরে এসেছিলেন সম্রাটের স্ত্রীও। তাঁরা এমনভাবে শাড়ি-ধুতি পরেছিলেন যার বেশিরভাগটাই মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল।
অঙ্গবস্ত্র হিসাবে পরেছিলেন আরেক ধরনের ও রংয়ের অতি সূক্ষ্ম বস্ত্র যা ভারত থেকেই আমদানি করা, যার নাম ‘Casha’। ওই ‘Casha’-ই হল ‘কাষায়’।
আজ দেবোদ্দেশে উপকল্পিত ছাগাদি পশুর মতোই, ‘নরশ্ছাগস্তথা মেষো মহিষঃশশকস্তথা’, বলিপ্রদত্ত আমাকেও এই ‘কাষায়’ ধুতি-চাদর পরে বলিদানের যূপকাষ্ঠে মাথা গলাতে হবে।
গলাতেই হবে যখন, যার পর নেই অতি দ্রুততার সঙ্গে ‘কাষায়’ পরিধান করে আমি পূজাস্থলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে ঘর-বাহির করতে লাগলাম।
২৮
খোল-কত্তাল ঢাক-ঢোল ঘাঘর-ঘন্টাধ্বনি আরোই নিকটবর্তী হচ্ছিল। কাছে, আরও কাছে। তারমানে এতক্ষণে নদী থেকে ‘বারি’ অর্থাৎ ঘট-উত্তোলন করে বুদ্ধেশ্বর লায়া আর বাড়চুনফলির লম্বোদর দলাইরা মন্দিরে হয়তো এসে পড়ল।
এই সময়টায় আমাদের ৺শীতলাতলায় মা-কাকিরা, গ্রামের অপরাপর বউড়িঝিউড়িরা মিরদঙ্গিয়া-ঢাকঢোল-বাদ্যকরদের থেকে ঈষৎ দূরে দাঁড়িয়ে, বলতে কি কীর্তনীয়াদের দিকে সামান্য অগ্রগমন করে সমস্বরে শাঁখ বাজায়, উলুধ্বনি দেয়।
ভাবতে না ভাবতে, এখানেও সমবেত উলুধ্বনি ও শঙ্খনিনাদ হতে লাগল। সেসব শুনে আমিও যার পর নেই উত্তেজিত ও শিহরিত হলাম। তারমানে এই যে, আমারও ‘অর্গলা ভূত’-এর যূপকাষ্ঠে বলিদানের সমূহ সময়কাল উপস্থিত !
তন্মুহূর্ত্তেই ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে বিছানায় আছড়ে পড়লাম । বিগত জীবনের কথা একে একে মনে আসছে । মা-বাবার কথা, কাকা-কাকিমা, আত্মীয়-পরিজন, এমনকি সেই ‘নলিনী + কুসুমকুমারী’-র কুসুমকুমারীকে মনে পড়ছে ।
মনে পড়ছে, কাপালিকের খড়্গাঘাত থেকে নবকুমারকে বাঁচাতে কপাল- কুণ্ডলার সেই বরাভয় বাণী :
‘কোথা যাইতেছ ? যাইও না।
ফিরিয়া যাও – পলায়ন কর।’
‘চুপ ! কথা কহিও না –
খড়্গ আমারই কাছে -চুরি
করিয়া রাখিয়াছি –’
হায় কপালকুণ্ডলা ! হায় কুসুমকুমারী !! চোখ ফেটে জল এসে যাচ্ছিল । এমন- সময় দরজায় করাঘাত, “কে ? কে ?” বলতে বলতে ধড়ফড়িয়ে উঠে দরজা খুলে দিলাম –
দেখি কী, দুয়ারে ফের আলুথালু বেশে এর-ওর গায়ে ঢলাঢলি করে দণ্ডায়মান সকালের সেই দুই রমণী । তাদের হাসি হাসি মুখ । গালে কপালে এখনও হলুদে- সিঁদুরে মাখামাখি।
দেখে ভারি আশ্বস্ত হলাম। কেমন যেন চেনা শোনা আপনজন বলেই বোধ হচ্ছিল। তারা আমাকে তাদের সঙ্গে সঙ্গে যেতে বলল।
–‘কোথায় ?’
