- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- মার্চ ১৭, ২০২৪
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৮
চারমাস কেটে গেছে হেমশশীর। পথ তাকে ডাকছে মন তাকে বেঁধে রাখছে। প্রতিদিনই ভাবছেন, আজ শুভক্ষণ। তবু কোন পিছুটান তাকে আঁচল ধরে টানে। বাঁধন ছিঁড়তে চাইছেন, পারছেন না...তারপর
অলঙ্করণ: দেব সরকার
।। ছ্যাতলাকান্ড ।।
ব্রজে রজে
ভোরেই স্নান সেরেছেন হেমশশী। পুকুরের কালো জলে দেহ শীতল। রোজই করেন, আজ স্নিগ্ধতা যেন অধিক। লঘুভার লাগছে, মনে হচ্ছে কালব্যাপী পাষাণভার বুক থেকে নেমে গেছে। ফিরে আসছিলেন, দেখলেন কোনো কোনো ঘরে সাড়া জেগেছে, বেশিটাই নিদ্রাচ্ছন্ন। আহা, ঘুমাক ওরা, ঘুম মানেই তো শান্তি। পরনে ভেজাকাপড় জড়ানো। জীবনপথের শেষ দুয়ারের দিকে এগিয়ে চলেছেন, আবরু নিয়ে মাথাব্যথা কারোরই নেই। তবু সম্ভ্রম রাখতে একফালি থান উড়নি সাজিয়ে উর্ধাঙ্গ ঢেকেছেন। দুই একটি উলঙ্গ বা প্রায় উলঙ্গ বালক বালিকা তাকে দেখে— ঠাকুমা, ঠাকুমা—ডাকলো। হেমশশী ওদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন। ফিরে কাপড় ছেড়ে শুদ্ধ হলেন তিনি।
সাধন রমার ঘুম এখনও ভাঙেনি।
দাওয়াতে এককোণে ক্যাম্প অফিস থেকে টিন চেয়ে এনে সাধনকে দিয়ে নিজের জন্য খুপড়ি বানিয়ে নিয়েছেন। সাধন রমা কড়া আপত্তি তুলেছিল। তিনি অনড় ছিলেন — আর কয়টা দিন তো রে, বাপ। কুঠা তো হয়ি গিছে পিরায়। আমার জন্যিও তুলিছিস। ওরে, আমারে যে রাজার মা করি রাখতি চাস। বুঝি নে?
সাধনের রাগ হয়েছিল — এমনি করিই যদি কাঁদবা তয় তোমারে ফ্যালায়ে দুইজনে চলি যাবো।
—আমি জানি, বাপ, খুড়িমারে তেয়াগ করি তুরা কুথাও যাতি পারবিনি নে। তোর যে দায় ঠেকিছে, মাত্তিরি দায়।
রমা এসে বসেছিল পাশে। শ্বাশুড়ির হাতে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। প্রথম রোদ্দুরটা এসে পড়েছিল গায়ে। বর্ষা আসি আসি, দুদিন ফিসফিসিয়ে বৃষ্টি হল, তবুও রোদটা ভালো লাগছিল হেমশশীর সেদিন।
সময়ের এই ফাঁকটুকুতে রমা উঠে পড়েছে। হেমশশীকে দেখতে পেয়ে লজ্জা পায়, ছি,ছি বউ মানুষের এমন যমঘুম ভালো নাকি!
হেমশশী বউকে চেয়ে চেয়ে দেখছেন। নিজেকেই ফিরে পাচ্ছেন যেন। রমা কিশোরী নয়, বছর আঠেরোর ধিঙ্গি। তবুও যেন ওকে ত্রয়োদশী মনে হচ্ছিল তার। সেই সে দিনে শ্বাশুড়ির ভয়ে তড়িঘড়ি চৌকি থেকে নামিয়ে, চন্দ্রমোহন আঁচল টেনে ধরেছিলেন।মরুচে স্মৃতি ঠোঁটের কোণে হাসি আঁকলো। শুনতে পেলেন রমা সাধনকে ডাকছে — এই উঠ, বেলা হইয়া গেল। তুমি না আইজ চরগাঙপুরে যাইবা। কইয়া রাখছিলা। কী গো, উঠবা তো!
