- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৪
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৩
আবার সেই টুসকিটা বাজে। ওই যে ডাক্তারদের দেখেন, সব ঘুষের মাল, কারো সবটাই জালি, কারো বা পার্ট। এ শর্মাই এজেন্ট ছিল। সে ঠোঁট টিপে হাসে...তারপর
অলঙ্করণ: দেব সরকার
।। ছ্যাতলাকান্ড ।।
বাজে শিঙ্গা বাজিল ডুমবুরু
শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরের জমায়েত দেখে সাধন একেবারে হতভম্ব। মাছি গলবার জায়গা নেই…
আনিসুরের কাছে শুনেছিল, খুব বড়ো সমাবেশ হবে। তাই বলে এমন আকৃতির! এ তার কল্পনার বাইরে। আয়োজকরাও বোধহয় এতটা ভেবে উঠতে পারেননি। সাধনদের ক্যাম্প থেকে আটশো মতো লোক এসেছে। দুপুরের লোকালের প্রায় সবটাই দখল করে নিয়েছিল। সঙ্গে নিয়ে এসেছে নানা মাপের প্ল্যাকার্ড। দরমার উপরে আঠা মেরে পুরোনো খবরের কাগজ সাঁটা, মাঝখানে উঁচু করে ধরার জন্য লম্বা বাতার হাতল। দাবিদাওয়াগুলো লেখা সে জমিনে। সস্তার রং, আলতার গাঢ় লাল, কোনটায় হ্যারিকেনের সিলিংয়ে জমা ভুষোর কালো।
এতগুলো প্ল্যাকার্ড লিখতে অনেক সময় খরচ হয়। লিখবার লোকও দরকার। তাই টেনসিলে খোদাই। শব্দটি সাধন নতুন শিখেছে। জিনিসটা ম্যাজিকের মতো । রবার ক্লথের চাদরে অক্ষরগুলো ফাঁক রেখে রেখে ছুরি দিয়ে কাটা। কাগজের উপরে চাদরটা পেতে তুলো, ন্যাতা, সাইকেল মেরামতির দোকান থেকে চেয়ে আনা স্পঞ্জের টুকরো রঙে চুবিয়ে ফুটে ওঠা অক্ষরের উপর ছোপ ছোপ চাপ মারলেই কেল্লাফতে। সাধনের লেখাপড়া লোককে বলা যায় না। খুড়েমশাই চন্দ্রমোহন সাধনকে ঘাড়ে ধরে বর্ণপরিচয় আর স্লেট পেনসিলের সামনে বসিয়েছিলেন। তখন সাধন বড়োই। ভালো লাগতো না। ভয়ে মাথা হেঁট করে আঁকিবুকি টানতো। এখন শিক্ষিত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হায়া জাগে। সেই সাধন কাজ থেকে ফিরে নিতাই সরকারের ঘরে অনেকগুলি পোস্টারে অক্ষর বসিয়েছে। গোপন গর্বের চারাটি যেন বুকের মাটি পেয়ে হালকা হাওয়ায় দুলছিল। নিতাই আরো একটা ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন। ছারপোকা মারার এসপেরে ডাব্বায় একটু বেশি গোলা তরল রং ভরে পিচকিরির হাতলটা ধরে পুচপুচ করলেই প্ল্যাকার্ডের লেখা তৈরি। সময় কম লাগে ঠিকই রং সামান্য বেশি খরচ হয়।
মেয়েরা এসেছে সাধনদের সঙ্গে। কিশোরী, যুবতী, বউ, বয়স্কা মা মাসি পিসি। সাধনের সকলের সঙ্গে চেনাপরিচিতি নেই। ক্যাম্পের কোনদিকের ঘরে এদের বাস ঠাওর করা মুশকিল। কয়েকটি চেনামুখ, চোখে চেনা, কথা হয়নি তেমন, নিতাইয়ের ঘরে আসা যাওয়া করে। ওদের একজন সেই সুবাদে সাধনের দিকে হাসি বিছোলো। সাধন ভাবতে থাকে যারা ক্যাম্পের বেড়া ডিঙিয়ে বাইরে বেরোতে সাহস পায় না, তারাই আজ এতদূরে অচেনা কলকাতায় পা মেলাবে তালে তালে। একটু ভয় আছে চোখে মুখে, সংকোচে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর হাত শক্ত করে ধরে আছে, ছাড়ছে না কিছুতেই, দলছুট হয়ে যায় যদি! তরাস চেপে দুজনেই জোর করে হাসে। ফুটিয়ে তুলতে চায় ভয় তাড়াবার জেদ। এসব দেখে সাধনের মনে হচ্ছিল, খুড়িমাকে নিয়ে এলে হতো। মনে পড়েনি বলে আফশোষ হয়। নিয়ে যেতো সবার আগে হাতে ধরে। কলকাতা দর্শন হয়ে যেত খুড়িমার।
