Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
  • এপ্রিল ১৪, ২০২৪

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২২

সুধীরকুমার শর্মা
মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২২

।। কাদাকান্ড ।। 

নব নন্দনবন

নতুন বাড়িতে এসেছেন যাদবচন্দ্ররা। হাল ডিজাইনের পাকা বাড়ি, উপরে ঢালাই ছাদ, তিনকামরার একটি যাদবের, একটি স্ত্রীর, অন্যটি ফাঁকাই। এরকম বসত যাদবচন্দ্রের স্বপ্নের অতীত ছিল। সামনে বেশ বড়ো উঠোন, গাঁথনি-উঁচু তুলসী মঞ্চ। এটি ফেলে আসা খুলনার বাড়ির কণাটুকু নিয়ে জেগে থাকতে চায়। অবশ্য সে মঞ্চটি ছিল মৃত্তিকাতলে, পোড়ামাটির মন্দির ছিল আদলটা। বয়স তো বেড়েছে, হাঁটু গেড়ে সন্ধ্যায় দীপ জ্বালাতে চারুশীলার আরামই হবে। রীতির বদল। বদলাচ্ছে দিকদিগন্ত। যাদবচন্দ্র নিজেও কি একইরকম আছেন? ছ-বছর হতে চললো তিনি দেশছাড়া। এখানে কাজ থেকে রিটায়ার করেছেন। টাকাপয়সা যা পাওয়ার ছিল— সবটা পাননি। তথ্যে অনেক ফাঁকফোকড়, কবে মেরামত হবে কে জানে। ছেলে বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই-ই প্রায়। পারতপক্ষে দেখা হয় না, হলেও কুশল বিনিময়ে ইতি হয়ে যায়। নাতনির জন্য বুকটা চিনচিন করে। এটুকু সামলাতে হবে। তার যে আত্মজবিদায় ঘটে গেছে। ভাবেন তিনি, সব সময়ে যাবে। সময় সইয়ে দেবে। দৌহিত্র্যকে পেয়ে অনেকটা ফাঁক পূরণ হয়। মেয়ের সন্তান, আদরের সন্দেহ নেই। কিন্তু পোয়ের বেটাবেটি যে রক্তের ধারা! নিজেকে বোঝাতে দুর্বলচেষ্টায় মন দিলেন তিনি। নতুন বাড়ির ঘর, আনাচে কানাচে, দেখতে দেখতে হঠাৎ এরকম ভাবনার উদয় হয়, শাসন করতে চান নিজেকে— ছিঃ ছিঃ। খুলনার কথা মনে আসে, না চাইলেও উপোসী শ্বাস গোপন করতে পারেন না। মই বেয়ে সুখের কুঠুরিতে এসে পৌঁছেছেন, তবু কাঁটা ফোটে, রক্ত গড়ায়। জামাইয়ের টাকায় এই কোঠা। সে যে পুত্রসমান। তবে? তবে পুত্র নয়। হেরে গেছেন যাদবচন্দ্র জীবনযুদ্ধের শেষে। উত্তরাধিকারহীন এক পুরুষ তিনি। কংগ্রেস, মহাসভা, লিগ সবাই মিলে দেশটাকে ভাগই করলো না, দেশের মানুষের হৃদয়টাকেও এমন নিষ্ঠুর অস্ত্রে টুকরো করলো, তাদের জীবনটাকেও।
 