হেমশশী রমাকে সেই কুঠুরিতে ডেকেছেন।
রমা এসে বসে। খুড়িমা বোধহয় বলবেন কিছু। হয়তো সংসারযাত্রার নিয়মাবলী। শ্বাশুড়িরা নতুন বউকে নিয়ে যা করে থাকেন। হেমশশী রমার কাছে আগে যা ছিলেন, আর এখন যা আছেন— দুইয়ের মধ্যে অনেকখানি ফারাক হয়ে গেছে যে। ছিলেন সাধনদার খুড়িমা, এখন নিজের শ্বাশুড়ি। আজকের হেমশশী ওর চেনা নয়। এ-ঘরে আসার সময় মা পই পই করে বলে দিয়েছিলেন — শ্বাশুড়ির মন বুইঝ্যা চলবি, ডাকাইত্যাপনা করবি না। তর স্বভাব তো ভালো না। উনি সাত্ত্বিক মাইয়ামানুষ। অমন দুগ্গাপুতিমার লাগান রূপ অখনও ঝরে নাই।— চুপ করে গেছিলেন মা। ভয়, সংশয়, কন্যাবিদায়ের বেদনা একাকার হয়ে যাচ্ছে তখন, দেখিস, মা, পানে চুনে য্যান গসাগসি থাকে। আমরায় ছুটো জাইত। নমশুদ্দুরের ঘরে যাইতাছস ঠিকই আছে। কিন্তুক,তর শাউড়ি যে উচ্চবংশ। সাবধানে থাকিস রে, মা। এইবার তরে নিয়া ডর লাগতাছে মনে।
এত সতর্কবাণী রমার মনে থাকে না। খুড়িমা যেন কেমন। এখনও রমা এঘরে ভাত রাঁধেনি। খুড়িমাই করেন, ও গুছিয়ে দেয়।তিনি বলেছেন, আরও কটাদিন যাক, নতুন বউয়ের আড়মোড়া ভাঙুক। তারপর স্বামীর খাবার রাঁধতে হবে বইকি।
রমা সাহস করে একদিন বলে বসেছিল — আমি রানলাম, তুমি খাইলা না তাইতো।
হেমশশী তৎক্ষণাৎ রমার মাথায় স্নেহের হাতটি রেখেছিলেন, কপালে অগেছালো উড়োচুল যথাস্থানে ঠেলে দিয়েছিলেন — দুঃখু পায়ো না, মা। বারোজাত, ছত্তিশজাত যে আমার নাই। উয়ের ভন্ডেমি তুমার শ্বশুর ঝাঁটায়ে দেছেন। মুক্তেকান্দিতে তেনার আপন ইয়ের ছেল জয়েন ঠাকুরপো। তেনার বিবি কুলছুম আমার সই। ইবাড়ি উবাড়ি ভালোমন্দ পাক হলি বাটিচেলান য্যাতো। তুলসিপাতা ছুঁয়ানের গরজ পড়ে নাই। বউমা, খাবার হতিছে স্বয়ং ভগবান। তেনার জাতি নাই।
পুটুলিটা রমাকেই খুলতে হয়েছিল। সে হতবাক। ভিতরে সোনার গয়না। নিরন্নদের কাছে গুপ্তধনের ভান্ডার। বালা-চূড়-হার-চুড়ি। সবই অল্প অল্প। হুকুম মেনে সেগুলোকে সমান দুভাগে ভাগ করেছে রমা। একখান থেকে হেমশশী একজোড়া ঝুমকো পাশা তুলে নিলেন — ইটা কানিতে পরবা, বউমা। বরণের সমায় দিয়া ওচিত ছেল
রমার লজ্জা লেগেছে, মুখ মেঝের কালোতে, ছিঃ ছিঃ, কী ছাইভস্ম ভেবেছিল সে। তখনও হেমশশীর হাত ওর মাথায় বিলি কাটছিল।
— খাতাম, বউমা। বউয়ির সিবা কোন শাউড়ির ভালো না লাগে! কিন্তুক খাবো না। একবিলা হবিষ্যেণ্ণ ফুটোয়ে খাবো।
— ক্যান, শরীরটা বাচবো ক্যামনে?
— সঞ্জম করতি লাগবে। তিনি যে নেদ্দেশ দেয়ি গেছেন। তাঁরে যে কখুনও ছাড়তি পারবানে না।
— হেমশশীর দুচোখ নিভু দীপালোক।
রমা চুপ থাকে, শেষে বললো, —আমি যদি তুমারে মা ডাকি, গুসা করবা?