নিতাই সরকার, আজ পাজামা শার্ট , কাঁধে ব্যাগ, ছোটাছুটি করছেন। বৌদিও এসেছেন, মেয়েদের কাছে এসে দাঁড়ালেন, কথা বলছেন…
কলিকেতা জেয়ন্ত নগরী, সিখানে জাগর কালির থান। ওই নগর রবি ঠাকুরের, স্বামীজির। এ নগর জিন্না সায়েবেরও, ওখানেই মনুমেন্টির নিচি মিটিংয়ে ঘোষনা করি দেলেন লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। এ নগর গান্ধি মহাত্মের— এখানে বেলিঘাটায় মসুলমান কোতল হল, ছুট্টে আলেন তিনি, বসি গেলেন অনশনে, কলেন এ তাঁরই পাপ। উলটি কোতল হল নুয়াখালিতে। কলকেতা থেকি গান্ধি দৌড়ি আসিছেলেন রক্তে পেছিল মাটি কাদায়।
চোখের সামনে কেবল লোকের মাথা, কালো সমুদ্রফেনার মতো। তবু তো ক্যাম্পের সকলে উজাড় করে আসেনি। সাধন লোকের কথা ভুলে গেল, সে কলকাতার কথা ভাবছে। চন্দ্রমোহন বলেছিলেন — কলিকেতা জেয়ন্ত নগরী, সিখানে জাগর কালির থান। ওই নগর রবি ঠাকুরের, স্বামীজির। এ নগর জিন্না সায়েবেরও, ওখানেই মনুমেন্টির নিচি মিটিংয়ে ঘোষনা করি দেলেন লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। এ নগর গান্ধি মহাত্মের— এখানে বেলিঘাটায় মসুলমান কোতল হল, ছুট্টে আলেন তিনি, বসি গেলেন অনশনে, কলেন এ তাঁরই পাপ। উলটি কোতল হল নুয়াখালিতে। কলকেতা থেকি গান্ধি দৌড়ি আসিছেলেন রক্তে পেছিল মাটি কাদায়।
ঘোর ভেঙে যায় সাধনের, নিতাইয়ের হাত তার কাঁধ ছুঁয়েছে — কী, সাধন! ভয় লাগছে বুঝি?
হাসলো সাধন মুখ ভরে, — না, নিতাইদাদা, ভয় লাগবে ক্যান?
মাইকে ঘোষনা হচ্ছে।
— বন্ধুগন, এবার আমাদের মিছিল শুরু হবে। সামনে হেঁটে নেতৃত্ব দেবেন অম্বিকা চক্রবর্তী, বলাই রায়, ও ইন্দুভূষণ সাহা। শান্তিপূর্ণ ভাবে এ মিছিল রাজপথের বাঁদিক দিয়ে দু-সারিতে যাবে। সবার আগে হাঁটবেন গানের দল। ওঁরা এসেছেন আমাদের আন্দোলনে শক্তি জোগাতে। তারপর থাকবেন নদিয়া জেলা থেকে আসা বন্ধুরা। প্রথমে কুপার্স, পরে ধুবুলিয়া, তারপর পিজরাপোল ক্যাম্পের বন্ধুরা দাঁড়াবেন। এরপর…
সাধন সকলের সঙ্গে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল। আনিসুর তাদের দেখভাল করে নিয়ে যাচ্ছে। সাধন দেখলো গানের লোকেরা একটি ভ্যান রিকশায় হারমোনিয়াম বসিয়ে রেখেছে। ঢোলক, ঝাম, অন্য বাদ্যযন্ত্রগুলো কারো গলায় ঝোলানো, কারো বা হাতে। তাঁরা দাঁড়িয়ে ঠিকঠাক করছেন। প্রস্তুতির পালা । দলে বেশকিছু মেয়েমানুষ।
আনিসুর সাধনকে বললো — দেখো, দাদা, ওই গানের দলে যাঁরা এসেছেন, অনেকেই রেডিওতে গান করেন, কলের গানে রেকর্ড বাজে। ওই যে লোকটাকে দেখছো, ওঁর নাম দেবব্রত বিশ্বাস, সবাই বলে জর্জদা। বাজের মতো গম্ভীর ওঁর গানের গলা। তাঁর পাশে রোগা মতো, হাতে ঘুঙুর, উনি হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সিলেটের লোক, পল্লীগানের ভান্ডারী। ওনার পেছনে মন্টুদা, ভালো নাম সুবীর ঘোষ। ওপাশের মহিলা পূরবী মুখার্জি। ওই যে বিড়ি খাচ্ছেন, ওঁর নাম ঋত্বিক ঘটক, নাটক করেন, ভবিষ্যতে সিনেমা তৈরির স্বপ্ন দেখছেন।
— ওই হাতে-বাঁশি লোকটা কে?