–‘মন্দিরে। পূজার স্থানে।’
শিহরিত হয়ে মনে মনে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন ?’
যেন শুনতেও পেলাম, ‘বধার্থ’
যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। এই পোড়ো গৃহ বা সংঘারামের দেওয়ালগাত্র বরাবর দড়িতে ঝোলানো হয়েছে সার সার আম্রপল্লব, ‘আমসার’। যা কীনা প্রসারিত হয়েছে মন্দিরতক, কিংবা মন্দির ছাড়িয়ে আরও দূর -এই গঞ্জে ঢোকার মুখপর্যন্ত। যেখানে হয়তো তৈরিও করা হয়েছে তোরণ।
‘আমসার’ অর্থাৎ আমপাতাগুলি আসল না নকল -হাত বাড়িয়ে দেখতে বড়ো কৌতূহল হল। দেখলামও, নকল কেন হবে, আসলই। ওই তো “ঝুরু ঝুরু পাতাগুলি কাঁপিছে সমীরে ”।
আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া ওই দুজন স্ত্রীলোক, জানি না তারা বিবাহিতা কীনা, যথারীতি পরস্পর হলাতে ঢলাতে যাচ্ছিল, নিজেদের ভিতর কী যেন কথা বলতে বলতে, আর হাসতে হাসতে।
পিছনে পিছনে যে মানুষটা আসছে, যাকে তারা ডেকে নিয়ে যাচ্ছে, তার যে একটু বাদেই ‘অর্গলা ভূত’-এর হাড়িকাঠে বলিদান হবে – সে সম্পর্কে তাদের যেন এতটুকু ভ্রূক্ষেপ নেই, কোনও প্রকার হিন্দোল নেই ।
এতদিনে তাদের কী গোত্রান্তর হয়ে গেছে, নাকি হয়নি ? কই, সকাল থেকে একবারও, একটুক্ষণের জন্যও তো তাদের হুটমুট হেলমেটের মতো মাথার খুলি খুলতে দেখিনি ?
শুধু তাদের কেন, এযাবৎ দেখা ওই যে ‘আঙরি’ ‘বিমলি’ ‘ঝুপা’ ‘ঝুমরি’ নামের মেয়েরা, কই তাদেরও তো দেখিনি – একবারের জন্য হলেও মাথার খুলি খুলতে ?
তবে কী ‘ইহ জগত’-এর মহিলামহলে তাদের গোত্রান্তর নেই ? নাকি ছাড় আছে বিশেষ বিশেষ কারণে ? বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ?
ভাবলাম, তাদেরকেই জিজ্ঞাসা করি, কিন্তু খোল-কত্তাল ঢাক-ঢোল ঘাঘর-ঘন্টাধ্বনি ক্রমশ নিকটবর্তী হওয়ায় নিরস্ত হলাম – না, থাক !