—যদি সাধ চায়, কবা। সাধনতো আমার বিটাই। গভ-ভে ধরলিই হয় নাকি? পেটিরখান কুথায় হারায়ে গেছে। সাধন আমারে আগলোয়ে রাখিছে।
এগুলো সদ্য পুরোনো কথা, কালকের, পরশুর। এখন রমা বসে আছে ওইরকম, হেমশশীর পায়ের কাছে। তিনি ডেকেছেন।
অবশেষে হেমশশীর আদেশ এলো। ঘরে একটা টিনের ট্রাঙ্ক আছে। চাবি লুকোনো আছে লক্ষ্মীর ফটো বসানো ছোট কাঠের টুলে, ফটোর পিছনে, খেলনা কোলবালিশ দিয়ে ঢাকা।ছোট্ট তালা খুললে পাওয়া যাবে একটা পুঁটুলি। সেটা এনে দিতে হবে।
পুটুলিটা রমাকেই খুলতে হয়েছিল। সে হতবাক। ভিতরে সোনার গয়না। নিরন্নদের কাছে গুপ্তধনের ভান্ডার। বালা-চূড়-হার-চুড়ি। সবই অল্প অল্প। হুকুম মেনে সেগুলোকে সমান দুভাগে ভাগ করেছে রমা। একখান থেকে হেমশশী একজোড়া ঝুমকো পাশা তুলে নিলেন — ইটা কানিতে পরবা, বউমা। বরণের সমায় দিয়া ওচিত ছেল। ঘরভরা লোকের সুমুখে বার করতি পারি নাই। ইবার দুডে পুঁটুলিই আলাদা করি বাঁধে রাখো। একখান তুমাগেরে আরেট্টা — চোখ বন্ধ করলেন — দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো — যদি কুনওদিন নীলু, নীলুর বউয়ের সাক্ষেত পাও তাগেরে দিবা। যদি না আসে, রাখি দেবা। যখুন তুমার ছাবালের বউ আসবে, তারে দিও। — কী হচ্ছে এসব রমা বুঝতে পারছে না — ইবার আমার ঘরের কাম ফুরেলো। বউমা ঘর থেকি সরাখান নাও, দেখো উয়ের মধ্যি তেলকমাটি রইছে, একটা আনবা, বাকিগুলান লক্ষ্মীর পায়ে রাখি দেও, সরাটাও আনবা, গিলাসে এট্টু জল দিবা।
যত্নে কপালে ফোঁটা দিলেন হেমশশী। অন্য কোনও রসকলি আঁকলেন না। সরা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
প্রবল বেত্রাঘাতেই যেন হুঁশে ফিরলো রমা। হাহাকার করে ওঠে — মা, ও মা, এ তুমি কী করতে চাও! ভ্যাক নিতাছো নাকি? ওইয়া ক্যান করো? তোমার পুলায় আমারে মাইরা ফেলাইবো। এইয়া কইরো না, তোমার পায়ে কুটি। আ-টাল এখন রমা। কন্ঠ তেজে চড়ালো — ওগো শুনতাছো ! কই গেলা? শিগগিরি আসো। মায়ে য্যান কী করে! রমা হাপুস কাঁদছে।
সাধন হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায়।
— কায়ন্দো না, বউমা। সাধন, তুই ভাবিস নে যে ভিক্ষি করতি বেরালাম। আমি যাতিছি পথে। তেনার নেদ্দেশ যে রে। না মানি ওপায় নাই। গান গায়ি তেনারে খোঁজতি হবে। ছাড়ান যে যাবে না। আমার যে পিতিজ্ঞে। — সাধনের মাথায়, রমার মাথায় হাত রাখলেন — আমি ছাবাল বউমারেও ছাড়ি যাতি পারবোনে না। বেশি দূরি যাবনে না। ফিরি আসবো।
হাঁটছেন হেমশশী মহকুমা শহর রানাঘাটের কালো রাস্তায়। পিচ-তাওয়ায় পাদুকাহীন পা সেঁকে যাচ্ছে। হাঁটছেন তিনি। একবাড়ির দরজায় দাঁড়ালেন, — মা, এট্টু নামগান করবো। ভালো লাগলি সিধে দেবেন।
মাপ করো।
হেঁটে চলেছেন দরজার পর দরজা, — মা, নামগান…।
— হাতজোড়া…আমরা ভিক্ষা দিই না, … ভিক্ষা করতে লজ্জা করে না, … খেটে খাও,… প্রেস্টিজ কত, … হু… কত ফ্যাশনই না দেখবো,… যতরাজ্যের রিফুজি এসে দেশটাকে নষ্ট করে দিল, …যেখানে যাও ভিখিরি, …গাইতে টাইতে হবে না, একপয়সা দিচ্ছি, ভাগো, … বাঙালের বাচ্চাগুলো …।
এই তো পথ। ঘৃণার আগুন তাকে দগ্ধ করছে না, বেদনাবিদ্ধ করছে না। এ তার পরীক্ষা। তপস্যার ব্রত যে কঠিনই। হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ালেন এক বাড়ির সামনে, ছোট বাড়ি, দোতলা, সুন্দর গড়ন, লোহার ছোট গেট, উপরে চন্দ্রাতপ মেলে দাঁড়িয়ে আছে বিস্তৃত বোগেনভিলিয়া, লাল-নীল-খয়েরি-হলদে-বেগুনি ডাল ভরে হাসছে ফুলেরা। গেটের মুখে একটা বোর্ড — পূর্ণিমা সঙ্গীত সম্মিলন, সঙ্গীত শিক্ষালয়, শিক্ষক পন্ডিত শশধর চট্টোপাধ্যায়, ক্লাসের সময় শুক্রবার ও শনিবার সন্ধ্যে ছ-টা। আস্তে গেট খুলে ডাকলেন হেমশশী — মা …।
— কে? — ভিতর থেকে মহিলার স্বর।
তারপর সেই একই কথা— নামগান, সিধে।
যুবতীই বলা যায় তাঁকে, বেরিয়ে এসেছে, — গাইতে হবে না এই নিন।— হাতে তাঁর সিকি।
— না, মা, …।
— কেন?
