Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • মার্চ ৩১, ২০২৪

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২০

ভূমিষ্ঠ হল হকার্স কর্ণার । সকালে পালবাবুরা লোকলস্কর খাঁকি-উর্দিদের নিয়ে ছুটে এলেন । শেষে ভদ্রলোকের চুক্তি হল। দখলি দোকানের ঘরের মাপে মাসে মাসে একসিকি দুসিকি ভাড়া দিতে হবে......তারপর

সুধীরকুমার শর্মা
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২০

অলংকরণ: দেব সরকার

।। কাদাকান্ড ।। 

হিপোক্রিটাসের ডায়েরি

মাতৃ (হোমিও) ঔষধালয়ে রমরমা। দোকানে তিনজন — সেলস কাউন্টারে এক, দুজন কমপাউনডার— একটা, তরতাজা যুবক, অন্যটি মিষ্টি যুবতী, দুজনেই হোমিওপ্যাথি শিখতে ভর্তি হয়েছে কলেজে, এখানে হাতেকলমে শেখার আগ্রহ। দোকানটা লিজ নিয়েছে আগের সেই রবীন মজুমদার। এখন সে রীতিমত ডাক্তার। নেমপ্লেট, দুজন ডাক্তার— ডাঃ এন আচার্য, এইচ এম বি (গোল্ড মেডালিষ্ট– ক্যাল), এম এইচ বি (দিল্লি), এম এইচ সি পি (লন্ডন), এম এইচ সি এম (এডিন), এম এইচ সি এস (ডাবলিন)। এবং ডাঃ আর মজুমদার, এইচ এম বি (ক্যাল)।
 
নীলাম্বর রবীনকে শুধিয়েছিল, — আপনি এত সোনার মেডেল বিলোলেন, নিজে নিলেন না কেন?
 
— ধরা পড়ে যেতাম, দাদা। পদকটাই মিথ্যে হয়ে যেত। আপনার মতো বিদ্যে যে আমার নেই। দেখছেন না, ডাঃ সনাতন মজুমদার, ডাঃ বৈদ্যনাথ গাঙ্গুলি কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছেন।
 
— কী যে বলেন! ঠাট্টা। — মুখে বলে নীলু, অন্তরে অহং পায়। জিভের নিচে হরিতকির টুকরো রাখার মত। প্রথমে একটু কষায়, তারপর এক গেলাস জল খেলেই, আহা, অমৃত।
 
ফার্মেসিতে নীলু চেম্বার করে সপ্তাহে তিনদিন। বাকি দিনগুলিতে রবীনের পালা। চেম্বারের দিন ভিতরে ঢোকার আগে বারান্দায় বেঞ্চিতে বসা, দাঁড়ানো ভিড়। মাথা নোয়াতে হয় নীলুকে। প্রথা। কমপাউনডার একগ্লাস জল রাখে টেবিলে। ফ্লাস্কে রাখা চা ঢালে কাপে। পালাপার্বণ শেষ হলে টেবিলে রাখা স্প্রিং-বেলটিতে বাঁহাতে ঠোকা দেয় ডাঃ আচার্য—টিং টিং। এতক্ষণ উৎকন্ঠ প্রথম রোগীটি তার সঙ্গীকে নিয়ে চেম্বারে প্রবেশ করে।
 

হোমিও জগতে কষ্মিনকালে এমন ঘটনা ঘটেনি । ছাপানো প্যাড, লেটারহেড, বাঁয়ে উপসর্গ ইত্যাদি, নীচে অ্যানাটমিক্যাল স্কেচ, ডানে অনুলব্ধ অসুখের নাম, নিচে গ্রিক, না রোমান দেবতার প্রতীকচিহ্নটি, তারপর ওষুধের নাম ও প্রয়োগবিধি । সবার শেষে তার স্বর্ণাক্ষরী স্বাক্ষর । অমন সই যিনি করতে পারেন, তার পাওয়া সার্টিফিকেট নিয়ে কে সন্দেহ করবে?