দ্বিপ্রহর বেলা । গবাক্ষ, ঝাঁঝরি দিয়ে বরফি-কাটা রৌদ্র পড়েছে ছাবকা ছাবকা । দ্বিপ্রাহরিক ভ্রমণ সেরে পারাবত কবুতরাদি যে যার প্রকোষ্ঠে, কড়ি-বরগায় অবসর যাপনে মামড়িতে চোখ ঢেকেছে।
অকস্মাৎ খোল-কত্তাল ঢাক-ঢোল ঘাঘর-ঘন্টাধ্বনিতে তারাও জেগে উঠে ডানা ফেটিয়ে ভদভদিয়ে আচমকা বেরিয়ে গেল। তাদের সঙ্গে নিশাচর বাদুড়া-চর্মচটারাও দিনমানে বেরিয়ে মাকুর ফিতার মতো ঘুরতে লাগল।
এ হেন হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতিতে আগে আগে হেঁটে যাওয়া দুই রমণী চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল – ‘বামাল’ হাত-ছাড়া হয়ে গেল কীনা, তা জলজ্যান্ত ‘মজুদ’ আছে দেখে তারা ফের মুচকি হাসল।
ধুস্, কোথায় পালাবো ? পালানোর পথ নেই, সে তো তারাও জানে। পায়ে এখনও যে ঝিঁজরি বাঁধা আছে । স্বচক্ষে দেখা যাচ্ছে না বটে, ‘ইনভিজিবল্’। তা সত্ত্বেও সে তো আছে । আছে, আছেই ।
ডান পায়ের বুড়ো আঙুল আর মেজো আঙুলের মাঝখানে যে যৎকিঞ্চিৎ শ্যাওলা ধরেছিল, তার যৎসামান্য তো এখনও লেগে আছে। আছে, আছে। সেই বলে না, “অঙ্গারঃ শতধা ধৌতো মলিনত্বং ন মুঞ্চতি”।
শ্বেতশুভ্র দুগ্ধে ডোবালেও অঙ্গার যেমন সাদা হয় না, কালোই থেকে যায় । তেমনি শত শতবার একটা তো একটা, দু-দুটো পা একসঙ্গে ছোঁড়াছুঁড়ি করেও শ্যাওলার ‘দাগা’ মোছা গেল না।
এক্ষণে শেষ চেষ্টার মতো আবারও একবার সরোষে আস্ফালন-আন্দোলন শুরু করলাম, তবে কেবলমাত্র ডাহিনা পায়েই । কিন্তু কাজের কাজ কিসসু হল না, উল্টে দুর্দ্দাম হয়ে হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিলাম।
আগু হেঁটে অগ্রবর্ত্তিনী ওই দুই রমণীকে অতিক্রম করে গেলে তারা দুজনে প্রথমে কোনও কথা না বলে কেবলমাত্র মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, তারপর জোরে জোরে হেসে উঠল।
তাদের হা হা হি হি করে হাসি, হলাহলি ঢলাঢলি করে হাঁটাচলা, কথা বলার হাবভাব দেখে সময় সময় আমার এমনটা বোধ হচ্ছিল যে, তারা বুঝি এই ‘গোত্রান্তরকরণ’-কে তেমন একটা ধর্তব্যেই নিচ্ছে না।
তাই দেখে, কী বলব, আমি যৎকিঞ্চিৎ হলেও ভরসা পাচ্ছিলাম, ভরসা – অথচ আস্ত একটা হৃদয়বিদারক ঘটনা ‘বলিদান’ -এতক্ষণে আমার চোখে পড়ল, ‘কাগজ ফুল’, ওই তো ‘কাগজ ফুল’ – তাহলে বুদ্ধেশ্বর লায়া আর বাড়চুনফলির লম্বোদর দলাইরা রাঙতা ও নানাবিধ রঙিন কাগজেরও ব্যবস্থা রেখেছে ?