মাস্টারমশাই ডি পি ঘোষের বর্তমান ঠিকানা কাছে নেই। জানতে পারলে চিঠি লিখে শুধোবেন— গাণিতিক জটিলতার সমীকরণ সমাধানের সময় অগাণিতিক সংখ্যা প্রয়োগের সূত্র ব্যবহার করেছিলেন তাঁরা। চিঠি পেলে তিনি কি জবাব দেবেন? একদা প্রিয় ছাত্রকে? নাকি তিনিও এই আত্মসমাধানের ভুলে বিপর্যস্ত? অত বড়ো মানুষ তো, পরাজয়ের কথা স্বীকার করতে পারবেন না। ভুলটা থেকেই যাবে, যতক্ষণ আরেকটা বড়ো ভুল এসে এটিকে না সামলায়। ভুল থেকে ভুলে, আরও ভুলে। ঋণাত্বককে ঋণাত্বক সংখ্যা দিয়ে গুন করলে সংখ্যার মাত্রা বাড়ে, কিন্তু ঋণের পরিমাণ যে বেড়ে যায় বহুগুণ। আরেকবার কি খুলনায় যাওয়া যাবে? দেখে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে জন্মভূমিকে। বয়স বাড়লে লোকে নাকি ছেলেবেলার কথা ভাবে। মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার বাসনা। এদিকে তার যে একগঙ্গা জলে পা ধোওয়ার সময় এলো বলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুহাত কচলাতে লাগলেন যাদবচন্দ্র অন্যমনে।
 
চারুশীলার মনে এসব কূটতর্কের উদয় হয় না। যেন অনন্ত হারিয়ে যাওয়ার সমুদ্রতরঙ্গ ভেঙে এসে থিরজলে নোঙর করেছেন। এখন শান্তি বিরাজিত। নতুনপল্লীর হাওয়ায় মিষ্টি সুবাস পাচ্ছেন তিনি। এ আবাসে দেশবাড়ির ঢেঁকিঘরে ধানভানার সময়ে নাক তো বটেই জিভের আস্বাদকেও ভরিয়ে রাখতো, অবিকল সে গন্ধটাই চুনসাদা দেয়াল থেকে পাচ্ছেন। বাসাবাড়ি থেকে আসবাবপত্র সবই নিয়ে এসেছেন, বড়ো গোছানো তিনি, এ মন দেশ ছেড়ে আসার সময়ও চেঁছে পুঁছে সব নিয়ে এসেছিল যেমন করে।
 
ভাবছেন, তখন কোনও কষ্ট হয়নি। স্বামী বুঝিয়েছিলেন যে দেশটা মুসলমানদের হয়ে গেছে, সেটা হিন্দুদের দেশ থাকতে পারে না। হিন্দুজাতির জন্য হিন্দুস্তান আছে। সব হিন্দু সেখানে বসত গড়বে, তেমনি ওখান থেকে মুসলমানেরা এসে পাকিস্তানে নতুন মাটির মালিক হবে। সেসব সত্যিই হয়েছে কিনা চারুশীলার জানা নেই। স্বামীর কথায় বিশ্বাস করেছিলেন। বিশ্বাস করতে হয়। স্ত্রী তিনি। কায়মনে স্বামীর পায়ে আশ্রয় না রাখলে বাঁধন ঢিলে হয়ে পড়ে। তখন কোথায় থাকবে সংসার। চারুশীলার কাছে সংসারটাই দেশ। এটাকেই শক্ত-আঁটুনিতে বেঁধে রাখাই যে তার কাজ। সংসার রমণীর গুণে সুতোয় বোনা বিশ্ব।
 