 
হোমিও চিকিৎসার চিরাচরিত দুনিয়ায় তিনটি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে নীলু। হোমিও ডাক্তারেরা ভিজিট নেন না, যেমন অ্যালোপ্যাথ এল এম এফ-রা। ওঁরা মিক্সচারে ভিজিটটি জুড়ে দেন। হোমিওরা তাদের পুরিয়ায়। ডাঃ আচার্যের ভিজিট চেম্বারে দু-টাকা, রোগী দেখতে বাড়ি গেলে চারটাকা। রিক্সাভাড়া রোগীর পরিজনদের বইতে হয়। এটি প্রথম বিপ্লব। ডাঃ আচার্য প্রেসক্রিপশন লিখে থাকেন। হোমিও জগতে কষ্মিনকালে এমন ঘটনা ঘটেনি। ছাপানো প্যাড, লেটারহেড, বাঁয়ে উপসর্গ ইত্যাদি, নীচে অ্যানাটমিক্যাল স্কেচ, ডানে অনুলব্ধ অসুখের নাম, নিচে গ্রিক, না রোমান দেবতার প্রতীকচিহ্নটি, তারপর ওষুধের নাম ও প্রয়োগবিধি। সবার শেষে তার স্বর্ণাক্ষরী স্বাক্ষর। অমন সই যিনি করতে পারেন, তার পাওয়া সার্টিফিকেট নিয়ে কে সন্দেহ করবে? তৃতীয়টি একেবারে নিঃশব্দ কীর্তি। তিনি জার্মান কোম্পানির ওষুধ দেন। লোকে বিশ্বাস করে বিদেশে তৈরি ওষুধে কাজ হয় ভালো। ইংল্যান্ড থেকেও ওষুধ আসে বইকি। কিন্তু ডাঃ আচার্য কাজে ব্যবহার করেন না। স্ময়ং হ্যারিকেন জার্মানির মানুষ। অবশ্যই রোগীদের পক্ষে খরচ বেশি পড়ে। তা হোক, রোগীরা ভাবে, ডাঃ আচার্যের দেওয়া ওষুধে গুণাবলী অধিক। উনি ধন্বন্তরী। বাকি থাকলো চারদিন। তারমধ্যে তিনদিন বাসাবাড়িতেই রোগী দেখেন। একদিন পরিবারের জন্য বরাদ্দ।
 
মালদা শহরে ডাঃ নীলাম্বর আচার্যের এই প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে একজনই—ফ্রেন্ড, ফিলোসফার ও গাইড— রবীন। সে বলেছিল, — জানেন, দাদা, লোকেরা যে হোমিওপ্যাথদের একটু নীচু নজরে দেখে, তার কারণ আছে।
 
— কী?
 
— অ্যালোপ্যাথদের দেখুন। কেমন ঠাটবাট ! পাড়ায় পাড়ায় এল এম এফদের বাদ দিন। ওদের ফার্মেসি ব্যবসার দিন ঘনিয়ে আসছে। ধুতি, সাইকেল, হ্যাট, পেটমোটা ব্যাগ আর থাকবে না। এম বিরা সাহেবি কেতায় চলে। ভাবুন, সাহেবরা দেশ ছেড়ে চলে গেল, এদিকে আমরা সাহেব হতে ঝাঁপ দিলাম। মজা বটে। কিন্তু আসল মজা। এটা আমাকে, আপনাকে চিনতে হবে, বুঝতে হবে। নইলে আমরাও কুপোকাত।
 
— ডাঃ গাঙ্গুলি, ডাঃ মজুমদার, দুজনেই যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত।
 
— পসার ছিল। ভালোই ছিল। এখনো আছে। কিন্তু সাহেবি ঘরানাটা নিতে ওঁরা ভয় পেয়েছেন। আপনি জানেন না ওদের গ্রাফ নিচের দিকে নামছে!
 
নীলাম্বর অবাক হয়ে ভাব, মিথ্যার উপর কী অনায়াসে এখন প্রাসাদ বানিয়ে নেওয়া যায়। আদর্শের বালাই নেই। শৈশব থেকে যে শিক্ষা, বা ভাবনার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠেছিল,সব গরসাল হয়ে গেছে। ভয় লাগে নীলাম্বরের। আজ যদি এখানে বাবা
 