কাঁচিতে কাগজ কেটে কেটে ফুল, ফুলের মালা, লতাপাতা, ফুলের পাপড়ি তৈরি করে কী সুন্দর টাঙিয়ে দিয়েছে, টাঙানো লতার মাঝে মাঝে ঝুলছে গোল গোল চাঁদমালা।
গোলাকার চাঁদমালার কেন্দ্রে কী লেখা আছে ? “ ওঁ মণিপদ্মে হুঁ ?” দেখি -দেখিই তো –
খানিক থমকে দাঁড়িয়ে চাঁদমালা হাতে ধরে চোখের সামনে নিয়ে পড়ে দেখলাম – না , “ওঁ মণিপদ্মে হুঁ” লেখা নেই, কেবলমাত্র লেখা আছে, “ওঁ”। যেমনটা আমাদের ৺শীতলা পুজোয় ‘দশকর্মা ভাণ্ডার’ থেকে কিনে আনা চাঁদমালায় সচরাচর লেখা থাকে।
দুই রমণীও এ-ওর কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে আমাকে দেখল, তারপর মুচকি হাসল। প্রত্যুত্তরে আমিও মুচকি হাসলাম।
কক্ষের পর কক্ষ পেরিয়ে যাচ্ছি, প্রায় সবকটা কক্ষই রুদ্ধদ্বার, বোধকরি ভিতরে কেউই নেই। হয়তো পূজাস্থলে চলে গিয়েছে সবাই । তা তো যাওয়ারই কথা, উৎসব না ? বলিদানের উৎসব।
ফাঁক ফোকর দিয়ে উড়ে যাওয়া কবুতর কটা আবার ফিরে এল। এসেই টোঙে ঢুকে কঁহরাতে লাগল, গজরাতে লাগল – সে কী জোরে জোরে বকম বকম ! ঢাক-ঢোল ঘাঘর-ঘন্টাধ্বনির মধ্যেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
তাদের হাবভাব, গজরানি শুনে এই মুহূর্তে আমারও মনে পড়ল আমাদের দালানের পায়রাগুলিকে । কোঠাবাড়ির দাঁতিয়ায় বাঁধা বাতিল ভুসো মাখা কালো মাটির হাঁড়িতে তাদের বসবাস, দিন গুজরান ।
একটা-দুটো কি, একসঙ্গে কতগুলো হাঁড়িতে কত শত কবুতর পায়রা যে সেখানে বসত করে, তার ইয়ত্তা নেই।
আমাদের মেজোকাকাই তাদের তত্ত্বাবধান করে, একবেলা কেন তিনবেলাই খেতে দেয় খুদকুঁড়ো, মুগচনা, দানাশস্য। হয়তো কাজে কামে বিলে-বাতানে গেছে, ফিরতে দেরি হয়েছে, তারমানেই খেতে দিতে বিলম্ব ।
যেই গলার আওয়াজ পেয়েছে মেজোকাকার, অমনি একসঙ্গে কঁহরাতে শুরু করে দিল উচ্চৈঃস্বরে, ঠিক যেমনটা এখন । কার কাছে, কী যে এদের এই মুহূর্তে বায়নাক্কা, আব্দার – ঠিক বুঝতে পারছি না।
এক্ষণে দুই রমণীর সচকিত ও ত্রস্তপদে হাঁটা মনে করিয়ে দিল মন্দির বুঝি সমুপস্থিত। তাছাড়া ঢাক-ঢোল খোল-কত্তাল ঘাঘর-ঘন্টাধ্বনির আওয়াজ ক্রমশ উচ্চ থেকে উচ্চতরই হচ্ছিল।
দু পা যেতে না যেতেই সাক্ষাৎ পাওয়া গেল কোলাহল মুখরিত মন্দিরের – এই তাহলে বুদ্ধেশ্বর লায়া আর বাড়চুনফলির লম্বোদর দলাইয়ের বাশুলী দেবীর মন্দির ?
