- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জানুয়ারি ২৮, ২০২৪
মাটি ব্রতের আখ্যান । পর্ব ১১
চোদ্দো পোনেরো হাজারেরও বেশি পরিবার নাকি এখানে ঠাঁই পেয়েছে। গিজগিজ ! গিজগিজ ! নরকরাজ্য। তারপর...
।। ছ্যাতলাকান্ড ।।
।। বায়েরের রোদ্দোর ।।
একটা মানুষকে নিয়ে ক্যাম্পের রিফুজিরা এবং ক্যাম্পের অফিসারেরা বড়োই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে কিছুদিন ধরে। লোকটার নাম নিতাই সরকার।
সরকার মশাই ভিতরে প্রবেশ করলেই সাজো সাজো রব। এ শিবিরের শাসন যাদের হাতে, তারা চায় না যে লোকটা আসে। অনুগত ভলান্টিয়ারেরা ছোঁক ছোঁক গন্ধ শুঁকে বেড়ায়। তারা তিনকাঠির উপরে সরেস। নিতাই কারো ঘরে এসেছিলেন খবর পাওয়ামাত্র দলবেঁধে চড়াও হয় সে ঘরে। জুজুর ভয়ে গ্রস্ত লোকগুলিকে ধমকায় — খবরদার! ওই লোকটা এলে ঘরে ঢুকতে দেবে না। খতরনাক লোক। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে। কথা না শুনলে বিপদ হবে। ঠেলা বুঝবে তখন।
ঘরের লোকেরা মাথা নাড়ে নীরবে। সত্যিই তো, বিদেশ বিভুঁইয়ে মানুষটা যদি আপদ কিছু একটা ঘটিয়ে দেয়! নাকালের শেষ থাকবেনা। হয়তো ক্যাম্প থেকে বের করে দিল। আবার আশ্রয়হারা হয়ে যেতে হবে। এমনিতেই ভয়ে কাঠ, দাবড়ানিতে সে ভয় ভূত হয়ে ঘাড়ে চেপে বসতে চায়।
আবার কেউ কেউ কথা শোনে, মানে না।
নিতাইবাবু কেন যে এত বিপজ্জনক সেটা জানা যায় না আকৃতিতে খর্বই একটু, রোগা,চোখে পাতলা ফ্রেম আর মোটা কাচের চশমা, পরণে ধুতি শার্ট, ধোপদুরস্ত নয়, সাদামাটা, লোকটাকে অনেকসময় চোখেই পড়ে না, ক্যাম্পের মানুষদের থেকে পৃথক করে আবিষ্কার করা যায় না, রঙটাও গাঢ়তর শ্যামলা। এইসবই নিতাইএর কামোফ্লাজে লাগে। দেখতে পেলে ভলান্টিয়ারেরা তাড়া করে। সরকার মশাইএর ঘ্রাণশক্তি প্রবল। আগেই আঁচ পান , পলকে কোথায় যে মিলিয়ে যান টের পাওয়া যায় না। স্বেচ্ছাসেবীরা দাপাদাপি করে ক্যাম্প জুড়ে।
তবু তিনি প্রায়ই আসেন, একাও না, সঙ্গে কয়েকজন যুবকযুবতী থাকে। তাদেরও চালচলন নিতাইএর ছায়ার মতো, হাতে থলি, ভিতরে পুরনো খবরের কাগজের মোটা মোটা গাট্টু, ঠোঙাভরা এরারুট, মোটা কাগজ, তুঁতে। এগুলো দিয়ে যায় ওরা চেনা ঘরগুলোর মেয়েদের, তারা ঠোঙা বানিয়ে দেবে। ওরাই এসে নিয়ে যাবে একদিন অন্তর। একদিস্তা, মানে বাইশটা , ঠোঙায় মজুরির হিসাব-একছটাকি দুপয়সা, দুছটাকি তিনপয়সা, একপো এক-আনা, আধসেরি দেড়-আনা। ওরা বলে— আর কটাদিন এগুলো করুন, হাত পাকা হোক, সেরি দোসেরি বানাতে দেবো। বাঁশকাগজে চা-পাতার ঠোঙাও করতে দেব। ওর মজুরি ভালো। — আবার কারও ব্যাগে থাকে কেন্দুপাতার গাঁটি, টিনের চাপ, ছোটো ধারালো কাঁচি, পেনসিল ছুরি। ওগুলো অনেকের ঘরে আগেই জমা আছে। নতুন কেউ কাজে নামলে যন্ত্রপাতি গুলো দিতে হবে। চাপের মাপে পাতা চৌকো করে কেটে মেয়েরা ভিজিয়ে রাখে কাপড় মুড়ে, ঠোঙার মতোই ভিজে পাতার গিট্টুগুলি নিয়ে যাবে একদিন পর পর। বিড়ির কাঁচামালের একটি। এইভাবে পাওয়া মজুরির আয় ক্যাম্পের বেশকিছু আঁধারমোড়কী ঘরে হাসির আলো , একটুখানি হলেও, ফুটিয়েছে। ওরা বলে নিতাই সরকার কল্কি অবতার।