থাকতেন, হয়তো শিউরে উঠতেন আত্মজকে নতুন রূপে আবিস্কার করে, হয়তো প্রেতদর্শনের বিবমিষা জাগতো, মুখ ঢাকতে দহন জ্বালায়। ভাগ্যিস এখানে নেই ! কিন্তু, — নীলু ভেবে চলে, — এটাও তো জীবন! এখন এটাই জীবন। এ জীবন মুক্তোকান্দির নির্মল বাতাসে ভাসমান প্রাণকণা নয়, এ জীবন নতুন। খন্ড হয়ে যাওয়া, রক্ত পুঁজ শুঁকিয়ে জমাট ক্ষতপিন্ডভরা দেশের বিভক্ত হওয়ায় টিকে থাকার রসদ খোঁজে। এই কালো পৃথিবীতে বাবাকে দরকার নেই। নীলু চায় না দৈবাৎ কোনও অবকাশে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হোক। বাবা, নীলু আজ নির্লজ্জ। এ জীবন মধুর। তাকে দিয়েছে অস্তিত্বের বীজমন্ত্র। একে সে ত্যাগ করতে পারবে না। স্রোতের বাইরে গেলে সে হারিয়ে যাবে ! অনেক পথ পেরিয়ে মাটিতে শিকড় পেয়েছে, সেটা সে শুন্য হতে দেবে না। বাবা ভেসে গেছেন যেমন। বাবার চিন্তাটা হঠাৎ তাকে নাড়া দিয়ে অস্থির করেছে। মর্ষিত করছে। নীলু জোর করে সব সরিয়ে দিল।
 
রবীন থেমে গেছিল। নীলাম্বরের আনমনা পরবাসী ভাবটা তার চোখে পড়েছে। সে মনে করলো, এই অদ্ভুত ডাক্তারটি কোনো রোগীর কঠিন উপসর্গের দাবাই খুঁজছেন। আবিস্কার করতে চাইছেন মায়াজমের গহন রহস্যটা।
 
একটু পরে তপ্ত দীর্ঘশ্বাসটি বুক খালি করে বেরিয়ে আসার কথা। নীলু নড়ে ওঠে, চেতন ফিরে আসে, — হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন?
 
রবীন দিক বদল করে, — বউদি কেমন আছেন?
 
— আছে, ভালোই।
 
— আর হবু ডাক্তারটা? কত বড়ো হল?
 
— কয়েকমাস বাদে চারে পড়বে।
 
— বাঃ। তাহলে বার্থডে পার্টি হবে নিশ্চয়ই?
 
— না, না। ঘরে ওসব সাহেবি চাল নেই। ওর মা দিদিমা পায়েস করবে। সকালে কাছের কোনো মন্দিরে পুজো দিয়ে আসবে।
 
— ভোজটা তবে মার গেল!
 
হাসে নীলাম্বর প্রাণ খুলে, — আচ্ছা। হবু ডাক্তারের কাকার ভোজ যেন থাকে— আরজিটা আহার বিহারের অধীশ্বরীকে জানিয়ে দেব।
 
রবীন আবার কথার দিক বদলায় — দাদা, আপনাকে একটা এডভাইজ দিচ্ছি। ফলো করবেন, প্লিজ।
 
— আপনার কোন পরামর্শটা শুনিনি, বলুন তো?
 
রবীন বুদ্ধিমান। নীলাম্বর তারিফ না করে পারে না। নানা খুঁটিনাটিতে ওর আশ্চর্য দূরদৃষ্টি। নীলাম্বর কিছু ভেবে উঠতেই পারে না। কেন এমন হয়? তবে কি জীবনের কাম্য বিষয়গুলিতে একমুখী অতি আগ্রহ না থাকাতেই রবীনের এই ভুয়োদর্শন? কোথাও কোনও বিশ্বাস, নিশ্চিতের মূল, হীনতার জন্যই বোধহয় সে ছড়িয়ে আছে চোখ মেলে।
 
আপনজন-চেনামানুষ-দেশ-কাল সম্পর্কে উদাসীন বলেই কি তার কাছে সব স্পষ্ট? রবীন বলছে ডাক্তারবাবুর নিজের বাড়ি হওয়া দরকার। ছোটো বাংলো ক্যালেন্ডারের ছবির মতো, লাল কালি বা রং করা অ্যাসবেসটসের করিডর প্যাসেজ, সামনে লন, একটা ঝাউ, ফরেন ফ্লাওয়ার প্ল্যান্ট, এন্ট্রান্সে আয়রন গেট, পাশের পাঁচিল গাঁথনিতে স্লেট পাথরে নেমপ্লেট। হেসে ফেলে রবীন, — দাদা, মালদা টাউনে জমি কেনাবেচার হিড়িক পড়েছে। দাম চড়বে একটু একটু করে, তারপর লাফ মারবে উপরে, আবার লাফ, লাফের পর লাফ।
 