এই পোড়োগৃহ বা সংঘারামের একেবারে শেষ প্রান্তে একটি কক্ষের অভ্যন্তরে তাঁর অধিষ্ঠান। ধূপধুনো মেথির সুবাসে আমোদিত ও চোখ-জ্বালা-করা ধোঁয়ায় ধূমায়িত জায়গাটা।
কী বলব, মাথামুণ্ডহীন লোকে লোকারণ্য পূজাস্থল। খটাং খটাং করে সময় সময় আওয়াজ উঠছে মাথার খুলি খুলে ফেলার, ফের স্ক্রু টাইট করার। এতক্ষণে চক্ষুষ করলাম মেয়েরাও মাথার খুলি খোলা-পরা করছে।
ভীত ও সন্ত্রস্ত আমি আমার একমাত্র ভরসাস্থল ওই দুজন রমণীকে আর কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। আমাকে হাজির ও হস্তান্তর করেই তারা যেন কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছে।
খোল-কত্তাল-মিরদঙ্গিয়ার দল একধারে জড়ো হয়ে ঘাঘর-ঘন্টাধ্বনি সহ-যোগে গলার শিরা ফুলিয়ে কীর্তন করছে । তাদের পরনে কাষাই ধুতি ও গায়ে কষাই গেঞ্জি-ফতুয়া। গলায় কাঠমালা।
ঢাক-ঢোল-চ্যাচ্চেড়ি, সানাই বাজাচ্ছে ডোম-বাদ্যকরেরা। যেমনটা আমাদের গ্রামেও মথো-ভটা-মিতিঞা-সন্তোষিয়া ডোমেরা বাজায়, বাজনায় গান তোলে, “সারারাতি ফুল কুড়ালি পৈসা পেলি কই ?”
ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে হলুদ, মসলা মাখানো মাছের খণ্ড ফেলে দিলে যেমন ছ্যাঁক্ করে আওয়াজ ওঠে, তেমনি ভাবে খানিক চুপ থেকে প্রচণ্ড জোরে জোরে মন্ত্র পড়তে লাগল পুরোহিত বুদ্ধেশ্বর লায়া –
“ ধ্যায়েদ্দেবীং বিশালাক্ষীং তপ্তজাম্বুনদপ্রভাম ।
দ্বিভুজামম্বিকাং চণ্ডীং খড়্গখর্পরধারিণীম্ ।।
নানালঙ্কারসুভগাং রক্তাম্বরধরাং শুভাম্ ।
সদা ষোড়শবর্ষীয়াং প্রসন্নাস্যং ত্রিলোচনাম্ ।।”…
এই পর্যন্ত বলে ফের থেমে গেল। আমি মন্দিরের গর্ভগৃহে উঁকি মেরে দেখলাম – বুদ্ধেশ্বর লায়াই তো ? হ্যাঁ, পৃষ্ঠদেশ অবলোকন করে তাই তো মনে হচ্ছে । কেননা, সে তো বসে আছে ‘বাশুলী দেবী’-র দিকে মুখ করে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু ধারেকাছে কোথাও লম্বোদর দলাইকে দেখতে পেলাম না। হয়তো কাজেকর্মে অন্য কোথাও গেছে। স্পষ্টতই চোখে পড়ছে সর্বাগ্রে দেবীমূর্তি, দেবীর মুখ। যেমনটা দেখেছি আমাদের লাউদহ কি কালরুই গ্রামে, মাথা-কাটা-মূর্তি, এবড়োখেবড়ো, তেমনটা নয় মোটেও।
অনেকটা বুদ্ধের আদল, তেমনি বসারও ভঙ্গি। তবে নিমীলিত চক্ষু নয়, বিস্ফারিত বড় বড় চোখ, চতুর্ভুজা নন দ্বিভুজা, একহাতে খড়্গ অপরহাতে বরাভয় । নৃমুণ্ডমালিনী, দেখেই ভারি শিহরিত হলাম ।
থেমেছিল বুদ্ধেশ্বর, এটা-ওটা ঘাঁটাঘাঁটি, দেবীর দিকে ফুল-বেলপাতা ছোঁড়াছুঁড়ি করছিল, এবার পুনরায় মন্ত্রোচ্চারণে ফিরে এল –
“ মুণ্ডমালাবতীং রম্যাং পীনোন্নত পয়োধরাম ।