বাঁধুনীর কথা মনে পড়তেই কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। সত্যিই কি সংসারটাকে বেঁধে রাখতে পেরেছেন? তাহলে হরীশ, তার বউ তাদের ছেড়ে অন্য বাসা নিলো কেন? চারুশীলার দড়ি কি এতটাই পাকা ছিল? নিঃশ্বাসপতন রোধ করতে পারলেন না। আজ সবকিছুই, প্রায়, পুনরায়, ফিরে পেয়ে চারুশীলার বুক মেয়েলি কীর্ণতার জালটা ছেড়ে ফেলেছে। কেউ তার শত্রু নয়। হরীশের দোষটা এখন লঘু হয়ে আসে। কঠিন সময়ের মধ্যে পড়ে গেছিল তার সংসারটা। নতুন শহরে, নতুন আছিস? হরীশের বাবার রোজগার দেশে যা পেতেন তার চেয়ে কম ছিল। সংসারটা ছেলের উপার্জনের উপর অনেকখানি নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছিল। খুলনার তুলনায় মালদাতে নৈমিত্তিক খরচ বাড়ছিল হু হু করে। হরীশের বউ আছে তখন, একটা মেয়ে হয়েছে, বছর দুই। এদিকে তার মেয়ে জামাই আশ্রিত, জামাই বেকার, মেয়ে গর্ভবতী। প্রায় তিনজনের বাড়তি গ্রাসাচ্ছাদনের খরচ। বাধ্য হয়েই যাদবচন্দ্রকে ঘাটতি মেটাতে ছেলের কাছে হাত পাততে হতো। মাধ্যম চারুশীলা। হরীশ তার প্রথম ‘পেটচিরা’ সন্তান। ভালো ছেলে, অবস্থা বিপাকে মাথাটা বেপথী হয়েছে। বড়ো আদরের ছিল যে। এমনকী পুত্রবধূ যে বোসেদের ঝিয়ের মুখে বিষবান উদগীর্ণ করেছিল সেটাও ক্ষমা করে দিলেন চারুশীলা — অত তিরুটি ধরলি চলে নাকি! উটিও যে একিবারে ছেল্যামানুষ। বাচ্চা বিয়োলিই বা কী!
 
ইচ্ছে হয় ওরা ফিরে আসুক, বাসা ছেড়ে দিক। এবাড়ির ‘অরিশন’ যে ওরাই। নাতনিটাকে কতদিন দেখেন না। ঠাকুমা যে তিনি। বেটা বেটার বউ এটুকুও বোঝে না! ঠাকুমা ঠাকুরদা হোক, বুঝবে। হবে তো নিশ্চয়ই।
 
আবার ভয় আসে। স্নেহ, নীলুবাবাজি রাগ করবে না তো? উত্তমর্ণকে অখুশি রাখা কি খাতকের উচিত কর্ম! চারুশীলা ধর্মসংকটে পড়ে যান। আর ভাবা যায় না। ঘর, বারান্দা এতক্ষণ তাকে ভরে রেখেছিল, হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল যেন।
 
স্নেহলতা এসেছে। তখন সন্ধে হয় হয়। দু-একদিন ফাঁকে ফাঁকে ছেলের হাত ধরে আগমন প্রায় নিয়মিত। তার ছেলেকে নিয়ে বাবা মায়ের ঝগড়া লাগে। যাদবচন্দ্র নাস্তিকের পাকড়াও করে উঠোনবাগিচায় নেমে যান খেলতে। ছেলেটাও দুষ্টু হয়েছে,দাদুকে হাঁকিয়ে মারে। ধ্বস্ত যাদবচন্দ্র ফিরে এলে চারুশীলা অধিকার কায়েম করেন, — আয়সো ধন, কোলি বসো আমি তোমারে বিত্তান্ত কবানে।
 
সে বৃত্তান্ত চার বছরের বিনুর ভালো লাগে না। পরী, সোনার কাঠি রূপোর কাঠি কিছুই নেই, আছে নদী, বড়শি নৌকো, বাদাম বহর, নৌকোয় বালাম চালের স্তূপ। কখনো জলকাটা স্টিমারের ছড়ছড়ানি অনুকার। বিনুর চোখে এগুলো সত্যি সত্যিতে নেই। সে দিদিমাকে ছেড়ে আবার দাদুর টানে ছুট মারে। মা দিদিমা দেখে হাসে।
 
— বিনুদাদার মুখিতে একদম বিয়াইমশায়ের মুখখান য্যান বসান রইছে।
 
— আমার তো মনি পড়ে না। তয় তোমার জামাই কয় ওর নাকখান আর থোতনিখান ঠাকুরির আদল পাইছে। হাতের আঙ্গোলগোলাও দীঘল দীঘল। ঠাকুরিরও নাকি অমন ছেল।
 