— উনি খালেদ চৌধুরি, ছবি আঁকেন, গান করেন, নাচতে জানেন। সব জানেন উনি। মজা জানো, ওঁর বাবা মা হিন্দু, বড়ো ঘরের পরিবার, আশ্রয় নিলেন মুসলমান বাপ-মায়ের ঘরে। আরো মজা, ইসলামি নাম হল কিন্তু তাঁর আব্বু তাঁকে কলমা পড়িয়ে ধর্মবদল করালেন না। উনি হিন্দুও না, মুসলমানও না। এই ভাগ করা দেশে তিনি একমাত্র মানুষ ধর্মের লোক শরীর নিয়ে। মণিকুন্তলা সেনকে দেখো, বাংলার অগ্নিকন্যা, গল্প করছেন সাধনা রায়চৌধুরি ও মহম্মদ জ্যাকেরিয়ার সঙ্গে।
সাধন নিঃসাড় হয়ে গেছিল। হাঁ করে দেখছিল। মনে করছিল, এ এক আজব কান্ড কারখানা। একটা ট্রাম টিং টিং বাজাতে বাজাতে এগোবার চেষ্টা করছে । সেই ধ্বনিই যেন সংকেত। নড়ে উঠল মিছিলদেহটা, পা নড়লো। এবার হাঁটা। অতি ধীরে। চত্বর ছাড়িয়ে তিনমুখো রাস্তা, দুপাশে অতিবপু অট্টালিকার দল পরপর দাঁড়িয়ে। কৌতুহলে ইতিউতি চাইছিল সাধন। বাবা রে বাবা ! দোকানও এত বড়ো হতে পারে! লম্বা সাইনবোর্ড। বানান করে করে পড়ছিল সাধন, লোয়ার সার্কুলার রোড। ঠিক তখনই গর্জন উঠলো দিগন্ত কাঁপিয়ে — ভিক্ষা নয়, ডোল নয়, দিতে হবে পুনর্বাসন।
ইমারত গুলির অলিন্দে অলিন্দে লোক । ফুটপাতে ব্যস্ত কলকাতা স্হবির হয়ে দেখছে। ওরা কি ভাবতে পেরেছিল যে ভিটে হারানো জীবেরা একদিন দাবি আদায়ের জন্য রাজপুরীর রাজপথে পায়ে পায়ে প্রতিধ্বনি তুলবে !
আরও কারা সব মিছিল করে এসে মিশে যাচ্ছে, ফেস্টুনে লেখা বঙ্গীয় প্রাদেশিক ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস, বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন, সারা ভারত কৃষক সভা, ছাত্র ব্লক, ক্রান্তি শিল্পী সংঘ আরো কত! আবার গর্জন উথলে উঠলো, — মানুষ আমরা পশু নই । সরকার নীরব কেন ?