অবতার বিশেষণটি অবশ্য লোকেরা দেয়নি।এ পরিচয়ে অভিষিক্ত করেছেন চন্দ্রমোহন। একদিন খেদাবাহিনীর তাড়া খেয়ে নিতাই হেমশশীর ঘরে আচমকা ঢুকে পড়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর আবার সকলের চোখের সামনে দিয়েই সুড়ুত করে বেরিয়ে গেলেন। হেমশশীর ঘরে বাহিনীর আস্ফালন তখন প্রায় স্তিমিত হয়ে এসেছে। এতক্ষণ ঠোঁটে কুলুপ চন্দ্রমোহন ফস করে বলে বসলেন — গীতা পড়িছো বাপধনেরা? ভগবান কী কয়েছেন, জানো ? যখুনি এই পৃথিবীতে ধর্মের পথে গ্লানি ফুটে ওঠে তখনই ধর্মের পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্যি তিনি স্বয়ং বারবার আবির্ভূত হন। পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুস্কৃতাম সম্ভবামি যুগে যুগে। বোঝ নাই । তোমরা তো তারে মারি দেবা ।মুশল ছুঁড়ি মারিতে আসিছো।
— এই বুড়ো! — বাহিনীর দাঁত কড়মড়ে আওয়াজ করে। হেমশশীকে ছুটে আসতে হয়, জোড়কর, কাতর বিনয়ে যেন এগিয়ে পড়া লতা, — আপনারা চলি যান বাবারা! অনার মাথাখান ঠিক নাই।
— পাগল! ছেড়ে দে।
মাঝে মাঝে আনিসুর ইসলাম নামের একজন আসে। শোনা যায় নিতাই সরকারের ডানহাত।
আনিসুর বয়সে তরুণ, মুখে নূর নেই। আর একটা ব্যাপার সে যে মুসলমান এ পরিচয় গোপন করে না , কারণে অকারণে সোচ্চারে বলে, যেন এই উচ্চারণে সে জোর পায়।
আনিসুরের একটু ভয় ভয় কিন্তু কিন্তু ভাব ছিল প্রথম দিকে, — নিতাইদা, আপনি তো আমায় ক্যাম্পে কাজ করতে বলছেন, কিন্তু রিফুজিদের বুকে পাকিস্তান হবার সময় থেকে আমাদের জাতের উপর ক্ষোভ ঘৃণা যে জমাট বেঁধে আছে। ওরা কি আমাকে নেবে?
— আমারও যে ভয় নেই তা নয়, আনিস। তবু তোমায় পাঠাতে চাইছি। দেখো ওদের মন আমাদের হৃদয় দিয়ে জানা দরকার। — বলছিলেন নিতাই, — এটা তো মিথ্যে নয়, যে ঘৃনা ওদের আছে, সেটা ওদের এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার পরিনাম। আবার এখানে , এই ক্যাম্পে এসে আর এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লাভ করছে ওরা।আগের বোধটা বদলাবে না নতুন দ্বন্দ্বে? যাও তো ,দেখো।যদি সমস্যা হয় তখন তোমার বদলে হিন্দু বেছে কাউকে পাঠানো যাবে।
আনিসুর কাজে নেমে থ বনে গেছিল। যে সব ঘরে ও ঢুকেছে, তাদের আপনজন হতে পেরেছে প্রথম থেকেই। কোনও আপতিত চেষ্টাচরিত্র করতে হয়নি। হতে পারে নিতাই সরকার জমিটা তৈরি করে রেখেছিলেন। তবুও প্রশ্ন উঠতেই পারে — আনিসুরের নিজের ভূমিকাটি কি ফেলনা!