— মা, এ ভিক্ষি নয়, মাধুকরী। মধুর সঙ্গি যে সম্পক্ক, মা।
উপর থেকে ভারী গলার আওয়াজ আসে, — বউমা, কী হয়েছে ?
— দেখুন না,বাবা, একজন ভিক্ষে করতে এসেছেন। বলছেন, গান শোনাবেন। ভালো না লাগলে ভিক্ষা নেবেন না।
— আসছি, ওনাকে ভেস্টিবিউলে বসতে বলো।
নেমে এলেন তিনি। সৌম্যদর্শন, প্রৌঢ়, আঙুলবাঁধা নাতিই হবে বছর ছয়েকের। বললেন, — আপনার কথাই রইলো।
হেমশশী চোখ বুঁজলেন, ঈশ্বর যেন শক্তি দেন, ঢাকার সেই ছেলেবেলার গুরুজি যেন আশীর্বাদ করেন। প্রথমে একটু কেঁপে উঠলো গলার ভিতরটা, তারপর তান বেজে উঠলো পঞ্চমে —
তুমি পথে এসে দরশ দাও হে
জীবন বঁধুয়া গগন ভোর
(আমি) অভাগিনী নারী সহিতে না পারি
বিরহযাতনা হে প্রাণেশ্বর। …
পথচলতি মানুষেরা দাঁড়িয়ে পড়েছে বাইরে। কেউ কেউ দরজা খোলা দেখে সাহস করে টব সাজানো ছোট্ট আঙিনায় ঢুকে পড়েছে।
শশধর বাবুর মনে হল, সবাই গান করেন, ইনি গাইছেন। পুত্রবধুকে ইশারায় ডেকে কানে কানে কী বলতেই সে উপরে চলে যায়। এবারে শশধর বাবু বললেন — আরেকটা শুনতে পাবো না ?
বধূটি ফিরে এসেছে, একহাতে চায়না ক্লের প্লেট, উপরে পিতলের ঘটিতে জল ঢাকা, অন্যহাতে ছোট একটা টুকরি, সেটায় পাঁচপোয়া চাল, ঠোঙাবাঁধা মুগ ও মটর ডাল, কিছু সবজি, কাঁচালঙ্কা, ছোট্ট শিশিতে সরষের তেল, কাগজের মোড়কে লবন ও চিনি, এবং একটি দুটাকার নোট।
জল বাতাসায় গলা ভিজিয়ে হেমশশী আবার শুরু করলেন —
কোন বিধি সিরজিল সোঁতের শেওলি
এমন ব্যাথিত নাই ডাকি বন্ধু বলি।…
শশধর জিগ্যেস করলেন, — ঠাকুরাণী, আপনার বাড়ি কোথায়?
— বাড়ি আমার পথ। আস্তেনা আপনাগেরি শহরের কেম্পিতে।
— আবার আসবেন। গান শোনাবেন। রোববার সকালে আমি ফাঁকা থাকি।
হেমশশী এখন মেঝেতে আভূমি প্রণত — একমাস পরে আসব ই বাড়িতে। হরহপ্তায় আলি বেরক্তি জন্মাবি যে। মাধুকরীতি কলুষ দিতি নাই।
শশধরের নাতিটি অতশত বোঝে না। তার মনে হল কিছু একটা বলা উচিত। চোখ বড়, ঠোঁট ফোলা, বললো সে— আসবে তো, ঠাকমা?
হেমশশীর হাসলেন অমৃত ছড়িয়ে, চোখে আষাঢ় মাস। শিশুটির থুতনিতে হাত রাখলেন — কেষ্টঠাকুর, তুমি আদিশ করলি রাধারানী কি না আসি পারে?
♦–♦♦–♦♦–♦♦–♦
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১৭
❤ Support Us