নিতাই সরকার দুই সারির মাঝখান দিয়ে দ্রুত একবার হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছেন, আবার তেমনি পিছনে হাঁটছেন । আনিসুরও । এখন সে ঠিক সাধনের পাশে, কথা বলছে চাপা গলায়, — অম্বিকা চক্রবর্তীকে দেখতে পেয়েছো? ওই যে হাফহাতা শার্ট পরে রয়েছেন ।
— আচ্ছা ।
— জানো উনি কে ? চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুঠের কথা শুনেছো তো? উনি তার নেতা ছিলেন ।
— খুড়েমশাই আমারে বলিছেলেন, নিতার নাম মাষ্টেরদা ।
সভা থেকেই পঞ্চাশজনের দল তৈরি হয়েছে । অম্বিকা চক্রবর্তী ও গোপাল বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ওরা রাইটার্স বিল্ডিং গেছে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে স্মারকলিপি দেবে । এদিকে একটু একটু করে জমায়েত তরল হচ্ছে । সাধন কেমন অবশ হয়ে ছিল, এখন তাঁর ভাবনা এলো, এত লোকের পা ও মাথা দেখেছে সে
— সাধনদা, একটা বিপ্লব বলো, বিদ্রোহ বলো, একজন নেতাকে দিয়ে হয় না । সূর্য সেন ছিলেন নেতাদের নেতা, যেমন রাশিয়া দেশের বিপ্লবে লেনিন ।
সাধনের কাছে এই ব্যাখ্যাগুলো কঠিন লাগে, তাঁর মোটা মাথা । আনিসুরেরা কতকিছু জানে । আনিসুর মনে হয় সাধনের অস্বস্তিটা বুঝতে পারে, সাধনের পিঠে আলতো চাপড় মেরে এগিয়ে গেল ।
অগণন পা চলেছে তালে তালে, সৈন্যদলের মতোই শৃঙ্খলায় বাঁধা কদম । সে তালে লয়েই গান হচ্ছে — ঝঞ্ঝা ঝড় মৃত্যু দুর্বিপাক, ভয় যারা পায় তাদের ছায়া দুরে মিলাক ।
মনুমেন্টের সভায় গান গাইলেন কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাস । অন্ধ মানুষ । দেশ ছেড়ে এসেছেন কারও হাত ধরে । গাইবার অপরাধে পাকিস্তান সরকার তাকে জেলে পুরে রেখেছিল । এখন ঠাঁই পিঁজরাপোল ক্যাম্পে । পি এল । আজ কলকাতাবাসী তার মাটিলেপা গোবরসোঁদা গানের গন্ধ পেল । সভা শেষ হতে হতে সন্ধ্যা হয় হয় । শীতকাল । বিমল মজুমদার মাইক্রোফোন মুখে হু হু কেঁদে ফেললেন । সভা থেকেই পঞ্চাশজনের দল তৈরি হয়েছে । অম্বিকা চক্রবর্তী ও গোপাল বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ওরা রাইটার্স বিল্ডিং গেছে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে স্মারকলিপি দেবে । এদিকে একটু একটু করে জমায়েত তরল হচ্ছে । সাধন কেমন অবশ হয়ে ছিল, এখন তাঁর ভাবনা এলো, এত লোকের পা ও মাথা দেখেছে সে, এই শক্তি যদি আগে দেখাতে পারতো, তবে খুড়িমা খুড়েমশাইকে আতান্তরে ভেসে হারাতে হতো না ।
নিতাই সরকারের ঘরে যে মেয়েটি খুবই আসা যাওয়া করে, মুখের চোপায় সকলেই ভয় করে তাকে, নাম রমা, এসে দাঁড়িয়েছে সামনে, দুহাত কোমরে, যেন যুদ্ধং দেহি — সাধনদাদায়, বইসা আছেন ? অহনও? ক্যান? মিটিন কি দুইবার অইবো? উটেন, উটেন । লন ।
সাধন ওঠে, পেছনের বসন ঝাড়ে, একটু সংকোচ, সামনে মেয়ে তার । হাত, পা একটু নাড়িয়ে নেয় ।
রমা বকে চলেছে, — আটটায় । শিয়ালদরে । লুকালটা দিছে । আনিসদাদায় কইয়া পাঠাইলো । ওই টিরন ধরতে না পারলে এক্কেরে নিশুতি রাইত । তহন আবার কেম্পের শয়তানগুলা ! চামুন্ডাগুলার হাতে পড়বেন । কথা কানেনি যাইতেছে ? এউড্যা আলসেইম করেন ক্যান ? আমাগো এউগ্যা আপুদবিপুদ ঘটাইবেনই আপনে । লন পা চালান ।
♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১২
❤ Support Us