রবীন একটা কাঠা তিনেকের দাঁও মেরেছে। নিজের টাকা, মায়ের সঞ্চয়, বউয়ের গয়নায় মূলধন। ভিত গড়ার কাজ যদিও শুরু করেনি। ওর মা এজমালি বাড়ি ছেড়ে আসত চাইছেন না। কষ্ট বোধা করছেন— শ্বশুরের ভিটে, স্বামীর ভিটে। রবীন বলে, — কত বোঝাচ্ছি, জানেন? তুমি তো আর দেশ ছেড়ে যাচ্ছো না। এ শহরেই, অন্য পাড়ায়। মায়ের কষ্টটা বুঝি। আপনি বুঝবেন। আপনাকেও দেশ ছেড়ে আসতে হয়েছে। মায়ের কষ্টটা ওইরকমই।
 
নীলাম্বর সবটা বোধহয় শুনছিল না, শুধু দেশ ছেড়ে কথাংশটি কানে আঘাত করে। উদাস চেয়ে থাকে সে। প্রশ্ন করে নিজেকে — সত্যিই কি দেশত্যাগের যন্ত্রণা সে পেয়েছিল? যৌবনের উদ্দামতায় সে সব ছেড়েছে। কষ্ট পেয়েছিল দেশ ছাড়ার পরে, হেরে যাওয়া হতাশায়, যখন গ্লানিমলিন দিনগুলিতে সে আত্মহনণের কথাও ভেবেছিল। স্মৃতি হঠাৎ উদয়ে পীড়া দিচ্ছে নীলুকে। রবীনের উপর সামান্য ক্ষোভও জন্মালো। জমি কেনার কথাটা তার কাছে খোলসা করেনি। কুয়াশাটিকে জোর করে উড়িয়ে দিল এবার— ছিঃ।
 
— আর একটা প্রোপোজাল দিই?
 
— কী?
 
— এ শহরে রোটারি ক্লার হয়েছে। ওটাতে আমি আপনি মেম্বার হবো।
 
— ও তো ধনী লোকদের ব্যাপার।
 
—ঠিক। কিন্তু সুন্দর বাড়ি, রোটারি ক্লাব এগুলো হচ্ছে স্টেটাস সিমবল। দিনের চাকা এত জোরে ঘুরছে যে খেই পাবো না। ধনী হতে তেমন চাইছি না, তবে ধনীসঙ্গ না থাকলে আমরা টিকবো না। আমাদের ডাক্তারি পেশাটা আগের মতো পুজো পুরুতের ভক্তি থাকছে না। খুব হিসেবি চালের ব্যবসা হয়ে যাচ্ছে।
 
মাথা ঝিম ঝিম করে নীলাম্বরের —আপনি করুন যা করবার।
 
ঘরে ফিরে নীলাম্বর বিশ্রাম নিচ্ছিল। পরিশ্রমটা কম নয়। মাথা সদা সর্বদা তাজা আর সচল রাখতে হয়। ফ্যানের রেগুলেটরটা টপে দিয়েছে। তখনই অনেক বছর পর এডভান্সড মেটিরিয়া মেডিকা সুড়ঙ্গ কাটলো।
 
অপচিকিৎসকগণ (এলোপেথিক) দুইচারিটি উপসর্গ দেখিলেন। ঠিক দেখিলেন না। ফস ফস করিয়া ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) রচনা করিতে বসিলেন। উপসর্গ সাময়িক দূরস্থ হইলে উহারা উল্লসিত অহমিকায় নৃত্য করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।উহারা জানিতেই পারিলেন না যে উপসর্গ দমিয়া গেলেই নিরাময় ঘটে না। ব্যাধি রোগীর শরীরে মায়াজম রূপ ধারন করিয়া বাসা বাঁধিয়া আছে। হোমিওপেথি চিকিৎসা মায়াজম সাধনা। হ্যানিম্যান ও কেন্ট, দুই মহাত্মাই, বলিয়া গিয়াছেন যে এই সাধনা জীবনসাধনারই নামান্তর। তাঁহারা ইহার পথপ্রদর্শক আলোকস্তম্ভ। আমরা ক্ষুদ্রমতি হইয়াও এই সাধনার অকাল বারিধিতে ভেলা ভাসাইলাম। সেই আলোকরশ্মি দেখিয়া জীবনসাধনায় আত্মসমর্পণ করিলাম। অপচিকিৎসকগণ সাধনা করেন না, তাহারা জীবন লইয়া জুয়া খেলেন। আমরা সাধক। জীবনের সাধক।
 