শিবোপরি মহাদেবীং জটামুকুটমণ্ডিতাম্ ।।
শত্রুক্ষয়করীং দেবীং সাধকাভিষ্টদায়িকাম্ ।
সর্বসৌভাগ্যজননীং মহাসম্পৎপ্রদাং স্মরেৎ ।। ”…
আমাদের গ্রামের ৺শীতলাদেবীর পূজায় মন্দিরের সামনে পাতা লাল নীল ডেকোরেটারের চেয়ারগুলো মূলত বয়স্ক ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলাদের জন্য বরাদ্দ হলেও ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সেসব জবরদখল করে একেকটা চেয়ারে একাধিক ছেলেমেয়ে, সংখ্যায় দু-তিনজন বা তারও বেশি, বসে বসে পা দোলায়।
এখানে তেমনটা একেবারেই দেখা যাচ্ছে না । তার কারণ, আমি আসা ইস্তক এমনকি গো-শকটে গঞ্জের ভিতর দিয়ে পরিভ্রমণ কালেও চোখের দেখতা একটা ছেলে কী মেয়ের দেখা পাইনি ! তবে কী এখানে এই পোড়ো গৃহে কী গঞ্জে বসবাসকারী লোকেরা নিঃসন্তান ? নাকি দিনমানে চাঁদের ছেলেমেয়েদের লুকিয়ে রাখার মতো তারাও তাদের সন্তানাদিকে লুকিয়ে রাখে ?
যাহোক এদের মধ্যে আমি, কেবলমাত্র আমিই, নিজেকে বয়ঃকনিষ্ঠ ভেবে নিয়ে ওই লাল-নীল-সবুজ চেয়ারগুলোর একটায় বসে জোরে জোরে পা দোলাতে লাগলাম।
পূজা যেমনকার তেমনই চলছে, ধূপধুনা মেথির গন্ধে চারধারটা ম ম করছে। মাঝে মাঝেই দু-চারজন হলুদগাবা শাড়ি পরিহিতা মেয়েমানুষ ঝকঝকে কাঁসার থালায় নৈবেদ্য এনে পূজাস্থলে সাজিয়ে রাখছে । তাদের মধ্যে কেউ কেউ ওখানেই পরিপাটি হয়ে বসে থাকছে, আবার কেউ কেউ উঠেও যাচ্ছে।
অবিকল আমাদের গ্রামের শীতলাতলায় ৺শীতলাদেবীর পূজারই হাবভাব । কেউ যেন সৃষ্টিধর আগুয়ানের মতোই “চ্যা-এ-র্-র্-দ্যা-ন্” “চ্যা-এ-র্-র্ দ্যা-ন্” “দো-ক্তা-পূ-জা” করে পূজাস্থলের অদূরেই অন্তরালে বসে ‘চ্যাচ্চেড়ি’ও বাজাচ্ছে, সঙ্গে ধনা-মিতিঞা-ভটা ডোমের ঢোলবাদন আর মথোর সানাই।
ভারি কৌতূহল হল ডোমপাড়ার ডোমেদের বাদ্যকর গুষ্টিরা অন্তরালে কোথায় বসে তাদের যন্ত্রাদি বাজাচ্ছে, একবার গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসি। রওনাও দিলাম, কিন্তু দু-চারটি চেয়ার টপকাতে না টপকাতেই চোখে পড়ল মেঝেয় পাতা শতরঞ্জির উপর ছড়ানো ছিটানো রঙিন কাগজ, কাঁচি, গঁদের আঠা ইস্তক।
রক্তরঞ্জিত হাড়িকাঠ সন্দর্শনে অতঃপর আমার রক্ত-মজ্জা-হাড় পর্যন্ত হিম হয়ে এল। অকুতোপায় ও নাচার হয়ে আমি শতরঞ্জিতেই খেলার যাবতীয় সরঞ্জাম ছুঁড়ে ফেলে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে কোনও মতে একটা কাছেপিঠের চেয়ার ধরে উঠে বসলাম
আর আমাকে পায় কে ? দেখামাত্রই বসে গেলাম, আশপাশে একটাও লোক নেই । কাঁচি দিয়ে দস্তুরমতো পাকা হাতে কাগজ কাটা শুরু করলাম, দিস্তা দিস্তা হরেক রংয়ের কাগজও তো পড়ে আছে !