জমা গুমোট পলকে অন্তর্হিত হল। নাতি দাদুর কোঁচা ধরে টান মেরেছে। ভাগ্যিস যাদবচন্দ্র অন্তর্বাস পরেন! ছেলের কান্ড দেখে স্নেহ হাসে না ধমকাবে ঠিক করতে পারছে না। যাদবচন্দ্র কোঁচা কুঁচোতে কুঁচোতে মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছেন, — খাড়াও, শালা, নাতি। তুমারে আমি এহন লেঙ্গুটা করি ছাড়বো

 
ঘরের অহংকার, খুশির সুঘ্রাণ কেমন ম্লান হয়ে আসে তখন। দেখা যায় না, তবু বসার ঘরের বাতাসে, মেঝেতে না-ভর চন্দ্রমোহন হেমশশীর ছায়া-অস্তিত্ব এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। অস্পষ্ট ভারমেদুরতা শব্দহীন পাক খায়। গলা ডুবে আসে চারুশীলার — মা,রে, বিয়াই বিয়ানের খবর আর পালি না?
 
— না, মা। তেনারা যে ইখানে চলি আসিছেন, সিটা তুমরা জানো। কিন্তুক কুথায়, সিটার পাকা খবর জানা যায় নাই। মা, — স্নেহলতা যেন প্রার্থনায় কাতর — বাবারে কও না। তার যে অনেক মান্যিগন্যি লোকির সাথি চিনাশুনা। তাদের খ্যামতা কত! তেনারা কি এট্টু খোঁজ করি দিতি পারবেনে না! তেনাগেরে আমার যে খুব দরকার, মা।
 
— কেন রে?
 
— পায়ে ধরি মাজ-জোনা চাতেম। আমিই যে অপ্রাধ করিছি। তাগের ছেলিরে অলাগ করি নেয়ি আসিছেলাম।
 
মেয়েকে ছুঁলেন চারুশীলা, — কব। জামাইবাবাজিরও তো আলাপ বাড়িছে। সে এট্টু…।
 
— তারে ছাড়ান দেও। কলি কয়, করতিছি তো। নানাজায়গেতে চিঠিচাপুটি করিছে বলে। গরমেন্টের কাছেও নাকি রিজেস্টারি দেছে। জানো, মা, মনি হয় এগুলান বানান কথা। চারুশীলা আঁতকে ওঠেন, একী! মেয়ে তার স্বামীকে বিশ্বাস করছে না! হায় ভগবান! এ কী অভিশাপ আসছে এদেশে!
 
জমা গুমোট পলকে অন্তর্হিত হল। নাতি দাদুর কোঁচা ধরে টান মেরেছে। ভাগ্যিস যাদবচন্দ্র অন্তর্বাস পরেন! ছেলের কান্ড দেখে স্নেহ হাসে না ধমকাবে ঠিক করতে পারছে না। যাদবচন্দ্র কোঁচা কুঁচোতে কুঁচোতে মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছেন, — খাড়াও, শালা, নাতি। তুমারে আমি এহন লেঙ্গুটা করি ছাড়বো।
 
খুট করে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ আসে। মেয়েলি গলা আবছা কানে এলো। স্নেহলতা উঠতে যাচ্ছিল, যাদবই গেলেন। দোর খুলেই হতভম্ব।
 
— আসলাম, বাবা। ঢুকতে বলবে না?
 
যেন আবেগ শুকিয়ে কাঠ, যাদবচন্দ্র বললেন, — আয়।
 
সপরিবার ছেলেকে দেখে চারুশীলার চোখে বাঁধ ভাঙলো, — বাবু আসিছিস!
 
স্নেহলতা অপলক দৃষ্টি রেখেছিল আগন্তুকদের দিকে। কঠিন সে জোড়া চোখ। হিমশীতল। তেমন কিছু শুনলে আজ সে ছেলেও ছোবলে নীল করে দেবে দাদা বউদিকে। আজ তার দিন।

 

♦—♦♦—♦♦—♦♦—♦

ক্রমশ…
 
আগের পর্ব পড়ুন: পর্ব ২১

মাটি ব্রতের আখ্যান। পর্ব ২১


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!