গ্রন্থের উপসংহারের শেষ অনুচ্ছেদটি ঢেউ হয়ে নীলুর মনোবালুচরে আছরে পড়ছে। বাবা বইটি হাতছাড়া করতেন না। সে কি এই শেষ বাক্যগুলির জন্যই? মনে মনে আওড়ায় নীলু — টিকে থাকার সাধনা করছিলাম, বাবা। দাঁত চেপে। আত্ম-অসম্মানের আগুনে, ফোসকায়, প্রদাহে। কিন্তু জীবনসাধনা যে বড়ো কঠিন। কেমনতরো, সেটাও যে জানি না। আমার হ্যানিম্যান নেই। কেন্ট নেই। তুমিও যে নেই, বাবা ! — চোখের পাতা ডললেন ডাঃ নীলাম্বর আচার্য, দেখলেন— চন্দ্রমোহন এখন অশ্রুপ্লবতায় ছেলের কাছে আসেন না।
 
স্নেহলতা ঢুকেছিল ঘরে। নীলু টের পেল কপালে নরম হাত পড়লে — কী গো, এমনি করি এলায়ি রইছো! শরিলটরিল…।
 
হাসে নীলু চাপা, — না, টাইয়ার্ড লাগতিছেল, তাই। কিছু কবা।
 
— কতাম একখান কতা। তেয়ার আগি তুমি একখান কথা কও। রুগিপত্তরের সাথি দেশির ভাষায় কও নাকি?
 
— পাগুল হইচো ! তালি রুগীরা ডাক্তার না কয়ে গিরামি বুত কবে। বুতির ওষুধ খাবেনে না। ই দেশিতে মানষির গিয়ানি বা সৎ হওনের দরকার নাই। ইখানে বাঁচতে গেলি মিথ্যি চাই। শ্যালচতোর হতি লাগে। এ দেশির জেবনসাধনা। তুমি কী কতিছেলে?
 
স্নেহলতার কথা খুবই স্বল্প। মালদায় নিউটাউন তৈরি হচ্ছে। ঝোপজঙ্গল বনবাদাড় কেটে সাফ। আস্তে আস্তে ওটাই হয়ে উঠবে কালকের শহর। বাতিল বুড়োবুড়ির মতো একান্তে পড়ে থাকবে পুরনোটা। সেখানে জমি বিক্রি হচ্ছে ‘পলোটে পলোটে’। দাম এখন বেশি নয়। স্নেহলতা কিনতে চায়।
 
— তুমি জানলা কী করি?
 
— ডাক্তার ঠাকুরপো আসিছেলেন।
 
— ও। তা তারে আমাগের খুকাবাবুর জন্মদিনের দিন খাতি নেমন্তন্ন করিছো তো?
 
— তেনায় নিজি যাচি নেছেন — স্নেহলতা হেসে গড়িয়ে পড়ে, এরম ভালোমানুষ ই দেশিতে আমরা পাই নাই, তাই না, গো?
 
— হুঁ।
 
— শোনো, দুইখ্যান পাঁচকাঠা করি পলোট নেবা।
 
— মানে?
 
— কাছাকাছি নেবা। লাগুয়া নেবা না। একটাতি বাবারে মায়েরে কুঠা করি দেব। মেয়ি জামায়ের সোংসারে থাকতি উয়েগের মনি কষ্ট হবে। এটাই নেয়ম। আমাগেরও যে লাগতো, মনি নাই? ত্যাখন তোমার কাম ছেল না।
 
নীলাম্বর আতান্তরে পড়ে। স্নেহর ইচ্ছা। রবীনের উসকানি। বাড়ি করা দরকার। সবই ঠিক আছে। কিন্তু, দশকাঠা!
 
— কি ভাবতিছো? টেকার চেন্তা? আমি দেব। লক্ষ্মীর গটগুলান ভাঙলিই হয়ি যাবেনে। না হলি, আমার বিয়ের গয়না রইছে না! — স্নেহলতা আকন্ঠ জড়িয়ে ধরেছে নীলাম্বরকে, স্পর্শে তার ডাক্তারের বউয়ের অহংকারের উত্তাপ, কেমন মোহময়ী আবিষ্ট কন্ঠস্বর, যেন ফুলসজ্জার রাতের স্নেহ, — শোনো, তোমার নিজির টাকায় একখান ইস্কুটার গাড়ি কেনো। আমার খুকাবাবুর বাপের ইমান নাই?
 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ১৯

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ১৯


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!