পরনের ‘কাষায়’-এর কোণা হাতের তালুতে চাপ দিয়ে কুঁচকে কুঁচকে কোঁচকানো কতক ফুলের পাপড়ি, কোঁচকানো কতক পাতা বানালাম । তারপর আঠা দিয়ে জুড়ে জুড়ে গোলাপ, পদ্ম, কলকে, করবী, হরেক প্রজাতির ফুল, ফুলগাছ বানালাম, ফুল দিয়ে মালা গাঁথলাম।
সে মালা এদের গাঁথা মালার থেকেও বড়। অতঃপর কতক কুমীর তৈরি করলাম, খাঁজকাটা খাঁজকাটা কুমীরের পিঠ, মুণ্ড । সুতো দিয়ে গেঁথে যেন টেনে তুললাম ডাঙায় । ডাঙায় এখন সার সার কুমীর।
শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ তর্জমা করে যে,“কুমীর বি [সং কুম্ভীর; হি কুমহীর; ‘কুমুর’( গ্রাম্য )]।”
“ সুতোয় টান মেরে আমি সার সার কুমীরগুলোকে নাচাতে লাগলাম এই বলে বলে, “কুমীরের মত তার খোপা-মারা-অঙ্গ। নামটি খেজুরগাছ বাস করে বঙ্গ।।”
উঁহু, খেজুরগাছ নয়, খেজুরগাছ নয়, সহসা আমার চোখে পড়ল ৺বাশুলী দেবীর মন্দিরের বাম পার্শ্বে অবস্থিত সিন্দুর-রক্তে রাঙারাঙি ‘হাড়িকাঠ’, ‘হাড়ি- কাঠ’, যা এতক্ষণ কোনও কিছুতে চাপাচুপি ছিল, চোখে পড়েনি।
এখন জনাকতক জনমানুষ মিলে জল ঢেলে হাড়িকাঠ ধোয়ামোছা করছে, বলির নর কী পশু বধার্থে হাড়িকাঠে ফেলা, এমনটা দেখেছি বটে আমাদের গ্রামের শীতলাতলায়, কালীতলায়, অপরাপর গ্রামের ওলাইচণ্ডীতলায়, বড়াম- গরাম-জাহের, ওলাবিবিতলায়।
নর কি পশু নাহোক, কুক্কুট-কবুতর-পায়রা, এমনকি লাউ-কুমড়ো-চালকুমড়ো-শশা-ঝিঙা-চিচিঙ্গা বলি দিতে গেলেও একটা খিলকাঠি সংযুক্ত হাড়িকাঠ চাই-ই-চাই।
সিন্দুরচর্চিত রক্তরঞ্জিত হাড়িকাঠ সন্দর্শনে অতঃপর আমার রক্ত-মজ্জা-হাড় পর্যন্ত হিম হয়ে এল। অকুতোপায় ও নাচার হয়ে আমি শতরঞ্জিতেই খেলার যাবতীয় সরঞ্জাম ছুঁড়ে ফেলে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে কোনও মতে একটা কাছেপিঠের চেয়ার ধরে উঠে বসলাম।
বসতে আর দিল কই ? অচিরেই দুজন ষণ্ডামার্কা লোক এসে টেনেহিঁচড়ে তুলে আমাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে গেল পূজাস্থলে। এবার আমাকেই তো পূজা আর বলি দেওয়ার উপযোগী করে তোলার পালা। যেমনটা দেখেছি বলির আগে ছাগ-মোষ-কুক্কুট-কুঁকড়ো-কবুতর-পায়রা, সদ্য সদ্য রোঁয়াওঠা সাদা মুরগির বাচ্চাগুলোকে তেল-সিঁদুর মাখিয়ে মেথি-হলুদের জল ছিটিয়ে শুদ্ধ, পবিত্র ও বলির উপযোগী খুঁতহীন করে তোলা হয়।