ওদের ঘরে সে ডাক না পেয়েও ঢোকে , — এলাম গো মাসি, কী পিসি, দিদি, বা বৌদি। — গল্প করতে বসে যায় আসনপিঁড়ি, ঢিলে গল্পের আসর। ফেরার তাড়া নেই, কথা শেষের ইচ্ছেও নেই। সে গল্পের বিষয় আর কতটুকু! পাথর চাল, ডাল, আমরিকি গমের আটা, পেটব্যথা, দাস্ত, বমি— এইসব না-কথা। আরও একটা বিষয় কখনও কখনও বিনা মুসাবিদায়। ক্যাম্পের উত্তর দিকে একটা বড়ো মাঠ, সেটা পেরোলে কংক্রিট পোল ও তারকাঁটার বেড়া আগলানো মিলিটারি ছাউনি। সন্ধের দিকে ক্যাম্পের বউ-ঝিদের কেউ কেউ ও পথের দিকে যায়। অভাবের পেট তাদের, ঘরের বাপ মা, শ্বশুর শ্বাশুড়ি, স্বামী ছেলেমেয়ে কী ভাইবোন ,উদরাময়ে ঢোল হয়ে ওঠা অথবা চিমসে মরা পেট। এভাবে দু চারটাকা তো আসে। ইজ্জত ধুয়ে পেট বাঁচে না। এরকম নষ্ট হয়ে বিনষ্টির গল্প। কখনও কখনও ফেলে আসা ভুখন্ডের স্বপ্নদৃশ্যের মালা — গঞ্জের বাজার ,বর্ষার থই থই জলে নৌকোয় ভাসমান দোকান পসরা, কাঁঠালবাগানে ভামের দৌরাত্ম্য। এইসব গল্পগাছা শুনতে শুনতে আনিসুরের চোখ জ্বলে, মেঘ জমে, জল ভাসায় না । কঠিন তার চোখ।
— আনিচুর বাই ,মিয়ারা খেদাইয়া দিল ,থাকতে দিল না, — আনিসুরের হাতটি ধরে একথা বলেছিল এক বৃদ্ধ।
আনিসুর বিস্মিত হয়ে ভেবেছে — এই মানুষেরা, মাটি হারানো , স্বজনহারা, মুসলিম লিগের দ্বিজাতি তত্ব, ও হিন্দু নেতাদের বিভ্রান্তি ও গোপন প্রশ্রয়ের শিকার। তবু কই এদের তো জাতিদ্বেষ নেই ! যদি থাকতো, তবে মুসলমান সে, তাঁরই হাত ধরে সেই বৃদ্ধ এই খেদ করবে কেন! একটা সত্যের রেখা যেন তার চোখে ভেসে উঠছে। মুসলমানেরা যে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে সেটা ওদের কাছে অবিশ্বাস্য। এমন ঘটনা কি আদৌ ঘটতে পারে! ওদের হতবাক হওয়া তারই জমাট রুদ্ধ বেদনাকে আনিসুর আবিষ্কার করতে পারে।
নিতাই সরকার ঠিক কথাই বলেছিলেন তাকে। পাড়ায় দুই পড়শির মধ্যে কুয়োর জল, গাছের ঝরাপাতা, ছাগলে বাছুরে বেড়া ভেঙে যাওয়া — এসব নিয়ে ঝগড়া হয়। রাগ চড়ে গেলে কখনও কখনও লাঠি বেরোয়। ঠিক নয়, তবু লেগে যায়। কিন্তু এদেশে হিন্দুতে মুসলমানে ধর্ম নিয়ে কোনও বিরোধ স্মরণকালে ছিল না, আজও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। উপরতলার ভাগ্যবেনে বুলবুলিরা আবোলতাবোল কথার কারসাজিতে ভগবান আর আল্লার ভয়ে মরা মানুষগুলোর জীবনযাপনের শুকনো ঘাসে দেশলাই কাঠি ছুঁড়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। নিতাই বলেন , — আমরা যদি মাটিতে রোজ জল দিই, ঘাস শুকোবে না। ছুঁড়ুক না ওরা যত ইচ্ছে বারুদমুখো কাঠি। আগুন জ্বলবে না।
আনিসুর সেদিন সেই বুড়োমানুষটির হাত মুঠোর তাপে সেঁকে ভোরের আজান গেয়েছিল, — ঠিক, নিতাইদা,ঠিক।
সাধনের আজ ফিরতে রাত হয়েছে। হাতে বান্ডিল বাঁধা কাগজ। ঢুকেই খেতে বসে পড়ল।
হেমশশী আজ ওকে রুটি সেঁকে দিয়েছে। কালচে আটা। পাশের ঘরের বধূটির কাছে শিখেছেন— সেঁকার পর রুটি গরমজলে ভিজিয়ে দিতে হয়, রুটি নরম থাকে। আচার্যবাড়িতে পেঁয়াজ রসুনের চল ছিল না। সাধন রাতে আলু,মুলো,পেঁয়াজ ,কাঁচালঙ্কা নিয়ে ফেরে। খাওয়ার সময় কড়মড় করে কাঁচা পেঁয়াজ চিবোয়। আজ প্রথাভেঙে হেমশশী আলু, পেঁয়াজ আর গুচ্ছের লঙ্কায় ঝাল চচ্চড়ি রেঁধে দিয়েছেন। সাধনের গ্রাস চিবুনো দেখে হেমশশীর মাতৃস্নেহ উথলে উঠছে, সাধন খাচ্ছে, যেন সাধন নয় অভুক্ত নীলু।
— খুড়িমা, কাল কাজে বেরাবো না ।
— ক্যানে রে ? শরিল খারাপ লাগতিছে?
— না। কাল কলিকেতা যাব।
— ছ্যাঁত করে উঠলো হেমশশীর বুক। কলকাতা অচেনাপুরী, আজবনগরী নাকি। সে নগর যদি তার বুক থেকে সাধনকেও গিলে খায় !
সাধন বলে চলেছে , — ই ক্যাম্পের অনেকেই যাবে, খুড়িমা, ভয় নাই। গরমেনের কাছে দাবি করতি যাবো। আমাগেরি জন্যি।
— গরমেন তোয়েগের কথা শোনবে?
— শোনবে না। শোনাতি লাগবে। নিতাইদা কয়েছেন। তুমি ওই গুছাখান খোলো। একখান কাগজ নাও। তুমিতো পড়তি জানো।
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১০
❤ Support Us