বারংবার “পবিত্র অপবিত্র বা … এতে গন্ধ পুষ্পে ওঁ” বলে মন্ত্র উচ্চারণ করে বামহাতে ঘন্টি নাড়িয়ে বেলপাতা, তুলসিপাতা, ফুল ও ধানদূর্বা আমার গায়েও মুহুর্মুহু ছড়াতে লাগল বুদ্ধেশ্বর লায়া, এতক্ষণে তার পাশে এসে বসেছে বাড়চুনফলির লম্বোদর দলাইও।
ইত্যবসরে একফাঁকে বলিদার লোকটাও তার বলিদানের খড়্গটা জলে ধুয়েপুঁছে হয়তো পূর্বতন রক্তের দাগও মুছে ফেলে সাফসুতোরো করে পূজা পেতে নিয়ে এসেছে পূজাস্থলে। পূজা পেয়ে পবিত্র ও আরও ক্ষুরধার হয়ে সে খড়্গ আজ আমারই ঘাড়ে নিপাতিত হবে।
এক্ষণে, এই মুহূর্তে, আমার বেলায় কে আর বলবে, “চুপ ! কথা কহিও না – খড়্গ আমারই কাছে – চুরি করিয়া রাখিয়াছি।
পূজা শেষও হল, খড়্গও পূজা পেয়ে আরও তীক্ষ্ণধার হল, এখনই তো বলি। তা নয়, পুরোহিত বুদ্ধেশ্বর লায়া ‘পাঁচালী’ অর্থাৎ সেই বিশাললোচনী ‘বাশুলীমঙ্গল’ গীত, যা কীনা এই তো ক রাত আগেই আমার জন্য দাগামারা সেই এক শো ছয়তম কক্ষেই দেখেছিলাম, তা পাঠ করার উদ্যোগ নিচ্ছে সে।
শুরুও করল ‘রুক্মিণীর বাশুলীপূজা’ অধ্যায় থেকে, সুর করে –
“আনন্দিত মানি সাধুর কামিনী
রুক্মিণী পূজে বাশুলী ।
পঞ্চ সখী মেলি দেই হুলাহুলি
শতেক ছাগল দিয়া বলি ।। ”
লম্বোদর দলাইসহ অন্যান্য দোয়ারকিরা খোলকত্তাল বাদ্যসহকারে দোয়ারকি ধরল, “ শতেক ছাগল দিয়া বলি গো, শতেক ছাগল দিয়া…”
এইভাবে ‘বিশাললোচনীর গীত’ শেষও করল বুদ্ধেশ্বর –
“নৈবেকীং বর্ণিতে চণ্ডী জ্ঞাতেন স্বয়ম্ভবা।
সদাস্তু মতিরস্মাকং ত্রিপুরাপদপঙ্কজে ।।
নমস্তে সমস্তে সদেবে সবন্দে
নমস্তে কৃপাম্ভোধিবক্ত্রারবিন্দে ।
নমস্তে ভবাম্ভোধিপারয়িতারে
নমস্তে বিশালাক্ষী মাতর্নমস্তে ।।
।। নমস্তে শ্রীদুর্গায়ৈ নমঃ ।।
।। নমস্তে শ্রীত্রিপুরায়ৈ নমঃ।।
।। শ্রীশ্রী ভবন্যৈ নমঃ।। ”
পাঠ শেষও হল আর কে যেন তার কাছে ছুটে এসে কী যেন বলল, আর সে তড়াক্ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলিদারকে ঘন ঘন ডাকতে লাগল।
♦–•–♦♦–•–♦♦–•–♦
ক্রমশ..
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ৮
❤ Support Us